পাহাড়ে ঘুরতে আমার সব সময়ই ভাল লাগে। প্রথম প্রথম যখন পাহাড়ে আসতাম তখন মূলত কোন গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে যেতাম। কিন্তু এতোবার এখানে আসা হয়েছে যে এখন আর গ্রুপের সাথে করে নয়, বরং একা একাই আসতে ইচ্ছে করে। পাহাড়কে নিজের মত করে উপভোগ করতে ইচ্ছে করে। ট্যুর গ্রুপের সাথে ভ্রমনে গেলে সময়ের একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। সেই সাথে নির্দিষ্ট একটা রুট ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া হয় না। তাই এখন আমি প্রায়ই একা একা বের হয়ে প্রি ট্যুরে। আমার বেশ কয়েকজন গাইডের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে গ্রুপের সাথে যাওয়ার কারণে। তাদের কাউকে নিয়ে আমি পাহাড়ে কয়েক দিনের জন্য হারিয়ে যাই। সত্যি বলতে এই সময়টা আমার কাছে একেবারেই অন্য রকম লাগে। মনে হয় যেন আমি অন্য কোন জগতে আছি।
আমার পাহাড় জয়ের খুব একটা ইচ্ছে নেই। অনেকে আছে পাহাড়ে চড়ে কোন চুড়া জয়ের জন্য। সেখানে গিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দেওয়াই থাকে তাদের আসল উদ্দেশ্য। আমার এসবের কোন ইচ্ছে কোন কালেই ছিল না। হ্যা এটা সত্য যে প্রথম প্রথম আমার ভেতরেও এই লোক দেখানো ব্যাপারগুলো ছিল কিন্তু কয়েকবার আমি যখন পাহাড়ে গিয়ে হাজির হলাম তখন আসলে বুঝতে পারলাম যে পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য্য। তারপর থেকে আমার কিছু জয়ের উদ্দেশ্য ছিল না। আমার কেবল এই পাহাড়ের ভেতরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। আমার কেবল এই পাহাড়ি পথে হাটতেই ভালা লাগত, পাহাড়ি ঝর্নাতে গোসল কিংবা জুম ঘরে রাতে শান্তির ঘুম, এসবের প্রতিই আমার আগ্রহ বাড়তে লাগল। সেই হিসাবে আমার আর ট্যুর গ্রুপগুলোর সাথে পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করত না। আমি চেষ্টা করতাম যেন কিভাবে একা কিংবা আমার দুই একজনের সাথে পাহাড়ে যাওয়া যায়।
এইবারও সেই হিসাবেই পাহাড়ে এসে হাজির হয়েছি। তবে এইবার একটু বিপদে পড়তে হল যখন পছন্দের মত কোনো গাইড খুজে পেলাম না। এখন আসলে পিক সিজন। তাই সবাই কোনো না কোন গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। আমি যখন এদিক ওদিক মানুষ খুজছি ভেতরে যাওয়ার জন্য তখন একজন আমার কাছে এসে হাজির হল।
আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ছেলেটার বয়স বেশি হবে না। আমার থেকে ছোটই হবে। চেহারা একটা সপ্রতিভ ভাব রয়েছে। আমি যেখানে যাবো তার একটা মোটামুটি আইডিয়া দিলাম। সে জানাল যে সে গাইড ঠিক না। তবে আমি যেখানে যাবো তার কাছেই তার বাড়ি। আমি চাইলে তার পাড়াতে গিয়ে থাকতে পারি। শহরে এসেছিল সে জিনিসপত্র কেনাকাটার জন্য। আমি তার হাতে ব্যাগ দেখতে পেলাম। আমি বললাম, সাথে না হয় আমি গেলাম কিন্তু ফিরে আসব কিভাবে?
সে হেসে বলল, প্রতি তিন চার দিন পরপরই কেউ না কেউ পাড়া থেকে দিকে আসে। তাদের কারো সাথে চলে আসবেন।
-তোমাদের পাড়ার নাম কী?
-ছইমুং পাড়া!
আমি এমন কোন পাড়ার নাম শুনেছি বলে মনে পড়ল না। সে আমার চেহারার ভাব ধরতে পারল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের পাড়াতে মানুষজন ঠিক যায় না।
-তাই নাকি?
