নীতু এন্ড দ্যা হর্সম্যান

oputanvir
4.7
(52)

নীতু ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে । এখনও ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে কাজটা করতে যাচ্ছে । অন্য কোন স্বাভাবিক সময় হলে হয়তো নীতুর এই সব আজগুবি ব্যাপার মনে হত কিন্তু এখন ওর মনে প্রতিশোধের একটা তীব্র আগুণ জ্বলছে । নিজেকে সে সব সময় শান্ত আর ধীর স্থির মানুষ হিসাবেই জেনে এসেছে । এমন একজন মানুষ যে কখনই কোন মানুষের ক্ষতি করার কথা ভাবে নি । বরং সবাই কে সব সময় ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষপাতিই ছিল সে। কিন্তু এখন ও যে কাজটা করতে যাচ্ছে তা কোন ভাবেই তাকে শান্ত আর ক্ষমাপ্রবণ মেয়ে মনে হচ্ছে না ।

এসবের কী দরকার আছে ? আফনানকে কি ক্ষমা করে দেওয়া যায় না? নিজের মনে প্রশ্নটা করলো সে আবার !
নীতু একটু যেন থেমে গেল । এছাড়া সামনের অন্ধকার রাস্তায় হাটতেও তার কিছুটা ভয় লাগছে । একা একা কাল সে এখানে কিভাবে এসেছিলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ।
তারপরই নীতুর চোখের সামনে আফনানের চেহারাটা ভেসে উঠলো । সেই সাথে ওর সাথে করা আফনানের অন্যায়টা মনে হতেই মনের ভেতরে তীব্র একটা প্রতিহিংসা জ্বলে উঠলো । তারপরই মনে মনে বলল যে আফনানের কোন ক্ষমা নেই । ওর কোন ক্ষমা নেই । ও যা করেছে তাতে ওর শাস্তি পেতেই হবে । কোন ক্ষমা নেই ওর !
নীতু ধীর পায়ে এগিয়ে গেল । চলে এসেছে প্রায় । হাতের ব্যান্ডটার দিকে তাকালো সে । সময় বলছে মধ্যরাত হতে আর বেশি বাকি নেই । কালকের কাজ গুলো যদি ঠিক থেকে থাকে তাহলে আজকে সে আসবে । আর যদি না আসে তাহলে বুঝতে হবে কালকে কোন একটা ভুল হয়েছিলো । কাজটা আবারও ঠিক মত করতে হবে । তবে সেটার জন্য আবারও আরেক আমাবস্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ।

কালকের কাজে কি কোন ভুল হয়েছিলো?
নীতু মনে করার চেষ্টা করলো । ওর দাদী বলেছিলো কী কী করতে !

হাট থেকে এক দামে একটা কালো মোরগ কিনতে হবে । কোন প্রকার দামাদামী করা যাবে না। তারপর কিনতে হবে আধা কেজি আঁতপ চাল । ব্যাস এই কাজ করতে হবে নীতুর নিজেকে । নীতু তাই করেছিলো । সোজা হাটে গিয়ে হাজির হয়েছিলো । এটা তার নিজের গ্রাম হলেও এখানে তার আসা হয় নি একদমই । সব সময় শহরেই থেকে এসেছে । কিন্তু ওর সাথে যে ঘটনাটা ঘটেছে তাতে শহরটা কেমন যেন খুব অসহ্য মনে হচ্ছিলো । গ্রামে আসতে চাওয়ায় ওর বাবা প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশি হয়েছিলো । মেয়েকে নিজে এসে গ্রামে রেখে গেছে । জানিয়েছে যে এক সপ্তাহ পরে এসে ওকে নিয়ে যাবে আবার ।

গ্রামে নীতুদের বাড়িটা বেশ বড়ই বলা চলে । আগে গেরস্তবাড়ি হিসাবেই পরিচিত । এখন অবশ্য কেবল নীতুর দাদী এখানে থাকে । বেশ জমি জমা রয়েছে সেগুলো দেখা শোনা করেন একাই । লিজ দেওয়া আছে সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে তার বেশ ভাল ভাবেই চলে যায় । নীতুর বাবারা দুই ভাই একবোন । সবাই ঢাকাতে থাকে । খুব বড় কিছু না হলেও সবাই মোটামুটি ভাল চাকরি বাকরি করে । স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করে তারা । নীতুর দাদীকে অনেক বার বলা হয়েছে শহরে গিয়ে থাকতে কিন্তু নীতুর দাদী সেটা করে নি মোটেও । তার নিজের গ্রাম নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না । তার দম বন্ধ হয়ে আসে ।

