শ্বশুরবাড়ির কফি

oputanvir
4.7
(53)

আমি ক্যাফেতে ঢুকতেই দেখলাম বেশ কয়েকটা চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হল । কারো কারো চোখে রাগ আবার কারো কারো চোখে বিস্ময় । সম্ভবত আমাকে ওরা এখানে মোটেই আশা করে নি । আমি একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতেই দেখলাম একজন এগিয়ে এল । আমার সামনে এসে বলল, আপনি এখানে কেন এসেছেন?

কন্ঠস্বর বেশ রুক্ষ। পারলে যেন আমাকে এখনই ধরে মাইর দেয়। আমি শান্ত কন্ঠে বললে, এখানে মানুষ কেন আসে? খেতে ! আমিও সেই জন্য এসেছি ! এক কাপ কফি !

-কফি শেষ । চলে যান !

-আরে এমন কেন করছো? ঐ যে আমি দেখতে পাচ্ছি কফি! আমি দেখতে পাচ্ছি যে কফি রয়েছে । এক কাপ খেয়েই চলে যাব ।

আমি দেখতে পেলাম একটা মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেন ঝামেলা সৃষ্টি করছেন বলুন তো । আপনাদের লোকজন এখানে আসে না । আমরাও যাই না আপনাদের দিকে । দয়া করে চলে যান !

আমি বললাম, আমি আমাদের আপনাদের এলাকার ভেতরে নাই । ওদিকে একটা কফির দোকানেও ভাল কফি বানাতে পারে না । অখাদ্য সব । শুনেছি আপনাদের এই দোকানের কফিটা বেশ ভাল । সাধারণ কাস্টমার হিসাবেই এক কাপ কফি খাওয়ান প্লিজ !

মেয়েটি বলল, এটা ঠিকই বলেছেন আপনাদের মত আপনাদের কফিও অখাদ্য ! 

তারপর মেয়েটি ঘুরে চলে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল । তারপর খানিকটা চিৎকার করেই বলল, সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলেকে কফি দাও । বিল নিও না । আমার পক্ষ থেকে ! 

আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা আরও কিছু সময় কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সেও কাউন্টারের দিকে হাটা দিল । সম্ভবত এরা ভাইবোন । মেয়েটা বড় ! 

কফি চলে এল একটু পরেই । চুমুক দিতেই একটা শান্তি অনুভব করলাম । আসলেই কফিটা দারুন । অন্তত আমাদের ঐদিকের কফি গুলো থেকে হাজার গুণ ভাল । যে কয়টা দিন এখানে আছি এই দোকান থেকেই খাওয়া যাবে । তবে চিন্তা আমি পরক্ষনেই বাদ দিয়ে দিলাম । এই দোকানে আর আসা যাবে না । এরা ব্যাপারটা যেমন পছন্দ করছে না আমার বাড়ির লোকজন জানলেও ব্যাপারটা পছন্দ করবে না ।  তারা যদি জানে যে আমি শহরের এই এলাকাতে এসেছি তাহলে আমার উপরে চড়াও হবে সবাই।

আমি ঠিক এই কারণেই এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম অনেক আগে । যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই মারামারি আমার পছন্দ ছিল না । এসবের থেকে দুরে থাকতেই আমি চলে গিয়েছিলাম । জীবনের বড় একটা সময় আমি কাটিয়েছি মামার বাড়ি সৈয়দপুরে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হয়েছে ঢাকাতে। তারপর থেকে সেখানেই থাকি । এমন কি ছুটি উৎসবেও আমি এখানে আসি না। এইবারও আসতাম না তবে দাদুর শরীর খুবই খারাপ । হয়তো তিনি আর খুব বেশিদিন বাঁচবেন না । তাই আমি এখানে এসেছি। 

আমি কফি শেষ করে কাউন্টারে গেলাম টাকা দিতে। মেয়েটিই বসে ছিল সেখানে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, টাকা দিতে হবে না।

আমি একটু হেসে বললাম, এভাবে ফ্রি খাওয়ালে তো আবারও আসব ! 

