নীতু এন্ড দ্যা হর্সম্যান (পর্ব দুই)

oputanvir
4.5
(42)

প্রথম পর্ব

নীতু দৌড়াচ্ছে । 

জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । এতো জোড়ে সে দৌড়াচ্ছে যে চোখের সামনে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না । অন্য কোন দিকে তাকানোর খেয়াল নেই তার । কেবলই মনে হচ্ছে সামনে পালিয়ে যেতে হবে । পেছনে সে ধেয়ে আসছে । 

ঘোড়ায় চড়ে । 

ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজটা তার কানে আসছে । কোন ভাবে তার হাতে পড়া যাবে না । তার কাছ থেকে দুরে তাকে যেতেই হবে। 

অবশ্য আরও একটা কারণে নীতু কোন ভাবেই তার হাতে পড়তে চায় না । কারণটা হচ্ছে নীতুর শরীরে কোন কাপড় নেই । একেবারে নগ্ন হয়ে সে দৌড়াচ্ছে । সে কিভাবে আর কেন এভাবে দৌড়াচ্ছে সেটা নীতু মনে করতে পারছে না । কেবল তার যতদুর মনে পড়ে তখন থেকেই সে কেবল দৌড়াচ্ছে । 

তখনই নীতুর মনে হল যে ঘোড়ার আওয়াজটা একেবারে ওর পেছনে চলে এসেছে । এতো পেছনে যে ও যেন ঘোড়ার নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজটা শুনতে পেল খুব পরিস্কার ভাবে । একটু যেন গরম বাতাসও পড়লো ওর পিঠে । তাকাবে না তাকাবে না করেও নীতু পেছনে ফিরে তাকালো দৌড়াতে দৌড়াতেই । তখনই সেই ঘোড়সাওয়ারকে দেখতে পেল সে । সেই প্রথম দিনের আগুন চোখ ! ভয়ে নীতুর বুকটা কেঁপে উঠলো । আর ঠিক তখনই কিছু একটাতে পা বেঁধে পড়ে গেল সে । 

ঘুম ভেঙ্গে গেল নীতুর ! কিছু সময় লাগলো নিজেকে সুস্থির করতে । এখনও যেন সেন সে স্বপ্নের ভেতরের সেই ভয়টা অনুভব করতে পারছে । তবে সময় যাওয়ার সাথে সাথে ভয়টা কমে এল । একটা সময়ে পুরোপুরি সুস্থির করতে পারলো । বিছানার পাশে রাখা মোবাইল টা হাতে নিয়ে সময়টা দেখলো । তারপর জানাল দিয়ে বাইরে তাকালো নীতু ।  সবে মাত্র সকাল হয়েছে । সূর্য সবে মাত্র আলো দিতে শুরু করেছে । কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো নীতু । তারপরই স্বপ্নের পুরোটুকু আরো ভাল করে মনে পড়লো ওর । এখন আর ভয় কাজ করছে না । বরং তীব্র একটা অস্বস্তি কাজ করছে । গত তিন দিন ধরে নীতু ঠিক এই স্বপ্নটা দেখছে । কেন দেখছে সেটা নীতু নিজেও জানে না । কোন ভাবেই বুঝতে পারছে না ওমন ভাবে সে কেন দৌড়াচ্ছে ! 

-আজকে ক্লাসে যাবি?

নীতু এক মনে স্বপ্নের কথা ভাবছিলো । কখন যে ওর মা ঘরে ঢুকেছে সেটা খেয়াল করে নি । মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মা শান্ত মুখে নীতুর দিকে তাকিয়ে আছে । পড়ালেখার ব্যাপার নীতুর মা সব সময়ই একটু সিরিয়াস ধরনেই । একদিন ক্লাস কামাই দিলে চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দেয় । সেই স্কুল থেকেই এমন করে আসছে । নীতু এখনও তাকে ঠিক বোঝাতে পারে নি যে ভার্সিটির ক্লাস আর স্কুলের ক্লাস এক নয় । তবে তিন দিন আগে নীতু হঠাৎ করেই ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে যায় । সবাই ভেবেছিলো যে শারীরিক কোন অসুস্থতার কারণেই নীতু অসুস্থ হয়েছিলো । ওর বন্ধুরা মিলে ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে গিয়েছিলো । নীতুর বাবা সন্ধ্যা বেলা ডাক্তারও ডেকে এনেছিলো । ডাক্তার সব দেখে কেবল বলেছিলো শরীর দুর্বল । ভিটামিনের অভাব । কয়েকদিন বিশ্রাম আর ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করলেই নীতু ঠিক হয়ে যাবে । আসল কারণটা কেউ ধরতেও পারে নি । আসল কারণ কেবল নীতু জানে না । নীতুর মন থেকে এখনও সেই আশঙ্কা যায় নি । এমন কি নীতু শুনেছে যে যখন তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয় তখন নাকি আরিয়ান কবির তাদের সাথেই ছিল । আরিয়ান কবিরের গাড়িতে করেই তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিলো । যদিও সে বাসার উপরে ওঠে নি । 

নীতু মায়ের দিকে তাকালো । একবার মনে হল যে আজও বলে যে সে ক্যাম্পাসে যাবে না তবে আজকে বলল না । আজকে সে ক্যাম্পাসে যাবে বলেই ঠিক করলো । ওর জীবনে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে । দাদীর কথা মত সে ঘোড়সাওয়ারের কাছে আবেদন নিয়ে গিয়েছিলো । তারপর অদ্ভুত ভাবেই আফনান দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে । এটা কি একেবারে কাকতালীয় ব্যাপার?

হ্যা হতেই পারে এটা একেবারে কাকতালীয় ব্যাপার কিন্তু নীতুর মন জানে যে তার এই ফরিয়াদই ঘোড়সাওয়ার পূরণ করেছে এবং তার ফলেই আফনানের ঐ অবস্থা হয়েছে । এই পর্যন্ত ঘটনা ঘটলে নীতুর চিন্তার আর কোন কারণ ছিল না । সে ফরিয়াদ জানিয়েছে ঠিক যেমনটা লেজেন্ড বলছে, সেই ফরিয়াদ ঘোড়সাওয়ার শুনেছে । কিন্তু তারপর সে স্বয়ং ঘোরসাওয়ার নীতুর কাছে এসে হাজির হবে সেটা তো জানা ছিল না । এই ব্যাপারে নীতু ঠিক করেছে তার দাদীর কাছে জিজ্ঞেস করবে । তবে সমস্যা হচ্ছে দাদীর কাছে শুনতে হলে নীতুকে আবারও যেতে হবে গ্রামে । নীতুর দাদীর মোবাইলে ঠিকমত কথা বলতে ও শুনতে পারেন না । বাসায় যদিও একটা মোবাইলফোন রয়েছে তবে সেটা কেবল মাত্র দরকারে ব্যবহার করা হয় এবং বেশির ভাগ সময়ই দাদীর কাজের ছেলেটা সেই ফোন ধরে । 

নীতু উঠে বসলো । মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে মা আমি ক্লাসে যাবো?

-যাবি?

নীতু মায়ের চেহারায় একটা উদ্বিগ্নের ভাব ফুটে উঠতে দেখলো । সেখানে একটা চিন্তার রেখা । মায়ের দিকে তাকিয়ে নীতু বলল, মা চিন্তা করো না । আমি একদম ভাল আছি । ঐদিন একটু মাথাটা ঘুরে উঠেছিলো তাই এমন হয়েছিলো । আজকে ঠিক আছি আমি । 

নাস্তা শেষ করে ক্যাম্পাসের দিকে রওয়ানা দিল সে । অন্যান্য দিন খুব বেশি সমস্যা না হলে নীতু বাসে করেই ক্যাম্পাসে গিয়ে হাজির হয় । একটু সকালে যাওয়া লাগলে ক্যাম্পাসের দোতলা বাস আছে । সেটা ওর এলাকাতে এসে থামে । সেটাতে চড়ে । তবে সেটা বেশ সকালে আসে বলে প্রায়ই দিনও যাওয়া হয় না । আর ক্যাম্পাস থেকে ওদের বাসা খুব বেশি দুরে না হওয়ার কারণে খুব একটা সমস্যা হয় না যাতায়াতে । তবে আজকে সে রিক্সাতে করেই ক্যাম্পাসে গেল । 

মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি নিয়ে ক্লাস রুমে গিয়ে হাজির হল । ও ঢুকতেই দেখতে পেল কয়েকজন ওর দিকে ফিরে তাকালো । বসতে বসতে রাইমা এগিয়ে এসে শরীরের ব্যাপারে জানতে চাইলো । 

-আজকে কেমন শরীর তোর?

-আজকে ভাল !

-আমরা তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো । আরিয়ান স্যারও বেশ চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলো ।

-আরিয়ান স্যার !

নামটা মুখ দিয়ে আপনা আপনি বের হয়ে এল । নীতু দেখতে পেল যে আরিয়ান স্যারের নামটা মুখে আনতেই রাইমার মুখে একটা হাসি দেখা দিয়েছে । রাইমা বলল, আরে আরিয়ান স্যার আমাদের নতুন স্যার !

নীতু খুব ভাল করেই জানে আরিয়ান স্যার কে । ক্যাম্পাসে না আসলেও ক্যাম্পসের খোজ খবর সে ঠিকই রেখেছে । ওদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে ডিপার্টমেন্টের । সেখানেই আরিয়ান স্যারকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে । তার বেশ কিছু ছবিও আপলোড হয়েছে সেখানে । কখনও তাকে দেখা গেছে একেবারে ফরমাল ড্রেসে কখনও বা ক্যাজুয়্যাল পোশাকে । দুই পোশাকেই তাকে দেখতে অসম্ভ সুদর্শন আর নজরকারা মনে হয়েছে । বিশেষ করে তার নীল চোখ দিক থেকে মেয়েরা কিছুতেই যেন চোখ সরাতে পারে না । রাইমাও যে তাদের ব্যতিক্রম নয় সেটা বুঝতে নীতুর মোটেই কষ্ট হল না । নীতু যদি তার ব্যাপারটা না জানতো তাহলে সেও হয়তো রাইমার মতই মুগ্ধ হত । 

রাইমা বলল, আরে স্যার খুব চিন্তা দেখাচ্ছিলো তোকে নিয়ে । প্রথমে তোকে স্যারদের স্টাফ রুমে নিয়ে যাওয়া হয় । স্যার নিজে ক্যাম্পাসের ডাক্তারকে কল নিয়ে নিয়ে আসেন । পরে তোকে দেখে শুনে সেই তোকে তোর বাসায় পৌছে দেয় । সাথে আমি আর রুবি ছিলাম । আমার তখন কেবল মনে হচ্ছিলো ইস তুই না হয়ে যদি আমি অজ্ঞান হতাম তাহলে কতই না ভাল হত !

নীতু কিছু বলতে গিয়েও বলল না । রাইমা বরাবরই এমনই করে । অবশ্য ক্যাম্পসে রাইমার থেকে কাছের বন্ধু আর কেউ নেই ওর । পড়াশোনাতে ভাল হওয়ার কারণে সবাই ওর কাছ থেকে একটু দুরে দুরে চলে । আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যারা একটু পড়াশোনাতে ভাল তাদের সবাই একটু ঈর্ষার চোখে দেখে । সেই স্কুল থেকে নীতু এই ব্যাপারটা দেখে এসেছে । খুব কমই ছেলে মেয়েই আছে যারা পড়ালেখার ব্যাপারটা ছাপিয়ে কিংবা কোন উদ্দেশ্য ছাড়া বিশেষ করে পড়ালেখার সাহায্য নেওয়া বাদ দিয়ে ওর সাথে মন খুলে কথা বলেছে । এই কম মানুষ গুলোর ভেতরে রাইমা একজন । 

ক্লাস শুরু হয়ে গেল একটু পরেই । প্রথম ক্লাসটা স্বাভাবিক ভাবে শেষও হয়ে গেল । কিন্তু দ্বিতীয় ক্লাস শুরুর সাথে সাথে নীতুর মনের ভেতরে সেই ভয়টা আবার ফিরে এল । সেই সাথে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যটা বার বার মনে আসতে শুরু করলো । অস্বস্তি মিশ্রত ভয়টা তুঙ্গে উঠলো যখন আরিয়ান কবির ক্লাস রুমে প্রবেশ করলো । নীতু খেয়াল করলো যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই সবার প্রথমে আরিয়ান কবির ওর উপরেই চোখ ফেলল । যদিও ও একেবারে শেষের দিকে বসেছে । সবার আগে চোখ পড়ার মত স্থানে বসে নি কিন্তু নীতুর মনে হল যেন আরিয়ান কবির ঠিক ঠিক জানে জানতো যে নীতু কোথায় বসে আছে । সেখানেই তাকিয়েছে প্রথমে 

হাতের বই আর খাতাটা টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে আরিয়ান সারাসরি আবারও তাকালো নীতুর দিকে । নীতুর ইচ্ছে হল চোখ সরিয়ে নিতে কিন্তু নীল চোখের সেই তীব্র চাহনী থেকে নীতু নিজের চোখ সরিয়ে নিতে পারলো না । 

-কেমন আছেন মিস আনিকা সারমিন?

আনিকা সারমিন নীতুর ফরমাল নাম । নিজের ফরমাল নাম টা আরিয়ান কবিবের মুখে শুনে অস্বস্তির মাত্রাটা যেন বাড়লোই কেবল । 

-আমার প্রথম ক্লাসেই একজন একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল এটা বলা চলে আমার জন্য একট অন্যন্য অভিজ্ঞতাই বটেই । 

সামনের থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো, স্যার আপনাকে দেখে নীতু ঠিক হজম করতে পারে নি ।

নীতু দেখলো পুরো ক্লাস হেসে উঠলো । এমন কি আরিয়ান কবিরও হাসলো । নীতুর দিকে তাকিয়ে আবার বলল, আজকে শরীর ভাল আপনার?

নীতু সংকোচ নিয়ে বলল, জ্বী স্যার ।

-গুড । নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন । বেশি বেশি খাওয়া দাওয়া করবেন। এতো পড়াশোনা না করলেও চলবে । 

আবারও ক্লাসের ভেতরে হাসির একটা আওয়াজ শোনা গেল । 

অবশ্য আর কিছু বলল না আরিয়ান কবির । সে পড়ানোতে মনযোগ দিলো । তবে পুরো ক্লাস জুড়ে নীতু একটা ব্যাপার খুব ভাল করেই খেয়াল করলো যে আরিয়ান কবিরের নজর সব সময় ওর উপরেউ নিবদ্ধ । ব্যাপারটা নীতুকে মোটেই শান্তি দিলো না । সেই সাথে সে এও বুঝে গেল যে সামনের দিন গুলোতে তার জন্য অস্বাভাবিক কিছু অপেক্ষা করছে । কিন্তু নীতু জানে না সেই স্বাভাবিক ব্যাপারটা কী ?

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 42

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →