মায়া নেকড়ে

4.9
(35)

বুনো পাহাড়ি আঁকাবাকা পথ ধরে আমি এগিয়ে চললাম। আজকে আমার সাথে রফিক মিয়া নেই । এখানে আসার পরে আমি যতবারই বনে এসেছি রফিক মিয়া সব সময় আমার সাথে সাথে থেকেছে। আমাকে পথ দেখিয়েছে। আজকেও হয়তো আমার সাথেই আসত তবে রফিক মিয়ার বাসায় একটু সমস্যার কারণে সে আজকে ছুটি নিয়েছে । আমি আজকে একা একাই বের হয়েছি।
রসুলপুর রেঞ্জের ফরেস্ট অফিসার হয়ে এসেছি মাস ছয়েক আগে। এখানে এসেই বুঝেছি যে শহরের কোলাহল থেকে একেবারে মুক্ত আর শান্তির জীবন কাটাতে যাচ্ছি । অন্তত যে কয়টা দিন এখানে আছে খুব শান্তিতেই থাকব। এখানে অল্প কিছু কাঠ চোরা চালানীর হয় তবে সেটা এই মাস ছয়েকের ভেতরেই মোটামুটি সামলে নিয়েছি । এখনো যে হয় না সেটা বলছি না তবে আগের থেকে কম । এই রেঞ্জের উত্তর পশ্চিম দিকেই বেশি হয় কাঠ পাচার । তবে অদ্ভুত কারণে দক্ষিণ দিকে কেউ যায় না । এমন কি পোচাররাও ঐদিকে পা বাড়ায় না । সবাই কিছু একটা ব্যাপারকে ভয় পায় । রফিক মিয়া আমাকে সব দিকে নিয়ে গেলেও দক্ষিন দিকে নিয়ে যেতে চায় না মোটেও।
আর আজকে আমি সেদিকেই চলেছি। একাই চলেছি । এই ছয় মাসে আমি বনের ভেতরের পথঘাট বেশ ভালই চিনে ফেলেছি । মোবাইলে কম্পাস রয়েছে । এছাড়া আলাদা করে জিপিএসও রয়েছে । তাই পথ হারানোর ভয় নেই আমার খুব একটা ।
আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম। আমার খুব বেশি দুরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই । এদিকটা একেবারেই আসা হয় নি । তাই একটু হেটে আছি।