-হ্যা। একেবারে সীমান্ত ঘেঁষে পাড়া।
আমি একটু ভেবে দেখলাম। ব্যাপারটা একেবারে মন্দ হয় না। আমি এইভাবে পাড়াতেও থেকেছি অনেক। এইবারও না হয় সেভাবেই থাকা যাক। আমি আর কোন চিন্তা না করে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। ছেলেটা আমাকে তার নাম বলল নইরং।
আলিকদম থেকে যখন আমি আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি করতে চাইলাম তখন নইরং আমাকে সেটা করতে মানা করল। বলল, আপনি একা যাচ্ছেন বললেন কিন্তু আপনাকে আর যেতে দিবে না।
-আরে আমি বলব যে মাঘের মুখ যাব।
-না ভাউ দরকার নেই। নানান রকম প্রশ্ন করবে। আপনি আমার সাথে আসেন। আমি পথ দেখাচ্ছি।
-এখানে নাম লিখিয়েই যাই। আমি আগেও গেছি তো।
-আমি তো লিস্টেড গাইড না ভাই। আমাকে যেতে দিবে না আপনার সাথে।
আর্মিক্যাম্প লুকিয়ে আমি এর আগেও গিয়েছি। এমন অনেক জায়গাই আছে যেখানে যাওয়ার কোন অনুমতি নেই। তখন সেখানে পালিয়েই গিয়েছি। তবে শুরুর কয়েকটা আর্মিক্যাম্পে ঠিকই আমাদের এন্ট্রি হয়েছে। ক্যাম্পে নাম লেখানোর সুবিধা হচ্ছে যদি কোন অঘটন ঘটেই যায় তবে আর্মি আমাদের খুজে বের করতে পারে। ক্যাম্পে আমাদের গাইডের নামও যুক্ত থাকে। তাই আমাদের সাথে কোন গাইড ছিল সেই ব্যাপারে খোজ পাওয়া সহজ হয়। তবে নইরংয়ের যুক্তিটাও বুঝতে পারলাম। যদি লিস্টেড গাইড না হয় তবে সম্ভবনা আছে যে আমার সাথে ওকে যেতে দিবে না। অন্য কাউকে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি যেখানে যাবো বলে ঠিক করেছি সেখানে যাওয়া হবে না।
মনের ভেতরে একটু খুঁতখুঁত করতে লাগল। তবে শেষ পর্যন্ত আমি নইরংয়ের কথাই মেনে নিলাম। নয়তো সত্যিই দেখা যাবে আমার যাওয়া হবে না। আমাদের যাত্রা শুরু আগে নইরংয়ের পরামর্শ বেশ কিছু খাবার জিনিস কিনে নিলাম। সামনের দুইদিন আমরা কোন পাড়াতে যাবো না বা থাকব না। আমার সাথে তাবু রয়েছে। এই দুইদিন রান্না বান্না আর খাওয়া দাওয়া সব পাহাড়েই হবে। নইরং জানাল যে কয়েকটা জুমঘর পড়বে। সেখানে রান্না করার জিনিসপত্র আছে। আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারব।
আমাদের যাত্রা শুরু হল।
আমার পাহাড় ভ্রমনের এই হাটাহাটির ব্যাপারটাই আমার সব থেকে বেশি পছন্দ। আমি এই হাটাহাটিকেই সব থেকে বেশি উপভোগ করি। এই পাহাড়ি রাস্তায় হাটার সময় যে শান্তিটা আমি অনুভব করি তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। নির্জন শান্ত পরিবেশের ভেতর দিয়ে হেটে চলতে মনের ভেতরে একটা প্রশান্তি কাজ করে। এটা সত্য যে হাটতে বেশ পরিশ্রমও হয় তবে শান্তির পরিমানটাই আমার কাছে বেশি মনে হয়।
হাটার পথে আমাদের দুইটা গ্রুপের সাথে দেখা হল। তাদের ভেতরে জানতে চাইল যে আমি কোন দিকে যাচ্ছি। আমি একা যাচ্ছি আর আমার কোনো গন্তব্য ঠিক নেই জেনে ওরা অবাকই হল। কয়েকজন পাহাড়িদের সাথে দেখা হল। সাধারণত এমন হয় যাওয়া আসার পরে যখন পাহাড়িদের সাথে দেখা হয় তখন তারা আমাদের গাইডদের সাথে কথা বার্তা বলে তবে আমি দেখলাম যে নইরংয়ের সাথে ওরা কোন কথা বলল না। আমার চোখের ভুল হতে পারে তবে আমার কাছে মনে হল যেন ওরা নইরংকে কেমন যেন এড়িয়ে গেল। আমার দিকে তাকাল ঠিকই তবে নইরংকে যেন ওরা দেখেই নি এমন একটা ভাব করেই আমাদের পার হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমি অবশ্য আমলে নিলাম না। মনে হল যে আমার হয়তো কোন ভাবে ভুল হচ্ছে। আমি হয়তো দেখতে ভুল করেছি।
দুপুরে আমরা এক জায়গা বসে সাথে করে নিয়ে আসা শুকনো খাবার খেয়ে নিলাম। দীর্ঘ হাটাহাটির সময়ে দুপুরে এই শুকনো খাবারই খাওয়া হয়। একেবারে যখন সন্ধ্যা নামল তখন আমরা একটা জুম ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। জুমঘরটা আমার কাছে বেশ নতুনই অনে হল। মনে হল যে সদ্যই এটা বানানো হয়েছে। আমি জুমঘরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিপাশটা দেখতে লাগলাম। একটু দুরে বোনা জুমের ফসলগুলো চিনতে আমার কষ্ট হল না। যদি এইবারই এই জুমে প্রথম ফসল বোনা হয় তবে আশা করা যায় আগামী তিন বছর এখানে চাষ চলবে। এই ঘরটাও ততদিন টিকে থাকবে।
পাহাড়ে রাত নামে খুব জলদি। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সাথে ঝুপ করে একেবারে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসে। এখানেও তাই হল। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। সব কিছু অন্ধকার হয়ে এল। আমি আরো কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর জুমের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। নইরং রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রান্নার জন্য খুব বেশি কিছু নেই। ডিম ভাজি, আলু ভর্তা আর সাদা ভাত। রান্না চড়িয়ে দিতে দিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ঘরটা ফাঁকা পাওয়া গেছে। আমি তো ভাবছিলাম আরও কেউ না কেউ আইসা থাকবে এইখানে। আইজা আর কেউ আইবো না আশা করি। ভালই হইলো!
আমিও মনে মনে খুশি হলাম। যদিও একই জুম ঘরে একাধিক গ্রুপ নিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। পাহাড়ে আসলে এসব ব্যাপার নিয়ে নাক সিটকানো চলে না। এসব মেনে নিয়েই পাহাড়ে আসতে হয়। আমি প্রথমবার যখন পাহাড়ি পাড়ায় ছিলাম তখন একই ঘরে সবার শোয়াটা আমার ঠিক পছন্দ হয় নি কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে এই গহীন পাহাড়ে যে শোয়ার জন্য জায়গা পাচ্ছি এইটাই তো অনেক বড় ব্যাপার।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুজনই ঘুমিয়ে পড়লাম। সাথে তাবু ছিল ঠিক কিন্তু সেটা টাঙ্গানোর কোন দরকার পড়ল না। রাতের ঘুমের ভেতরেই অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম আমি। দেখলাম যে আমি শুয়ে রয়েছি আর আমার চারিপাশ দিয়ে কোন ছায়া যেন ঘুরছে। আর এই ছায়াটা কোন মেয়ের ছায়া। আমার কেন ঠিক মেয়ের ছায়া মনে হল সেটা আমি নিজেও জানি না। মাঝ রাতের দিকে যখন ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন সত্যিই মনে হল যেন ঘরের ভেতরে আমি আর নইরং ছাড়াও আরও কেউ রয়েছে। জুমঘরে যতই সাবধানে কেউ পা ফেলার চেষ্টা করুক না কেন আওয়াজ একটু হবেই ঠিক তেমন আওয়াজ হচ্ছে।
কোন চোর এল নাকি?
