নীতু দৌড়াচ্ছে ।
জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । এতো জোড়ে সে দৌড়াচ্ছে যে চোখের সামনে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না । অন্য কোন দিকে তাকানোর খেয়াল নেই তার । কেবলই মনে হচ্ছে সামনে পালিয়ে যেতে হবে । পেছনে সে ধেয়ে আসছে ।
ঘোড়ায় চড়ে ।
ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজটা তার কানে আসছে । কোন ভাবে তার হাতে পড়া যাবে না । তার কাছ থেকে দুরে তাকে যেতেই হবে।
অবশ্য আরও একটা কারণে নীতু কোন ভাবেই তার হাতে পড়তে চায় না । কারণটা হচ্ছে নীতুর শরীরে কোন কাপড় নেই । একেবারে নগ্ন হয়ে সে দৌড়াচ্ছে । সে কিভাবে আর কেন এভাবে দৌড়াচ্ছে সেটা নীতু মনে করতে পারছে না । কেবল তার যতদুর মনে পড়ে তখন থেকেই সে কেবল দৌড়াচ্ছে ।
তখনই নীতুর মনে হল যে ঘোড়ার আওয়াজটা একেবারে ওর পেছনে চলে এসেছে । এতো পেছনে যে ও যেন ঘোড়ার নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজটা শুনতে পেল খুব পরিস্কার ভাবে । একটু যেন গরম বাতাসও পড়লো ওর পিঠে । তাকাবে না তাকাবে না করেও নীতু পেছনে ফিরে তাকালো দৌড়াতে দৌড়াতেই । তখনই সেই ঘোড়সাওয়ারকে দেখতে পেল সে । সেই প্রথম দিনের আগুন চোখ ! ভয়ে নীতুর বুকটা কেঁপে উঠলো । আর ঠিক তখনই কিছু একটাতে পা বেঁধে পড়ে গেল সে ।
ঘুম ভেঙ্গে গেল নীতুর ! কিছু সময় লাগলো নিজেকে সুস্থির করতে । এখনও যেন সেন সে স্বপ্নের ভেতরের সেই ভয়টা অনুভব করতে পারছে । তবে সময় যাওয়ার সাথে সাথে ভয়টা কমে এল । একটা সময়ে পুরোপুরি সুস্থির করতে পারলো । বিছানার পাশে রাখা মোবাইল টা হাতে নিয়ে সময়টা দেখলো । তারপর জানাল দিয়ে বাইরে তাকালো নীতু । সবে মাত্র সকাল হয়েছে । সূর্য সবে মাত্র আলো দিতে শুরু করেছে । কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো নীতু । তারপরই স্বপ্নের পুরোটুকু আরো ভাল করে মনে পড়লো ওর । এখন আর ভয় কাজ করছে না । বরং তীব্র একটা অস্বস্তি কাজ করছে । গত তিন দিন ধরে নীতু ঠিক এই স্বপ্নটা দেখছে । কেন দেখছে সেটা নীতু নিজেও জানে না । কোন ভাবেই বুঝতে পারছে না ওমন ভাবে সে কেন দৌড়াচ্ছে !
-আজকে ক্লাসে যাবি?
নীতু এক মনে স্বপ্নের কথা ভাবছিলো । কখন যে ওর মা ঘরে ঢুকেছে সেটা খেয়াল করে নি । মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মা শান্ত মুখে নীতুর দিকে তাকিয়ে আছে । পড়ালেখার ব্যাপার নীতুর মা সব সময়ই একটু সিরিয়াস ধরনেই । একদিন ক্লাস কামাই দিলে চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দেয় । সেই স্কুল থেকেই এমন করে আসছে । নীতু এখনও তাকে ঠিক বোঝাতে পারে নি যে ভার্সিটির ক্লাস আর স্কুলের ক্লাস এক নয় । তবে তিন দিন আগে নীতু হঠাৎ করেই ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে যায় । সবাই ভেবেছিলো যে শারীরিক কোন অসুস্থতার কারণেই নীতু অসুস্থ হয়েছিলো । ওর বন্ধুরা মিলে ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে গিয়েছিলো । নীতুর বাবা সন্ধ্যা বেলা ডাক্তারও ডেকে এনেছিলো । ডাক্তার সব দেখে কেবল বলেছিলো শরীর দুর্বল । ভিটামিনের অভাব । কয়েকদিন বিশ্রাম আর ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করলেই নীতু ঠিক হয়ে যাবে । আসল কারণটা কেউ ধরতেও পারে নি । আসল কারণ কেবল নীতু জানে না । নীতুর মন থেকে এখনও সেই আশঙ্কা যায় নি । এমন কি নীতু শুনেছে যে যখন তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয় তখন নাকি আরিয়ান কবির তাদের সাথেই ছিল । আরিয়ান কবিরের গাড়িতে করেই তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিলো । যদিও সে বাসার উপরে ওঠে নি ।
নীতু মায়ের দিকে তাকালো । একবার মনে হল যে আজও বলে যে সে ক্যাম্পাসে যাবে না তবে আজকে বলল না । আজকে সে ক্যাম্পাসে যাবে বলেই ঠিক করলো । ওর জীবনে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে । দাদীর কথা মত সে ঘোড়সাওয়ারের কাছে আবেদন নিয়ে গিয়েছিলো । তারপর অদ্ভুত ভাবেই আফনান দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে । এটা কি একেবারে কাকতালীয় ব্যাপার?
হ্যা হতেই পারে এটা একেবারে কাকতালীয় ব্যাপার কিন্তু নীতুর মন জানে যে তার এই ফরিয়াদই ঘোড়সাওয়ার পূরণ করেছে এবং তার ফলেই আফনানের ঐ অবস্থা হয়েছে । এই পর্যন্ত ঘটনা ঘটলে নীতুর চিন্তার আর কোন কারণ ছিল না । সে ফরিয়াদ জানিয়েছে ঠিক যেমনটা লেজেন্ড বলছে, সেই ফরিয়াদ ঘোড়সাওয়ার শুনেছে । কিন্তু তারপর সে স্বয়ং ঘোরসাওয়ার নীতুর কাছে এসে হাজির হবে সেটা তো জানা ছিল না । এই ব্যাপারে নীতু ঠিক করেছে তার দাদীর কাছে জিজ্ঞেস করবে । তবে সমস্যা হচ্ছে দাদীর কাছে শুনতে হলে নীতুকে আবারও যেতে হবে গ্রামে । নীতুর দাদীর মোবাইলে ঠিকমত কথা বলতে ও শুনতে পারেন না । বাসায় যদিও একটা মোবাইলফোন রয়েছে তবে সেটা কেবল মাত্র দরকারে ব্যবহার করা হয় এবং বেশির ভাগ সময়ই দাদীর কাজের ছেলেটা সেই ফোন ধরে ।
নীতু উঠে বসলো । মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে মা আমি ক্লাসে যাবো?
-যাবি?
নীতু মায়ের চেহারায় একটা উদ্বিগ্নের ভাব ফুটে উঠতে দেখলো । সেখানে একটা চিন্তার রেখা । মায়ের দিকে তাকিয়ে নীতু বলল, মা চিন্তা করো না । আমি একদম ভাল আছি । ঐদিন একটু মাথাটা ঘুরে উঠেছিলো তাই এমন হয়েছিলো । আজকে ঠিক আছি আমি ।
নাস্তা শেষ করে ক্যাম্পাসের দিকে রওয়ানা দিল সে । অন্যান্য দিন খুব বেশি সমস্যা না হলে নীতু বাসে করেই ক্যাম্পাসে গিয়ে হাজির হয় । একটু সকালে যাওয়া লাগলে ক্যাম্পাসের দোতলা বাস আছে । সেটা ওর এলাকাতে এসে থামে । সেটাতে চড়ে । তবে সেটা বেশ সকালে আসে বলে প্রায়ই দিনও যাওয়া হয় না । আর ক্যাম্পাস থেকে ওদের বাসা খুব বেশি দুরে না হওয়ার কারণে খুব একটা সমস্যা হয় না যাতায়াতে । তবে আজকে সে রিক্সাতে করেই ক্যাম্পাসে গেল ।
মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি নিয়ে ক্লাস রুমে গিয়ে হাজির হল । ও ঢুকতেই দেখতে পেল কয়েকজন ওর দিকে ফিরে তাকালো । বসতে বসতে রাইমা এগিয়ে এসে শরীরের ব্যাপারে জানতে চাইলো ।
-আজকে কেমন শরীর তোর?
-আজকে ভাল !
-আমরা তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো । আরিয়ান স্যারও বেশ চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলো ।
-আরিয়ান স্যার !
নামটা মুখ দিয়ে আপনা আপনি বের হয়ে এল । নীতু দেখতে পেল যে আরিয়ান স্যারের নামটা মুখে আনতেই রাইমার মুখে একটা হাসি দেখা দিয়েছে । রাইমা বলল, আরে আরিয়ান স্যার আমাদের নতুন স্যার !
নীতু খুব ভাল করেই জানে আরিয়ান স্যার কে । ক্যাম্পাসে না আসলেও ক্যাম্পসের খোজ খবর সে ঠিকই রেখেছে । ওদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে ডিপার্টমেন্টের । সেখানেই আরিয়ান স্যারকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে । তার বেশ কিছু ছবিও আপলোড হয়েছে সেখানে । কখনও তাকে দেখা গেছে একেবারে ফরমাল ড্রেসে কখনও বা ক্যাজুয়্যাল পোশাকে । দুই পোশাকেই তাকে দেখতে অসম্ভ সুদর্শন আর নজরকারা মনে হয়েছে । বিশেষ করে তার নীল চোখ দিক থেকে মেয়েরা কিছুতেই যেন চোখ সরাতে পারে না । রাইমাও যে তাদের ব্যতিক্রম নয় সেটা বুঝতে নীতুর মোটেই কষ্ট হল না । নীতু যদি তার ব্যাপারটা না জানতো তাহলে সেও হয়তো রাইমার মতই মুগ্ধ হত ।
রাইমা বলল, আরে স্যার খুব চিন্তা দেখাচ্ছিলো তোকে নিয়ে । প্রথমে তোকে স্যারদের স্টাফ রুমে নিয়ে যাওয়া হয় । স্যার নিজে ক্যাম্পাসের ডাক্তারকে কল নিয়ে নিয়ে আসেন । পরে তোকে দেখে শুনে সেই তোকে তোর বাসায় পৌছে দেয় । সাথে আমি আর রুবি ছিলাম । আমার তখন কেবল মনে হচ্ছিলো ইস তুই না হয়ে যদি আমি অজ্ঞান হতাম তাহলে কতই না ভাল হত !
নীতু কিছু বলতে গিয়েও বলল না । রাইমা বরাবরই এমনই করে । অবশ্য ক্যাম্পসে রাইমার থেকে কাছের বন্ধু আর কেউ নেই ওর । পড়াশোনাতে ভাল হওয়ার কারণে সবাই ওর কাছ থেকে একটু দুরে দুরে চলে । আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যারা একটু পড়াশোনাতে ভাল তাদের সবাই একটু ঈর্ষার চোখে দেখে । সেই স্কুল থেকে নীতু এই ব্যাপারটা দেখে এসেছে । খুব কমই ছেলে মেয়েই আছে যারা পড়ালেখার ব্যাপারটা ছাপিয়ে কিংবা কোন উদ্দেশ্য ছাড়া বিশেষ করে পড়ালেখার সাহায্য নেওয়া বাদ দিয়ে ওর সাথে মন খুলে কথা বলেছে । এই কম মানুষ গুলোর ভেতরে রাইমা একজন ।
ক্লাস শুরু হয়ে গেল একটু পরেই । প্রথম ক্লাসটা স্বাভাবিক ভাবে শেষও হয়ে গেল । কিন্তু দ্বিতীয় ক্লাস শুরুর সাথে সাথে নীতুর মনের ভেতরে সেই ভয়টা আবার ফিরে এল । সেই সাথে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যটা বার বার মনে আসতে শুরু করলো । অস্বস্তি মিশ্রত ভয়টা তুঙ্গে উঠলো যখন আরিয়ান কবির ক্লাস রুমে প্রবেশ করলো । নীতু খেয়াল করলো যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই সবার প্রথমে আরিয়ান কবির ওর উপরেই চোখ ফেলল । যদিও ও একেবারে শেষের দিকে বসেছে । সবার আগে চোখ পড়ার মত স্থানে বসে নি কিন্তু নীতুর মনে হল যেন আরিয়ান কবির ঠিক ঠিক জানে জানতো যে নীতু কোথায় বসে আছে । সেখানেই তাকিয়েছে প্রথমে
হাতের বই আর খাতাটা টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে আরিয়ান সারাসরি আবারও তাকালো নীতুর দিকে । নীতুর ইচ্ছে হল চোখ সরিয়ে নিতে কিন্তু নীল চোখের সেই তীব্র চাহনী থেকে নীতু নিজের চোখ সরিয়ে নিতে পারলো না ।
-কেমন আছেন মিস আনিকা সারমিন?
আনিকা সারমিন নীতুর ফরমাল নাম । নিজের ফরমাল নাম টা আরিয়ান কবিবের মুখে শুনে অস্বস্তির মাত্রাটা যেন বাড়লোই কেবল ।
-আমার প্রথম ক্লাসেই একজন একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল এটা বলা চলে আমার জন্য একট অন্যন্য অভিজ্ঞতাই বটেই ।
সামনের থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো, স্যার আপনাকে দেখে নীতু ঠিক হজম করতে পারে নি ।
নীতু দেখলো পুরো ক্লাস হেসে উঠলো । এমন কি আরিয়ান কবিরও হাসলো । নীতুর দিকে তাকিয়ে আবার বলল, আজকে শরীর ভাল আপনার?
নীতু সংকোচ নিয়ে বলল, জ্বী স্যার ।
-গুড । নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন । বেশি বেশি খাওয়া দাওয়া করবেন। এতো পড়াশোনা না করলেও চলবে ।
আবারও ক্লাসের ভেতরে হাসির একটা আওয়াজ শোনা গেল ।
অবশ্য আর কিছু বলল না আরিয়ান কবির । সে পড়ানোতে মনযোগ দিলো । তবে পুরো ক্লাস জুড়ে নীতু একটা ব্যাপার খুব ভাল করেই খেয়াল করলো যে আরিয়ান কবিরের নজর সব সময় ওর উপরেউ নিবদ্ধ । ব্যাপারটা নীতুকে মোটেই শান্তি দিলো না । সেই সাথে সে এও বুঝে গেল যে সামনের দিন গুলোতে তার জন্য অস্বাভাবিক কিছু অপেক্ষা করছে । কিন্তু নীতু জানে না সেই স্বাভাবিক ব্যাপারটা কী ?
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.