ঘন্টা খানেক হাটার পরেই মনে হল আমি যেন একেবারে অন্য জগতে চলে এসেছি। এখানকার বন অনেক বেশি ঘন । সেই সাথে গাছের পরিমানও অনেক বেশি । সরু একটা পায়ে চলে পথ আমি আবিস্কার করেছি বটে তবে এখানে লোকজন আসে না বললেই চলে । অন্তত নিয়মিত পথ দেখে যেমন মনে হয় এটা তেমন কিছু মনে হল না । তবে একেবারে যে আসে না সেটাও না । তার মানে এখানে কেউ না কেউ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ঠিকই আসে ।
এই বনে কেন আসে?
আমি আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। যতই আমি সামনের দিকে যাচ্ছি আমার কাছে চারিপাশটা যেন যেমন মোহাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে । কেউ যেন আমাকে বলছে আরও একটু এগিয়ে যেতে । সামনে কী আছে সেটা দেখার জন্য কেউ আমার মনের ভেতরে একটা চাপ সৃষ্টি করছে। আমি নিজের ভেতরেই সেই অনুভূতিটা বেশ ভাল ভাবেই টের পেলাম । আমি যতই গভীরে যেতে শুরু করলাম আমাকে সব কিছু কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন আর ঘন কুয়াছন্ন মনে হতে লাগল ।
এক সময়ে এসে আমি বুঝতে পারলাম যে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার মনে কোন দিক থেকে যে আমি এসেছিলাম সেটা আমি একেবারে হারিয়ে ফেলেছি। কিছুই চিনতে পারছি না । কোথায় চলে এসেছি একেবারে আমার কাছে অপরিচিত মনে হতে লাগল । আমি যেন কিছুই ঠিক মত চিনতে পারছি না । নিজের মোবাইল বের করে কম্পাসটা দেখার চেষ্টা করলাম । অদ্ভুত ভাবে দেখলাম সেটা কাজ করছে না ।
আমি কিছু সময় চুপ একই স্থানে দাঁড়িয়ে রইলাম । কোণ দিকে যাবে ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছিলাম না । এমন তো হওয়ার কথা না । এদিকে দিনের আলো কমে আসতে । যদি এখানে রাত নেমে আসে তাহলে একটু বিপদে পড়ব বইকি ! এখনো বনের ভেতরে রাত কাটানোটা পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারি নি। বিশেষ করে এমন ভাবে একেবারে কোন প্রকার প্রস্তুতি ছাড়া তো নয়ই।
কিছু সময় আমি এদিক ওদিক ঘুরলাম দিশে হারার মত । যখন আমার মনে হল যে আমার আসলে আর কোন উপায় নেই এই বনে রাত কাটানো ছাড়া তখনই আমি একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেলাম ।
আমি একটা নেকড়ে দেখতে পেলাম ।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম শেয়াল ! তবে একটু ভাল করে তাকাতেই বুঝলাম যে সেটা কোন ভাবেই শেয়াল না । শেয়াল এতো বড় হয় না । আর শেয়ালের গায়ের রঙ এমন ধূসর হয় না ।
এই বনে নেকড়ে আছে আমার জানা ছিল না । আমি সত্যিই অবাক না হয়ে পারলাম না। নেকড়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল একভাবে । আমার উপর হামলা করল না কিংবা আমাকে দেখে পালিয়েও গেল না । কেবল একভাবে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । আমার তখনই মনে হল এই নেকড়েটা আমাকে যেন কিছু বলতে চাইছে !
আমার দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে সেটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল একটু । তারপর থামল তারপর আবার এগিয়ে গেল । তারপর আবার থামল। আমার দিকে আবার ফিরে তাকাল । আমি নেকড়েদের আচরণ সম্পর্কে কোন কিছুই জানি না তবে আমার কেন জানি মনে হল যে নেকড়েটা আমাকে তার পেছন পেছন যেতে বলছে । আমি সেদিকে হাটতে শুরু করতে সেটা আবার হাটতে শুরু করল । আমি সেটার পেছন পেছন হাটতে শুরু করলাম । কোথায় যাচ্ছি আর কেন যাচ্ছি সেটা আমি জানি না । তবে কেবল যাচ্ছি ।
কত সময় হেটেছি আমি জানি না তবে একটা সময়ে আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে একটা গুহার মত স্থানে এসে পৌছিয়েছি। আমি সেটার কাছে এগিয়ে গেলাম । এবং আরো আবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে সেখানে আরও ১০/১২টা নেকড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । আমি সেখানে যেতেই দেখলাম যে ওরা পথ করে দিল । গুহার পথে যাওয়ার পথ । আমাকে গুহাতে প্রবেশ করতে বলছে ।
আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই গুহার ভেতরে ঢুকলাম । গুহাটা খুব বেশি বড় না । একটা বড় ঘরের সমান হবে । ছাদটা আমার সমান উচু । তবে আমি ঠিকঠাক মত দাড়াতে পারি । আমি গুহার ভেতরেই দেখতে পেলাম সেটাকে !
একটা নেকড়ে !
আকারে অন্য সে কোণ নেকড়ের থেকে বড় ! গায়ের রঙ ধূসর নয় বরং সাদা ! মাটিয়ে চুপ করে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে । আমি কাছে যেতেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল । তারপর গভীর নীল চোখ সেটার । একেবারে যেন মানুষের মত । আমি অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
আরেকটা অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই নেকড়েটার গলার কাছে একটা লোহার বেড়ি পরানো । এবং সেটা একটা লম্বা শিকল দিয়ে আটকানো । শিকল টা গুহার দেওয়ার একটা আংটার সাথে আটকে আছে । ব্যাপারটা আমাকে অবাক করল খুব। এই বনে এইভাবে একটা নেকড়ে কেন কেউ আটকে রাখবে?
আমি সেটার দিকেই এগিয়ে গেলাম । যদিও বন্য প্রাণীর কাছে যাওয়া নিরাপদ না মোটেই তবে আমার কেন জানি মনে হল আমার কোন ক্ষতি এই নেকড়ে করবে না । আমি এগিয়ে গেলাম একেবারে কাছে । সাথে সাথে আমার নাকে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ লাগল । আমাকে যেন আছন্ন করে ফেলল । বন্য নেকড়ের গা থেকে কি এমন গন্ধ বের হয় ? আমি জানি না । এর আগে আমি কখনই নেকড়ের এতো কাছে যাই নি !
আমি নেকড়েটার গলার বেড়ির দিকে ভাল করে তাকালাম ! বেড়ীর স্টিলের অদ্ভুর কিছু লেখা রয়েছে । অপিরিচিত কোন একটা ভাষায় কিছু লেখা ! নেকড়ের চোখের দৃষ্টি আমার কাছে সেটা খুলে ফেলার আকুতি জানাচ্ছে ! একটা বন্যপ্রাণী কে এভাবে আটকে রাখার কোন মানে নেই ।
আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু নেকড়ের গলা থেকে সেটা খুলতে পারলাম না কিছুতেই । তবে শিকল আটকানোর তালাটা আমার পকেট নাইফ দিয়ে খুলতে সমস্যা হল না।
নেকড়েটা শিকল থেকে মুক্ত হতেই এক লাফে গুহার বাইরে গিয়ে দাড়াল । তারপর জোড়ে করে ডেকে উঠল । দেখলাম এক সাথে বাকি নেকড়ে গুলোও একই ভাবে ডেকে উঠল । আমি কাছ থেকে এগুলো নেকড়ের ডাক এর আগে কোন দিন শুনি নি । আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল । সেই সাথে একটা তীব্র ভয় আমার মনে এসে উদয় হল ।
সেই সাথে এতো সময়ে যে আমি যে একটা ঘোরের ভেতরে ছিলাম সেটাও যেন কেটে গেল । আমার তখন মনে হল এই নেকড়ে গুলো যদি আমার উপরে এখন হামলা করে আমাকে মেরে ফেলে আমি কোন ভাবেই নিজেকে এদের হাত থেকে বাচাতে পারব না । আমি কেন এখানে এলাম ? কেনই বা এই অদ্ভুর নেকড়েটাকে মুক্ত করলাম ? আর কে এই নেকড়েটাকে এখানে এভাবে আটকে রেখেছিল ?
এসব কোন উত্তর আমার জানা হবে না হয়তো । তার আগেই আমি নেকড়ের পেটে চলে যাব ।
ডাকাকাডি শেষ হলে আমি ভয়ে ভয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম । দেখলাম ঠিক আগের মত করে নেকড়ে গুলো আমার জন্য পথ ছেড়ে দিয়েছে । আমাকে যেন যাওয়ার জন্য বলছে !
এরা কি আমাকে চলে যেতে দিচ্ছে?
আর সামনে সেই প্রথম নেকড়েটাকে দেখতে পেলাম সেই আগের মত একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে । আমার কাছে মনে হল যেন ওটা আমাকে যেভাবে এখানে নিয়ে এসেছে ঠিক ওভাবেই পৌছে দিবে ।
আমি ভয়ে ভয়ে নেকড়ে গুলোর মাঝ দিয়ে হেটে গেলাম । আমি কাছে যেতেই দেখলাম সেই নেকড়েটা হাটতে শুরু করলাম । আমিও দ্রুত সেটার পিছু নিলাম । গুহার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে আমি একবার পিছন ফিরে তাকালাম । দেখতে পেলাম সেই সাদা নেকড়েটা আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । সেই নীল চোখের গভীর দৃষ্টি আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে !
আমি মুখ ঘুরিয়ে আবারও হাটা দিলাম !

