মীরা ভিজিটিং কার্ডটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। মানুষটা যে এখানে চলে আসবে মীরা সে ভাবতে পারে নি। মীরা তো ভেবেছিল তাকে কোন দিন এই মহিলার মুখোমুখি হতে হবে না । আর রিয়ানকে তার সিদ্ধান্ত জানানোর পরে তিনি তো খুশি হবেন । ভাব্বেন যে ঝামেলা দূর হয়েছে ভাল হয়েছে। কিন্তু আজকে একেবারে মীরার অফিসে এসে হাজির হলেন। মীরার সাথে দেখা করতে চান। মীরার একটু অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। রিয়ানের মায়ের সাথে আসলে সে কী কথা বলবে? তার কিসের কথা বলার আর বাকি আছ এখন?
তুবও যখন চলে এসেছে তখন কোন ভাবেই দেখা না করে পারা যাবে না। মীরা পিয়নকে চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে রিয়ানের মাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলল। তবে কী মনে করে শেষ পর্যন্ত সে নিজেই পিয়নের সাথে ওয়েটিং রুমে গিয়ে হাজির হল।
-আসসালামু আলাইকুম আন্টি ।
রিয়ানের মা রেবেকা সুলতানা পেশায় একজন সচিব। এছাড়া রিয়ানের বাবা বড় ব্যবসায়ী । এসব কিছু যদি মীরা আগে জানত তাহলে সে রিয়ানের সাথে হয়তো কখনো সম্পর্কেই জড়াত না। যখন রিয়ানের সাথে ওর প্রেম শুরু হয় তখন রিয়ান ভব ঘুরের মত ঘুরে বেড়াত । সেই কারণেই প্রেমটা শুরু হয়েছিল ওদের ভেতরে । এমন কি রিয়ান নিজেও কোন দিন নিজের পরিবার নিয়ে কিছুই বলে নি। রিয়ানের আচরণে মীরার সব সময় মনে হয়েছে যে রিয়ানের হয়তো মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্মবিত্তের থেকে এসেছে। তাই মনে মনের ভেতরে একটা সাহস সঞ্চয় করেছিল । কিন্তু যখনই জানতে পারল রিয়ানের আসল পরিচয়, তখনই ওর কাছ থেকে দুরে চলে এল একেবারে । বেশ কয়েকবার রিয়ান এসেছে ওর কাছে, কারণ জানতে চেয়েছে তবে মীরা সে প্রশ্নের উত্তর দেয় নি। এক সময়ে রিয়ান আসা বন্ধ কয়ে দেয়। কিন্তু দেখা করতে আসা বন্ধ করে দিলেই কি সব কি আগের মত হয়ে যায়?
মীরার জীবন আগের মত কি হয়েছে? রিয়ানের জীবনও কি আগের মত আর হবে? তবে মীরা জানে যে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। থাকবে না ।
রেবেকা সুলতানা মীরার দিকে ভাল করে তাকালেন। তারপর সালামের জবাব দিয়ে বললেন, লাঞ্চের সময় তো হয়ে গেল। চল এক সাথে লাঞ্চ করা যাক।
রেবেকা সুলতানার কন্ঠে কোন অনুরোধের ভাব নেই। সে মীরাকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা শোনাল । মীরা কী বলবে ঠিক বুঝল না। তার এখানে কিছু বলারই নেই। যদিও মানা করা যায় তবে সেটা বেয়াদবি হবে । মীরা এই বেয়াদবিটা করতে চাইলো না।
রেবেকা সুলতানা বললেন, তোমার অফিসের ক্যান্টিনে নাকি ভাল ভুনা খিচুড়ি পাওয়া যায়। রিয়ান বলছিল।
মীরা বুঝতে পারল রিয়ান অনেক কিছুই তার মায়ের সাথে শেয়ার করে। মীরা কেবল মাথা ঝাকাল ।
-আমি তোমার বেশি সম্ময় নিব না। লাঞ্চ শেষ করতে করতে আমার কথা শেষ হয়ে যাবে। আশা করি এই সময়টুকু আমাকে দেবে
-জ্বী আন্টি কোন সমস্যা নেই। চলুন ।
ক্যান্টিনটা শুধু মীরাদের একার অফিস স্টাফদের জন্য না । পুরো বিল্ডিংয়ের আরও যতগুলো অফিস আছে সবার জন্য। তাই সব সময় বেশ ভীড় থাকে । বিশেষ করে লাঞ্চ আওয়ারে বেশ ভীড় হয় এখানে । তবে এখনও সেটা শুরু না হওয়ার কারণে ভীড় একটু কম। কোণার দিকের একটা টেবিল নিয়ে বসল। মীরা নিজেই গিয়ে ভুনা খিচুড়ীর অর্ডার দিয়ে আসল । রেবেকা সুলতানা চুপ করে কিছু সময় বসে রইলেন।