-দেখুন মিস্টার আকাশ, এই শহরে এমনিতেও অনেক ঝামেলা । দয়া করে আর নতুন করে ঝামেলা সৃষ্টি করবেন না । আর আসবেন না এদিকে । 

আমি মেয়েটার কন্ঠের উত্তাপটা বুঝতে পারলাম। তবে মেয়েটা যে আমার নাম জানে এটা আমাকে একটু অবাক করল । এটা আমার দাদা বাবার কারণেই হয়েছে । আমি বললাম, আমি কিন্তু এসবের ভেতরে নেই । আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন?

-আপনি আছেন কি নেই সেটা বড় ব্যাপার না । বড় ব্যাপার হচ্ছে আপনি সৈয়দবাড়ির বড় ছেলে । আর এটা বিশ্বাসদের এলাকা । এটার থেকে বড় আর কোন ব্যাপার হতে পারে না । প্লিজ চলে যান এখান থেকে । আর আসবেন না !

আমি আর কথা বাড়ালাম না । ক্যাফে থেকে বের হয়ে এলাম । আমার বাইকটা ক্যাফের বাইরেই দাড় করিয়ে রেখেছিলাম । সেটা নিয়ে শহরের মাঝ দিয়ে রওয়ানা দিলাম । রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একটা ব্যাপার ঠিকই টের পাচ্ছিলাম । সবার চোখ ছিল আমার উপর । 

এই খবর আমার বাসায় পৌছাতেও সময় লাগল না । রাতের বেলা খাওয়ার সময় বাবা কঠিন গলায় জানতে চাইলেন, ওদিকে কেন গিয়েছো?

আমি শান্ত কন্ঠে বললাম কফি খেতে!

আমাদের এখানে কফি পাওয়া যায় না?

-যায় তবে অখাদ্য । ওদের ওখানকার কফিটা ভাল !

-তুমি কি এখানকার পরিস্থিতি জানো না ? যদি ওরা তোমার উপর হামলা করত ! ওদের ওখানে কেনই যেতে হবে !

এই নিয়ে আরও কিছু সময় লেকচার দিতে শুরু করলে কেন জানি আমার মেজাজ হারিয়ে ফেললাম । আমি খাবার টেবিলের উপরে থাকা গ্লাসটা সজোরে টেবিলের উপর বাড়ি মারলাম । ভাঙ্গল না বটে তবে আওয়াজ হল বেশ । দেখলাম সবাই একটু থতমত খেয়ে গেল । আমি খানিকটা গড়া চড়িয়েই বললাম, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতো কথা বলার কী আছে ! তোমাদের এই ঘোড়ার ডিমের মারামারির জন্য এই শহর ছেড়েছি । তোমাদের এখানে আসাই আমার ভুল হয়েছে । সভ্য মানুষের মত থাকো তোমরা ! জন্তু জানোয়ারের মত মারামারি কর ! একটু লজ্জাও লাগে না?

দেখলাম আর কেউ কোন কথা বলল না । বাকি সময় কেউ আর কোন কথা বলল না । 

দাদুর শরীর দিনকে দিন আরও খারাপ হয়ে গেল । সত্যিই মনে হচ্ছিল তিনি আর খুব বেশি সময় বাঁচবেন না । তিনি আমাকে কী কারণে যেন অন্য সবার থেকে বেশি পছন্দ করেন । একদিন তার ঘরে বসে আছি, তিনি আমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন । তারপর ফিসফিস করে বললেন, তুই এই মারামারি শেষ করে দিস পারলে ! কেউ পারলে তুই পারবি ! 

আমি হেসে বললাম, আপনার ছেলে আর নাতিপুতিরা তো এসব চায় না । তারা তো আরও এগিয়ে নিতে চায় !

দাদু আর কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন । তবে কেন জানি আমার মনে হল তিনি সত্যিই চান এসব বন্ধ হোক । অনেক দিন তো হল ! 

শহরের দক্ষিণ দিকটা পাহাড়ি অঞ্চল । এদিকে আমাদের কিংবা বিশ্বাসদের কারোই ঠিক আধিপত্য নেই । এইদিকটা বেশি উন্নত নয় । লোকজনও বেশি না। আমি বাইক নিয়ে প্রায়ই চলে চাই এদিকে । আজকেও বের হয়েছিলাম । ফেরার পথে আবারও বিশ্বাস বাড়ির সেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল । দেখলাম রাস্তার পাশে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । গাড়ি সম্ভবত নষ্ট হয়ে আছে । একজন সেটার ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে । আমি বাইক নিয়ে দাড়ালাম । তারপর বলল, নিড হেল্প ?

মেয়েটি কঠিন কন্ঠে বলল, নো!

আমি একটু হাসলাম । তারপর বাইক থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম । ইঞ্জিনের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে এই জিনিস কোন ভাবেই এখানে চালু করা সম্ভব না ।  আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই জিনিস এখানে ঠিক হবে না । মেকানিক লাগবে !

-সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা না করলেও চলবে!

-দেখুন আমি এখান থেকে চলে যেতেই পারি তবে আমার এটা মোটেই ভাল লাগবে না । আর এখানে কেউ আপনাকে সাহায্য করতে আসবে না । এমনও হতে পারে যে সারা রাত আপনাদের এখানেই থাকতে হবে । আর এখানে মোবাইলের টাওয়ারও নেই । কাউকে ডাক দিতে পারবেন না । এর থেকে আমার সাথে চলুন । আপনি শহরে নেমে মেকানিককে খবর দিবেন । সে এসে গাড়ি ঠিক করে নিবে । গাড়িতে কাঁচামাল দেখতে পাচ্ছি। সারারাত এগুলো এখানে থাকলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ! আসুন !

মেয়েটি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল । তবে আমি জানি যে যা বললাম তার ভেতরে যুক্তি রয়েছে । এটাই সব থেকে ভাল বুদ্ধি। মেয়েটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার বাইকে চেপে বসল । তবে পুরো যাত্রায় একটা কথাও বলল না । আমি অবশ্য প্যাচাল থামালাম না !

আবারও যখন আমি ওদের ক্যাফের সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমি ব্যাপারটা খুব ভাল করে খেয়াল করলাম যে সবার চোখ আমার উপরে রয়েছে । শহরের ভেতরে ঢোকার পর থেকেই সব গুলো চোখ আমাদের উপরেই ছিল । সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলের বাইকে বিশ্বাস বাড়ির বড় মেয়ে ! 

ক্যাফের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি যখন মেয়েটি বলল, ধন্যবাদ !

-মেনশন নট । ইয়ে মানে এক কাপ কফি কি খাওয়া যাবে আপনাদের ক্যাফেতে ? আমাদের ওদিককার কফি সত্যিই অখাদ্য !

এই প্রথমবার দেখলাম মেয়েটি হাসল । তারপর বলল, আসুন !

মেয়েটি নিজেই কফি নিয়ে এল । তবে আগের দিনের মত চলে গেল না । আমার সামনেই বসল। তারপর বলল, আপনি আপনার দাদা বাবাদের মত না । 

-তাদের মত না বলতে?

-এই যে মারামারি কাটাকাটি পছন্দ করেন না । এটার কারণে শহর ছেড়েছেন।

আপনি কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললাম, আপনি? 

-আমি এর ভেতরেই বড় হয়েছি । না চাইতেও অনেক কিছু করতে হয় । 

-তা হয় । তবে নিজের চয়েজ তো থাকেই সব সময় । বাই দা ওয়ে আপনার নাম এখনও আমি জানি না। বলা যাবে? বলতে চাইছি যে বিশ্বাস বাড়ির মেয়েরা কি সৈয়দ বাড়ির ছেলেদেরকে নিজেদের নাম বলে?

দেখলাম মেয়েটা আবারও হেসে ফেলল। তারপর বলল, কফি যখন খাওয়াতে পারছি, নামও বলা যাবে । আমার নাম লীনা ! 

-আমি আকাশ !

-আমি জানি ! 

