অভিনেত্রী নায়েরা আহমেদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল জিমে। আমি যে জিমে যেতাম সেই একই জিমে নায়েরা আহমেদ ওয়ার্কআউট করত। আমি অফিস যাওয়ার আগে এখানে আসতাম, একেবারে সকালে। এত সকালে সাধারণত মানুষজন কম আসত। আমি ঘণ্টাখানেক সময় দিতাম জিমে। এই সময়েই প্রায়ই আমার নায়েরা আহমেদের সাথে দেখা হত। দেখা হত বলতে আমি তাকে জিমে আসতে দেখতাম। সে কারও দিকে খুব একটা তাকাত না। নিজের মতো আসত আর ওয়ার্কআউট করে চলে যেত। আমাদের জিমে যদিও ছেলে-মেয়ে এক সাথেই জিম করত, তবে মেয়েরা সাধারণত জিমের ডান দিকে থাকত। আমরা থাকতাম বামে। কিছু কিছু জিনিসপত্র ছিল যা আলাদাভাবে রাখা ছিল না। সেগুলোতে ছেলে-মেয়েরা এক সাথেই কাজ করত।
এমনই একটা ঘটনায় নায়েরার সাথে আমার প্রথম কথা বলার সুযোগ হয়। সেদিন আমি যখন জিমে এসে হাজির হলাম, তখন কেউ আসে নি। এমনকি আমাদের জিম ট্রেইনার পর্যন্ত আসে নি। আমি আসার কয়েক মিনিট পরেই দেখলাম নায়েরা ঢুকল।
জিম পোশাক বদলে নিয়ে ওয়ার্কআউট শুরু করল। তবে আজকে অন্য কিছু না করে সবার আগে সে গেল হেভিওয়েট লিফটিংয়ের দিকে। এই ওয়েট লিফটিং সেকশনটা আলাদা নয়। এখানে ছেলে-মেয়েদের এক সাথেই জিম করতে হয়।
আমি অবশ্য কেবল নিজের ট্রেডমিলের উপরেই ছিলাম। আমি জিমে খুব বেশি কিছু করি না। লম্বা সময় ধরে দৌড়াই, কিছু পুশআপ করি, এই যা। আজকেও তাই করছিলাম, কিন্তু আমার চোখ ছিল নায়েরার উপরে। একজনের মনিটরিং ছাড়া সাধারণত এই হেভিওয়েট লিফটিং কেউ করে না। এখনও জিমে কেউ আসে নি, অথচ নায়েরা একা একাই সেদিকে যাচ্ছে।
কত কেজি নিল সেটা আমি খেয়াল করতে পারলাম না, তবে বেশ ভালোই নিল। আমার মনে একটা কু ডেকে উঠল। এবং সত্যিই হলও তাই। যখন সে ওয়েটটা ঘাড়ের উপরে তুলেছে, তখনই মনে হল নায়েরার পা দুটো একটু টলে উঠল। সে যেন এখনই পড়ে যাবে এমন মনে হল আমার কাছে।
আমি কয়েক মুহূর্ত কেবল ভাবলাম। তারপর এক লাফে ট্রেডমিল থেকে নেমে নায়েরার পেছনে গিয়ে ওয়েটটা ধরে ফেললাম। আরেকটু দেরি হলে অবশ্য দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। আমি ওয়েটটা মাটিতে নামাতে সাহায্য করলাম। নায়েরা আমার দিকে প্রথমে তাকাল না। তবে একটু পরে নিজেকে ধাতস্থ করে তারপর আমার দিকে তাকাল। বলল, “আসলে বুঝতে পারিনি এমন হয়ে যাবে। মাথার ভেতরে কেমন যেন করে উঠল। এমন তো সাধারণত হয় না।”
“বেশি ওয়েট নিলে এমন হতে পারে! এই জন্য একজনকে সামনে রাখা উচিত সব সময়।”
“হ্যাঁ। সরি। আসলে এমনটা করা ঠিক হয়নি। আপনি না থাকলে কী যে হত!”
