ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার নয় । রাস্তার সামনের ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকে কিছু আলো এসে পড়েছে ঘরে । সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে মাঝ বয়সী এক লোক নিজের আরাম কেদায় বসে কিছু যেন ভাবছনে এক মনে । এমন সময় দরজায় কড়া নড়লো ।
তিনি মাথা তুলে তাকালেন সেদিকে । অন্ধকারের ভেতরেই দেখতে পেলেন যে দরজাটা খুলে যাচ্ছে । সেখানে একটা মাথা দেখা গেল তার পরেই ।
বল কামাল !
কালাম নামের মানুষটা এবার দরজাটা পুরো খুলে ফেলল । ঘরটা আরো একটু আলোকিত হয়ে উঠলো । কামালকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। তিনি তাকালেন কামালের মুখের দিকে । বুঝতে পারলেন যে খবর ভাল আনে নি কামাল । যা আশংঙ্কা করা হয়েছিল তাই কি তাহলে হতে চলেছে ?
-খবর কী ?
-স্যার আপনি যা ভেবেছিলেন সেটাই ।
-কোথায় আছে এখন সে?
-আমরা স্যার এখনও বের করতে পারি নি । তবে এই শহর ছেড়ে সে যায় নি এটা নিশ্চিত । এখানেই আছে । আমরা তার উপস্থিতি টের পাচ্ছি ।
-আর মেয়েটা?
-সেটাও জানা সম্ভব হয় নি ।
সাথে সাথেই একটা রাগের অনুভূতি এসে জড় হল তার মনে । কিন্তু সেটা বেশি সময় স্থায়ী হল না । নিজেকে শান্ত করে নিলেন তিনি । কামাল কিংবা অন্য কারো পক্ষে এতো জলদি সব খবর বের করাটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার । এতো বড় শহর, চার কোটি লোকের ভেতরে একটা মেয়েকে খুজে বের করা সহজ কোন কাজ নয় ।
-ওকে যাও । খোজ চালাও । মেয়ের বয়স ১৯ থেকে ২২ এর ভেতরে হবে । খোজ চালাও যে এই বয়সের মেয়েদের কারা কারা গত ১০/১২ দিনে ঢাকার বাইরে গেছে এবং ফিরে এসেছে । তাহলে খোজটা একটু সহজ হয়ে যাবে ।
-জ্বী স্যার ।
কামাল চলে গেল দরজা বন্ধ করে দিয়ে । ঘরের আলোটা আবার কমে এল । তিনি আবারও নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল । মনে মনে ভাবছেন কী করা যায় । সে যদি মুক্তি পেয়ে যায় পুরোপুরি তাহলে সামনে যে কী হবে সেটা কল্পনা করা যায় না ।
নীতু ক্লাসে সব সময় এক কোনার দিকে বসে । নিজের ভেতরেই থাকে সব সময় । আশে পাশের মানুষ কে কী করলো সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না । তবে বান্ধবী রাইমার কারণে ক্লাসে কে কী করলো সব খবরই নীতুর কাছে চলে আসে । তবে কয়েকদিন ধরে সে ক্লাসের সবার আচরণে একটা আলাদা পরিবর্তন খেয়াল করছে । বিশেষ করে মেয়েদের আচরণ গুলো দেখে নীতুর মনে একটা বিরক্তির উদ্রেক হয়েছে । হঠাৎ করেই যেন সব মেয়ে নিজেদের চেহারার দিকে আলাদা নজর দেওয়া শুরু করেছে । সবাই নিয়োমিত ক্লাসে আসা শুরু করেছে । কেন এসব সবাই করছে সেটা নীতুর বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না ।
আরিয়ান কবীর ! এই মানুষকে নিয়ে সে কী করবে নিজেও জানে না । যদিও সে তো মানুষ না ।
আচ্ছা আসলেই কি সে মানুষ না? দেখতে শুনতে তো একেবারে মানুষের মতই।
অন্য কিছু?
কোন অশরীরি !
এটা কি আসলেই সম্ভব?
নীতু সব কিছু ভুলে যেতে চায় । বিশ্বাস করতে চায় যে ওর সাথে যা যা হয়েছে সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে । এর ভেতরে কোন অস্বাভাবিকত্ব নেই । থাকতে পারে না । আফনানের ঐ দুর্ঘটনাটাও একটা কাকতালীয় ব্যাপারই ছিল । এর বেশি কিছু না । হয়তো ঐদিন চৌরাস্তায় নীতু এমনি এমনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল । স্বপ্নে দেখেছে সব টুকু । বাস্তবে কিছুই ঘটে নি । কিন্তু তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে এই আরিয়ান কবির কিভাবে এতো কিছু জানে । তার কোন ভাবে এতো কিছু জানার কথা না ।
নীতু আর কিছু ভাবতে চায় না । ওর ভাবতে ভাল লাগছে না । ও কেবল সব কিছু থেকে মুক্তি চায় । বিশেষ করে এই আরিয়ান কবিরের কাছ থেকে !
এই কথা ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেল আরিয়ান কবির ক্লাসে ঢুকছে । সবাই উঠে দাড়ালো । নীতু নিজেও উঠে দাড়ালো । ক্লাসে ঢুকেই আরিয়ান সবার আগে নীতুর দিকে তাকালো । নীল চোখের দিকে তাকিয়ে নীতুর মনে হল সে একেবারে নীতুর মনের ভেতরেই ঢুকে গেছে । সব কিছু পড়ে ফেলেছে । নীতু এতো সময় ধরে যা যা ভাবছিল তার সব কিছুই আরিয়ান বুঝে গেছে । ওর মুখের হাসি দেখেই সেটা নীতু বুঝতে পারলো ।
ক্লাসের ভেতরে মেয়ে গুলো এমন আচরণ করতে লাগলো যেন আরিয়ান নামের মানুষটা জগতের সব থেকে ফানি একজন মানুষ । যে যাই বলছে তাতেই মেয়ে গুলো হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে । হাসির আওয়াজ শুনে নীতুর বিরক্তিতে মন ভরে যাচ্ছে ।
-মিস আনিকা সারমিন!
নিজের নাম শুনে নীতু একটু চমকে গেল । ক্লাসের দিকে সে মনযোগী ছিল না একদম । তাই স্যার কী পড়াচ্ছিল কিংবা কী বলছিল সেদিকেও খুব একটা খেয়াল ছিল না । কেবল হাসির আওয়াজে বিরক্তি আসছিল ওর ।
উঠে দাড়ালো । ক্লাসের সবাই তখন ওর দিকে ফিরে তাকিয়েছে । নীতুর একটু অস্বস্তি হল । কিছু দিন আগেই এমন ঘটনা ঘটতো যখন সবাই ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতো । আফনানের ঘটনার পরে ও খানিকটা কৌতুকে পরিনত হয়েছিল। কিন্তু আফনানে এক্সিডেন্টের পরে সব শান্ত হয়ে গেছে । এখনও সবাই ওর দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছে ।
-মিস আপনার কি আমার ক্লাস ভাল লাগছে না?
-জ্বী না স্যার ।
জ্বী না বলেই নীতুর মনে হল কী করলো ওটা । এভাবে কোন শিক্ষকের মুখের উপরে তার ক্লাস ভাল লাগছে না বলাটা খুব বেশি সাহসের কাজ । যত যাই হোক আরিয়ান এখন এই ডিপার্টমেন্টের টিচার । তার হাতে অনেক কিছু । এই কোর্সের পাশ ফেল পর্যন্ত তার হাতে । এভাবে ক্লাস ভাল না লাগা বলাটা সরাসরি তাকে অপমান করা বোঝায় । তবে নীতু দেখলো যে আরিয়ান হাসি মুখেই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ওর দিকে তাকিয়েই বলল, ক্লাস ভাল না লাগলে আপনি অবশ্যই ক্লাস ছেড়ে চলে যেতে পারেন । কোন বাধ্যবাধকতা নেই ।
তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা চাইলে এখন ক্লাস ছেড়ে চলে যেতে পারেন যার ক্লাস ভাল না লাগছে । এটেন্ডেন্স নিয়ে মোটেই ভাব্বেন না । সবাইকে নম্বর দেওয়া হবে ।
নীতু ধীর পায়ে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে গেল । যাওয়ার আগে আরিয়ান চোখের দিকে তার চোখ পড়ল আবার । সেখানে একটা সুক্ষ হাসি খেলা করছে । যেন সে জানতোই যে এমন কিছুই হবে । তবে কেবল নীতুই ক্লাস ছেড়ে বের হল । আর কেউ বের হল না ।
কাল থেকে বের হওয়ার পরেই নীতুর মনে হল এইভাবে বের হওয়ার কোণ দরকার ছিল না । ক্লাসে বসে থাকলেই বরং ভাল হত । এখন কেমন যেন নিজেকে উদ্ভাস্তুর মত মনে হচ্ছে । ক্লাস রুম থেকে বের করে দেওয়া হলে যেমনটা মনে হয় সেই রকম মনে হচ্ছে নিজেকে। কোন কারণে কি আরিয়ান কবির ইচ্ছে করেই ওকে ক্লাস থেকে বের করে দিল?
নীতু জানে না । তবে ওর মনে কু ডেকে উঠলো কেন জানি । মনের কু ডাকাটা মনেই রইলো ঠিক সেই সময়েই ঘটলো ঘটনা । নীতুর ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো । সে ক্যাম্পাসের রাস্তা ধরে আপন মনেই হাটছিলো তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করলো । তার চোখ গেল ক্যাম্পাসের ডানদিকের একটা ফোয়ারার দিকে । সেই ফোয়ারার পানি স্থির হয়ে গেছে । ব্যাপারটা যেন ঠিক বিশ্বাস হল না ওর । পানি কি কোন ভাবে স্থির হয়ে যেতে পারে?
তখনই সে চারিদিকে তাকাতে লাগলো এবং বুঝতে পারলো যে সব কিছু একেবারে স্থির হয়ে গেছে । সব কিছু মানে সব কিছু । কেবল সে সচল রয়েছে !
তীব্র একটা বিস্ময় কাজ করলো ওর ভেতরে ! এমন কি আদৌও সম্ভব ? এমন কি হতে পারে?
পারে না ।
যখনই মনে হল সে জ্ঞান হারাবে ভয়ে তখনই দেখতে পেল তাকে ! কালো ঘোড়াটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে । তার উপরে বসে রয়েছে আরিয়ান । তবে আজকে সে কোন কালো পোশাক পরে নি । একটু আগে যে স্যুট পরেছিলো সেটাই পরে আছে । ঘোড়াটা এসে থামলো একেবারে ওর সামনে । তারপর নীতুর কিছু বলার আগেই আরিয়ান একেবারে ওকে ঘোড়ায় তুলে নিলো । কিভাবে নিলো সেটা নীতু জানে না । কেবল অনুভব করলো যে ওকে এক হাত দিয়েই তুলে নিল । তারপর ঘোড়া ছুট দিলো । পরিচিত ক্যাম্পাসের পথ দিয়েই ঘোড়া এগিয়ে চলল । নীতু কেবল দেখতে পাচ্ছিলো যে সব কিছু থেমে আছে স্থির হয়ে আছে ।
ঘোরাটা থামলো অনেকটা সময় । তবে কত সময় সেটা নীতু জানে না কারণ ওর হাতের ঘড়িও থেমে গেছে । নীতুকে নামিয়ে দিল আরিয়ান । নিজেও নামলো । নীতু রাগত কন্ঠে বলল, এসবের মানে কী?
-কী মানে?
-আমাকে এভাবে তুলে নিয়ে এলেন কেন আপনি?
-তো কিভাবে নিয়ে আসবো? তুমি আমার ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবে তোমাকে ছেড়ে দিবো আমি?
-আপনিই না বললেন চাইলে বের হয়ে যেতে পারি !
-আমি বলবো বলেই চলে আসবে নাকি ! অন্য কেউ তো গেল না !
নীতু কী বলবে ঠিক খুজে পেল না । সত্যিই ওর মনে হচ্ছিলো যে কিছু একটা করবে সে যখন নীতু বের হয়ে গেল । এখন সে সব কিছু থামিয়ে দিয়েছে । কী আশ্চর্য এটাও সম্ভব নাকি ! এভাবে কিছু থামিয়ে দেওয়া যায় নাকি !
নীতু বলল, সব কিছু স্বাভাবিক করুন !
-নাহ । করবো না । আগে আমার ডিমান্ড ফুলফিল কর!
-আপনার কী ডিমান্ড !
-কিস মি!
-হোয়াট?
-তুমি পরিস্কার শুনতে পেয়েছো । কিস মি !
-নো নেভার !
-তাহলে এভাবেই থাকবে সব কিছু ।
-না প্লিজ । সব কিছু আগের মত করুন !
-কিস মি !
নীতু অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে । আরিয়ান দুষ্টামির চোখে তাকিয়ে রয়েছে নীতুর দিকে । আরিয়ান ঠিক ঠিক জানে যে নীতুর হার মানতেই হবে ওর কাছে ।
ঘন্টা খানেক ওভাবে থাকার পরে নীতু হার মানতে বাধ্য হল । সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আরিয়ানের কাছে । তারপর বলল চোখ বন্ধ করুন !
-কেন ?
-যা বলছি করুন । নয়তো পাবেন না ।
আরিয়ান হাসি মুখে চোখ বন্ধ করলো । নীতু মৃদু ভাবে আরিয়ানের গালে চুমু খেল । আরিয়ান চোখ সাথে সাথে খুলে ওর মাথার পেছনে হাত রাখলো । তারপর চট করেই ওর ঠোঁটে চুমু খেল । নীতু নিজেকে মুক্ত করতে চাইলো বটে কিন্তু কাজ হল না ।
যখন নিজেকে মুক্ত করলো তখন রাগে দুঃখে নীতুর কান্না চলে এল তবে সে জানে সে কিছুই করতে পারবে না । আরিয়ান তখনও হাসি মুখেই ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । যেন মজা পাচ্ছে খুব ।
এরপর থেকে নীতু আর আরিয়ানের ক্লাস রুম থেকে বের হত না । পুরো ক্লাসে বসে থাকতো । তবে তারপরেও মাঝে মাঝে আরিয়ান ঠিকই সুযোগ পেয়ে যেত । ওর কাছে চলে আসতো । তখন নীতুর জীবনে আরেকটা পরিবর্তন এল । আফনান ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে এসে হাজির হল।
আফনান আর সেই আগের আফনান নেই । চেহারায় অনেক গুলো দাগ পড়েছে । একটা পায়ে জোর পায় না ঠিক মত । হাতে একটা স্টিক নিয়ে হাটতে হয় । ক্যাম্পাসে এসে সবার আগে সে নীতুর সামনে গিয়েই হাজির হল । তারপর সবার সামনে ওর হাত ধরে ক্ষমা চাইলো । ওর মনে হয়েছে নীতুর সাথে ওমন আচরণ করার জন্যই নাকি আজকে ওর কপালে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে । কিন্তু নীতু জানে যে আফনানের এই অবস্থার জন্য ও নিজেই দায়ী ।
নীতু বলল, ইটস ওকে । তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি আমি ।
-আমরা কি আবার বন্ধু হতে পারি?
-না আফনান আমাদের অবস্থা আর কখনই আগের মত হবে না । সো বেটার না ট্রাই ইট ।
নীতু আর না দাড়িয়ে হাটা শুরু করলো । আফনান পেছন থেকে ওকে ডাকলো বটে তবে নীতু দাড়ালো না । তখনই দেখতে পেল আরিয়ান দাড়িয়ে আছে । নীতু সোজা আরিয়ানের সামনে গিয়ে হাজির হল । সে জানে আফনান ওদের দেখছে । নীতু বলল, আপনার ক্লাস আছে এখন ?
আরিয়ান ব্যাপারটা ঠিক বুঝে গেল । মৃদু হেসে বলল, না এখন নেই ।
-তাহলে চলুন । লাঞ্চ করা যাক একসাথে । আপনার ঘোড়া কই !
আরিয়ান হেসে ফেলল । ঘোড়া তো নেই । বাইক আছে । চলবে?
-চলবে !
ক্যাম্পাসের সবার সামনেই আরিয়ানের বাইকের পেছনে উঠে বসলো নীতু । তারপর ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে গেল ।
সরাসরি গল্পের লিংক পেতে হোয়াটসএপ গ্রুপ কিংবা টেলিগ্রামে জয়েন করুন । ল