খিচুড়ি আসতেই খাওয়া শুরু করলেন । মুখে দিতেই বললেন, রিয়ান ঠিকই বলেছিল। চমৎকার স্বাদ ।
মীরা বলল, জ্বী। এখানকার খিচুড়িটা বেশ ভাল।
মীরা আর কী বলবে বুঝতে পারল না । আসলে পুরো ব্যাপারটা মীরার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। মীরা মনে করেছিল যে রিয়ানের জীবন থেকে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা তার মা ভাল ভাবেই নিবেন। বিশেষ করে তিনি খুশিই হবেন। সত্যি বলতে মীরা আর রিয়ানের পরিবারের যদি তুলনা করা হয় তাহলে আকাশ আর পাতাল পার্থক্য। মীরা যখন পুরোটা জানতে পারলো তখন এটা পরিস্কার হয়েছিল যে ওর পরিবারের সাথে মীরার পরিবারেরর কোন তুলনাই হয় না। রিয়ানের মা কোনো দিন রাজি হবে না। হওয়ার কথাও না। তাহলে আজকে এখানে সে কেন এসেছে? মীরা ঠিক বুঝতে পারছে না।
মীরার মনের কথা মনেই রয়ে গেল। রেবেকা সুলতানা বললেন, তুমি হয়তো অবাক হয়েছে যে আমি এখানে কেন এসেছি সেটা জেনে ?
মীরা বলল, একটু।
-আমি আসলে তোমার ব্যাপারে রাজি ছিলাম না। রিয়ান আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু আমি রাজি হয় নি। তারপর একদিন এসে জানাল যে তুমি নাকি ব্রেক আপ করেছ। রিয়ানের আসল পরিচয় জানার পরে নাকি এটা করেছ। এটা জেনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। তোমার যেখানে সব কিছু জানার পরে আমার ছেলের পেছনে আঠার মত লেগে থাকার কথা সেখানে কিনা দুরে সরে যাচ্ছো । ব্যাপারটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছে। আমি আসলে কারণটা জানতে এসেছি। আমি তোমাকে জোর করব না। যদি না বলতে চাও সেটাও ঠিক আছে।
মীরা কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। আসল কারণটা কি উনাকে বলে দিবে? যদি বলে দেয় তাহলে? কিছুই হবে না সেটা মীরা জানে । আজকালকার দিন আসলে কেউ কারো জন্য মরে না । কিছুদিন শোক করে তাহলে সবাই নতুন কাউকে খুজে নেয়। রিয়ানও নিশ্চয়ই এমন কিছু করবে।
মীরা বলল, আসলে আপনাদের পরিবারের সাথে আমার পরিবারর একেবারেই যায় না । বিয়ে হলে পদে পদে কেবল রিয়ানকে আমার জন্য অপমানিত হতে হত। জানেনই তো আমার বাবা নেই। মা সাধারণ একজন। স্কুলে চাকরি করেছেন। আমাকে মানুষ করেছেন । সেখানে আপনাদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক করার কোন অবস্থানই আমাদের নেই। জীবন তো সিনেমা নয় । এই বিয়ে গুলো কখনই সুখের হয় না। কী দরকার বলেন ঝামেলা বাঁধিয়ে !!
-এটাই কারণ?
-হ্যা এটাই কারণ ।
এই বলে মীরা জোরে একটা দম নিল । অন্য কিছু সে আর বলতে চায় না । নিজের ভেতরে যে সত্যটা আছে সেটা নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রাখতে চায় ।
-রিয়ানও এটাই মনে করে । তুমি কি জানো সে দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে । একেবারে । আমাদের সব কিছু ছেড়ে সে চলে যাবে । সেখানে সেলেটড হওয়ার চেষ্টা করবে । জানোই তো দেশের বাইরে গেলে এসব কিছু আর কোন ম্যাটার রকরে না । এমন যদি হয় তাহলে কি তুমি যাবে?
মীরা এবার একটু বিপাকে পড়ল । কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। যে কারণটা সে দেখিয়েছে সেটা এখন আর দেখানো যাবে না । মীরা কোন কথা না বলে চুপ করে রইলো। রেবেকা সুলতানা বললেন, আমি জানি তুমি অন্য কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করো নি। তাহলে রিয়ানের কী সমস্যা শুনি?
মীরা কোন কথা বলল না । চুপচাপ খেয়ে গেল কেবল । খাওয়া যখন শেষ হল তখন মীরাই বিল দিতে গেল। মীরা একটু অবাক হল এই দেখে যে রেবেকা সুলতানা মানা করলেন না । তারপর যখন যাওয়ার সময় এল তখন রেবেকা সুলতানা নিজের ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের মীরার দিকে এগিয়ে দিল । আইফোনের বক্স। একেবারে লেটেস্ট মডেল।
-এটা তোমার জন্য ।
-না না এটার রকোন দরকার নেই।
-শোন মেয়ে বড়রা কিছু দিলে সেটা নিতে হয়। এটা নাও। আমি তোমাকে আসলে ধন্যবাদ দিতে এসেছিলাম আজকে । রিয়ানের জীবন থেকে চলে যাওয়ার জন্য । তুমি ঠিকই বলেছো যে জীবন আসলে নাটক সিনেমার মত না। নায়কেরা সব কিছু মেনে নিতে পারে না । এক সময় সেগুলো গলায় বেধে থাকে।
একটা লম্বা সময় চুপ করে রেবেকা সুলতানা আবারও বললেন, রিয়ান আমাদের একমাত্র ছেলে । ওর বাবার খুব নাতি নাতনির শখ।
লাইনটা শুনতেই মীরার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠল। তার মানে রিয়ানের মা সব টা জানে । তার গোপন রহস্যটা সে জানে । হঠাৎ করেই মীরার বড় ছোট মনে হল । ইচ্ছে হল একেবাররে মাটির সাথে মিশে যেতে ।
রেবেকা সুলতানা এবার একটা কাছে এসে মীরার মাথায় হাত রাখলেন। মীরা নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করল প্রবল ভাবে। এভাবে এতো মানুষের সামনে কান্না করে দেওয়াটা মোটেই ভাল দেখাবে না।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, রিয়ানকে বললেন না। ও এটা জানলে ওকে বোঝানো মুস্কিল হবে। আর ওর জন্য একটা ভাল মেয়ে খুজে বের করবেন ।
রেকেকা সুলতানা এবার মীরা একটু জড়িয়ে ধরলাম । একটু যেন আদর করার মত করে। তারপর ওকে ওভাবে রেখে চলে গেলেন।
তারপরে কত দিন চলে মীরা বলতে পারবেনা । জীবন চলছিল আগের মতই। সব কিছুই ঠিক ছিল তবুও কিছুই যেন ঠিক ছিল না। সব কিছু আছে তার পরেও যেন মনে হয় কিছু একটা নেই। মীরা অনেক বার উপরওয়ালার কাছে জানতে চেয়েছে ! বারবার মনে হয়েছে যে কেন ওর সাথেই এমনটা হতে হবে ? কেন ওর ভাগ্যটাই খারাপ হতে হবে !
প্রায় ৫ বছর পরে মীরার সাথে রিয়ানের আবার দেখা হল । মীরা অফিসের একটা কাজে দিল্লীতে গিয়েছিল। সাথে আরও চারজন কলিগ ছিল । কাজ শেষে তাদেরই পীড়াপীড়িতে তাজমহল দেখতে গেল । সেখানেই রিয়ানকে দেখতে পেল । ছোট ফুটফুটে একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটছে। পাশে সুন্দর দেখতে একটা মেয়ে ।
এতো গুলো বছর পরে এই দৃশ্য দেখে মীরার মনে আবার সেই না পাওয়ার অনূভূতিটা তীব্র ভাবে জেগে উঠছ । জীবনে কিছু কষ্টের কোন শেষ হয় না।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
সরাসরি মেসেজ পাঠাতে চিঠি.মি এপ ব্যবহার করুন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.