নীতু যখন প্রথম দিন আসলো সেদিনই তার দাদী তাকে চেপে ধরলো । তার নাতনি যে এমনি এমনি গ্রামে আসে নি সেটা সে ঠিকই বুঝেছিলো । দাদীকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছু সময় ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো নীতু । তারপর ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলল দাদীকে । নীতু দেখতে পেল বুড়ো বয়সেও তার মুখের পেশি কেমন রাগে টনটন করতে শুরু করেছে । নাতীর সাথে এমন অন্যায় ঘটনাটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ।

নীতু দেখতে যে খুব বেশি সুন্দরী সেটা না । তবে ওর চেহারাতে একটা সৌম্য স্নিগ্ধ ভাব আছে । নীতু অবশ্য জানে যে সে সুন্দর না । এটা নিয়ে তার খুব একটা আক্ষেপও ছিল না । সে নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো । তবে এতো কিছুর পরেও ক্লাসের সব থেকে জনপ্রিয় ছেলে আফনানকে তার ভাল লাগতো । আসলে আফনান এমনই একজন ছেলে যে যাকে পছন্দ না করে উপায় নেই । দেখতে সুন্দর । ভাল গান করে । কবিতা আবৃতি করে । মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে গিটার নিয়ে আসে । সেখানে গান চলে । পড়াশোনাতেও ভাল । সব দিক দিয়েই সেরা সে । এমন ছেলেকে পছন্দ না করে কেউ পারে !

তবে নীতু এও জানতো যে তার আর আফনানের মিলন আসলে কোন কালেই সম্ভব না । তবে অপু তানভীরের গল্পে যেমন হয়, তেমন ভাবেই তার জীবনে আফনান চলে এল । প্রথমে নীতুর যেন ব্যাপারটা একদম বিশ্বাসই হল না । ভ্যানেলটাইনস ডে সবার সামনেই নীতুকে প্রোপোজ করলো সে । নীতুর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো । আরেকটু হলে সে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেত ।

এরপর ওদের প্রেম শুরু হল । নীতু স্বপ্নের দুনিয়াতে ভাসতে শুরু করলো । তবে সেই স্বপ্নের দুনিয়া থেকে বের হতে খুব বেশি সময় লাগলো না । ঠিক দুই সপ্তাহ পরে নীতুকে সবার সামনেই আফনান প্রত্যাখ্যান করলো । তাকে আসলে সে বেট হিসাবে নিয়েছিলো । বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে যে কোন মেয়ের সাথেই সে চাইলে প্রেম করতে পারবে এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রেম করেছিলো নীতুর সাথে । এছাড়া তার নিজের গার্লফ্রেন্ড রয়েছে ।

নীতু সবার সামনে হাসির পাত্র হয়ে গেল । সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করলো । লজ্জা আর অপমানে নীতু তখনই ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে এল । প্রথমে কান্না করলো খুব । কিন্তু পরে সেই কান্নার স্থান জায়গা করে নিল রাগ আর প্রতিশোধ নেওয়ার স্পীহা । কিন্তু সত্যি বলতে কি নীতু আসলে কিছুই করতে পারবে না । আফনানের বাবা বিশাল বড়লোক । সেই সাথে রাজনীতির সাথে যুক্ত । এমন কারো কোন কিছু করা নীতুর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কারো কর্ম নয় এটা নীতু জানতো ! কিন্তু সে ভুল জানতো ।
তার দাদীর কিছু করার ক্ষমতা ছিল। সেই মোতাবেগই কাজ করতে নীতু আজকে এখানে এসেছে ।

নীতুদের গ্রামে এই মিথটা প্রচলিত আছে । দাদীর কাছেই সে আগে গল্প শুনেছে । এই গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় চৌরাস্তা আছে । গ্রাম থেকে একটা রাস্তা সোজা গেছে বড় জঙ্গলের দিকে । অন্য আরেকটা রাস্তা সেই রাস্তটাকে ভাগ করেছে । একটা গেছে নদীর দিকে অন্যটা পেছনের আরেকটা গ্রামের দিকে । এই চৌরাস্তটার নাম ঘোড়সাওরের ঘাট । এখানে আগে মানুষ নাকি নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার দিত । তাদের ফরিয়াদ শুনতে একজন আসতো ঘোড়ায় চেপে । তার কাছে কাগজে লিখে দিতে হত তার সাথে কী হয়েছে । যদি তা সত্য হত তাহলে ঠিক ঠিক ব্যবস্থা গ্রহন করা হত ।

যদিও এই গল্প এখন কেউ বিশ্বাস করে না । এটা গ্রামের একটা কিংবদন্তী বলা চলে । কিন্তু তার দাদী ঠিকই ব্যাপারটা বিশ্বাস করে । এবং দাদীর এই তীব্র বিশ্বাস দেখে নীতুর কেন জানি এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল খুব । একবার মনে হল যে চেষ্টা করে দেখলে তো সমস্যা নেই । হলে হবে না হলে না হবে ।

নিয়মটা খুব সাধারণ । আমাবস্যার ঠিক আগের দিন একটা কালো মোরগ আর আধাকেজি আতোপ চাল কিনে এই চৌরাস্তার ঠিক মাঝে রেখে আসতে হবে ঠিক মধ্যরাতের সময় । পরদিন একই সময়ে গিয়ে হাজির হতে হবে । তখনই আসবে ঘোড় সাওয়ার । তার সামনে থামবে । তার দিকে হাত বাড়াবে । তখন তাকে কাগজটা বাড়িতে দিতে হবে । সে কাগজটা নিয়ে চলে যাবে । এই হচ্ছে কাজ । আর কিছু নেই । সমস্যা একটাই তা হচ্ছে যার ফরিয়াদ তাকেই যেতে হবে । নীতু গতকালকে একা একা এসে রেখে গেছে মুরগি আর চাল । যদিও অর্ধেকটা পথ তার দাদী সাথে ছিল । এই চৌরাস্তার আগে এসে সে থেমে গেছে । এই পথ টুকু একা আসতে নীতুর খুব ভয় করছিলো । তবে সে রেখে গেছে ।
আজকে অবশ্য এতো ভয় লাগছে না ।

নীতুর কেন জানি মনে হল সেই ঘোড়সাওয়ার ঠিক ঠিক আসবে । এমনটা মনে হওয়ার পেছনে কোন কারণ নেই তবুও মনে হল যে যে আসবে । আসলে এখনকার পরিবেশটাই এমন । আবাবশ্যার কারণে চারিদিকে ঘুরঘুটে অন্ধকার । কিছুই দেখা যায় না । হাতে করে নিয়ে আসা মোবাইল টর্টটা জ্বালিয়ে এসেছে । চৌরাস্তার ঠিক একপাশে সে দাড়িয়ে রইলো । জঙ্গলের দিক থেকে আসবে সেই ঘোর সাওয়ার । হাতে কাগজটা শক্ত করে চেপে ধরেছে ।

এভাবে একভাবে দাড়িয়ে রইলো সে । চারিদিকে রাতের একটা নিঃতব্ধতা নীতুকে যেন পেয়ে বসলো । নীতুর মনে অদ্ভুত একটা ভয় এসে জড় হল । ওর মনে হল যে কেউ যেন ওকে দেখতে । ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আশে পাশের কোথা হতে এখনই হয়তো ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়বে । নীতু ভয়ে যখন তুঙ্গে, নীতু এখনই ঘুরে পেছনে দৌড় দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ঠিক তখনই আওয়াজটা শুনতে পেল সে । অনেক দুর থেকে আসছে ।
ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ।

দম বন্ধ হয়ে এল ওর !
সত্যি সত্যি আসছে !

তীব্র এক বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো সেই জঙ্গলের পথের দিকে । সত্যিই আসছে সে !
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আওয়াজটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে ওর দিকে । নীতুর ভয়ে পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করলো । রাতের অন্ধকার চারিদিকে । কোন আলো নেই । কিন্তু তারপরেও নীতু সেই কালো অন্ধকারের ভেতরে সেই কালো ঘোড়সাওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখলো । পুরো মাটি কাঁপিয়ে এগিয়ে এসে থামলো ঠিক নীতুর সামনে ।
নীতুর মনে হল যে সে এখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে । ঘোড়সাওয়ার আসলো । তারপর ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ।

ঘোড়সাওয়ারের পুরো শরীর কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা । এমন কি মুখের উপরেও একটা কালো কাপড় দিয়ে আটকানো । তবে চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে । সেই চোখ যেন আগুনের মট জ্বলছে । মাথায় হেলমেট জাতীয় কিছু রয়েছে । নীতু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল ।
প্রথমে কিছু সময় সে বুঝতেই পারলো না যে কী হচ্ছে ওর সাথে !
কিন্তু হাতটা যখন দেখলো তখন মনে পড়লো তার কী করার কথা । হাতের কাগজটা বাড়িয়ে দিল সে ।
ঘোড়সাওয়ার নিল সেটা ।

তারপর আর কিছু না বলে ঘোরা ঘুড়িয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই ছুটে চলে গেল । নীতু সেদিকেই তাকিয়ে রইলো । একটা সময় নীতুর মনে হল এতো উত্তেজনা সে নিতে পারছে না । জ্ঞান হারিয়েই সে মাটিতে পড়ে গেল !

সকালে বেলা যখন নীতুর ঘুম ভাঙ্গলো তখন নিজেকে আবিস্কার করলো গ্রামে তার দাদীর ঘরে । দাদী পাশেই বসে রয়েছে তার দিকে তাকিয়ে । ঘুম ভাঙ্গতেই জলদি বলে উঠলো, এখন কেমুন লাগতাছেরে তোর !!

নীতু প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না কী হয়েছে । ও কিভাবে এখানে এল সেটাও মাথায় ঢুকলো না । তাহলে কি রাতে যা দেখেছে সব স্বপ্ন ছিল ! নয়তো এখানে কিভাবে এল সে ! তার তো চৌরাস্তার মোড়ে থাকার কথা ছিল ! কিন্তু সে এখানে কিভাবে এল?
তাহলে কি সে গতকাল যায়ই নি সেখানে?
নীতুর মনের কথা বুঝতে পেরেই তার দাদী বলল, তুই আইতাছোস না দেইখা আমিই জমিররে নিয়া আগায়া গেছিলাম । দেখি তুই মাটিতে পইড়া আসোস !
নীতু ভেবেছিলো এরপর দাদী ওকে আরও প্রশ্ন করবে । তবে তেমন কিছুই করলো না ।

এরপরে আরও কয়েকটা দিন সে থাকলো গ্রামে । তারপর আবারও ঢাকা ফিরে এল । ক্যাম্পাসে ফিরতে কেন জানি ওর কোন সংকোচ হল না । কয়েকদিন আগে ওকে করা অপমানের কথা কেন জানি নীতুর আর মনে রইলো না । কিন্তু যখন সে ক্যাম্পাসে ফিরলো, নিজের ক্লাস রুমে ঢুকলো তখনই বুঝতে পারলো যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে । সবার মুখ কেমন যে থমথমে !

কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না । তবে আসল খবর ঠিকই বের হয়ে এল ! এমন একটা খবর যা শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না । অন্তত ব্যাপারটা যে এই দিকে যাবে সেটা নীতু স্বপ্নেও ভাবে নি ।

আফনান ভয়ানক ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে । আফনানের বাইক রয়েছে । প্রায় দিনই সে বাইক নিয়ে রাতে বের হয়ে যেত । দুইদিন আগেও বাইরে গিয়েছিলো রাতে । তখনই নাকি একটা ট্রাকের সাথে ভয়ানক ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে । দুর্ঘটনাটা এমনই ভয়ানক যে প্রায় মরেই গিয়েছিলো সে । তবে এখন মনে হচ্ছে যে মরে গেলেও ভাল হত তার জন্য । ডান পাটা ভয়ানক ভাবে ভেঙ্গেছে । সুন্দর চেহারার পুরো অংশটাই ঘষা খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে । চেহারা হয়ে গেছে ভয়ংকর !

নীতুর মনে আফনানের জন্য মায়া হওয়া দরকার কিন্তু কেন জানি নীতুর মোটেই এটা শুনে খারাপ লাগলো না । ক্লাস শেষ করে সে হাজির হল আফনানের হাসপাতালের কেবিনে । আইসিইউএর ভেতরে ঢুকতে না পারলেও কাঁচের এপাশ থেকে সে তাকিয়ে রইলো আফনানের দিকে । মনের ভেতরে কোন অনুশোচনা জন্মালো না । বরং মনের ভেতরে একটা অচেনা আনন্দ হল । কেবল মনে মনে বলল যে ইউ ডিজার্ভ ইট ! ইউ ডিজার্ভ ইট !

যখন হাসপাতাল থেকে বের হল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । সেখান থেকেই সে টিউশনিতে গিয়ে হাজির হল । সেটা শেষ করে বাসায় পথে যখন রওয়ানা দিল তখন রাত প্রায় নয়টা বাজে । টিউশনিটা যেদিন থাকে সেদিন এমন দেরি হয় । এই নিয়ে নীতুর মা প্রায়ই রাগ করে । মেয়েদের এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা উচিৎ না সহ আরো নানান কথা । অবশ্য নীতুর বাবা এটা নিয়ে কোন কথা বলে না । তার এই ব্যাপারে একটা সায় আছে । এই কারণে নীতু এখনও টিউশনিটা করে যেতে পারছে ।

আজও বাসার দিকে হাটছিলো । ঠিক এমন সময়ে লোডশেডিং হল । পুরো এলাকা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল । সেই সাথে একেবারে সব কিছু যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল । বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ব্যাপারটা নীতুর কাছে কিছু মনে হল না । কারণ এই রকম হুটহাট বিদ্যুৎ চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক । কিন্তু চারপাশটা এই রকম ভাবে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়াটা নীতুর কাছে একেবারে অস্বাভাবিক মনে হল । ঢাকা শহরটা কখনই এমন নিশ্চুপ হয় না । সব সময় মানুষ জন গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ভেসে আসে চারিদিক থেকে !

ঘোড়া !

নীতু তখনই আওয়াজটা শুনতে পেল । ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ।

নীতু একেবারে ভয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে রইলো । যেন নড়তে পাড়ছে না একদম । আওয়াজটা এগিয়ে আসতে থাকলো । নীতু দেখতে পেল তাকে । সেই কালো বিশাল ঘোড় আর তার উপরে বসে থাকা ঘোড়সাওয়ার !

ঘোড়সাওয়ার একেবারে এসে থামলো নীতু সামনে । নীতু ভয়ে ভয়ে তাকালো তার দিকে । তখনই অবাক হয়ে দেখলো আজকে তার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা নয় । বরং সেখানে একটা সুদর্শন মুখ দেখা যাচ্ছে । চোখের রং গতদিনের মত লাল নয় । আজকে এই অন্ধকারের ভেতরে তার নীল চোখ নীতু পরিস্কার দেখতে পেল । ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো ঘোড়সাওয়ার । তারপর বলল, যারা আমার কাছে সাহায্য চায় কাজ হওয়ার পরে তারা বেশির ভাগই নিজের ভেতরে অনুশোচনায় ভোগে । কিন্তু তোমার ব্যাপারটা ভিন্ন দেখতে পাচ্ছি । আই লাইক দ্যাট !

ঘোড়সাওয়ার মুখে ইংরেজি শুনে নীতুর চোয়াল ঝুলে গেল । এই লোক ইংরেজি জানে কিভাবে? ঘোড়সাওয়ার নীতুর দিকে তাকিয়ে হাত তুলল । তারপর বলল, দেখা হবে আবারও । খুব জলদি ।

তারপর ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেভাবে ঘোড় সাওয়ার চলে গেল । সাথে সাথে যেন সব কিছু আবার আগের মত হয়ে গেল । বিদ্যুৎ ফিরে এল সেই সাথে ফিরে এলো চারিদিকের আওয়াজ কোলাহল !

নীতু কিছুই যেন বুঝতে পারছিলো না । অতিপ্রকৃস্থের মত করে হেটে বাড়িতে গিয়ে হাজির হল । কিন্তু নীতুর জীবনে তখনও অবাক হওয়ার ঘটনার বাকি ছিল । পরদিন ক্লাসে গিয়ে জানতে পারলো যে তাদের ডিপার্টমেন্ট নতুন স্যার নিয়োগ । সদ্য বুয়েট থেকে পাশ করেছে । ওদের থেকে বয়স বেশি হবে না । কয়েক বছরের সিনিয়র। আজকে ওদের ক্লাস দিয়ে শুরু তার চাকরির জীবন শুরু হবে । স্যার নাকি দারুন সুন্দর দেখতে । নাম তার আরিয়ান কবির।

যখন আরিয়ান কবির ক্লাসে ঢুকলো তখন ক্লাসের সব মেয়েদের মুখ থেকে আপনা আপনিই একটা আনন্দধ্বনি বের হয়ে এল । কেবল একজন মেয়ে তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আরিয়ান কবিরের দিকে । সেই একজনটা হচ্ছে নীতু নিজে । কারণ তাদের সদ্য জয়েন করা স্যার আর কেউ নয় গত রাতের নীল চোখের সেই ঘোড়সাওয়ার !

এতো খানি উত্তেজনা নীতু নিতে পারলো না । ঘোড়সাওয়ারকে দেখে দ্বিতীয়বারের মত সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ।

গ্রামের ঘোড়সাওয়ার কিংবদন্তী অবলম্বনে

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 52

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “নীতু এন্ড দ্যা হর্সম্যান”

  1. আরেকটা পার্টের আশায় রইলাম।

Comments are closed.