আমি আমার ব্যাগের অস্তিত্ব অনুভব করলাম আমার শরীরের সাথেই। এছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের কাছে যা চুরি হতে পারে! অবশ্য পাহাড়ে এমন কিছু হয়েছে বলে কখনো শুনি নি। পাহাড়ি পাড়াগুলোতে ঘরের দরজায় হুড়কো লাগানো থাকে না বললেই চলে। কোন কোন ঘরে তো ঠিক মত দরজাই থাকে না। একটা বাঁশের বেড়া অথবা পর্দা দেওয়া থাকে। জুম ঘরে কোন দরজা থাকে না। আমার মাথার কাছেই একটা ছোট টর্চ ছিল। আমি সেটার সুইট টিপে দিলাম। পুরোঘর ফাঁকা! কেউ নেই কোথাও। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না যে আমি ভুল করেছি। ঘরে কেউ ছিল না। আমি ঘুমের ঘরেই ভুল কিছু দেখেছি। সম্ভবত স্বপ্ন দেখার কারণেই এমনটা মনে হয়েছে। আমি আর কিছু চিন্তা না করে শুয়ে পড়লাম।
সকালে আবারও আমাদের চলাচল শুরু হল। আজকে চলতে গিয়ে খেয়াল হল যে আজকের পাহাড়ের পথটা একটু বেশি বুনো। কাল যখন আমি হাটছিলাম তখন সেই পথ দেখে মনে হচ্ছিল সেই পথে মানুষের চলাচল নিয়মিত হয়। কিন্তু আজকে যখন চলতে শুরু করেছি কিছু সময় পার হওয়ার পরেই অনুভব করলাম যে এই পথে মানুষজনের চলাচলে চিহ্ন নেই। বিশেষ করে মুল পথ থেকে নইরং যখন ডান দিকের একটা বাক নিয়ে নিচে নেমে গেল তখন থেকেই এই অবস্থা। মনে হচ্ছে যেন এই পথে মানুষের চলাচল খুবই কম। নইরংকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, জ্বে ঠিকই ধরছেন। এই পথে মানুষজনের চলাচল একদমই কম। আমাদের পাড়াই কেবল পড়ে এই পথে। এই কারণে কেবল আমাদের পাড়ার লোকজনই এইটা দিয়া যাওয়া আসা করে।
অবশ্য আমরা নইরংদের পাড়াতে সেদিনও পৌছাতে পারলাম না। সারাদিন কেবল হেটেই গেলাম। উচু নিচু পাহাড় পেরিয়ে সন্ধ্যার আগে আবারও একটা জুমঘরে এসে হাজির হলাম। তবে এই জুমঘরের অবস্থা বেশ কাহিল মনে হল। এমন কি ছাদটাও কয়েক স্থানে ফুটো হয়ে গেছে। নইরং জানালো যে এইদিকে ঠিক জুম চাষ হয় না। মানুষজন এদিকে আসেও না। ওদের পাড়ার লোকজনরা উল্টোদিকে কাজ কর্ম করে। এই দিকটা তারা কেবল শহরে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করে। রান্না করতে করতেই নইরং আমাকে আরও একটা গল্প শোনাল।
ভাত বসিয়ে দিয়েই নইরং বলল, আপনি কি দেবতায় বিশ্বাস করেন?
পাহাড়ের নানান উপজাতিরা নানান ধর্মে বিশ্বাস করে। তাদের দেব দেবীও আলাদা। আমি ধর্ম নিয়ে কখনই আলাদা কোন মনভাব পেষণ করি না। আমি আমার ধর্মে বিশ্বাস করি। অন্যেরা কী ধর্মে বিশ্বাস করে সেটা নিয়ে আমার খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। আমার বিশ্বাস যাই হোক না কেন আমি সব সময় চেষ্টা করি যে আমি কথা বা কাজে যেন অন্য ধর্মের মানুষ কোন প্রকার আঘাত না পায়!
আমি বললাম, দেবতা বলতে? আমি আমার ধর্মে বিশ্বাস বিশ্বাস করি।
-আপনার ধর্মে সর্ব শক্তিমানে বিশ্বাস করেন, তাই না?
-হ্যা তা তো অবশ্যই।
-আপনাদের ধর্মে তো জ্বিন বলে একটা জাতি আছে। সেটাতে তো বিশ্বাস করেন?
-তা বিশ্বাস রাখতেই হবে নয়তো হবে না।
-আমাদের ধর্মেও আছে এমন বেশ কয়েকটা দেবী। আমরাও ঠিক এমন এক দেবীর আরাধনা করতাম।
-করতাম বলছো কেন? এখনও আর কর না?
-এখন আর করি না যে!
-কেন?
আমার এই কেনর প্রশ্ন সে চট করে দিল না। কিছু সময় সে ভাবল কি যেন। তারপর হাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখিল । খিচুড়িটা হতে এখনও বেশ সময় লাগবে। সে এবার আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর বলা শুরু করল।
আমার পাড়ার নামটাই এখনও আপনাকে বলা হয় নি। আমার পাড়ার নাম তো আপনাকে বলেছি আগেই। আমাদের ভাষায় ছইমুং মানে হচ্ছে রক্ত। আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশ মায়ানমান সীমান্তে বসবাস করছে। আমাদের দেবী আমাদের সব দিক থেকে সুরক্ষা দিয়ে আসত। তবে এর বিনিময়ে তাকে প্রতি বছর এক নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ভেট দিতে হত। রক্তের ভেট।
প্রাচীন অনেক ধর্মের বলির ব্যাপারটা প্রচলিত ছিল। গরু ছাগল সহ নানান প্রাণী দেব দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। এমন কি এখনও অনেক জায়গায় এটা করে। সেই সময়ে মানুষ পর্যন্ত বলি দেওয়া হত। আমি জানতে চাইলাম, রক্তের ভেট মানে কিসের রক্তের ভেট? পশু পাখি নাকি…!
-মানুষ।
আমি অবশ্য চমকালাম না। এমন কিছু আমি আশাই করেছিলাম। নইরং বলল, দেবীর সব থেকে পছন্দের ভেট ছিল কচি বাচ্চাদের রক্ত। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা তাই করত। তারপরই এক সময়ে তারা সেটা করা বন্ধ করে দিল। দেবী আমাদের উপর রুষ্ঠ হলেন। আমাদের ছেড়ে চলেও গেলেন।
-এরপর?
-এরপর আর কী! আমাদের সে পাড়াটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেল। একটা ঝর্ণা ছিলস এটা শুকিয়ে গেল। বনে শিকার পাওয়া গেল না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা তখন সে স্থান ত্যাগ করে নতুন জায়গায় এসে পাড়া স্থাপন করল। এখন যেখানে আছি। তবে আমরা নামটা আগের মতই রেখে দিলাম। আমাদের পাড়ার নাম এখনও ছইমুং পাড়া।
আরও কিছু সময় গল্প চলল। এরই মাঝে রান্না হয়ে এসেছে। খিচুড়ি খেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম জলদি জলদি। কাল দুপুরের দিকে আমরা ছইমুং পাড়াতে পৌছে যেতে পারব আশা করা যায়। রাতে ঘুমানোর আগে তাবুটা টাঙ্গিয়ে নিলাম ঘরের ভেতরেই। আমার পাশেই নইরং শুয়ে পড়ল।
গত রাতের মত আজকের রাতেও আমি সেই একই স্বপ্নটা দেখতে পেলাম। আজকেও আমি সেই মেয়ের ছায়াই দেখলাম। তবে এবার সে আমার আরও কাছে চলে এসেছে। যদিও আমি মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না তবে গতরাতের মত আজকের রাতে আমার এই ছায়াকে দেখে মোটেই ভয় লাগল না। কেন ভয়টা আমার লাগল না সেটা আমি জানি না। স্বপ্নের ভেতরে আজকে আমি একটা সুগন্ধ টের পেলাম। স্বপ্নের ভেতরে গন্ধ টের পাওয়া যায় নাকি?
গতরাতের মত আমার ঘুম যখন ভাঙ্গল আমি আবারও ঘরের ভেতরে সেই অস্তিত্ব টের পেলাম। কেউ যেন খুব সাবধানে এই জুমের ঘরের ভেতরে হেটে বেড়াচ্ছে ধীরে সুস্থে। খুব সাবধানে। আমি আজকে আলো জ্বাললাম না। তাকে হেটে বেড়াতে দিলাম। কেন এমনটা মনে হল সেটা আমি সত্যিই বলতে পারব না। আশ্চর্যজনক ভাবে স্বপ্নের ভেতরের সেই সুগন্ধটাও আমি যেন টের পাচ্ছিলাম। আমি চোখ মেলে একভাবেই তাকিয়ে রইলাম। অন্ধকার চোখে সেই অদৃশ্য কেউটাকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম শুধু। তবে কোন কাজ হল না। আমি তাকে চোখে দেখতে পেলাম না।
কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি সেটা আমি নিজেও জানি না। সকালে নইরংয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। রাতের খিচুড়ি খেয়ে আবারও আমরা রওয়ানা দিলাম। যদিও আশা করেছিলাম যে দুপুরের আগেই পৌছে যাব তবে আমার হাটার গতি আজকে একটু ধীর ছিল। পৌছাতে পৌছাতে দুপুর পার হয়ে গেল।
সত্যি বলতে কি ছুইরং পাড়াটাকে আমার কেমন একটু অদ্ভুত মনে হল। আমি অনেক পাহাড়ি পাড়াতে গিয়েছি তবে এই পাড়াটা তাদের মত নয়। অন্যান্য পাড়ার ঘরগুলো একটা থেকে আলাদা থাকে। তবে এই পাড়ার সব ঘর একেবারে এক সাথে। লম্বা করে ঘরগুলো বানানো হয়েছে। শহরের এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের মত মনে হল। নইরং আমাকে জানালো যে প্রতিটা ঘরে একটা করে পরিবার বাস করে। সবাই কাছাকাছি থাকে যাতে কোন বিপদ এলে সবাই দৌড়ে গিয়ে সাহায্য করতে করতে পারে। তবে আমি যখন আরও কাছে গিয়ে হাজির হলাম তখন বড়ির চারিদিকে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম। সেখানে ছোট ছোট কয়েকটা মুর্তি দাড় করানো। দুরে অন্য প্রান্তেও ঠিক একই রকমের মূর্তি দেখতে পেলাম। আমি নিশ্চিত জানি পেছন দিকে গেলেও আমি ঠিক একই মুর্তি দেখতে পাব। আমার কাছে মনে হল যেন এই মূর্তিগুলো এই যৌথবাড়িটাকে পাহারা দিচ্ছে।
আমি যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি তখন দেখতে পেলাম যে ঘরের জানালা থেকে কিছু মুখ আমার দিকে উকি ঝুকি মারছে। তবে আমি তাকালেই সেগুলো আবার চলে যাচ্ছে জানালার আলাড়ে। পুরো পরিবেশটা একটু অস্বস্তির মত মনে হল। আমি নিজেকে খানিকটা অবাঞ্চিত অনুভব করলাম। আমার কাছে মনে হল যে আমি এখানে এসেছি এটা এরা পছন্দ করছে না।
কিছু সময় পরেই নইরং একজন বয়স্ক লোককে নিয়ে ফিরে এল। তার চেহারা দেখেই আমার মনে হল যে সে মোটেই আমার এখানে আসাটা পছন্দ করে নি। একটু ভাঙ্গা বাংলায় সে বলল, আমাদের এখানে আমরা বাইরের লোক রাখি না। আমার ছেলে না বুঝে আপনাকে নিয়ে এসেছে।
-তাহলে এখন?
-এখন আর কী করবেন যখন চলেই এসেছেন। তিন দিন পরে আমার শহরে যাওয়া কথা, এর আগে কেউ যাবে না সেদিকে। আমি তখন আপনাকে নিয়ে যাব। এই তিনদিন এখানেই থাকতে হবে। কোন উপায় নেই। তবে আমাদের এই ঘরে না। ঐ যে ঘরটা দেখছেন ওখানে থাকতে হবে।
সে হাত তুলে একটা ঘর দেখাল। পাড়ার সীমানার একেবারে শেষ প্রান্তে। আমি সেদিকে তাকালাম। লোকটা আবারও বলল, খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমার বাসা থেকেই তিন বেলা খাবার পাবেন। ঠিক আছে?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। এটা হলেই আমি খুশি। তিন দিন শান্তিমত থাকা যাবে। খাওয়ার চিন্তা নেই। আমি বললাম, আপনাদের খরচ পাতি?
-এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। যাওয়ার দিন আপনার সুবিধা মত খরচ দিলেই চলবে।
আমি যখন ওদের যৌথ বাড়িটা পার হয়ে আমার থাকার কটেজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন অনুভব করলাম যে সবগুলো চোখ আমার উপরেই নিবদ্ধ ছিল। আমার কটেজের সামনে এসে আমি দেখলাম যে এই বাড়ির চারিপাশে কোন মূর্তি বসানো নেই। ঐ যৌথবাড়ির মত কেউ এই ঘরটা পাহারা দিচ্ছে না।
চলবে

