শোভা খানিকটা অবাক চোখে ডেস্কের দিকে রয়েছে । এই মানুষটাকে সে এখানে কোন ভাবেই আশা করে নি । এখানে সে কী করছে? শোভা আরেকবার ভাল করে তাকিয়ে দেখল । রাফানের সাথে ওর আগে কখন কথা না হলেও আগের অফিসে সে তাকে ঠিকই চিনত ।
বসের ছেলেকে কে বা চিনবে না। কোম্পানীর সবাই তাকে চেনে খুব ভাল ভাবেই। শোভাও খুব ভাল করেই চিনত তাকে । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ছেলে এই ব্যাংকে কী করছে?
শোভা ভাবতেই পারছে না রাফান এই ব্যাংকে চাকরি করছে? কেন চাকরি করছে সে?
কোন কারণ আছে কী?
এতো বড় কোম্পানীর মালিকের ছেলে এই ব্যাংকে চাকরি করছে করছে কেন?
শোভা আসলেই বুঝতে পারছে না। নাকি শোভা ভুল দেখল ! হয়তো রাফানের মত দেখতে কেউ হবে। রাফান হতে পারে না ।
শোভা নিজের চিন্তা পরিস্কার করল । জোর করে আগের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল । বিশেষ করে যে কোম্পানী তাকে কোন প্রকার কোন কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে বের করে দিয়েছিল ।
সেদিনের কথা শোভার খুব ভাল করেই মনে আছে। অফিসে গিয়েছিল অন্য দিনের মতই । অফিসে গিয়ে ম্যানেজারের রুমে ডাক পড়ল । তারপর ওকে অবাক করে দিয়ে তাকে টার্মিনেশন লেটার ধরিয়ে দেওয়া হল । কোন কারণ দেখান হল না ।
শোভার যদিও কষ্ট লেগেছিল তবে খুব বেশি চিন্তা করে নি সে। কারণ আরেকটা চাকরি পেতে শোভার খুব বেশি সময় লাগে নি । তারপর শোভা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সেই কোম্পানির কথা । প্রায় বছর খানেক পার হয়ে গেছে । তারপরই আজকে রাফানকে দেখতে পেল ।
এই চিন্তাটা শোভার মনে শান্তি দিল না মোটেই। পরের দিন আরেকবার সময় বের করে চেক করতে গেল সে। এবং বেশ ভাল ভাবেই খেয়াল করে দেখল । এই মানুষটা যে রাফান সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই তার। রাফানের এখানে চাকরি করার ব্যাপারটা শোভা কিছুতেই বুঝতে পারল না । গতকাল রাতে সে আগের কোম্পানীর এক কলিগের কাছে ফোন করেছিল । সেখান থেকে সে জেনেছে যে শোভার চাকরি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর থেকে বসের ছেলে রাফান নাকি আর অফিসে আসে নি । তার জায়গাতে নতুন কর্মী এসে কাজ করছে !
অনেকেই বলছে যে বাবার সাথে নাকি ছেলের কোন এক ঝামেলা হয়েছে । সব কিছু ছেড়ে দিয়ে রাফান চলে গেছে !
শোভার ব্যাপারটা একটু হয়তো বুঝতে পারল । রাফান তার বাবার সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে গেছে । জেদ আছে তাহলে !
বড় লোকের ছেলেদের এই রকম জেদ থাকতে পারে বিশেষ করে যার ফলে এতো আরাম আয়েশের জীবন ত্যাগ করে চলে আসতে পারে সেটা শোভার চিন্তার বাইরে ছিল !
শোভা আবার ভাবল হয়তো কেবল অফিস থেকে বের হয়ে এসেছে । অনেকের ভেতরেই এই রকম মনভাব থাকে যে বাবার গড়ে দেওয়া সম্পদ ভোগ করবে না । নিজের পায়ে দাঁড়াবে । রাফানও হয়তো সেই রকম কেউ !
