পার্সেল

4.5
(8)

ঢাকাতে আমি মোটামুটি একাই থাকি সব সময়। সারাদিনই বাসায় বসে থাকি। কারো সাথে দেখা করতে আমার ভাল লাগে না। বাবা মায়ের রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটে নিশ্চিন্তে বসবাস করছি বেশ কয়েক বছর ধরে। ব্যাংকে বেশ পরিমান টাকা পয়সা রয়েছে তাই খুব বেশি কাজকর্ম আমাকে করতে হচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে আমি ঠিক বেকারও না। একেবারে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকি না। আমার একটা অনলাইন শপ আছে। এখানে আমি নানান বিদেশী পারফিউম আমি ইম্পোর্ট করি তারপর সেগুলো বেশ ভাল দামে বিক্রি করি। আমার বড় মামা থাকেন লন্ডনে। তিনি আমার চাহিদা মোতাবেক পণ্য কিনে পাঠান। এছাড়া আমিও নানান জায়গা থেকে পণ্য নিয়ে আসি। এভাবেই দিন আমার বেশ ভাল কেটে যাচ্ছিল।
পুরানো বন্ধুদের অনেকের সাথেই এখন আর যোগাযোগ নেই ঠিক। পড়াশোনা থেকে ড্রপ-আউট হওয়ার পর থেকে আপনা-আপনিই অনেকের সাথে সম্পর্কে নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল বলে একটা কথা আছে। এখানেও তাই হয়েছে। মিলির সাথেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে। আমি যখন ওকে জানিয়েছিলাম যে আমি আর পড়াশোনা করব না তখন সে কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়েছিল। আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল। তবে এক সময়ে বুঝে গেল যে আমি আর ফিরব না। তারপর আস্তে আস্তে সেও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আমি এটা নিয়ে কোন অভিযোগ রাখি নি। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক।
তাই আজকে মিলির সাথে মেসেজটা পেয়ে আমি বেশ অবাকই হলাম।
প্রায় দুই বছর পরে প্রথম মিলি আমাকে মেসেজ পাঠাল। ওর নম্বরটা কেন জানি আমি ডিলিট করি নি। আর আমার নম্বরও যে ও রেখে দিয়েছে সেটা জেনেও অবাক হলাম।
কেমন আছো নিলয়?
ভাল আছি। তোমার কী খবর?
একটা কাজে নক দিয়েছি। একটু সাহায্য করতে পারবে?
বল, কী সাহায্য?
আমি একটু বেড়াতে এসেছি। কিন্তু একটা পার্সেল অর্ডার করেছিল। ওরা বলছে এখন ডেলিভারি দিবে। আমি চাচ্ছি না আমার অবর্তমানে আমার পরিবার বা বন্ধুদের কেউ সেটা রিসিভ করুক। তুমি কি একটু রিসিভ করতে পারবে?
আমি এবার একটু অবাকই হলাম। মিলি যে এখনও আমাকে এতোখানি বিশ্বাস করে এটা দেখে সত্যিই ভাল লাগল। পার্সেলে এমন কিছু আছে যা ওর পরিবার বা বন্ধুদের কাউকে সে দেখাতে চায় না। কিন্তু আমার উপরে বিশ্বাস আছে! কিংবা আমি সেটা দেখলেও ও কিছু মনে করবে না এমন কিছু!
আমি বললাম, আচ্ছা, কোন সমস্যা নেই। আমার ঠিকানা তো মনে আছে?
হ্যা, আমি জানি তুমি কোথায় থাকো। আমি ডেলিভারি ম্যানকে তোমার ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। আজকের ভেতরেই তোমার বাসায় দিয়ে যাবে। আমি ফিরেই তোমার কাছ থেকে নিয়ে আসব
তারপরেই দেখলাম মিলি অফলাইনে চলে গেল।

পার্সেলটা এলো বিকেলবেলা। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে ফেখতে পেলাম সেটা। পার্সেলটা কে দিয়ে গেল সেটা রহস্যের ব্যাপার। আমাদের এই এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে সব সময় সিকিউরিটি থাকে। যখন কেউ আসে তখন আমাদের নিচ থেকে ইন্টারকম থেকে ফোন করা হয়। আমরা হ্যা বললেই কেবল তাদের পাঠানো হয়। তবে আজকে তেমন কিছুই হয় নি। ছোট বক্সটা ঠিক আমার বাসার দরজার সামনে রাখা ছিল।
এমন হতে পারে যে ডেলিভারি বয় সিকিউরিটির কাছে রেখে গেছে। আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে ফোন দিয়ে পায় নি। পরে সিকিউরিটির কেউ এখানে আমার দরজার সামনে রেখে গেছে। আমার বাসায় যেহেতু অনেক পার্সেল আসে তাই এমনটা হওয়াটা অস্বাভাবিক না। আমি এটা নিয়ে অবশ্য আর বেশি কিছু চিন্তা করলাম না।
ছোট বক্স সাইজের একটা পার্সেল। বেশ ভাল করেই র‍্যাপিং করা। ভেতরে নিশ্চিত বেশ দামী কোনো জিনিস রয়েছে। আমি পার্সেলটা হাতে পেয়েই মিলিকে মেসেজ পাঠালাম। ‘‘পার্সেল চলে এসেছে।’’
কিন্তু ম্যাসেজটা ডেলিভারি হল না। এক দাগ উঠে রইলো। সম্ভবত এখন সে অনলাইনে নেই। আমি তখন বেশি চিন্তা করলাম না। কিন্তু পরের দুই দিনেও যখন মেসেজটা দুই দাগ হল না তখন মনের ভেতরে একটু অন্য রকম লাগল। তার মানে হচ্ছে দুইদিনে সে একটা বারের জন্যও অনলাইনে আসে নি। বেড়াতে গিয়েছে কিন্তু কোথায় গেছে? এমন কোনো জায়গাতে গিয়েছে যেখানে কোন নেটওয়ার্ক নেই। এমন জায়গা বলতে পাহাড়ে গেছে? হয়তো লম্বা কোণ ট্রেকিংয়ে গেছে যেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না।
কিন্তু একটা সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মেসেজটা গেল না, তখন কেন জানি আমার একটু খটকা লাগল। মিলির কি কিছু একটা হয়েছে? কোনো বিপদে পড়েছে নাকি সে? নয়তো পুরো একটা সপ্তাহ সে একবারের জন্যও অনলাইনে এল না। ব্যাপার কি স্বাভাবিক!

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ আছে এখনও। এমন না যে নিয়মিত যোগাযোগ হয় তবে কাজে কর্মে নক দিলে পাওয়া যায়। কয়েকজন আমার কাছ থেকে পারফিউম কেনে মাঝে মাঝে। তাদের ভেতরেই একজনকে নক দিলাম। মিলির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, তুই জানিস না খবর?
মনের ভেতরে একটা কু ডেকে উঠল। আমি বললাম, না। কী খবর জানবো?
-মিলি তো মারা গেছে।
কথাটা আমার মনের ভেতরে একটা ধাক্কার মত দিল। আমার মনে হয়েছিল যে হয়তো কোন বিপদ টিপদ হবে তাই বলে একেবারে মারা গেছে! মিলির চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ওর সাথে একটা বছর আমি বেশ চমৎকার সময় কাটিয়েছি। প্রেমিকা হিসাবে সে বেশ চমৎকারই ছিল।
আমি কোন মতে বললাম, মারা গেছে? কবে?
-সপ্তাহ দুয়েক আগে। ও সাজেক যাচ্ছিল বেড়াতে। সেখানে গাড়ি উল্টে গাড়ি খাদে পড়ে গিয়েছিল। চারজন মারা গেছে। তার ভেতরে মিলি একজন। আমি ভেবেছি তুই জানিস। আমি যদিও ওর জানাযাতে যেতে পারি নি। আমি ভেবেছি তুই জানিস।

আমি ফোন রেখে দিলাম। একটু পরে দেখলাম সে আমাকে একটা খবরের লিংক পাঠাল। খবরের লিংকে ক্লিক করতেই খবরটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ‘সাজেকে টুরিস্ট নিহত’।
চাঁদেরগাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পরে গেছে। ১৫ ট্যরিস্টের ভেতরে চারজন মারা গেছে। তাদের নাম পরিচয় দিয়েছে।
আমি খবরটা ক্লোজ করে দিতেই যাচ্ছিলাম তখনই আমার কাছে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ধরা পড়ল। আমি সংবাদ প্রকাশের তারিখটা দেখলাম। ৪টা আগস্ট। তারপর আমি দ্রুত আমি হোয়াটসএপের উইন্ডো ওপেন করলাম। মিলির পাঠানো মেসেজটার দিকে তাকালাম। ৯ আগস্ট।
আমি অনুভব করলাম আমার হাত কাঁপছে। মিলি যদি ৪ আগস্ট মারা যায় তবে আমার কাছে সে নয় আগস্ট মেসেজ পাঠাল কিভাবে? এটা কিভাবে সম্ভব?
তাহলে ওর ফোনটা কি অন্য কারো কাছে ছিল? সে পাঠিয়েছে মেসেজটা? কিন্তু কেন? এই পার্সেলটা যে পাঠাল সেটাই বা কিসের? অন্য কেউ আমার ঠিকানা কিভাবে জানবে?
আমি আরও কয়েকটা নিউজ ঘেটে দেখলাম। চাঁদের গাড়িটা ৪ তারিখেই খাদে পড়েছে। আমাকে তাহলে ৯ তারিখে মেসেজ পাঠাল কে? কেন পাঠাল?
আমি মিলির পার্সেলটা হাতে নিয়ে কিছু সময় বিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। আসলে কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এখন কি আমার এটা ওর ফ্যামিলির কাছে পৌছে দেওয়া উচিৎ?
তখন আবারও ওর মেসেজটা মনে পড়ল। সে চাচ্ছে না এটা অন্য কারো হাতে পড়ুক। তাই আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
এক সময়ে ঠিক করলাম যে আমি পার্সেলটা খুলে দেখব।
কাঁপা হাতে পার্সেলটা খুললাম।
‘একটা স্মার্ট ফোন।’
ডিসপ্লেটা ভেঙ্গে গেছে। আমাকে কেউ বলে দিল না তবে আমার কেন জানি মনে হল যে এটা মিলির মোবাইল ফোন। ডিসপ্লে ভেঙ্গেছে মিলিদের গাড়ি খাদে পড়ে যাওয়ার কারণে।
আমার কাছে সব কিছু কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। আমার সামনে এই ফোনটা আসা আসলে কোন ভাবেই সম্ভব না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি মোবাইলটা চালু করার চেষ্টা করলাম বটে তবে এমন ভাবে সেটা ভেঙ্গেছে যে মনে হল এটা আর কোনো ভাবেই ঠিক হবে না। অনেকটা সময় চার্জে দিয়েও ফোনটা ওপেন হল না। আমি তখন কী কবর ভাবছিলাম তখনই আমার চোখ গেল ফোনের মেমোরি কার্ড স্লটের দিকে গেল। সেটা খুলতেই একটা মেমোরি কার্দ দেখতে পেলাম। সেটা বের করে আমি আমার নিজের ফোনে প্রবেশ করালাম।
গ্যালারিতে যেতেই মিলির বেশ কিছু ছবি আমি দেখতে পেলাম। একটু নিচে যেতেই মিলির বেশ কিছু অন্তরঙ্গ ছবি দেখতে পেলাম সেখানে।
আমি সাথে সাথেই আমি স্ক্রিন অফ করে দিলাম। হাজার হলেও এটা মিলির একান্ত গোপন জিনিস। কারো প্রাইভেট ছবি এভাবে দেখা কোনো ভাবেই ঠিক না, বিশেষ করে যে কিনা মারা গেছে !
আমি মেমোরি কার্ডটা ফোন থেকে বের করে সাথে সাথেই ভেঙ্গে ফেললাম। এই ছবি কারো দেখার দরকার নেই। সম্ভবত এই কারণেই মিলি এই ফোনটা আমার কাছে পাঠিয়েছে।
আমি মেমোরিকার্ডটা ভাঙ্গা অংশটা আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর ফোনটাও ভেঙ্গে একেবারে চুর্ণ বিচুর্ণ করে ফেললাম। সেই অংশ একেবারে নষ্ট করে দিলাম যাতে করে কোন ভাবে কেউ এই ফোন থেকে কিছু উদ্ধার করতে না পারে!

রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে এই কথাই যখন ভাবছি তখনই আমার মনে হল মিলিকে একটা মেসেজ পাঠানো যাক। জানি এটা পাগলের মত কাজ হচ্ছে তবুও আমার করতে ইচ্ছে হল। আমি মোবাইলের হোয়াটসএপে গিয়ে মিলির মেসেজটা ওপেন করলাম। তারপর সেখানে লিখলাম, ডান!
আমাকে তীব্র অবাক করে দিয়ে মেসেজটা সাথে সাথেই ডেলিভারি হয়ে গেল। মেসেজের নিচে দুই ব্লু টিক উঠল। তার মানে ওপাশে যেই থাকুক সেই মেসেজটা সে দেখেছে। একটু পরেই একটা স্মাইলির ইমোজি এসে হাজির হল।
আমি অনুভব করতে পারলাম আমার বুকের ভেতরে একটা তীব্র কাঁপন শুরু হয়েছে। আমি কোন মেসেজই পাঠাতে পারলাম না। ঠিক ভয় না তবে কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগল আমার। একজন মৃত মানুষ আমাকে মেসেজ পাঠাচ্ছে।
আবারও টুং করে আওয়াজ হল।
‘আমি জানতাম আমি তোমার উপর ভরশা করতে পারব। ভাল থেকো।’
‘তুমিও ভাল থেকো।’
আমি ভেবেছিলাম যে আমার মেসেজটা বুঝি আগেরটা মত করে সাথে সাথে পৌছে যাবে। কিন্তু মেসেজটা গেল না। সেই এক টিক হয়ে রইল। বুঝলাম যে এই মেসেজ আসলে আর কোন দিনই মিলির কাছে পৌছাবে না।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

অপু তানভীরের নতুন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে থেকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 8

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *