নোভা কোর্টের বারান্দার এক কোনে বসে রয়েছে বেশ কিছুটা সময় । ওদের কেস কোর্টে ওঠার কথা বারোটার সময় । এখন সবে মাত্র সাড়ে দশটা বাজে । সকালে জ্যাম থাকে এই রাস্তায় । তাই তারা আগে আগেই বের হয়েছিল বাসা থেকে । একটু বেশি আগে চলে এসেছে । ওদের সময় আসতে এখনও বেশ খানিকটা সময় বাকি। এখন এই বারান্দায় হাটাহাটি করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই।
নোভা তার বাবা মা আর বোনের দিকে তাকাল । তারা এক কোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ।
কী বিষয় নিয়ে কথা বলছে সেটা নোভা জানে । সেই ব্যাপার নিয়ে নোভার কথা বলতে ভাল লাগছে না। সে তার বাবা মা আর বোনের ব্যাপারটা এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না । তার একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । আর তারা এখন এই নিয়ে চিন্তা করছে যে ডিভোর্সের পরে তারা আর কী করবে? কিভাবে তার প্রাক্তন স্বামী উপরে প্রতিশোধ নেওয়া যায় আর কী কী বাগিয়ে নেওয়া যায় !
প্রাক্তন স্বামী!
নোভা কথাটা আরেকবার ভাবল !
রাশেদ এখনও ওর স্বামীই আছে ! এখনও প্রাক্তন হয় নি । আজকের সই করার পরেই সে প্রাক্তন হয়ে যাবে !
কিভাবে স্বামী থেকে প্রাক্তন স্বামী হয়ে যাবে !
কথা ভাবতেই নোভার কেমন যেন লাগছে ! মনের ভেতরের একটা অংশ বারবার বলছে যেন এই কাজটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না ! একটু চেষ্টা করলে ওদের সম্পর্কটা ঠিক হলেও হতে পারত ! একটু চেষ্টা করলে কী হত না?
রাশেদের কথা মনে আসতেই রাশেদকে দেখতে পেল সে । বারান্দা দিয়ে ওর দিকে হেটে আসছে। একেবারে ওর সামনে এসে থামল। নোভা দেখতে পেল ওর বাবাও রাশেদকে দেখতে পেয়েছে। সে একেবারে নোভার সামনে এসে দাড়াল ।
নোভার সাথে রাশেদকে কথা বলতে দেওয়ার কোন ইচ্ছে তার নেই । রাশেদকে থামতে হল । সে নোভার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি নোভার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
নোভার বাবা বেশ শক্ত ভাবেই বলল, ওর সাথে কীসের কথা?
রাশেদ এবার নোভার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, নোভা ! প্লিজ । অল্প কয়েকটা !
রাশেদ সব সময়ই নরম স্বরে কথা বলে । বেশি উত্তেজিত হতে দেখে নি কখন । আজকেও শান্ত কন্ঠেই সে নোভার দিকে তাকিয়ে আছে। নোভা ওর বাবার কাধে হাত দিল । তারপর বলল, বাবা, ঠিক আছে।
নোভা রাশেদেরর সাথে কোর্ট চট্টরে হাটতে লাগল । রাশেদ সামনে সামনে হাটছে। নোভা পেছন পেছন হাটছে। এক সময় নোভা ওদের নীল রংয়ের গাড়িটা দেখতে পেল। বিয়ের মাস খানেক পরেই রাশেদ গাড়িটা কিনেছিল । নোভাকে নিয়ে গিয়েছিল শোরুমে । নোভার পছন্দেই এই রঙয়ের গাড়িটা কেনা হয়েছিল। এই গাড়িতে করে ওরা কত দিন রাতে ঘুরতে গেছে।
রাদেশ বলল, গাড়ির ভেতরে বসি একটু !