কিন্তু মাস খানেক পরে শোভার পুরো জীবন একেবারে আপসাইট ডাউন হয়ে গেল। সেদিন অফিস শেষ করে সে বাসার দিকে যাচ্ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু সময় রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিল । অফিস ছুটির পরে এইখানে রিক্সা পাওয়াটা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার । শোভা কিছু সময় সেই অপেক্ষা করে হাল ছেড়ে দিল । মনে মনে ঠিক করল যে সামনে কিছু দূর হেটে যাবে । একটু হাটলেই মেট্রো স্টেশন পাবে। আজকে সে মেট্রোতে করে একটু ঘুরবে ! মনে মনে এই সিদ্ধান নিল সে ।
কয়েক কদম হাটতে যাবে তখনই দেখতে পেল ওর দিকে এক কোটটাই পরা লোক তাকিয়ে রয়েছে । লোকটাকে কেমন যে একটু পরিচিত মনে হল । লোকটা যখন আরও একটু এগিয়ে এল তখন শোভা তাকে চিনতে পারল । যদিও কোন দিন এই মানুষটার সাথে তার সরাসরি কথা হয় নি তবে তাকে না চেনার কোন কারণ নেই । কিন্তু শোভা এটা ঠিক বুঝতে পারল না যে এই মানুষটা ওর সামনে কেন এসে হাজির হয়েছে !
-কিছু সময় কথা বলা যাবে?
শোভা কোন কথা না বলে কেবল মাথা ঝাকাল । পাশের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল মুখোমুখি ! কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না। এক সময় আফসার আহমেদ বললেন, কাজ কর্ম কেমন চলছে?
-জ্বি ভাল স্যার !
শোভা আসলেই বুঝতে পারছে না যে তার অফিসের আগের বস তার মত একজন সাধারণ কর্মীর সাথে কেন দেখা করতে এল । যাকে সে এক বছর আগেই চাকরি থেকে বের করে দিয়েছিল । কোন কারণ শোভার মাথায় ঢুকছিল না ।
-তোমার কি কখনো মনে হয়েছিল যে কেন তোমাকে ফায়ার করা হয়েছিল?
-না স্যার । আমি জানি না । কারণটা আমার মাথায় ঢোকে নি । মানে চাকরি যাওয়ার মত বড় কোন ভুল আমি করেছিলাম কিনা সেটাও আমার জানা ছিল না।
আফসার আহমেদ হাসলেন একটু । তারপর বললেন, না তোমার কোন ভুল ছিল না ।
-মানে আমাকে এমনি এমনি চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ।
-হ্যা । অন্তত তোমার কোন ভুলে নয় । তাই তো আমি এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছি যাতে তুমি দ্রুত অন্য কোথায় চাকরি পেয়ে যাও ! তোমার এই কোম্পানীতে চাকরিটা আমার সুপারিসেই হয়েছিল ।
শোভা একটু বিস্ময় প্রকাশ করল । তবে ব্যাপারটা তার কাছে এখন আরও ভাল করে পরিস্কারও হয়ে উঠল । সত্যিই আগের চাকরি চলে যাওয়ার মাত্র ৯ দিনের মাথায় এই নতুন চাকরি পাওয়াটা তার কাছে স্বপ্নই মনে হচ্ছিল ।
আফসার আহমেদ স্মিথ হেসে বললেন, তোমার বর্তমান বস আমার এক সময়কার বন্ধু ছিল । আমার অনুরোধ সে ফেলতে পারে নি। যাই হোক আমি চেয়েছি যাতে তোমার কোন ক্ষতি না হোক !
-আমি আসলে বুঝতে পারছি না কিছুই । আপনি আমার ক্ষতি চাননি আবার নিজের কোম্পানীতে রাখতেও চাননি । কেন?
-কারণ ……
আফসার আহমেদ কিছু সময় চুপ করে রইলেন । তারপর বললেন, কারণ রাফানকে আমি আমার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম । চৌধুরী গ্রুপের নাম তো শুনেছ ? অনেক দিন থেকেই সেই সেটার সাথে আমাদের একটা বড় মার্জিংয়ের পরিকল্পনা চলছিল । আমরা চেয়েছিলাম ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে আমরা সেটা আরও পাকাপোক্ত করব । তবে রাফান বেঁকে বসে । সে কিছুইতে সেই মেয়েকে বিয়ে করবে না ।
-তা তো বুঝলাম । কিন্তু এর সাথে আমি কিভাবে জড়িত ?
আফসার আহমেদ কিছু সময় শোভার দিকে তাকালেন । চোখের দৃষ্টি এমন করলেন যে শোভা প্রথমে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল এবং সেই সাথে সাথে ওর মনে একটা সম্ভবনা দেখা দিল । পরক্ষণেই সেটা বাতিলও করে দিল । তবে আবারও সেটা মনের ভেতরে এসে উকি দিল !
শোভা বলল, আর ইউ কিডিং, রাইট?
-নো আই এম নট ! রাফান কতটা সিরিয়াস তুমি হয়তো জানো না ! আমি যখন তাকে বললাম আমার কথা মত না চললে সে আমার আমার সম্পদের কিছুই সে পাবে না । এই কথা বলার পরে সে আমার অফিস থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । নিজে চাকরি জোগার করেছে । গাড়ি ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছে । লোকাল বাস আর মেট্রোতে করে যাওয়া আসা করে সে । এই যে এক বছর সে বাসায় এসেছে ঠিকই তবে আমার কাছ থেকে একটা টাকাও সে নেয় নি !
আফসার আহমেদ একটু থেমে আবারও বললেন, তোমার মনে আছে মাস চারেক আগে তোমার প্রায় বিয়ে হয়েই যাচ্ছিল ?
শোভা এবার সত্যিই অবাক হল ! বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো আফসার আহেমের দিকে । সত্যিই মাস চারেক আগে শোভার প্রায় বিয়ে হয়েই যাচ্ছিল । পাত্র পক্ষ বেশ ভাল ছিল। সরকারি বিসিএস ক্যাডার ছিল । শোভার প্রতি তাদের আগ্রহও ছিল বেশ । তবে শোভার কেন জানি মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা খুব জলদিই ঘটছে। আর পাত্রপক্ষ যেন একটু বেশিই আগ্রহ দেখাচ্ছে । তারপরেও সব দিক দিয়ে সেই ছেলে মানান সই ছিল । শোভার বাবা মায়েরও কোন আপত্তি ছিল না । শোভারও যে আপত্তি ছিল সেটাও না । তবে মনের ভেতরে একটা খুঁতখুতানি রয়েই গেল । বার তিনেক ছেলের সাথে সে দেখাও করল । যতই দেখা করল তত মনের ভেতরে সেই খুঁতখুতানিটা বাড়লই । কমল না । তারপর বিয়ের যেদিন তারিখ পড়ার কথা সেদিন সকালে শোভা পরিস্কার জানিয়ে দিল এই ছেলেকে সে কোন ভাবেই বিয়ে করবে না । ওর বাবা মা অবশ্য একটু রাগ করেছিল তবে শোভা সেটা কানে তুলল না । সেখানে মানসিক শান্তি নেই সেখানে কোন ভাবেই বিয়ে করা যাবে না !
শোভা বলল, আপনি কি ঐ বিয়েটা ………?
আফসার আহমেদ হাসলেন একটু । তারপর বললেন, না আমি মিরাজকে ফোর্স করি নি। আমার গ্রামের ছেলে সে । বিয়ের জন্য পাত্রী খোজ করছিল সে । আমার মনে হল তোমার যদি বিয়ে হয়ে যায় তাহলে হয়ত রাফানের মাথা থেকে ভুত নামবে! তাই তোমার কথা তাদের কাছে বলেছিলাম । ও নিজেও এই ব্যাপারে কোন কিছু জানে না । তুমি আগে আমার কোম্পানীতে চাকরি করতে, এই সুবাদে তোমার খোজ দিয়েছিলাম ! আর জানিয়েছিলাম যে তুমি ভাল মেয়ে ! কিন্তু যখন এতো ভাল পাত্র তুমি মানা করে দিলে তখন কেন জানি মনে হল যে তোমার ভাগ্য হয়তো রাফানের সাথেই লেখা !
শোভা কী বলবে খুজে পেল না । আফসার আহমেদ বললেন, দেখ আমি বলছিই না যে তুমি রাফানকেই বিয়ে কর । তবে বাবা হিসাবে ছেলের জেদের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। তাকে বাধ্য করাতে পারি নি । বরং সে আমাকে বাধ্য করেছে বুঝতে যে টাকা পয়সার থেকে তার কাছে তুমি বেশি জরুরী । তাই বাবা হিসাবে আমার এই দায়িত্ব এসে পড়ে যে ছেলের পক্ষ হয়ে ওকালতি করা। আমি তোমাকে বাধ্য করব না । কেবল অনুরোধ করতে পারি ।
এরপর আফসার আহমেদ নিজের কোটের পকেট থেকে একটা খাম বের করে শোভার সামনে রাখলেন । বললেন, এটা তোমার এপোয়েন্টমেন্ট লেটার । আগের থেকেও ভাল স্যালারি আর পজিশন । আমার ছেলেকে গ্রহন কর বা না কর, আবার জয়েন কর প্লিজ । তুমি ফিরে এলে রাফানও ফিরে আসবে । তোমার চাকরি যখন আমি নট করেছিলাম তখন সেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলেছিল যে আমি যদি নিজে এসে তোমাকে না নিয়ে আসি তাহলে সে কোন দিন ফিরে আসবে না । এই টুকু অন্তত রাখো প্লিজ।
দুই
শোভা আগে একটা কমন ডেস্কে বসলেও এখন আলাদা একটা ছোট কেবিন দেওয়া হয়েছে ওকে । ওর এভাবে ফিরে আসাটায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছে একটু । শোভার ফিরে আসার পনের দিনের মাথায় রাফানও আগের অবস্থায় অফিসে এসে জয়েন করল । সব কিছু আবার আগের মতই চলতে লাগল তবে শোভা অন্তত জানে যে সব কিছু আর আগের মত নেই কোন ভাবেই । এখন প্রতিদিন যখন রাফান অফিসে ঢোকে শোভার তখন বুকের স্পন্দন বেড়ে যায় । পুরো দিন এক অদ্ভুত আন্দোলন চলে বুকের ভেতরে । নিজের কাছেই সব কিছু কেমন যে অবিশ্বাস লাগে । এই ছেলে ওকে এভাবে কেন পছন্দ করে ! এমন ভাবে কি কাউকে পছন্দ করা যায়?
রাফানের বাবা যদি নিজ থেকে তাকে এই সব কথা না বলত তাহলে হয়তো শোভা নিজেও কোন দিন এসব বিশ্বাস করত না। শোভা এখন অপেক্ষা করছে কবে রাফান নিজ থেকে ওর সাথে কথা বলতে আসবে। তবে আরও মাস খানেক কেটে যাওয়ার পরেও যখন রাফান নিজ থেকে এল না তখন শোভার নিজের মেজাজ খুব খারাপ হল !
কেন রে বাপু? নিজ থেকে কবে আসবে ? নাকি আসবাই না?
এতো কিছু করতে পার আর এই কাজটা করতে পারবে না?
শোভা অপেক্ষা করতে করতে যখন বিরক্ত হয়ে গেল তখন সুযোগটা এল । এল বলতে আফসার আহমেদ সুযোগটা ব্যবস্থা করলেন। সৈয়দপুরে তাদের নতুন একটা রিসোর্ট তৈরি হবে । সেটার জন্য রাফানের সেখানে যেতে হবে । তার সাথে অফিসের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার যাবে এই প্রথমিক ভাবে ঠিক হল । প্লেনে করেই যাওয়া হবে। টিকিট কাঁটা থাকবে । তবে মূলত একেবারে শেষ মুহুর্তে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বাসা একটা ইমার্জেন্সী দেখা দিবে ! এবং তার বদলে শোভা যাবে । আফসার আহমেদ শোভাকে তৈরি থাকতে বললেন।
পরিশিষ্ট
রাফানের বুকের ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে লাফাচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না । পাশে বসা মেয়েটার জন্য এই অনুভূতি । অথচ শোভা কতই না শান্ত ভাবে বসে রয়েছে ওর পাশে । রাফান খুব ভাল করেই জানে শোভা ওর ব্যাপারে সব জানে । ওর বাবার সাথে শোভার যে কথা হয়েছে সেটাও রাফান জানে । অথচ মেয়েটা এমন একটা ভাব করে আছে যেন কিছুই জানে না । অবশ্য এটাও রাফানকে একটা চমৎকার অনুভূতি দিচ্ছে । রাফান খুব ভাল করেই জানে যে শোভাকে নিজের করে নেবেই । নিজের উপর এই বিশ্বাস তার আছে । অবশ্য চাকরি থেকে দুরে চলে যাওয়ার পরে একটু ভয় পেয়েছিল বটে তবে এখন সেটা আবারও ফিরে এসেছে। এখন এই ভালবাসার লুকোচুরি খেলতে তার ভালই লাগছে। দেখা যাক এটা কতদিন চলে !