কত সময় আমি নেকড়ের পেছন পেছন হেটেছি আমি নিজেও জানি না । একটা সময়ে আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম সে নেকড়টা থেমে গেল । আমিও থেমে যাবো কিভাবে ভাবছি তখনই আমি চারিপাশে স্থানটা পরিচিত মনে হল । বড় কলুই গাছটা আমার চিনতে কষ্ট হল না ।
দেখলাম নেকড়েটা আমার পাশ দিয়ে চলে গেল । একেবারে আমার গা ঘেষে । আমি নিজের ফেরার পথ ধরলাম !
রাতে নিজের বিছানাতে শুয়েই আমি নেকড়ের ডাক শুনতে পেলাম ! বেশ জোড়েই শুনতে পেলাম। অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে আমি এই ছয় মাসে এই প্রথম নেকড়ের কাড শুনতে পাচ্ছি । যদি এই বনে নেকড়ে থাকবেই তাহলে এতোদিন ডাকে নি কেন?
আর বনের ভেতরে ঐ নেকড়েটাকে এভাবে আটকে কে রেখেছিল?
গলায় ওভাবে বেড়ী- রিং পরালো কে ? আর ওটাতে ওমন অদ্ভুত ভাষায় কি লেখা ছিল? এই সব প্রশ্ন আমাকে ভাবাচ্ছিল । তবে এসবের উত্তর আমার জানা নেই ।

দুই

সকালে ঘুম ভাঙ্গল রফিক মিয়ার ডাকে । তার ডাক শুনেই আমি বুঝলাম যে কোন না কোন ঝামেলা হয়েছে । দরজা খুলে বের হয়ে এলাম । দেখি কেবল রফিক মিয়াই না সাথে আরও দুইজন আছে । এরা সবাই ফরেস্ট গার্ড । পাশের গ্রামেই এদের বাসা । আমার দিকে তাকিয়ে রফিক মিয়া বলল, স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে !
আমি ঘুম জড়ানো চোখে রফিক মিয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম যে কী এমন সর্বনাশ হতে পারে । এই অঞ্চলে সর্বনাশ বলতে পোচার বা চোরাকারবারীরা গাছ কেটে নিয়ে যায় । এটা ছাড়া আর কোন সর্বনাশ এখানে হয় আর তেমন কিছুই হয় না । তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে রফিক মিয়া বলল, স্যার গম্বু খুন হইছে !
আমি একটু চমকালাম । গম্বুর নাম আমি শুনেছি অনেকবারই । এই এলাকাতে যে কয়জন চোরাচালানী রয়েছে গম্বু তাদের অন্যতম । আমি আসার পরে তার দৌড়াঝাপ একটু কমেছিল । আমি শুনেছিলাম যে গ্রামের বাজারে সে নাকি প্রায়ই আমাকে দেখে নেওয়ার কথা বলত তবে আমার সামনে কোন দিন আসে নি । সে আজকে এভাবে খুন হয়েছে !
অবশ্য এটা নিয়ে আমি খুব বেশি চিন্তার কোন কারণ খুজে পেলাম না । কারণ চোরাচালানীদের মাঝে এমন অনেক সময় ঝামেলা হয় । একে অন্যের সাথে মারামারি খুন খারাবি স্বাভাবিক ব্যাপার । আমি রফিক মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাকে এতো চিন্তিত কেন মনে হচ্ছে? দেখো গিয়ে নিজেদের ভেতরে কোন ঝামেলা হয়েছে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে !
রফিক মিয়া যেন জানতই আমি এমন কথাই বলব । সে আমাকে বলল, স্যার আপনি একটু চলেন । পুলিশ আসবে এখনই । আপনেও যাওনের দরকার ।
এই পুরো এলাকা আমার নিয়ন্ত্রণে । এখানে একজন মানুষ মারা গেলে সেটা আমার দায়িত্বের ভেতরেই পড়ে । রফিক মিয়া সম্ভবত এটাই বুঝিয়েছে । তাড়াহুড়া করে সকালের নাস্তা খেয়েই আমি রওয়ানা দিলাম রফিক মিয়ার সাথে । জায়গাটা আমার বাংলো থেকে অনেক টা দক্ষিনে । এবং গতকাল আমি যেখানে গিয়েছিলাম সেটার দিকেই । তবে আমাকে সেই গুহার কাছে আজকে যেতে হল না । আমি গতকাল ঠিক যেখান থেকে পথ হারিয়েছিলাম ঠিক সেই স্থানেই এসে থামলাম। সেখানেই আমি সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখতে পেলাম । লাশটা পড়ে আছে মাটিতে । তবে সেটাকে আর মানুষের লাশ বলে মনে হচ্ছে না । ভয়ংকর আক্রোশে কোন বন্য প্রাণী যেন এই হামলা করেছে। আমি কাছে যেতে পারলাম না । তার আগেই বমি করে দিলাম । এর আগে আমি এতো ভয়ংকর কিছু দেখিনি কোন দিন ।
কে ভাবে গম্বুকে মারতে পারে ?
এই বনে এতো হিংস্র পশু ত নেই !
তখনই আমার মনে পড়ল নেকড়ের কথা !
নেকড়ে !
আমি যতদুর জানি যে এই বনে বাঘ নেই । তাহলে নেকড়ে ছাড়া আর কেউ এই কাজ করে নি।
যখন পুলিশ এল তখন একটা অবাক করা ব্যাপার চোখে পড়ল আমাদের সবার । সেটা হচ্ছে লাশের পাশে মাটিতে কোন পশুর পায়ের ছাপ নেই। সেখানে রয়েছে তাজা মানুষের পায়ের ছাপ ।
আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে পুলিশ এস আই বলল, এটা তো মানুষের কাজ মনে হচ্ছে । তবে কোন মানুষ কি এতো ভয়ংকর ভাবে কাউকে মারতে পারে? আর আরেকটা ব্যাপার এখানে স্পষ্ট !
-কী ?
-এই পায়ের ছাপ কোন পুরুষ মানুষের না। এটা মেয়েদের পায়ের ছাপ !
-কী বলছেন?
-হ্যা । আমি একশ ভাব নিশ্চিত যে এটা মেয়েদের পায়ের ছাপ ! ক্রাইম সিনে মাত্র দুই জোড়া পায়ের ছাপ রয়েছে । একটা যে গম্বুর সেটা সন্দেহ নেই । অন্যটা কার? কোন মেয়ের ? আর কোনো মেয়ের শরীরে এতো শক্তি এলো কোথা থেকে যে গম্বুর মত একজন মানুষকে এভাবে মেরে ফেলল !
বাংলোতে ফেরার পথে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই লাগলাম । আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না । সারাদিন কাজ কর্মে আর মন বসছিল না । রফিক মিয়া আর আমাদের অন্যান্য গার্ডদের ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা আমি খেয়াল করছিলাম । আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল ওরা সবাই কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত । ওরা এমন কিছু জানে যা আমি জানি না । আমাকে ওরা সেটা বলছেও না । আমি জানিও না ওরা আসলে কোন ব্যাপারটা জানে না । তবে ওদের মুখ দেখে আমি সেটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি যে ওরা গম্বুর লাশ দেখে বেশ ভয় পেয়েছে। তবে এই ভয়ের ভেতরে অন্য রকম কিছু রয়েছে সেটাও আমার বুঝতে কষ্ট হল না।
ব্যাপারটা আরও পরিস্কার হল যখন বিকেল হল । আমার বাংলো থেকে রফিকদের গ্রামটা খুব বেশি দূরে নয় । হেটে গেলে ১৫/২০ মিনিটের মত সময় লাগে ওদের । সন্ধ্যার বেশ পরেও রফিক মিয়া আমার বাসায় থাকে । রাতের খাবার খেয়েই তারপর বাসায় যায় । তবে আজকে দেখলাম বিকেল হতেই রফিক মিয়া তার গ্রামে চলে যাওয়ার অনুরোধ জানাল । আমি রফিকের মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম যে ও কোন একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ ভয় পেয়েছে । কী এমন ব্যাপার হল যেটা নিয়ে রফিক মিয়া ভয় পাচ্ছে ?
আমি এতো বেশি চিন্তা করলাম না। রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম । আমার ঘুম ভাঙ্গল বেশ রাত করে। প্রথমে কিছু সময় আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে কেন আমার ঘুম ভাঙ্গল । ঘর অন্ধকার করে আমার ঘুমানোর অভ্যাস । তবে আমি ঘরের ভেতরে একটা আলোর আভা দেখতে পাচ্ছি। সেটা আসছে জানালা দিয়ে যেন বাইরে খুব আলো এসে হাজির হয়েছে। আমি মোবাইলে সময় দেখলাম । রাত পনে তিনটা । সকাল হতে এখনও অনেক বাকি !
আমি ঠিক এমন সময়ে সেই গন্ধটা পেলাম । গতদিন আমি সাদা নেকড়ের কাছে যাওয়ার সময়ে যে গন্ধটা আমার নাকে এসে লেগেছিল !
আমাকে কেউ বলে দিল না কিন্তু আমি নিশ্চিত বুঝতে পারলাম যে আমার বাড়ির সামনে সেই নেকড়েটা এসে হাজির হয়েছে !
আমার এখন কী করা উচিৎ?
এখানে শুয়ে থাকব?
আমার ঘরটা কাঠের তৈরি হলেও বেশ মজবুত ! একমাত্র হাতি এসে হামলা না করলে অন্য কোন প্রাণী এর ভেতরে ঢুকতে পারবে না । নেকড়ের পক্ষে কোন ভাবেই এর ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব না । তার আনে হচ্ছে আই যদি এখানে চুপচাপ শুয়ে থাকি তাহলে নিরাপদে রাত পার হয়ে যাবে । কোন সমসয়া হবার কথা না । কিন্তু আমার নিজের কাছেই মনে হল যে আমার এখন বাইরে যেতেই হবে । না বাইরে গেলে চলবে না কোন ভাবেই । আমার মনের ভেতরে কেন এমন মনে হল সেটার কোন ব্যাখ্যা আমার নিজের কাছে নেই । আমার কেবল মনে হল যে এখন আমাকে যেতেই হবে!
আমি দরজা খুলে বাংলোর বারান্দায় বের হয়ে এলাম । আমার ধারণা যে ভুল নয় সেটা টের পেলাম প্রায় সাথে সাথেই । দেখলাম একটা বড় গাছের আড়াল থেকে সেই সাদা নেকড়টা বের হয়ে এল । এই অন্ধকারেও তার শরীরটা যেন আলোর আভা ছড়াচ্ছে । আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম সেটার দিকে । আমি বারান্দা থেকে নেমে যেতেই দেখলাম সেটা আমার আকছে এগিয়ে এল । তারপর আমার চারপাশে একটা চক্কঅর দিয়ে আমার শরীরে নিজের শরীর ঘষল । ঠিক যেমন কোন পোষা প্রাণী তার মালিকার শরীরের সাথে শরীর ঘষে সেই রকম ।
আমি নিজেও আদর করলাম তাকে । যেন আমার আদর পেয়ে সেটা আরও বেশি সাড়া দিল । আমি নেকড়ের গলার সেই স্টিলের কলারটা হাত দিয়ে নাড়লাম । দেখতে পেলাম সেটার সেই অদ্ভুর লেখা গুলো এখনও জ্বলছে । এ অন্ধকারে সেগুলো বেশ ভাল করেই দেখা যাচ্ছে । আমি কৌতুহলী হয়ে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেগুলো ছবি তুলে নিলাম । দেখলাম নেকড়েটা সেটাতে বাধা দিল না । আমি এমন কি নেকড়ের সাথে কয়েকটা সেলফি তুলতেও ভুললাম না ।

একটা সময়ে নেকড়েটা চলে যায়। ঠিক যেভাবে এটা এসেছিল সেভাবে । আমারও যেন ঘোর খানিকটা কেটে গেল । আমি নিজেও নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম ।
এভাবে পরপর বেশ কয়েকদিন ঘটতে লাগল । প্রতিদিন রাতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত, আমি ঘরের ভেতর থেকেই টের পেতাম যে নেকড়েটা এসেছে । আমি সেটার কাছে চলে যেমন । প্রথম প্রথম আমরা আমার বাংলোর আশে পাশেই কেবল থাকতাম । তবে দিন দিন আমাদের ঘুরে বেড়ানো বাড়তে লাগল । আমরা কেবল আমার বাংলোর আসেপাশেই বসে সীমাবদ্ধ রইলাম না। আমরা বনের ভেতরে এদিক ওদিক হাটতে যেতাম । তবে মাঝে মাঝে নেকড়েটা আসত না। আর যেদিন সে আসত না সেদিন আশে পাশের কেউ না কেউ ভয়ংকর ভাবে মারা পড়ত । ভয়ংকর ভাবে কেউ যেন তাদের মেরে ফেলেছে। আমি যেন ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে রইলাম ।
আমি কেবল প্রতিদিন সাদা নেকড়েটার আসার অপেক্ষা করে থাকতাম । সে এলেই তাকে ঘুরে বেড়াতাম । তাকে আদর করতাম । তার গায়ের গন্ধ আমাকে পাগল করে দিত । আমার কেবল মনে হত ও যদি আমার কাছে না আসে তাহলে আমি বাঁচব না ।

ওয়্যার উলফ বা মায়া নেকড়ের কমন থিমের উপরে এই গল্পটা লেখা ।

পরের পর্ব

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 35

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →