মেঘলা দিনে ক্লাসে উপস্থিতি এমনিতেই কম হয় । সামনের দিন দশেক পরে আমাদের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে । এখনও পিএল শুরু হয় নি । আরও দুইটা দিন বাকি । তবে আজকে থেকেই যেন অঘোষিত পিএল শুরু হয়ে গেছে । সকালে যখন ক্লাসে আসার জন্য বের হচ্ছিলাম তখনই একটু একটু বৃষ্টি পড়ছিল । একবার মনেও হল যে বাইরে না বের হয়ে আরও কিছু ঘুমাই । আজকে হয়তো ক্লাসে কেউ আসবে না । আমার কেউ আশংকাই সত্যি করে দেখলাম আসলেই খুব কম মানুষ জন এসেছে ।
এতো কম ছাত্র ছাত্রী যে প্রথম ক্লাসে স্যার এসেও ফিরে গেলেন । বলে গেলেন যে এই কয়জনে ক্লাস নিবেন না। আজকের লেকচার গ্রুপে দিয়ে দিবেন । আমি কিছু সময় এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলাম । বুঝলাম যে আজকে আর কোন ক্লাস হবে না । তবে এখনই কেন জানি ফিরে যেতে মন চাইলো না । ক্লাসের পরে একটা টিউশনি রয়েছে । সেটা ক্যাম্পাসের একেবারে কাছে । বাসায় গিয়ে আর ফেরত আসতে মন চাইল না । তার থেকে বরং এখানেই কিছু সময় কাটাই । একবারে ক্লাস পড়িয়ে তারপর বাসায় যাওয়া যাবে।
ক্যান্টিনের একেবারে কোনার দিকে বসলাম চা আর সিঙ্গাড়া নিয়ে। কামড় দিতে যাবো তখনই অনুকে দেখতে পেলাম । আজকে কালো রংয়ের একটা জিন্স পরেছে । উপর নীল রংয়ের একটা কুর্তা। অনু প্রথম কিছু সময় এদিক ওদিক তাকালো । পুরো ক্যান্টিনটা প্রায় ফাঁকা বললেই চলে । অনেক ফাঁকা টেবিল রয়েছে ।
চারিদিকে চোখ ঘোরানোর সময়েই অনুর চোখ আমার দিকে পড়ল । আমাদের চোখাচোখি হল কিছু সময়ের জন্য । তবে সেটা একেবারেই কয়েক মুহুর্তের জন্য । অনু তারপর চলে গেল কাউন্টারের দিকে । দেখলাম কিছু সময় পরে আমার মতই ট্রেতে চায়ের কাপ আর সিঙ্গাড়া নিয়ে সে আমার দিকেই আসতে লাগল ।
আমার মনে হল যে অনু সম্ভবত আমার টেবিলে এসেই বসবে । যদিও এমনটা ভাবার কোন কারণই নেই । আমি চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলাম । তবে তারপরেই আমার ভুল ভাঙ্গল। কারণ অনু ঠিক আমার টেবিলে আমার চেয়ারের পাশে এসে বসল । খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, কী ব্যাপার আজকে কেন এলে? কেউ তো আসে নি!
আমি যে কী বলব সেটা বুঝতেই পারলাম না । কারণ ব্যাপারটা তখনও আমার ঠিক হজম হচ্ছে না । মেয়েটা হঠাৎ একেবারে আমার পাশে এসে কেন বলল । আর এমন স্বাভাবিক ভাবে আমার সাথে কথা বলছে যেন আমাদের কত দিনের না পরিচয়! আমি বললাম, না মানে …!
অনু বলল, আমিও তোমার মত এসে ফিরে আটকে গেছি! আজকে আসাই ঠিক হয় নি । বাসায় থাকলে ভাল হত !
আমি কেবল মাথা ঝাকালাম । চায়ের কাপে চুমুক দিলাম । দেখলাম অনু আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেছে । কোন সাবজেক্ট সে ভাল করে পড়েছে কোনটা নিয়ে সে খুব চিন্তায় আছে ! আমি ওর কথা শুনছি ! বিস্মিত আবার কিছু আনন্দিত । হঠাৎ অনু বলল, গত পরশু দিন তুমি ঐ কথাটা কেন লিখেছিলেন?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কোন কথাটা ?
-ঐ যে লিখলে যে কিছু কিছু মেয়ের আজীবন সিঙ্গেল থাকা উচিৎ? কেন স্বভাবের কারণে?
আমি হেসে ফেললাম।
অনু বলল, নামে সেই কিছু মেয়েরা আসলে কারা আর কেন তাদের সিঙ্গেল থাকা উচিৎ?
আমি একটু সময় ধরে অনুর দিকে তাকিয়ে রইলাম । তারপর বললাম, আসলে ব্যাপারটা ঐ রকম না । একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখবে যে প্রতিটা ক্লাস কিংবা অফিসে এমন একজন মেয়ে থাকে যাকে সবাই ভালবাসে । কোন দিন পাবে না জেনেও তাকে নিয়ে কল্পনা করে স্বপ্ন দেখে । কিন্তু যখন সেই মেয়েটা অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় কিংবা বিয়ে হয়ে যায় তখন সেটা দেখে ক্লাসের অন্য সব ছেলে কষ্ট পায় ! মেয়েটা যখন তার ভালবাসার মানুষটার হাত ধরে হাটে, আনন্দের সময় পার করে সেই সব দেখে কত ছেলে কষ্ট পায় সেটার কোন ঠিক নেই।
অনু খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল । তারপর বলল, সত্যিই?
-হ্যা ।
-আমাদের ক্লাসে এমন কেউ আছে?
আমি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওর দিকে তাকালাম । ওর গভীর কালো চোখের ভেতরে যেন আমার ডুবে দেখে ইচ্ছে করল । মনে হল যে এই চোখের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাবে সারাটা জীবন !
আমার এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই অনু প্রথমে কিছু সময় বিভ্রান্ত হল। তারপর ওর চোখে আমি বিস্ময় দেখতে পেলাম !
চোখে বড় বড় করে বলল, আমি ?
আমি সরাসরি জবাব না দিয়ে হাসলাম কেবল । এই মেয়েটার কোন ধারণাই নেই যে ক্লাসের কত গুলো ছেলে ওর জন্য পাগল হয়ে আছে । অনু আবারও প্রশ্নটা করল, সত্যিই আমি?
-হ্যা ।
অনু যেন আমার কথা বিশ্বাসই করতে পারছে না । চাপের কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেছে । আমি বললাম, তুমি সত্যিই জানো না এই ব্যাপারে ! ক্লাসে অন্য সব মেয়ের থেকেও সবাই তোমার প্রতি একটু আলাদা আচরণ করে সেটা টের পাও নি?
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেবল হাসলাম । মেয়েটার আসলেই ওর যে এই ব্যাপারে কোন ধারণা নেই সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । আমি বলল, ঐ আমাদের ক্লাসের শফিক আছে না, তোমাকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে একটা কবিতা লেখে । ওর ওয়ালে যে কবিতা গুলো লেখা তার প্রায় সব গুলো তোমাকে নিয়ে ! তারপর রাজু, দ্বীপ, নাজিম আর রাফি …. আরও নাম বলবো?
অনু মাথা ঝাকালো । সে নাম শুনতে চায় না । আমি যদিও থামলাম না । বললাম, ঐ মামুন আছে না !
-মামুনও ?
অনুর চোখে বিস্ময় ! সে খানিকটা বিস্মিত কন্ঠে বলল, ওর না প্রেমিকা আছে?
-তো কী হয়েছে ! প্রেমিকা থাকলেও তারা সবাই তোমাকে পছন্দ করে । যেদিন তুমি প্রেম শুরু করবে এই সবাই কষ্ট পাবে ! কারো কারো তো রাতে ঘুমই আসবে না ।
অনু আমার দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে রইল । আমাদের মাঝে আরও কিছু কথা বার্তা হল । ততক্ষণে বৃদ্ধি থেমে গেছে । সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল । তারপর একবারও পেছনে না তাকিয়ে চলে গেল । আমি ক্যান্টিনের গেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময়। কেন জানি মনে হচ্ছিল অনু আবারও ক্যান্টিনের ভেতরে আসবে । তারপর সেই প্রশ্নটা করবে!
তবে সে এল না । আমি জানি সে যদি প্রশ্নটা আমাকে করত আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করতাম । হয়তো সত্য কথাটা আমি এড়িয়ে যেতাম । সরাসরি এই কথাটা ওকে কোন ভাবে বলতে পারতাম না । চাইলেও বলা যায় না এসব কথা । তবে না বলতে পারলেও কথাটা যে সত্যি এই ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই । সন্দেহ নেই যে গতদিন আমি স্টাটাসটা কেবল অনুকে নিয়েই দিয়েছিলাম । এখানে আমি নিজেও যুক্ত । আমি আসলে আমাকে নিয়েই কথাটা বলেছিলাম।
অনুর সাথে যদি কোন দিন কাউকে প্রেম করতে দেখি কিংবা ওকে যদি বিয়ে করতে দেখি তাহলে সত্যি আমার বুকের ভেতরে কী এক তোলপাড় শুরু হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না । অনু হয়তো কোন দিন এই কথা জানতেও পারবে না ! আর আজকের পরে হয়তো সে আমার সাথে ঠিক মত কথাও বলবে না । আজকে মেঘলা দিনে অন্য কেউ আসে নি দেখেই হয়তো এই কারণেই আমার কাছে সে কথা বলেছে ! অন্য স্বাভাবিক দিনে হয়তো আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না ! তবে একটা ব্যাপার আমাকে একটু মনে আনন্দ দিল যে অনু আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস খেয়াল করে ।
আমি যেমনটা ভেবেছিলা তেমনটাই হল । সত্যিই অনুর সাথে সব কিছু আগের মতই রইল । আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল । আমরা সবাই পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত । তারপরেও আমার চোখ অনুর উপরে থাকতই সব সময় । আমি সব সময় খেয়াল করতাম অনু কখন কী করছে !
এরপরেই একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটল । আমাদের ক্লাসের কবি শফিককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল । ঢাকার অদুর গাজিপুরের একটা বাড়িতে তার কাঁটা ছেড়া লাশ পাওয়া গেল। আমাদের পুরো ক্লাস যেন স্থব্ধ হয়ে গেল !
শফিক খুবই আত্মভোলা আর নরম টাইপের একটা ছেলে । কারো সাথে কোন দিন উচু গলায় কথা বলেছে কিনা আমরা কেউ বলতে পারব না। কার সাথে শফিকের কোন শত্রুতা ছিল বলে আমরা জানি না । তাহলে এই ছেলেটাকে কেউ কেন এভাবে খুন করবে?
আমরা কেউ কোন কারণ খুজে পেলাম না । পুলিশ এসে আমাদের অনেকের সাথেই কথা বললেন । আমি ব্যাপারটা ঠিক যেন মেনেই নিতে পারছিলাম না । আমাদের স্যারের পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দিলেন।
আমরা যখন এই শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি ঠিক তখনই আরেকটা ভয়ংকর ঘটনা আমরা জানতে পারলাম । আমাদের ক্লাসের রাজুকেও ঠিক একই ভাবে কে বা কারা যেন মেরে ফেলেছে। এবং দ্বীপকে নাকি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না । শফিক আর আর রাজু হলে থাকে তাই তাদের গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেউ খুব একটা খেয়াল করে নি কিন্তু দ্বীপ নিজের বাসায় থাকে । তাকে নাকি দুদিন থেকেই খুজে পাওযা যাচ্ছে না ।
আমাদের সবার মনে একটা তীব্র একটা ভয় এসে জড় হল । বিশেষ করে ছেলেদের মনে । আমাদের ক্লাসের ছেলেদেরকে কেউ খুন করছে। কেন করছে এমন করে !
দ্বীপের লাশ পাওয়া গেল আরও সপ্তাহ খানেক পরে । আমাদের মনে তীব্র একটা ভয় দেখা দিল । কেউ কেউ তো ঢাকা ছেড়ে বাড়িতে পালিয়ে গেল। ঠিক এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পরে নাজিমের লাশ উদ্ধার হল তখন আমার মনে একটা ব্যাপার ধরা দিল । এই ব্যাপারটা আমার মনে সন্দেহের উদ্রেগ করছিল । আমি একটা মিল খুজে পেতে শুরু করলাম ।
কেবল মাত্র সেই ছেলে গুলোই খুন হচ্ছে যাদের কথা আমি অনুকে সেদিন বলেছিল । যারা অনুকে পছন্দ করে !
নাম গুলো আমি আরেকবার ভাল করে দেখতে লাগলাম ! কিছুতেই যেন নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না । আবার নিজের চোখকে অবিশ্বাসও করতে পারছিলাম না । এমন কি হতে পারে?
অনু এই সবাইকে খুণ করতে পারে?
এই একটা ব্যাপার আমি পুলিশকে জানিয়ে দিলাম । আমার মনের সন্দেহটা ।
পরিশিষ্টঃ
খুনী ধরা পড়ল।
আমার সন্দেহের কথা পুলিশকে জানাতেই পুলিশ মামুন আর রাফির উপর নজর রাখা শুরু করল । তবে রাফি ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে নজরটা শুধু মামুনের উপরে গিয়ে। ঠিক দুইদিন পরে মামুনকে কেউ কিডন্যাপ করল । রাতের বেলা সে টিউশনি থেকে ফিরছিল । সেই সময়ে একজন পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করে এবং গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায় । পুলিশ চাইলে তখনই খুনিকে ধরতে পারত তবে ধরে নি । তাদের দেখার দরকার ছিল যে আর কে কে আছে ওদের সাথে । গাড়ি থামে পুরান ঢাকার একটা বাসায় । সেখানেই ধরা হয় তাকে।
তবে আমার মনে যে ভয়টা ছিল সেটা সত্য হল না। খুনী অনু নয়। অনুর পক্ষে আসলে এই খুন গুলো করা সম্ভবই ছিল না । খুনী অনুর বয়ফ্রেন্ড ! আমরা যদিও কেউ জানতাম না যে অনুর কোন বয়ফ্রেন্ড আছে । সেদিন আমার সাথে গল্প করার পরে অনু আমার কথাই তার বয়ফ্রেন্ডকে বলেছিল এবং সেখান থেকেই ওর বয়ফ্রেন্ড লিমন এই কাজটা করেছে । কোন সন্দেহ নেই যে অনুর বয়ফ্রেন্ড মানসিক ভাবে বিকার গ্রস্থ। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতোটা ভয়ংকর পর্যায়ে যাবে সেটা অনু নিজেও জানত না । যদি জানত তাহলে কি নিজের প্রেমিকের কাছে এই ছেলে গুলোর কথা সে বলত ?
আমাদের স্বাভাবিক হতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল তবে অনুর সময় লেগেছিল সব থেকে বেশি। সে এই সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে দিল । যদিও তার কোন দোষ ছিল তবে তার কারণেই এতো গুলো মানুষ মারা গেল ! এটা থেকে সে সহজে বের হতে পারছিল না । সেই হিসাবে আমিও যে দোষী সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
এ যুগে ভালোবেসে মানুষের ভাল হয় না । তাদের কেবল খারাপই হয়। আজকে ওরা যদি অনুকে ভালো না বাসত তাহলে ওরা আজকে ঠিকই বেঁচে থাকত । ভালো বেসেই মরেছে !
ভালোবাসা ভাল নয় !