আমি পকেট থেকে আমার একটা কার্ড বের করে দিলাম লীনাকে । বললাম, যদি কখনো ঢাকাতে আসেন তাহলে যোগাযোগ করবেন । ঢাকার সব থেকে ভাল কফি খাওয়াব আপনাকে । 

লীনা হাসি মুখেই কার্ডটা নিল । 

পরের দিনই দাদু মারা গেলেন । আমি আর বেশিদিন থাকলাম্না বাড়িতে। দুদিন পরেই ঢাকা চলে এলাম ! তারপর কেটে গেছে প্রায় মাস ছয়েক । বাসায় খবর খুব একটা জানি না । মায়ের সাথে কথা বললেও তাকে আমি সব সময় বলেছি যে শহরের ঝামেলার কথা যেন সে আমাকে কোন ভাবে না জানায় । শহরে কী হচ্ছে কে মরছে এসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই । 

তবে শহরের ঝামেলার কথা আমার কাছে পৌছেই গেল । তবে মায়ের মাধ্যমে নয় । লীনার মাধ্যমে । একদিন অফিসের মাঝে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এসে হাজির হল । ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে মেয়েটা যখন বলল যে সে লীনা আমি সত্যিই অবাক হলাম । সে জানাল যে একটা কাজে যে ঢাকা এসেছে । আমার দেওয়া কফির অফার সে নিতে আগ্রহী । 

বিকেল বেলা অফিসের পরে আমাদের দেখা হল । ঢাকার সব থেকে চমৎকার কফি সপে লীনাকে নিয়ে গেলাম । আমি সত্যিই ভাবতে পারি নি যে লীনা আসবে আমার সাথে দেখা করতে !

তবে কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি টুকটাক গল্প করছিলাম । লীনাও জবাব দিচ্ছিল । তবে একটা সময়ে এসে আমার কেন জানি মনে হল লীনা ঢাকা অন্য কোন কাজে নয় বরং আমার সাথে দেখা করতে এসেছে । এর পেছনে বিশেষ কোন কারণ রয়েছে।

কারণটা আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করতে দেখলাম লীনা সেটা অস্বীকার করল না । সে স্বীকার করেই নিল যে কোন কাজে নয় সে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।

লীনা কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, সপ্তাহ খানেক আগে আবারও শহরে একটা ঝামেলা হয়েছে দুই গ্রুপের ভেতরে । ছোট একটা খেলাকে কেন্দ্রে করে বেশ বড় পর্যায়ে মারমারি । শহরের অবস্থা একেবারে থমথমে । বিপুল পরিমান পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে তবে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে । দুই গ্রুপের ভেতরে যে কোন সময়ে মারামারি শুরু হবে যে কোন সময়ে । আর মারামারি শুরু হলে পুলিশ মাঝে থাকে না । দুই গ্রুপ মরছে কেন ওরা মাঝে থাকবে ? ওদের কোন দায় নেই। আপনার বাবাকে কয়েক দফা প্রশাশনের লোকজন বোঝানোর চেষ্টা করেছে বটে কিন্তু কাজ হয় নি কোন !

লীনা এক ভাবে কথা বলে থামল । আমি চুপ করে রইলাম ! আসলে কী যে বলব সেটা আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আমি সব সময়ই এসব থেকে দুরে থেকেছি । আমার এসব ভাল লাগে নি কোন সময়ই । লীনাকে বললাম, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?

লীনা বলল, আসলে আমি জানি না । আমি সত্যিই জানি না আমি কেন এলাম আপনার কাছে । আমি কোন ভাবে কেবল এই ঝামেলা দূর করতে চাই । গত বছর আমার ছোট ভাই মারাত্বক আহত হয়েছিল। একেবারে মরতে মরতে বেঁচেছে । এবারও যদি এমন কিছু হয় !

আমরা কেউ কোন কথা বললাম না অনেকটা সময়ে । তারপর বললাম, একটা কাজ করা যায় !

-কী?

-যদিও নিশ্চিত না যে এতে কাজ হবে কিনা ! তবে চেষ্টা করা যায়?

-কী কাজ?

-চলেন বিয়ে করে ফেলি !

-কী !

-জ্বী ! এটার থেকে ভাল সমাধান আর আমার চোখে পড়ছে না । দুই পরিবারের বড় দুই ছেলে মেয়ের ভেতরে বিয়ে হওয়া মানে আত্মীয়তার সম্পর্ক ! এই খবর যখন ছড়িয়ে পড়বে তখন একটা প্রতিক্রিয়া তো শুরু হবেই ! কাজ যে হবেই সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না । তবে চেষ্টা করা যায় । করবেন কি?

লীনাকে আমি দ্বিধান্বিত দেখলাম। তবে সে নিজের পরিবার নিয়েও চিন্তিত । যে কোন ভাবেই সে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চায় । অন্তত চেষ্টা করতে তো চায়ই । 

লীনা বলল, চলুন চেষ্টা করা যাক ! 

দুই

আমি আর লীনা ইচ্ছে করেই রিক্সা নিলাম । আমাদের লক্ষ্য মূলত ছিল যেন সবাই আমাদের দেখতে পারে । সেটাই হল । শহরের প্রতিটা চোখ আমাদের উপর নিবদ্ধ হল । রিক্সাটা যখন আমাদের বাড়ির গেটে থামল তখন লীনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর ভীর চোখে তাকিয়ে রয়েছে । জীবনে প্রথম বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে সৈয়দ বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে । তাও আবার পুত্রবধু হিসাবে!

আমি লীনার হাত ধরলাম । তারপর বললাম, ভয় নেই । আমি আছি !

গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম বাবা বের হয়ে এলেন । তার পেছনে আমার ছোট চাচা আর আমার ছোট দুই ভাই ! বাবা কঠিন কন্ঠে বললেন, এই মেয়ে এই বাড়িতে কেন?

আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, বাবা ওকে আমি বিয়ে করেছি । ও এই বাড়ির বউ !

কারো কারো চোখে আমি বিস্ময় দেখলাম কারো কারো চোখে রাগ! বাবা আগের থেকেও কঠিন কন্ঠে বললেন, তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি ! এই মেয়ে আমার বাড়িতে ঢুকবে না । কোন ভাবেই না !

আমি আগের থেকেও শান্ত কন্ঠে বললাম, তোমরা ইতিমধ্যে জানো যে দাদা এই সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিয়ে গেছেন । বাড়ি ঘর আর সমস্ত ব্যবসা । জানো না?

দেখলাম কেউ কোন কথা বলল না । আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি যে বাড়ির সবাই সেটা জানে । আমি বললাম, তাই আমার বাড়িতে ঢুকবে না এই কথা বল না । সবাইকে এক ঢাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিব । 

বাবার মুখের ভাব দেখে বুঝলাম তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এই কথা বলেছি । একেবারে যেন পাথর হয়ে গেছেন । তবে আমার পিঠাপিঠির যে ছোট ভাই সাগরের এই কথা মোটেই সহ্য হল না । সে মারামারি সবার আগে থাকে । তার রাগও সব থেকে বেশি। সাগর আমার দিকে তেড়ে এল । 

এতো বড় সাহস তোর !

এই বলে সে এগিয়ে এল । আমার ঠিক কাছে আসতেই কষে এক চড় মারলাম ওর গালে ! এতোটাই জোড়ে যে খানিকটা উল্টেই পড়ল মাটিতে । ওর দিকে আঙ্গুল তুলে বললাম, সবার আগে তোকে বাড়ি থেকে বের করব ! 

তারপর সবাইকে আগের স্থানে রেগে লীনাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম । 

খবর রাষ্ট্র হতে সময় লাগল না । সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলে বিশ্বাস বাড়ির বড় মেয়েকে বিয়ে করেছে । এই এক খবরেই কাজ হল । কাজ হবে আমাদের ভরশা ছিল না তবে হল । বিয়ের বন্ধন বড় একটা বন্ধন । এটা অনেক কিছু বদলে দেয় !

রাতে খাবার টেবিলে দেখলাম সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে । কেউ কোন কথা বলছে না । আমি লীনাকে নিয়ে বসলাম এক পাশে । তারপর বাবার উদ্দেশ্য বললাম, আমার দুপুরের আচরণের জন্য আমি সরি বাবা । আমি জানি আমি বেয়াদবি করেছি তবে এটা আমি কেন করেছি সেটা আপনার বোঝার কথা ! দাদু আমাকে কেন সব কিছু দিয়ে গিয়েছে আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন । এই রেশারেশি মারামারি বন্ধ হওয়া দরকার । প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটা চলতে পারে না । 

আমি একটু চুপ থেকে আবার বললাম, আমার এই সম্পদ বাড়িঘরের কিছুই দরকার নেই । আমি এসব নিতেও আসব না । দুদিন পরে আমি আবার ঢাকা চলে যাব । তবে আপনারা যদি এ রেশারেশি বন্ধ না করেন তাহলে যে সম্পদ জমিজমার জন্য এই এতো কিছু এই সব কিছু থাকবে না । কিছু না । আপনার যেমন জেদ আছে আমিও আপনারই ছেলে । এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব । প্লিজ বাবা আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি এসব বন্ধ করেন । 

দেখলাম বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, আমরা বন্ধ করলেই কি ওরা করবে?

-করবে বাবা !

কথাটা আমি বলি নি । বলেছে লীনা । এবং আমার বাবাকে বাবা বলে ডেকেছে । দেখলাম খাবার টেবিলের পরিবেশ মুহুর্তেই বদলে গেল ! বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে সত্যি সত্যিই তাহলে সৈয়দ বাড়ির পুত্রবধু হয়ে গেল ! 

 লীনাদের বাসায় আমার অভ্যর্থনা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত ছিলাম বটে তবে দুইদিন পরে যখন ওদের বাসায় প্রথমবারের মত গেলাম তখন দেখলাম সব কিছু স্বাভাবিক । বিশেষ পুরো শহরে আমাদের বিয়ের খবর বেশ ভাল ভাবেই ছড়িয়েছে । আমিও যদি তখনই আসতে চাইছিলাম না । কারণ লীনাদের বাসায় আমাকে কিভাবে নিবে সেটা আমি তখনও জানি না । 

লীনাই আমাকে সাথে করে নিয়ে গেল । ওর বাসা থেকেই নাকি আমাকে যেতে বলেছে । হাজার হলেও আমি ওদের বাড়ির জামাই । 

লীনার বাবা আমাকে প্রথম যে কথা জিজ্ঞেস করলেন সেটা হল, আমার বাবা এই বিয়ে মেনে নিয়েছেন কিনা !

আমি বললাম, হ্যা । তার আপত্তি নেই । 

যদিও সত্য কথা বললাম না । 

তিনি আমার দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে রইলেন । তারপর বললেন, লীনার কাছ থেকে আমি সব শুনেছি । তোমার সত্যিই সাহস আছে। লীনাকে তুমি সুখে রাখবে ! একজন বাবার কাছে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না যে তার মেয়ে সুখে থাকবে । আমি এখনই কথা দিতে পারছি না যে আজই সব ঠিক হয়ে যাবে । তবে আমিও চেষ্টা করব ! 

দুপুরে বিশাল খানাপিনা হল । শ্বশুর বাড়ির আপ্যায়ন যাকে বলে । বিকেলে আমি আবারও সেই ক্যাফে গিয়ে হাজির হলাম লীনাকে নিয়ে । লীনার ছোট ভাইকে দেখতে পেলাম সেখানেই আছে । সে তখনও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি । আমার ছোট ভাই সাগরের মত অবস্থা ! আজকে অবশ্য আমাকে আর বাইরে বের হয়ে যেতে বলল না । তবে স্পষ্টই আমাকে এখানে তার বোনের সাথে দেখে তার ভাল লাগছে না । লীনা নিজেই আমার জন্য কফি নিয়ে এল । আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললাম, সাগরকে এখানে একদিন নিয়ে এলে কেমন হয়? 

লীনা বলল, দুজন মারা বাঁধিয়ে দিবে ! 

-দিক । আমরা দেখি দুজন কত সময় মারামারি করতে পারে । পুরো শহরের থেকে এই দুইজনের মারামারিই বরং ভাল ! 

আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম । আগের থেকে অবস্থা যে উন্নতি হচ্ছে এটাই সব থেকে ভাল সংবাদ ! তার থেকেও বড় কথা যে এখন থেকে এখন থেকে শ্বশুর বাড়ির কফি খাওয়া যাবে বিনা পয়সাতেই ।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 53

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →