নায়েরার সাথে আমার পরিচয় হওয়ার কথা ছিল না। ভাগ্যের কারণে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। সেদিন যদি ঐ রকমভাবে ঘটনাটা না ঘটত তবে নায়েরা হয়তো কোনোদিন আমার সাথে কথা বলত না। আসলে কথা বলার কোন দরকারও ছিল না। ওর আর আমার পথ একেবারেই আলাদা। আমাদের পথ কোন দিন একে অন্যের সাথে মেশার কোন কথা ছিল না। কিন্তু তারপরেও এক সাথে মিশেছে। কিন্তু যেভাবে আমাদের পথটা একসাথে মিশলো, সেটার পরে যা হল, এই পুরো ব্যাপারটার কোনো ব্যাখ্যা এখনও আমার কাছে নেই।
পরের সপ্তাহটা আমার বেশ উত্তেজনাতেই কাটল।
আমি অনেকভাবে পুরো ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনটাতেই আমার মনকে বুঝ দিতে পারলাম না। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি সেটাও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছি না। এটা কি আসলেই সম্ভব? এই যুগে এসে কেউ অশরীরিতে বিশ্বাস করে? ভুত-প্রেত কি আদৌও আছে? আমি আজ পর্যন্ত এমন কাউকে খুজে পাই নি যে কিনা নিজে মুখে বলেছে যে সে ভুত দেখেছে। সবাই বলে যে আমার মামার বন্ধু কিংবা চাচার বড় ভাই অথচ বউয়ের দাদা শ্বশুরের ছোট বউ ভুত দেখেছে। এমনই হয় সব সময়। সবাই শুনেছেই কেবল! কিন্তু আমার সাথে গতদিন যা হল সেটার ব্যাখ্যা কী?
এমন হতে পারে যে নায়েরার মাঝে কোন মানসিক রোগ আছে। এই কারণে সে মুখ দিয়ে ওমন শব্দ বের করতে পেরেছিল, ওমন ভাবে কথা বলতে পেরেছিল। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে আমি কেন ঐ দৃশ্য দেখতে পেলাম?
এটার ব্যাখ্যা হতে পারে যে পরিবেশটাই এমন ছিল যে আমি অনেক কিছুই ভুলভাল দেখেছি। নায়েরার কথা শুনে আমার মনের ভেতরে কিছু সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে আমার অবচেতন মন আমাকে সেই জিনিস দেখতে সাহায্য করেছে। এই রকম আরও কতই না ব্যাখ্যা আমি দার করানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু নিজের মনকে ঠিকমত আমি বুঝ দিতে পারলাম না। আমি সেদিন রাতে যা দেখেছি তার আমি এর আগে কোন দিন দেখি নি। এটা আমার কাছে একেবারে নতুন। এই অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।
আমি যখন সেই রাতের ঘটনা মন থেকে মুছে ফেলতে শুরু করেছি ঠিক সেই সময়ে ব্যাপারটা আবারও আমার সামনে এসে হাজির হল। এবং নায়েরাই আমার সামনে সেই ব্যাপারটা নিয়ে এল।
অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম তখন নায়েরার ফোন এসে হাজির।
-আপনি কি ফ্রি আছেন?
-অফিস থেকে বের হলাম।
-পার্ফেক্ট। আমি আমার বাসার ঠিকানা টেক্সট করছি। প্লিজ চলে আসুন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। প্লিজ।
আমার একটু অবাক লাগল তবে আপত্তি করার কোন কারণ ছিল না। আমি বাইকটা নিয়ে নায়েরার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। নায়েরা নিজেই দরজা খুলে দিল। ওকে দেখে একটু চমকে উঠলাম আমি। আমার সামনে অভিনেত্রীর সেই চকচকে নায়েরা দাঁড়িয়ে নেই। বরং সাধারণ বাড়ির নায়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর পরনে একটা কালো ঢোলা টিশার্ট আর একটা জিম লেগিংস রয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, সরাসরি অফিস থেকে আসতে বললাম বলে রাগ করেন নি তো?
-না না ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই।
-আচ্ছা আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি ওয়াশরুমে আপনার জন্য তোয়ালে দিয়েছি।
সেদিনের মতই আমি আবারও একটু অবাকই হলাম। আমার সাথে নায়েরার এমন স্বাভাবিক আচরণই আমার বিস্ময়ের কারণ।
ফ্রেশ আসতে না আসতেই দেখলাম টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। ওর বাসার হাউজমেইড খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নায়েরা টেবিলের বসে পড়েছে আগেই। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন আগে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক তারপর কথা শুরু করি।
-আসলে এসবের কোন দরকার ছিল না।
-ছিল। ছিল। ভরা পেটে আলোচনা ভাল হয়। আসুন তো!
আমাদের কথাবার্তা খেতেই শুরু হল। নায়েরা অবশ্য ভাত খেল না। সে আমার পাশে বসে একটা ফলের ঝুড়ি থেকে আপেলের টুকরো আর আঙ্গুর নিয়ে খেটে লাগল। খেতে খেতেই নায়েরা বলল, আসলে আপনাকে কথাটা বলার কারণ হচ্ছে আপনি ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা বুঝবেই না। আমাকে পাগল ভাববে। আমি নিজেও যদি এই একই কথা অন্য কারো মুখ থেকে শুনতাম তবে আমিও একই রকম ভাবতাম।
আমি চিংড়ি মাছের টুকরোটা মুখে দিতে দিতে বললাম, আপনার থিউরিটা কী শুনি?
-হাসবেন না, কথা দিন।
-আমি নিজেও ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি। আমি দেখতে চাচ্ছি যে আপনার সাথে আমারটা মেলে কিনা!
নায়েরা একটা লম্বা দম নিল। তারপর বলতে শুরু করল, আপনাকে তো বলেছি যে ঐ জমিদার বাড়িতে কদিন আগে আমাদের একটা নাটকের শুটিং হয়েছিল। তাই না?
-হ্যা বলেছিলেন।
-আমার বিশ্বাস যে আমরা যখন সেখানে ছিল তখন সেখান থেকে এই অশরীরি আত্মাটা আমার সাথে এসেছে।
-ইউ মিন প্রোজেজ করেছে আপনাকে?
-জ্বী। আমার ধারণা যে মেয়েটাকে ওখানে হত্যা করা হয়েছে এবং ঐ বাড়ির পেছনেই তার লাশ পুঁতে রাখা হয়েছে। তার সেই অতৃপ্ত আত্মা এখন সেই বাড়ির রয়েছে। ছিল। এখন সেটা আমার ভেতরে রয়েছে।
অন্য সময় হলে আমি এমন কথা শুনে হেসেই ফেলতাম। কিন্তু নায়েরা কথাটা এমন ভাবে বলল যে সে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে যে তার ভেতরে এমন কিছু রয়েছে। আমার নিজেরও কেন জানি নায়েরার এই কথা বিশ্বাস করতে মন চাইল।
নায়েরা আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বলল, আমি খোজ খবর নিয়েছি।
আমি এবার একটু অবাক হলাম। খোজ নিয়েছেন বলতে?
-খোজ নিয়েছি মানে হল আমি ঐ বাড়ির মালিককে সে কোথায় থাকে এই সবই খোজ নিয়েছি।
আমি এবার একটু কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। বললাম, খোজ নিয়ে কী জেনেছ?
-ঐ মালিকের নাম আরফান আহমেদ। বেশ বড়লোক পরিবার ছিল। তবে এখন আর তারা বেঁচে নেই। বংশের ভেতরে কেবল এই লোকই জীবিত। এই লোকের ঢাকাতে বেশ বড় ব্যবসা রয়েছে। ফার্নিচারের ব্যবসা। আরোরা ফার্নিচারের নাম শুনেন নাই? ওটার মালিক এই লোক।
এমন একটা বাগান যার রয়েছে সে যে বড়লোক হবে সেটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। আমি নায়েরার দিকে তাকিয়ে বললাম, এরপর আর জানতে পারলে?
নায়েরা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর বলল, আর এই জানতে পারলাম যে তুমি আমাকে আপনি থেকে তুমি বলা শুরু করে দিয়েছো!
আমার মুখে একটা লজ্জার ভাব ফুটে উঠল। সত্যিই আমি কখন যে নায়েরাকে আপনি থেকে তুমি বলা শুরু করেছি সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারি নি। আসলে এমন ঘরোয়া পরিবেশে সে আমার সামনে বসে রয়েছে, এমন ভাবে কথা বলছে যে আমার মনেই হচ্ছে না যে সে দুরের কেউ হতে পারে।
-আমি আসলে সরি! আমি খেয়ালই করি নি!
-ইটস ওকে। কোন সমস্যা নেই। তুমিতেই ঠিক আছি। যে ব্যাপারটা এমন ন্যাচারালি চলে এসেছে সেটা বদলানোর কোন দরকার নেই। যে কথা বলছিলাম সেটা বলি। মজার তথ্য যে পেয়েছি সেটা শুনো।
আমি যেমন ভাবে নায়েরাকে তুমি করে বলছি নায়েরাও আমাকে তুমি করেই বলা শুরু করেছে। এই ব্যাপারটা ভাল লাগল আমার কাছে। সম্পর্কটা যেন আরও একটু কাছে চলে এল।
নায়েরা বলল, আরফান আহমেদের বাসা গুলশানে। তবে সে আগে প্রায়ই তার এই টঙ্গির বাসায় থাকতে যেতেন। খোজ নিয়ে জানা যায় যে বউ ছাড়া আর বেশ কয়েকজন প্রেমিকা ছিল। তাদেরকে নিয়েই সে যেখানে যেত। বউ এসব জানলেও কিছুই বলত না বা বলতে সাহস পেত না। তারপর কী হল কেউ জানে না আরফান একেবারে বদলে গেছে। এই ধর মাস ছয়েক আগে এই পরিবর্তন এসেছে তার ভেতরে। তার আর কোনো বদ অভ্যাস নেই। একেবারে যেন ভাল মানুষ হয়ে গেছে। নিয়মিত নামাজ কালাম পড়তে শুরু করেছে। অথচ আগে তার মদ গাজা আর নারী সহ আরও নানান বদ অভ্যাস ছিল।
আমার খাওয়া শেষ। বেসিংয়ে হাত ধুয়ে এলাম। মেইড আমার জন্য এককাপ কফি এনে রাখল বসার ঘরের টি-টেবিলের উপরে। নায়েরা সোফার উপরে পা তুলে বসেছে ততক্ষণে। আমিও সেই সোফাতেই বসলাম। নায়েরা বলল, তার মানে হচ্ছে এর মাঝে মাস ছয়েক আগে এমন কিছু হয়েছে।
আমি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম, তুমি এতো কিছু কিভাবে জানো শুনি? এতো খোজ খবর কিভাবে নিলে?
-আরে এটা সহজ। তোমাকে তো বলেছি যে কদিন আগে আমাদের একটা নাটকের শুটিং হয়েছিল সেখানে। সেই সময়েই ঐ বাড়ির কেয়ারটেকার আমার সাথে কয়েকটা ছবি তুলেছিল। সে আমার বেশ ভক্ত বলতে পার। তার কাছে গেলাম খোজ খবরের জন্য। সেই লোক আমাকে সব কিছু জানাল।
-আচ্ছা!
-সে আর কী জানিয়েছে জানো?
-সে জানাল যে ঐ বাড়িতে ভুত আছে। সে এই বাড়িতে সন্ধ্যার পরে থাকে না। কেউ থাকে না। থাকতে পারে না। বিশেষ করে মাস পাঁচেক আগে এক কেয়ারটেকারকে এই বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তারপর থেকেই এখানে কেউ থাকে না। বর্তমান কেয়ারটেকার দিনে একবার আসে। ঘরদোর পরিস্কার করে তারপর বিকেলের আগেই চলে যায়।
আমি বুঝতে পারলাম কেন সেদিন রাতে ঐ বাড়িতে কেউ ছিল না। আমি বললাম, তো এখন কী করবে শুনি?
-আমি ঠিক করেছি যে ওখানে গিয়ে রাতে থাকব।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, মানে কী?
-এটাই মানে!
-দেখ, সেদিন আমি কী দেখেছি আমি জানি। আমি জীবনে এতো ভয় পাই নি যতটা সেদিন পেয়েছিলাম। ওখানে কি যাওয়ার সত্যিই দরকার আছে?
-হয়তো নেই তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে যে ওখানে কোনো না কোনো অন্যায় হয়েছে। সব থেকে বড় সে সম্ভবনা সেটা হচ্ছে ঐ বাড়িতে কোনো মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে এবং সেই মেয়ের লাশটা সেখানেই পুঁতে রাখা হয়েছে। প্রতিরাতে আমি মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখছি। মেয়েটা যেন আমার কাছে আঁকুতি জানাচ্ছে। যদিও মেয়েটার চেহারা আমি দেখি নি, কেবল অন্ধকার একটা আবয়ব দেখাচ্ছে তবুও আমি নিশ্চিত যে এই মেয়েটাই আমাকে স্বপ্নে বারবার করে ওখানে যেতে বলছে।
সত্যি বলছি যে অন্য সময় হলে এই কথা শুনে আমি হেসেই দিতাম। কিন্তু সেদিন নিজের চোখে সব কিছু দেখার পরে আমি মোটেই হাসতে পারলাম না। আমার কাছে নায়েরার কথা গুলো অযৌক্তিকও মনে হল না।
আমি বললাম, ওখানে যাওয়াটা বিপদজনক হবে না?
-আমার মনে হয় না। আমার কি মনে হচ্ছে জানো?
-কী?
-আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা আমাদেরকে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিছু জানাতে চাচ্ছে।
আমি একটু হেসে বললাম, তুমি ভুতের মুভি খুব বেশি দেখো। তাই মনে হচ্ছে।
-হাহা ভেরি ফানি। তবে তুমি যাই বল না কেন আমি যাবই। আমি গিয়ে দেখব আসলেও ওখানে কিছু হয় কিনা। আবারও সেই একই ঘটনা ঘটে কিনা।
আমি একটু চিন্তা করলাম। তারপর বলল, চল আমি যাবো তোমার সাথে। আমি জানি না আমি কী দেখব, হয়তো আবারও ভয় পাব তবে তোমাকে একা ছাড়া যাবে না। আমি জানি তুমি ডাকলে আরও অনেকেই চলে আসবে তবুও আমি যেতে চাই।
নায়েরা বলল, আসলে আমি আর কাউকে এই ব্যাপারটাতে জাড়াতে চাচ্ছি না। একবার যদি এই কোন ভাবে মিডিয়া পাড়ায় ছড়িয়ে যায় তবে আমার অবস্থা কী হবে একবার ভেবে দেখেছো? আমাকে নিয়ে কী পরিমান ট্রোল হবে একবার ভাব!
-বুঝতে পারছি। তাহলে কবে যাবে শুনি?
-তোমার ছুটি কবে?
-ছুটি ম্যানেজ করে নিব। সমস্যা নেই।
দুই
আমরা বাইকে করেই আবারো সেই বাড়িটার সামনে এসে হাজির হলাম। এবার অবশ্য দিনের বেলাতেই এসে হাজির হয়েছি আমরা। গতদিনের মত নায়েরা আমার বাইকের পেছনে চড়ে এসেছে। আমাদের সাথে একটা সাইডব্যাগ রয়েছে। নায়েরা বাড়িটার সামনে নামতে নামতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দিনের আলোতে কিন্তু এতোটাও ভয় লাগছে না, তাই না?
-হুম। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে রাত্রে আমাদের খবর আছে!
আমার খবর আছে বলা শুনে নায়েরা হেসে উঠল। সেই সময়েই দেখতে পেলাম যে বাড়ির সেই পাশ রাস্তা দিয়ে একজন লোক বের হয়ে এল। তার মুখে একটা বিস্তৃত হাসি। নায়েরা তার দিকে তাকিয়ে বলল, রমিজ ভাই কেমন আছেন?
-আপনেরা চইলা আসছেন। আসেন আসেন।
রমিজ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল যদিও এই রাস্তা আমরা আগেই চিনি। আমার বাইকটা কোথায় রাখতে হবে সেটা দেখিয়ে দিল। এটা ঠিক বাইক রাখার জায়গা নয়। একটা ছাউনি দেওয়া জায়গা, সেখানে কোদাল শাবলের মত বেশ যন্ত্রপাতি রাখা রয়েছে। আমি সেখানেই বাইকটা রাখলাম। বাইকটা রেখে বের হতে না হতেই দেখলাম ওরা বাড়ির দরজার কাছে পৌছে গেছে। সামনের দিকে দরজাটা বন্ধ দেখেছিলাম। এই পেছন দিক দিয়েও একটা বড় দরজা রয়েছে। সেই দরজাটাই খোলা রয়েছে। আমি দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে হাজির হলাম।
বড় একটা হল ঘরে রমিজ আর নায়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হল আমার কাছে। নায়েরা বলেছিল যে এই বাড়িতে ছয় মাস ধরে আরফান আহমেদ আর আসেন না। আমার মনের কথা যেন রমিজ মিয়া বুঝতে পারল। সে বলল, মালিক আর এই বাড়িত আসে টাসে না। তবে এই বাড়িত নিয়মিত ফিল্মের লুকজন আসে। শুটিং হয়, হেগো লাইগাই সব কিছু চকচকা রাখি। কোন ময়লা নাই সব পরিষ্কার। আপনেগো ঘর উপরে। চলেন দেখায়া দেই।
আমাদের দুজনের জন্য দুইটা ঘর ঠিক করে রাখা হয়েছে।
নায়েরা সব কিছু কিভাবে ম্যানেজ করেছে আমি জানি তবে দেখলাম সব কিছু একেবারে আমাদের হাতের কাছেই এসে হাজির হয়েছে। আমি নায়েরাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে রাতের খাবার জন্য আমরা কিছু কিনে নিয়ে যাবো কিনা ! নায়েরা তখন আমাকে জানাল যে সব ব্যবস্থা সে আগে থেকেই করে রেখেছে। এসব নিয়ে আমাকে একদম চিন্তা করতে হবে না। সত্যিই তাই হল।
সন্ধ্যার কিছু আগেই দেখতে পেলাম যে রমিজ মিয়া একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে এসে হাজির হল। আমরা তখন দো-তলার বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। রমিজ মিয়ার চেহারায় একটা তাড়াহুড়ার ভাব দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি নিচে নেমে আসতেই সে টিকিফিন ক্যারিয়ারটা আমাদের সামনে রাখল। তারপর বলল, এইখানে আপনাগো রাতের খাবার। আমি যাই।
নায়েরা বলল, আপনি সত্যিই থাকবেন না রমিজ ভাই?
-না গো আফা! এইখানে আমার থাকা হইব না। আপনেরা না হইয়া অন্য কেউ হইলে আমি থাকবার দিতাম না। রাতে খাওয়া দাওয়া কইরা জলদি শুইয়া পড়বেন। আওয়াজ শুনলেও দোতলা থেইকা নামবেন না কইলাম। দো-তলায় কিছু হয় না। তয় নিচ তলা আর বাড়ির পেছন দিকে যাইবেন না একদম। দুইটা হ্যারিক্যান আছে। বোতলে কেরোসিনও পাইবেন। আমি যাই!
এই বলেই রমিজ বাইরে যাওয়ার পথ ধরল। আমার কাছে মনে হল রমিজ যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। বিকেলের দিকে আমরা যখন এসেছিলাম তখন রমিজ এই বাড়িটাকে ভয় পাচ্ছিল না কিন্তু এই সন্ধ্যার সময়ে সে এই বাড়িটাকে ভয় পাচ্ছে।
তিন
হ্যারিক্যান জ্বালাতে আমাদের সমস্যা হল না। আমরা আগে খেয়াল করি নি। বাড়ির সীমানার পাশে বেশ একটা বিল রয়েছে। দোতলায় উঠলে সেটা বোঝা যায়। দেয়ালের পাশে কিছুটা গাছপালা থাকায় নিচ থেকে বোঝার উপায় নেই। আমি দুই তলায় বসে যখন গল্প করছিলাম তখন বিলটা চোখে পড়ল। আমরা সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের সময়টা ভাল কাটছিল। নায়েরার কথা জানি না তবে আমার সময় ভাল কাটছিল। আমি নায়েরার মত একজনের সাথে এই নির্জন জমিদার বাড়িতে বসে বসে গল্প করছি। আমার কাছে সব স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে আরও লম্বা সময় বসে বসে গল্প করলাম। নায়েরা তার জীবনের গল্প বলল। কীভাব সেই এই অভিনয়ের জগতে এসেছে এখানে এসে কী কী পেয়েছে আর কী কী হারিয়েছে সব। আমিও আমার ছোট বেলার গল্প করতে লাগলাম। জীবনে প্রেমট্রেম হয় নি শুনে খুব হাসল।
রাত যখন বারোটা বেজে গেল তখনও কিছুই হল না। সব কিছু আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হল। ভয়ের কোন কারণই আমরা খুজে পেলাম না। শেষে হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম দুজন। নায়েরাকে ওর ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। আর বলে এলাম যে যদি রাতে ওয়াশরুমে যেতে হয় তাহলে যেন আমাকে যেন ডাক দেয়। নায়েরা হেসে জানালো যে সে জানাবে। আমি গুডনাইট জানিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলাম। বিছানাতে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সেটা নিজেও জানি না।
ঘুম ভাঙ্গল মাঝ রাতের পরে। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে। নায়েরার ঘরের দরজা খুলেছে। রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে দরজার খোলার আওয়াজটা একটু যেন বেশি জোরে শোনা গেল। আমার ঘুম এমনিতেই বেশ পাতলা। তাই ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে। নায়েরা কি ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। আমি যখন দরজা খুলে বের হয়েছি তখনই আমার চোখ গেল সিড়ির দিকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ যেন সেদিকে এগিয়ে চলেছে। নায়েরা নিচে যাচ্ছে? এতো রাতে?
আমার মাথায় অন্য কিছু আর এল না। আমি দ্রুত সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। কিন্তু নায়েরাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। দরজার কাছে এসে চেক করে দেখি দরজাটা খোলা। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলাম।
আজকের আকাশে চাঁদ আছে, সব কিছু একেবারে পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে। আমি দরজা খুলতেই নায়েরাকে দেখতে পেলাম। সে ঘোর লাগা পায়ে এগিয়ে চলছে। তার হাতের দিকে তাকাতেই আমার শরীর জুড়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। ওর হাতে একটা কোদাল। এটা সে কোথায় পেল? তারপরেই মনে হল যে আমি যেখানে বাইক রেখেছিলাম সেটার পাশেই এমন কিছু যন্ত্রপাতি রাখা ছিল। সেখান থেকেই নিয়েছে নিশ্চিত। আমার কেন জানি নায়েরাকে থামাতে মন চাইলো না। আমার বরং দেখতে মন চাইলো যে সে কোন দিকে যায় আর কী করে। যদিও অনুমান করতে আমার খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। আমি সেদিন যা দেখেছিলাম সেটার অনুমানের ভিত্তিতে বলতে পারি যে নায়েরা কোন দিকে যাচ্ছে।
নায়েরা সেই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে কোদাল চালাতে লাগল। থপথপ আওয়াযে চারিদিকটা একেবারে ছেঁয়ে গেল। আমার কাছে মনে হল যেন রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যাচ্ছে। সবাই এই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। একটু পরে বুঝি পুরো গ্রামের মানুষ এখানে এসে হাজির হবে। আমি মূর্তির মত করে দাড়িয়েই রইলাম।
যখন গর্তটা শেষ হল তখন নায়েরা আমার দিকে ফিরে তাকাল। তার সেই অগ্নিভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা একটু কেঁপে উঠল বটে তবে আমি নিজেকে এই বলে শান্তণা দিলাম যে আমার কোন ক্ষতি সে করবে না। নায়েরা যখন আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল তখন আমার মনে হল যেন ওর শরীর দিয়ে একটা গরম ভাব বের হচ্ছে। আগুনের পাশ দিয়ে গেলে যেমনটা লাগে ঠিক তেমন ! নায়েরার দিকে তাকানোর সাহস আমার হল না। আমাকে পার হয়ে নায়েরা কতদুর গেল আমি জানি না তবে একটু দূরে যেতেই আমি মাটিতে কিছু পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। নায়েরা যে মাটিতে লুঠিয়ে পরেছে সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। আমি ঘুরে নায়েরার কাছে গিয়ে হাজির হলাম।
আমি নায়েরাকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর ওকে নিয়ে হাজির হলাম ওর ঘরে। মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর পরে নায়েরা কিছু সময় আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আমাকে এখানে দেখে সে অবাক হয়েছে। আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে নায়েরার কিছুই মনে নেই। তবে আমার মুখের ভাব দেখেই সে বুঝতে পারল যে কিছু একটা হয়েছে।
-কী হয়েছিল আমার?
আমি ওর শরীরের দিকে ইঙ্গিত করলাম। নায়েরা ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে গেল। ওর হাতে মাটি লেগে রয়েছে। পুরো পোশাকে মাটি লেগে আছে। পায়ে ময়লা। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। নায়েরা কিছু সময় বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো নিজের শরীরের দিকে।
-কী করেছি আমি?
-গর্ত খুড়েছ?
-দেখেছ কী আছে?
-নাহ। দেখার সময় পাই নি। তুমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আর তোমাকে নিয়ে এখানে চলে এলাম।
নায়েরা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, চল আগে দেখে আসি।
আমি নায়েরার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। আমি যদি ওর জায়গায় হতাম তবে কি আমি এমন ভাবে সাহস দেখাতে পারতাম?
একটু পরে আবারও আমরা দুজন দোতলা থেকে নিচে নেমে এলাম। আমাদের দুজনের হাতেই এবার হ্যারিকেন রয়েছে তাই আলোর কোন অভাব নেই। আমরা দুজন এক হাত দিয়ে হ্যারিকেন ধরে রেখেছি আর অন্য হাত দিয়ে একে অন্যের হাত ধরে আছে। আমার বুকের ভেতরে টিমটিম করছে। একটা ভয় লাগছে মনের ভেতরে। বারবার মনে হচ্ছিল যে হয়তো এখনই কেউ আমাদের পেছন থেকে এসে আমাদের ঘার মটকে দিবে অথবা আবারও নায়েরার উপরে সেই অশরীরিটা এসে হাজির হবে!
তবে গর্ত পর্যন্ত আসার পরেও কিছুই হল না। আমরা দুজনেই গর্তের পাড়ে এসে নিচে তাকালাম। নিচে একটা পলিথিনে মোড়া কিছু একটার অস্তিত্ব চোখে পড়ল আমাদের। আমাদের বলে দিতে হল না যে এই পলিথিনের নিচে ঠিক কী রয়েছে!
আমার স্কুল জীবনের এক বিসিএস বন্ধু রয়েছে। পুলিশ অফিসার। সেই রাতের বেলায় তাকে ফোন দিলাম। সব কিছু খুলে বললাম তাকে। যদিও তার পোস্টিং অন্য এলাকাতে তবে সে ঘন্টা খানেকের ভেতরেই ব্যবস্থা করে ফেলল। আমাকে জানাল যে কিছু সময়ের ভেতরেই পুলিশ পৌছে যাবে। আমরা যেন অপেক্ষা করি সেখানে আর কোন ভাবেই যেন পলিথিনের ব্যাগটা না খুলি!
এরপরের ঘটনা দ্রুত ঘটতে লাগল। পুলিশ এসে হাজির হল। পলিথিন ব্যাগটাও খোলা হল। একটা গলিত লাশ পাওয়া গেল সেটার ভেতরে। চেহারা বোঝার কোন উপায় নেই। পুলিশ রমিজকে ধরে নিয়ে গেল। তবে নায়েরা জানাল যে রমিজ এখানে নতুন এসেছে। তার আগে থেকেই সম্ভবত এই লাশটা এখানে আছে। এই বাড়ির মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
পুলিশ যখন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল যে আমরা এইখানে মাটি কেন খুড়লাম তখন আমরা তাদেরকে সত্য কথা বললাম না। নিশ্চয়ই তাদের বলা যাবে না যে এই মেয়ের আত্মা নায়েরার উপরে ভর করেছিল, সেই খুজেড়ে এই জায়গাটা। তার বদলে আমরা বললাম যে একটা শেয়াল এই খানে হাত পা দিয়ে খোড়ার চেষ্টা করছিল। সন্দেহ থেকেই আমরা এটা খোড়া শুরু করি। তারপর এই পলিথিন বের হল। ভেতরে কিছু আছে দেখেই আমি আমার পরিচিত বন্ধুকে ফোন দেই।
মাস খানেক পরে আমার বন্ধুর কাছ থেকে এই ঘটনার আপডেট জানতে পারি। মেয়েটার লাশ কম করে হলেও সাত মাস আগের। মেয়েটার পরিচয় পাওয়া গেছে। সে সাত মাস আগেই গায়েব হয়েছিল এমন মিসিং রিপোর্ট লিখিয়েছিল তার বাবা। সেই হিসাবে রমিজকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে কারণ রমিজ তার পরে এসেছে চাকরি নিয়ে। পুলিশের প্রধান সন্দেহ এখন আরফান আহমেদের উপরেই। তারা খোজ নিয়ে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে আরফান আহমেদ আগে প্রায়ই নারী নিয়ে এই বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। এখন কেবল এই মেয়েটির সাথে আরফান আহমেদের একটা যোগসুত্র খুজে পেলেই হয়ে যাবে। পুলিশ সেই মোতাবেগই কাজ করে যাচ্ছে।
এদিকে নায়েরার সাথে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একসাথে জিমে তো প্রতিদিন আমাদের দেখা হয়ই তাছাড়াও সপ্তাহে একবার আমরা ডিনার করি এক সাথে; ডিনারের পরে বাইকে করে এদিক ওদিক চলে যাই। আমাদের দুজনের সময়ই ভাল কাটে। সেদিনের পরে নায়েরার মাঝে সেই সত্ত্বার উপস্থিতি আমি আর দেখি নি। হয়তো আর দেখবোও না। তাই নয় কি!