নোভা কোন আপত্তি করল না। দুজন গিয়ে ঢুকল গাড়ির ভেতরে । নোভার মনটা আবার কেন জানি সিক্ত হয়ে উঠল । ওদের ভেতরে ঝামেলা শুরুর পর থেকে এই গাড়িতে সে এতোদিন আর ওঠে নি । আজকে আবার অনেক দিন পরে উঠল।
গাড়িতে ওঠার পরে রাশে একটা প্যাকেট তুলে দিল ওর দিকে ।
-কী এটা ?
-এটা কাবিনের টাকা !
-এটা দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকলে?
রাশেদ বলল, উহু ! এটা তো দিতেই হবে । তাই দিলাম । ডেকেছি অন্য কারণে?
নোভা প্যাকেটটা নিল । তারপর সেটা গাড়ির সামনের রেখে দিল । তারপর আবারও তাকাল রাদেশের দিকে। রাশেদ ওর দিকে কেমন গভীর চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তারপর বলল, আর হয়তো আমাদের এভাবে বসা হবে না । আজকের পরেই সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে!
নোভা খেয়াল করল রাশেদের কন্ঠে একটা বিষাদের ছায়া । রাশেদ তাহলে কষ্ট পাচ্ছে?
কিন্তু এই ডিভোর্সের প্রথম কথা তো রাশেদই বলেছিল। নোভা তো বলে নি !
তারপর নোভাকে অবাক করে দিয়েই রাশেদ নোভার হাত ধরল । উষ্ণ স্পর্শ নোভার হাত থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরল মুহুর্তেই । নোভা নিজেই অবাক হয়ে গেল ! রাশেদের উপর তার নিজের অনুভূতি এখনও এতো তীব্র সে ভাবতে পারে নি ।
কত সময় ওরা ওভাবেই বসে রইল হাত ধরে । এক সময়ে নোভা খানিকটা অভিমানের স্বরে বলল, এখন এতো প্রেম দেখাচ্ছো কেন ? আলাদা হতে চেয়েছিলে তো তুমি নিজেই !
রাশেদ কিছু সময় নোভার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি শান্তির জন্য বলেছিলাম । তুমি জানো আমি সব সময় শান্তি চাই।
-আচ্ছা তাহলে আমি তোমার অশান্তির কারণ? তাহলে তো ভালই । আমি তাহলে যাই !
এই বলে সে বের হতে চাইল তবে রাশেদ ওকে ছেড়ে দিল না । হাতটা একটু শক্ত করে ধরে রইল । রাশেদ বলল, যেও না প্লিজ ! আজকে অন্তত না । প্লিজ !
নোভা থামল । রাশেদ বলল, তোমার প্রতি আমার অভিযোগ ছিল যে তুমি তোমার বাবা মা আর বোনের কথা মত সংসারে অশান্তি করতে ! দেখ নোভা সব সংসারে অশান্তি হয় । সেটা নিজেদের ভেতরেই সমাধান করতে হয় । আমি সেটাই চেষ্টা করেছি সব সময় । কিন্তু তুমি তোমার বাবা মা আর বোনকে নিয়ে আসতে । সত্যি বলতে আমি তাদের কোন দিন পছন্দ করি নি । বিশেষ করে তোমার বড় বোনকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না । আজকে ওরা না থাকলে আমাদের এই পর্যন্ত আসতে হত না !
নোভা এই কথার প্রতিবাদ করতে গিয়েও করতে পারল না । কারণ রাশেদের এই অভিযোগ আসলেই মিথ্যা না । আজকে তার বাবা মা এবং বিশেষ করে বড়বোন শোভা যদি না আসতো ওদের সম্পর্কের ভেতরে তাহলে আজকে হয়তো এই পর্যন্ত ঘটনা আসত না ।
নোভার মনে আছে এই ঘটনার শুরুটা কবে ! সেদিন শোভার বিবাহ বার্ষিকী ছিল । নোভাদের দাওয়াত দিয়েছিল । নোভা বিয়ের পরে রাশের অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছিল । এর ভেতরে একটা হচ্ছে রাশের সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে একদম পছন্দ করে না। মানুষের ভীড় ও একদম পছন্দ করে না। শোভার ঐ দাওয়াতে রাশেদ যায় নি। নোভা একাই গিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে না যাওয়ার কারণে অশান্তির শুরু । ঐদিন শোভা নানান কথা শুনিয়েছিল নোভাকে । এবং এটা দিনকে দিন বাড়তেই থাকল । নোভা একটা ব্যাপার এখন খুব ভাল করে বুঝতে পারে যে তার বড়বোন এই আগুন নেভানোর বদলে সেটাতে ঘি ঢেলে চলেছিল ।
নোভার দৃষ্টি তখন হঠাৎ রাশেদের দিকে গেল । সে খানিকটা অবাক হয়ে দেখল রাশেদের চোখটা সিক্ত । নোভার মনের ভেতরে একটা তীব্র অনুভূতি হল। ছেলেটা ওকে হারিয়ে কাঁদছে !
সত্যিই কাঁদছে !
নোভার সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে এল । কাজটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না । যে কাজটা এখনও ঠিক হচ্ছে না ।
রাশেদের কাছ থেকে আলাদা হওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এখন তো অনেক দেরি হয়ে গেছে !
আসলে কি দেরি হয়ে গেছে?
নোভা বলল, চল তো একটু বিউটির লাচ্চি খাব!
রাশেদ বলল, কী !
-বললাম বিউটির লাচ্চি খাব । কাছেই তো না?
-হ্যা কাছেই । আমরা একবার একবার এসেছিলাম।
-চল । আবার সুযোগ আসবে না !
রাশেদের চোখের দিকে তাকিয়ে নোভার মনে হল সে যেনে একটু যেন অবাক হয়েছে । যে মেয়ের একটু পরে স্বামীর সাথে ডিভোর্স হবে সেই মেয়ে এখন লাচ্চি খেতে চাচ্ছে তাও আবার সেই স্বামীর সাথেই!
তবে রাশেদ মানা করল না। গাড়িটা সেদিকেই নিয়ে গেল !
বেশি সময় লাগল না । এর মাঝে নোভার ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন এল তার বাবা আর মায়ের কাছ থেকে । নোভা একবারও ধরল না। রাশেদ এই ব্যাপারটা দেখল যে ফোন আসছে কিন্তু নোভা ধরছে না ।
-ফোন কেন ধরছো না?
-ভাল লাগছে না। আগে লাচ্চি খাই। তারপর !
লাচ্চি খাওয়ার পরে নোভা এবার রাশেদ বলল, চল যাওয়া যাক !
-তুমি দেখি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছ!
-আরে এটা কী বলছ?
-তাহলে যাওয়ার জন্য এতো উতলা হচ্ছো কেন?
-আচ্ছা ! যাব না তাহলে?
-না ।
-তোমার বাবা মা আর বোন কী ভাব্বে?
-যা ভাবার ভাবুক ! জীবন তো তাদের না । আমার !
-এই কথাটা আগে ভাবলে তো এসব হত না !
-হ্যা আমারই তো দোষ !
রাশেদ দ্রুত বলল, আচ্ছা যা হয়েছে ! এখন ওসব বাদ । আমি আর কখনই আগের কথা তুলব না । ঠিক আছে ? আজ থেকে আবার নতুন করে শুরু করি ?
নোভা যেন একটু শান্ত হল । তারপর বলল, এখন বাসায় যাওয়া যাবে না । চল অন্য কোথাও যাই ।
-কোথায় যাবে?
-চল গাজীপুরে যাই । মনে আছে একটা রিসোর্টে গিয়েছিলাম। ওখানে যাই ?
-চল !
গাড়িটা ছুটে চলে গাজীপুরের দিকে । ভেঙ্গে যাওয়া একটা সম্পর্ক আবারও নতুন ভাবে জোড়া লেগেছে । এটা এবার আর এতো সহজে ভেঙ্গে যাবে না ।
এই থিমে আরও একটা গল্প আগেও লিখেছিলাম । আজকে আবারও লিখতে ইচ্ছে হল ।