নায়েরা আর বেশি সময় থাকল না। আমি আবার নিজের কাজে মন দিলাম। তারপরের দুইদিন নায়েরা জিমে এল না। তিন দিনের দিন আবারও এসে হাজির। তবে আমার সাথে আগের মতোই আচরণ করল। দেখে মনে হল যে আমাদের যেন কোনো দিন কথাই হয় নি। অবশ্য আমিও ভেবেছিলাম যে এমন কিছুই হবে। এটা ছাড়া আর কিছু হওয়ার কথাও না। তবে মনের ভেতরে একটা আশা ছিল যে কথা না বলুক, আমার দিকে তাকিয়ে সে একটু হাত নাড়বে বা একটু হেসে ‘হ্যালো’ বলবে। যাই হোক, আমি সেদিকে আর বেশি মন দিলাম না। জিম শেষ করে চেঞ্জিং রুমের দিকে গিয়ে হাজির হলাম। ফ্রেশ হয়ে যখন গেট দিয়ে বের হয়ে এলাম, তখন একটু অবাক হলাম। ঠিক দরজার বাইরে নায়েরা দাঁড়িয়ে আছে। আমার কেন জানি মনে হল যে নায়েরা আমার জন্যই অপেক্ষা করছে।
আমার দিকে একটু হেসে নায়েরা বলল, “গতদিন আপনাকে ঠিক মতো ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। আসলে আমি নিজেও একটু শকে ছিলাম তাই।”
আমি দ্রুত হেসে বললাম, “আরে কোনো দরকার নেই। আমি বাদে অন্য যে কেউ থাকলে এই একই কাজ করত!”
নায়েরা বলল, “আপনাকে একটা ট্রিট দিতে চাই। কফি ট্রিট!”
আমার এখন বলা উচিত যে, “আরে না না, কী যে বলেন, এসবের কী দরকার আছে!” তবে আমি এসব কিছুই বললাম না। নায়েরার মতো কেউ যখন আপনাকে কফি ট্রিট দিতে চায়, তখন আপনি কেন মানা করবেন? আপনি মানা করতে পারবেন না আসলে! আমিও পারলাম না। নায়েরা আবার বলল, “আপনার সময় কখন থাকে বলুন।”
“ছুটির দিনে যেকোনো সময় আর অফিস আওয়ার বাদ দিয়ে।”
“ছুটির দিনে আসলে একটু টাফ সময় বের করা। শুটিং ছাড়াও নানান কাজ থাকে। তবে অফিস আওয়ারের পরে সম্ভব। আপনার নম্বরটা আমাকে দিন তো!”
এই বলে সে নিজের ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি ফোনটাতে নিজের নম্বর সেভ করে দিলাম। নায়েরা এবার হেসে বলল, “আমি আপনাকে নক করব। কেমন! আজকে আসি!”
নায়েরা আমাকে সেখানে রেখেই চলে গেল। আমার মনের ভেতরে একটা আলাদা আনন্দ এসে ভর করল। দেশের নামকরা একজন মডেল এবং অভিনেত্রী আমাকে কফি ট্রিট দিতে চলেছে। ব্যাপারটা আনন্দেরই বটে।
তবে সেদিনই নায়েরার কাছ থেকে ফোন এল না। ফোনটা এল আরও সপ্তাহখানেক পরে। সে জানাল যে সোমবার তার শুটিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হবে। তারপরেই সে আমাকে রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিল। এখানেই টেবিল বুক করা থাকবে। তবে কফি ডেট না, মূলত সে ডিনার করতে চাচ্ছে।
নির্দিষ্ট সময়ে আমি ঠিক হাজির হয়ে গেলাম। নায়েরা জানিয়েছিল সে আটটার ভেতরে চলে আসবে, তবে একটু দেরি হল আসতে। অবশ্য আমার তাতে খুব বেশি সমস্যা ছিল না। যদিও নায়েরা বারবার আমাকে সরি বলতে লাগল। ব্যাপার প্রথমে একটু ভালো লাগলেও, পরে আমার কাছে কেন জানি পুরো ব্যাপারটার ভেতরে একটা মেকি ভাব রয়েছে বলে মনে হল। এমনটা কেন মনে হল সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে মনে হল। সব থেকে আমি অবাক হলাম যখন সে নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমার বাইকের পেছনে চড়ে বসল। আমার আসলে কেমন লাগছিল সেটা আমি বলতে পারব না। নায়েরা এমন ভাবে আমার বাইকের পেছনে চড়ে বসল যেন সে আমার প্রেমিকা টাইপ কিছু। মুখে একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নিয়েছে, যাতে করে মানুষজন তাকে ঠিক চিনতে না পারে। আমি বাইক চালিয়ে দিলাম।
“আপনাকে কোথায় নামিয়ে দিব?”
“এখনই তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন?”
“আরে ছি ছি, কী যে বলেন। তাড়িয়ে দিতে চাইব কেন?”
“তাহলে একটু বেহিসেবি চলুন! জীবন বড্ড হিসেবি হয়ে গেছে আমার। সিডিউলের বাইরে যেন কিছুই করার উপায়ই নেই। সব কিছু বাধা ধরা নিয়ম। আমি খানিকটা ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না। আমার মনের ভেতরে একটু অস্বস্তি যে কাজ করছিল না, আমি বলব না, তবে নায়েরার মতো একজনের সাথে এভাবে রাতের বেলা বাইকে করে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা অন্য রকম একটা ব্যাপার।
একটু পরেই নায়েরা আমাকে উত্তর দিকে বাইক নিয়ে যেতে বলল। জানালো যে এই সময়ে ঐদিকটা কিছুটা ফাঁকা পাওয়া যাবে আশা করি। আমারও তাই মনে হল।
আমরা কত সময় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম বাইকে করে।
রাত প্রায় বারোটা যখন বাজে, তখন আমি আমার বাইক থামালাম। ঠিক থামালাম বললে ভুল হবে, নায়েরা আমাকে রাস্তার পাশেই বাইকটা থামাতে বলল। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম জায়গাটা একদমই নির্জন। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম এখানেই থামাবো কিনা!
নায়েরা বলল, “এই একটু সামনেই একটা কাঁচা রাস্তা পাবেন। ওটার ভেতরে যান।”
“আপনি জায়গাটা চিনেন?”
“হ্যাঁ। এটা আমাদের শুটিংয়ের একটা স্পট বলতে পারেন। এইখানে একটা পুরানো জমিদারবাড়ি আছে। কদিন আগেই এখানে আমরা শুটিং করেছি।”
আমি আর বেশি কথা না বলে নায়েরার কথা মতোই সেই পথটা খুঁজতে লাগলাম এবং সত্যিই কিছুদূর যাওয়ার পরে মূল রাস্তার পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা আমি দেখতে পেলাম। এই নির্জন রাস্তা আমার কাছে সত্যিই খুব ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল। এত রাতে আমি এমন জায়গাতে এর আগে কোনো দিন আসিনি। বাইক দিয়ে মাঝে মধ্যে আমি এদিক ওদিক যাই সত্যি, তবে এমন নির্জন স্থানে এর আগে আসিনি। আমার মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি কাজ করা শুরু করল। কেন এমন হচ্ছিল আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
আরও মিনিট দশেক চলার পরে সত্যি সত্যি আমি সেই পুরানো জমিদারবাড়িটা দেখতে পেলাম। তার মানে নায়েরা সত্যি কথা বলছিল।
বাইক থেকে নামলাম। আমি জমিদার বাড়িটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। আমার বাইকের আলোটা তখনও আমি বন্ধ করিনি। সেই আলো পুরোটা জমিদার বাড়িটার উপরে গিয়ে পড়েছে। পরিবেশটা আরও একটু যেন ভুতুড়ে মনে হল। তবে বাড়িটাকে আমার মোটেই পরিত্যক্ত মনে হল না। বেশ পরিপাটি, পরিষ্কার পরিছন্নই মনে হল। আমি নায়েরার কাছে জানতেই চাইব যে এইখানে কেউ থাকে কিনা, তার আগেই পেছন থেকে নায়েরা বলে উঠল, “এই জমিদার বাড়ির একটা গল্প আছে জানেন?”
আমি বললাম, “এটার আবার গল্প আছে নাকি?”
“হুম, আছে। শুনবেন?”
“বলুন। তার আগে বলুন এই বাড়িটা কত পুরানো? বেশ নতুনই মনে হচ্ছে।”
“এটার বয়স প্রায় একশ বছর। জমিদারি বিলুপ্তির পরেও তার বংশধরেরা এখানে বসবাস করেছে। এখন এটা তাদের বাগানবাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।”
“আচ্ছা। তার মানে এখনও নিয়মিতভাবে এখানে লোকজন আসে?”
“এখন আর ঠিক ওভাবে কেউ আসে না। এইটা এখন শুটিংয়ের জন্য বেশিরভাগ সময়ে ভাড়া দেওয়া হয়।”
আমি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশ চমৎকার একটা বাড়ি বলতেই হবে। এমন একটা বাড়ি যদি আমার থাকত, তবে আমি নিয়মিতই এখানে আসতাম।
নায়েরা আমার মনের কথাই যেন বুঝে ফেলল। সে বলল, “ওরা এখন আর এখানে থাকতে পারে না। বিশেষ করে ঐ ঘটনার পর থেকে ওরা আর এখানে আসে টাসে না।”
আমি এবার কৌতুহলী হয়ে তাকালাম নায়েরার দিকে। বাইকের পেছনে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই আলো তার উপরে পড়ছে না। বাইকের ব্যাকলাইটের লাল আলোতে ওর চেহারাটা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে একভাবে তাকিয়ে আছে জমিদার বাড়িটার দিকে। আমার কাছে নায়েরার এই চেহারাটা একেবারেই অন্য রকম মনে হল। কেমন যেন আগুন জ্বলছে সেখানে। আমার মনে সেই অস্বস্তিটা আবারও ফিরে এল। নায়েরাকে আমার অন্য রকম মনে হল। একটু আগেও নায়েরার ভেতরে যে মোলায়েম ভাবটা ছিল, এখন যেন সেটা আর নেই, বরং সেখানে একটা অন্য রকম কিছু রয়েছে। আমি সেটা ঠিক ধরতে পারছি না। আমার মন বলছে যে কিছু একটা এখানে ঠিক নেই। নায়েরা একভাবে বিল্ডিং বাড়ির দিকেই তাকিয়েই রয়েছে। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে।
আমি লেখাটির বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধ করে দিচ্ছি, যে শব্দগুলো শুদ্ধ করা হলো তা বোল্ড করে দেওয়া হলো:
আমি জানতে চাইলাম, সেই ঘটনা বলতে কোন ঘটনা?
নায়েরা আমার দিকে ফিরে তাকাল না। সে তাকিয়ে রয়েছে বাড়িটার দিকে। সে বাড়ির দিকে তাকিয়েই বলল, “ওরা মেয়েটাকে মেরে ফেলেছিল। তারপর এই বাড়ির পেছনেই পুঁতে দিয়েছে।”
আমি বিস্মিত চোখে নায়েরার দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল। নায়েরা কী বলছে? কে কাকে মেরে ফেলেছে! নায়েরা কিভাবে জানল এসব?
আমি কিছু বলতে চাইলাম বটে, তবে কেন জানি আমার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না। দেখতে পেলাম যে নায়েরা আস্তে আস্তে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। আমিও কেন জানি নায়েরার পিছু পিছু যেতে লাগলাম। নায়েরা আর কোনো কথা বলল না। সে এগিয়েই যেতে লাগল।
আমিও নায়েরার পেছনে পেছনে নিরবে যেতে লাগলাম। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথায় কিছুই ঢুকল না। নায়েরা বলেছিল যে কদিন আগে তারা এখানে শুটিং করে গেছে। কিন্তু এখন এভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়া কি ঠিক হবে? তবে আমি নিজেকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আমি নায়েরার পেছন পেছনে যেতে থাকলাম।
তবে নায়েরা বাড়ির ভেতরে ঢুকল না। সে বাড়ির পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা একটা পথ দিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেল। আমিও ঠিক তেমন ভাবে নায়েরার পেছন পেছন এসে বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির সামনে আমার বাইকের আলোতে আলোকিত ছিল, কিন্তু এইখানে কোনো আলো নেই। চারিদিকে অন্ধকার। তবে আকাশে চাঁদ আছে। একেবারে অন্ধকার নয়। কিছু সময় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকার পরেই আমার চোখে অন্ধকার সয়ে এল। এবং আমি কিছুটা দেখতে পেতে শুরু করলাম। তখনই নায়েরা আমাকে হাতে ইশারায় সামনের দিকে তাকাতে বলল। আমি নায়েরার দেখানো দিকে তাকালাম। তখনই আমি দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। বাড়ির পেছনে কেউ রয়েছে। আমি চোখ কচলে আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। দেখতে পাচ্ছি একজন মানুষ কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। সেই থপথপ আওয়াজ হচ্ছে। আমি সেদিকে একভাবে তাকিয়ে রইলাম। আমার কাছে মনে হল যে এইখানে একটা ভয়ংকর কাজ হয়েছে। লোকটা অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে একভাবেই সে মাটি খুঁড়েই চলেছে। আমার তখনই একটু আগে বলা নায়েরার কথা মনে পড়ল। সে বলেছিল যে কাউকে এখানে পুঁতে ফেলা হয়েছে।
আমি চোখ বড় বড় করে কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। এক সময়ে মাটি খোঁড়া শেষ হল। তারপরই আমি দেখতে পেলাম লোকটা একটু হেঁটে দূরে গেল। তারপর কিছু একটা কাঁধে তুলে নিল। আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে লোকটা একটা মানুষকে কাঁধে তুলে নিল। আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে সেটা একটা মৃতদেহ। একটা মেয়ের মৃতদেহ!
আমি যেন একেবারে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমি কেবল নিসাড় দেহের মতো সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
ঠিক এই সময়ে নায়েরাকে আমি দেখতে পেলাম। নায়েরার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার আত্মা যেন উড়ে গেল। সেখানে সত্যি সত্যিই যেন আগুন জ্বলছে। এটা যে নায়েরা নয়, সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না। কোনো ভাবেই এটা কোনো মানুষ হতে পারে না! আমি জীবনে এমন কিছু প্রত্যক্ষ করিনি। এমন কিছুতে এতোদিন আমার বিশ্বাসও ছিল না। কিন্তু এই অলৌকিক ব্যাপারটা যে আমার সাথে ঘটছে, সেটা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হল না।
তারপরই আমি নায়েরার সেই ভয়ংকর কণ্ঠস্বর আমার কানে এল। মনে হল যেন দুজন মানুষ এক সাথে কথা বলছে। তীব্র একটা কষ্ট বেরিয়ে এসেছে সেই কণ্ঠে।
“এইখানে ওরা আমার মেরে পুঁতে রেখেছে। এই খানেই!!”
নায়েরা তখনও হাতের ইশারা সেই একই দিকে আছে।
নায়েরা বা অন্য কিছু যাই হোক না কেন, এই কণ্ঠটা এতো ভয়ংকর ছিল যে আমি এটা মোটেই সহ্য করতে পারলাম না। হঠাৎ করে এতো উত্তেজনা আমার সহ্য হল না। আমার মনে হল যেন আমার মাথাটা ঘুরে উঠল কেবল। আমি আর মোটেই সেখানে দাঁড়াতে সাহস পেলাম না। কিভাবে যে আমি পেছন ঘুরে দৌড়ে নিজের বাইকের কাছে এলাম সেটা আমি বলতে পারব না। তারপর বাইক দিয়ে সোজা মূল রাস্তার দিকে এগিয়ে চললাম। আমার আর কিছুই মনে রইল না। আমার কেবল মনে হতে লাগল যে আমাকে এখান থেকে পালিয়ে যেতেই হবে।
কত সময় আমি বাইক চালিয়েছিলাম সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে যখন আমি প্রায় ঢাকার কাছে চলে এসেছি, তখন আমার মাথাটা একটু শান্ত হল। তখন আমার মনে হল যে নায়েরা মেয়েটা তখনও সেখানেই রয়েছে। আমি নিজেকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার এখন সেদিকে যাওয়ার কোনো মানে নেই। সেখানে যাওয়া মানেই বিপদ। তবে নিজের মনকে আমি বোঝাতে পারলাম না। আমি আবারও বাইক ঘুরিয়ে সেই দিকেই রওয়ানা দিলাম।
আমি আবার যখন সেই জমিদার বাড়িটার সামনে গিয়ে হাজির হলাম, তখন ভোরের আজান দিয়ে দিয়েছে। আজান শুনেই কেন জানি আমার বুকের ভেতরে একটা বল এল। আমার মনে হল যে এবার আমার ভয় নেই। আমি যখন আবার বাড়িটার পেছনে গিয়ে হাজির হলাম, তখন দেখলাম নায়েরা মাটিতে পড়ে আছে। একটু ভয় হল। তবে কাছে গিয়ে নাকের কাছে আঙুল ধরতেই বুঝতে পারলাম যে নায়েরা কেবল জ্ঞান হারিয়েছে। আমি ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকালাম। সেই দূরের জায়গাটার দিকে তাকালাম। সব কিছু আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হল।
নায়েরার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সকাল হয়ে গেছে। চোখ পিটপিট করে চারিদিকটা দেখার চেষ্টা করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। আমাকে চেনার চেষ্টা করল কিছুটা সময়।
“আমার কী হয়েছিল?”
“আপনার মনে নেই?”
“ঠিক মনে নেই। আপনার সাথে আমি বাইকে উঠেছিলাম। কিন্তু কেন উঠেছিলাম সেটা আমি বুঝতে পারছি না, মনে পড়ছে না।”
আমার সাথে বাইকে ওঠার পর থেকে যা যা হয়েছে সব তাকে খুলে বললাম। আমার মনে একটা সন্দেহ ছিল যে নায়েরা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তবে আমাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই সে বলল যে কদিন থেকেই সে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছে। বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে গলা টিপে মেরে ফেলছে; তারপর মাটিতে পুঁতে রাখছে। এতো বাস্তব যে স্বপ্ন বলে মনে হয় না।
নায়েরা আবারও আমার বাইকে উঠে বসল। ওকে যখন ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিলাম, তখন বেশ সকাল হয়ে গেছে। রাস্তায় ব্যস্ততা বেড়েছে অনেক। গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে নায়েরা আমাকে বলল, “আবার ফিরে আসার জন্য ধন্যবাদ।”
“আমার চলে যাওয়াই উচিত হয় নি। এই জন্য আমি সরি।”
“ইটস ওকে। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমরা এই ব্যাপারে পরে কথা বলব।”
আমি বাইক নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। আমি খুব ভালো করেই জানি যে নায়েরার সাথে আমার আবারও দেখা হবে এবং আমাদের আবার সেই জমিদার বাড়িতে যেতে হবে। সেখানে কোনো না কোনো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।

