মিমি একভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা যেন ঘোরের মত লাগছে ওর মনে। এই ভাবনাটা এখন ওর মনে প্রায় দিনে এসে জড় হয়। এখনও যতই দিন যাচ্ছে মিমির মনে হচ্ছে যে এটা ছাড়া তার সামনে এই পথ ছাড়া তার সামনে আসলে আর কোনো পথ খোলা নেই। একবার যদি সেই ছবিগুলো সামনে চলে আসে তবে সে আর কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না।
প্রথম যেদিন রাফি তাকে এই কথা জানালো সেদিনই মনে হয়েছিল মরে যেতে। ওর বাবা মা যদি সত্যিই তার ঐ ছবিগুলো দেখে তাহলে তারা আর কেউ কোনো দিন স্বাভাবিক হতে পারবে না। মিমি তখন তার বাবা মায়ের দিকে তাকাবে কিভাবে? বয়স কালের ছোট একটা ভুল যে এতোদিন পরে এমন ভাবে তাকে চেপে ধরবে সেটা সে বুঝতে পারে নি কোন দিন। মিমি দিশেহারা বোধ করছে। তার সামনে এখন আর কোন পথ খোলা নেই। এই মরন ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার! ছবিগুলো যদি সত্যি সবার সামনে চলে আসে তাহলে সে যেমন মুখ দেখাতে পারবে না, তারা বাবা মাও কারো সামনে মুখ দেখাতে পারবে না।
এখন মিমির মনে হয় যে সেই বয়সে এমন একটা ভুল সে কেন করেছিল? মিমির মা সব সময় ওকে সাবধান করে এসেছে যেন সে ছেলেদের সাথে এই ধরনের সম্পর্কে না জড়ায়। সব কিছুর জন্য একটা বয়স আছে। এখন মিমির ভাল মন্দ বিচারের বুঝ আসে নি। কিন্তু মিমি তখন এসব আমলে নেয় নি। বিশেষ করে যখন রাফির সাথে তার পরিচয় হল তখন মনে হয়েছিল যে রাফির মত কেউ বুঝি আর হয় না। দেখতে শুনতে ভাল, সেই সাথে খুবই চমৎকার ভাবে কথা বলে তার উপরে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করে। এতো চমৎকার একজন ছেলের থেকে কি দুরে থাকা যায়?
এভাবেই তাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল। একবার মাত্র দেখা হয়েছিল তাদের। ঈদের ছুটিতে রাফি দেশে এসেছিল। তবে নিয়মিতই ওদের কথা হত। মিমি তখন সবে মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে উঠেছে। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য তার বাবা তাকে একটা আইফোন কিনে দিয়েছিল। এর আগে সব কিছু সে তার মায়ের ফোন থেকে করত বলে সেখানে কিছুই করার সাহস পেত না কিন্তু যখন নিজের ফোন এল তখন যেন একটু বেশি স্বাধীনতা পেয়ে গেল। সাহসটাও বেড়ে গেল অনেক বেশি পরিমানে। অনেক রকম কথা বলতে শুরু করল। তারপরেই সেই ভুলটা করল সে। আবেগে বশবর্তী হয়ে সে রাফিকে নিজের এমন কিছু দিয়েছিল যা দেওয়া ঠিক হয় নি।
তারপরে এক সময়ে মিমি নিজে জানতে পারে যে রাফি আরও কয়েকটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে আছে। এটা জানার পরেই সে সরে এসেছিল। নিজের সীম বদলে ফেলেছিল। তারপর অনেক দিন মিমি শান্তিতেই ছিল সব কিছু ভুলে গিয়েছিল। তবে সেই ছবি পাঠানোর ব্যাপারটা তাকে মানসিক ভাবে একটা অশান্তি দিচ্ছিল। তবে অনেক দিন হয়ে যাওয়া তেমন চিন্তা করছিল না। কিন্তু সেই ভুলের মাসুক তাকে এখন এসে দিতে হচ্ছে।
মিমি পড়াশোনা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। তার জীবনটা শান্তিতেই কেটে যাচ্ছিল তখন আবারও রাফি তার জীবনে ফিরে এল। সে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছে। দেশে ফিরে এসে কিভাবে জানি মিমি নম্বর যোগার করে ফেলেছে। তারপর থেকেই তাকে ফোণ দেওয়া শুরু। আবারও সে মিমির সাথে সম্পর্কে যেতে চায়। মিমি যখন পরিস্কার মানা করে দিল তখন রাফি জানাল যে তার কাছে মিমির এমন সব ছবি রয়েছে যা সে নেটে ছেড়ে দিলে মিমির জীবন ধ্বংশ হয়ে যাবে। মিমি নিজেও জানে যেমন ছবি সে রাফিকে দিয়েছিল সেই ছবি যদি সামনে চলে আসে তবে তার জন্য খুব ভয়ংকর ব্যাপার হবে।
-কেমন আছো মিমি?
মিমি চমকে উঠল। নিজের ভাবনাতে সে এতোটাই মগ্ন ছিল যে কেউ যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে খেয়াল করে নি। একটু চমকে উঠল। সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল তার বয়সী একজন মেয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চেহারা তার পরিচিত নয় তবে কোথাও হয়তো সে দেখেছে এই চেহারা! এখন মনে করতে পারছে না। মেয়েটার মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছে। মিমি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ঝাপ দেওয়ার কথা ভাবছিলে?
-মানে? কী বলছেন এসব? ঝাপ দিব কেন?
-তুমি জানো সেটা! তোমারই জানার কথা। তাই না?
যদিও মেয়েটা বলল যে তোমারই জানার কথা কিন্তু মেয়েটার চেহারার ভাব দেখে মিমির কেন জানি মনে হল তার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মেয়েটা সব কিছু জানে?
-আপনি আমাকে চিনেন?
-চিনি বলতে ঠিক ঐভাবে চিনি না। আমাদের একজন কমন পরিচিত মানুষ আছে।
-কে?
-গেস কর?
মেয়েটি এমন ভাবে মিমির দিকে তাকিয়ে কথা বলছে যেন মিমি তার অনেক দিনের পরিচিত কেউ। মিমি কিছুটা সময় অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে মনে করার চেষ্টা করছে আসলে এই মেয়েটাকে সে কোথায় দেখেছে। মেয়েটার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করল সে। স্মৃতির পাতায় হাতড়ে একটা চেহারা ভেসে উঠল। মেয়েটাকে সে চিনতে পেরেছে।
মিমির মুখ দিয়ে আপনা আপনি একটা নাম বেরিয়ে এল, রাফি!
মেয়েটা একটু হাসল। হাসলে মেয়েটাকে আরও সুন্দর দেখায়। মেয়েটা দেখতে আসলেই সুন্দরী। কোন সন্দেহ নেই রাফি ওকে ছেড়ে এই মেয়েটার কাছে গিয়েছিল। হ্যা, সেই সময়ে রাফির সাথে এই মেয়েটাকেই সে দেখেছিল। রাফি এই মেয়েটার জন্যই ওর সাথে চিট করেছিল। সাথে সাথেই মিমির মুখটা একটু শক্ত হয়ে এল। সে বলল, আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?
-আরে আপনি করে কেন বলছো? তুমি করে বল। তোমার সম্ভবত এখন ফাইনাল ইয়ার চলছে, তাই না?
-হ্যা। আমারও। সামনে আমার ফাইনাল প্রোফ।
-তুমি মেডিকেলে পড়ছো? ডিএমসিতে। নাইস টু মিট ইউ। আমি নাইরা।
এই বলে মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিল। মিমি কিছু সময় দ্বিধা নিয়ে নাইরা নামের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। আসলে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যে এই মেয়েটা এখানে কী করছে। তার সাথে এই মেয়েটার কীই বা কাজ থাকতে পারে? তবে মেয়েটার হাসিমুখ দেখে মিমির মনে হল যে মেয়েটা তার খারাপ কিছু করতে আসে নি।
আচ্ছা এই মেয়েটার সাথে কি এখনও রাফির সম্পর্কে আছে? মেয়েটা কি জানে রাফি তার সাথে যোগাযোগ করেছে আর কী চেয়েছে? এই জন্যই কি মেয়েটা তার সাথে দেখা করতে এসেছে? মেয়েটা যেন মিমির মনের কথাটাই বুঝে ফেলল। সে বলল, নাহ, ঐ বদমাইশটার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। যেদিন থেকে আমি ওর চিটিং ধরতে পেরেছি সেদিন থেকেই সরে এসেছি।
-তার মানে অন্য কারো সাথে সে নতুন সম্পর্ক তৈরি করেছে?
-আরও কত ঠিক নেই। আমি ছয় জনের খবর পেয়েছি। তুমি আমি নিয়ে মোট আট জন।
-কীই!
-হ্যা।
-তাহলে কী….?
মিমি কথাটা শেষ করল না। নাইরা বলল, হ্যা সে প্রায় সবার সাথেই যোগাযোগ করেছে যারা যারা তাকে ছবি পাঠিয়েছিল। তুমি আমি আরও চার জন মেয়ে এই কাজ করেছে।
মিমি নির্বাক হয়ে নাইরার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। এখন সে কী করবে? কার কাছে যাবে? পুলিশের কাছে যাবে? যদি পুলিশের কাছে যায় তবে হয়তো সাহায্য পাওয়া যাবে কিন্তু যে জানাজানিটা হবে সেটা মিমি কিভাবে সহ্য করবে? এই খবর ওর বাসায় যদি পৌছে যায় তাহলে সত্যিই মিমির মরণ ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকবে না।
নাইরা বলল, আমি আসলে এলাম তোমার কাছে একটা সাহায্যের জন্য?
-কেমন সাহায্য?
-আমার সাথে এক জায়গা যেতে হবে। গেলেই বুঝতে পারবে? যাবে?
মিমি কিছু সময় দ্বিধাবোধ করল। এই মেয়েটাকে সে চিনে না। নাম ছাড়া আর কিছুই জানে না। কেবল এই তথ্য জানে যে তার প্রাক্তন প্রেমিক যেমন তার সাথে চিট করছে, এই মেয়ের সাথে তেমন ভাবে চিট করেছে। এই মেয়েকেও সম্ভবত রাফি ব্লাকমেইল করছে। এই মেয়ে তার সাহায্য চাইছে।
মিমি আবারও বলল, কী করবে বল?
-তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর তবে যে ঝামেলায় পড়েছে সেটা চিরোদিনের মত চলে যাবে। যাবে? দেখ বেশির ভাগ কাজই আমি করে ফেলেছি। এখন কেবল একটা ছোট কাজ বাকি। এটা শেষ করতে পারলে তুমি যে ঝামেলায় পড়েছ সেটা দূর হবে।
-সত্যিই হবে?
-হ্যা। করবে সাহায্য?
-করব, যা বলবে সব করব। বল কী করতে হবে?
-আপাতত আমার সাথে যেতে হবে। একটা জায়গা থেকে একটা জিনিস নিতে হবে। ব্যাস । আমিই যেতাম তবে আমাকে সে চেনে। এই জন্য আমি যেতে পারছি না।
মিমি আর চিন্তা করল না। সে বলল, চল ।
মিমি নাইরার সাথে সাথেই বের হয়ে এল। মিমি ভেবেছিল যে ওরা হয়তো উবার বা সিএনজি নিবে তবে মিমি অবাক হয়ে দেখল যে পাশেই পার্ক করা একটা বাইকের কাছে গেল। তারপর বাইকে চড়ে বসল। মিমির দিকে তাকিয়ে একটা হেলমেট এগিয়ে দিল। মিমি এতোদিন ঢাকায় আছে তবে কোন দিন বাইরে ওঠে নি। বাইরে চড়তে তার কিছুটা ভয় লাগে। এখনও বেশ ভয়ই লাগছিল। তবে মিমি বুঝতে পারল যে নাইরা মেয়েটা বেশ ভালই বাইক চালায়।
বাইকটা একটা বাড্ডার একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামল। মিমি নেমে যেতেই নাইরা বলল, ফ্ল্যাট ফাইভ বিতে যাবে। কলিংবেল চাপবে। যেই বের হোক না কেন বলবে যে আমার নাম সুচি। রাফি আমাকে পাঠিয়েছে। তাহলে সে তোমাকে একটা ব্যাগ দিবে।
-নাম বললেই দিয়ে দিবে?
-হ্যা। চিন্তা কর না। নাম বললেই দিয়ে দিবে। আমাকে ঐ ছেলেটা চিনে। এই জন্য আমি যাচ্ছি না। আর একটা কথা মনে রাখবে, শান্ত থাকবে। কোন ভয় নেই। ঠিক আছে?
মিমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল বিল্ডিংয়ের ভেতরে। রিসিপশনে ফ্ল্যাটের নাম বলতেই তারা যেতে বলল। মিমির দারোয়নের দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখে মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। তখনই বুঝতে পারল যে এমন ভাবে প্রায়ই মেয়েরা এই ফ্লাটে এসে হাজির হয়।
ফাইভ বির কলিং বেল চাপার কয়েক সেকেন্ড পরে একটা ছেলে দরজা খুলে দিল। ওর দিকে তাকিয়ে কিছু সময় চেনার চেষ্টা করল। তারপর বলল, আপনি?
-আমি রাফির কাছ থেকে আসছি। আমার নাম সুচি।
-ও আচ্ছা। হ্যা রাফি ফোণ দিয়েছিল। আসুন ভেতরে আসুন।
-না না ভেতর না। আমি একটু তাড়ার ভেতরে আছি। প্লিজ আপনি ব্যাগটা এনে দিন।
কথাগুলো একভাবে বলার সময়ে মিমি অনুভব করছিল যে সে চরম ভাবে উত্তেজিত হয়ে আছে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল সে। কোন ভাবেই যেন তার গলার ভয়টা সামনের মানুষটা টের না পায়। সামনের মানুষটা ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর ফ্লাটের ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল কিছু সময় পরে। তার হাতে একটা ল্যাপটপের ব্যাগ। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই নিন। এটাই রাফি আপনাকে দিতে বলেছে।
একটু কাঁপা হাতে ব্যাগটা নিয়েই সে পেছনে হাটা দিল দ্রুত। লিফটের দিকে গেল না। সোজা সিড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে শুরু করল। মিমির কেবল মনে হচ্ছিল যেন সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সে এখনই পা পিছলে পড়ে যাবে। তবে নিজেকে সে কিছুই শান্ত করতে পারছিল না। ওর কেবল মনে হচ্ছিল যে ওকে এখান থেকে যতদ্রুত সম্ভব পালিয়ে যেতে হবে। নাইরা যদিও ওকে বলেছি শান্ত থাকতে কিন্তু সে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিল না। একবার কোন মতে পা পিছলে যেতে যেতে সে কোন মতে রক্ষা করল।
বাইকটা যখন আবার চলতে শুরু করেছে তখনও মিমির বুকটা ধড়ফড় করছে। সামনে থেকে নাইরা বলল, রিল্যাক্স। কিছুই হয় নি। তুমি ঠিক মতই বের হয়ে এসেছো।
মিমি নিজেকে শান্ত করে কোণ মতে বলল, এই ল্যাপটপে কী আছে?
-রাফি আজ পর্যন্ত যত মেয়ে নুড ছবি যোগার করেছে সব এখানেই আছে।
-তাই নাকি?
-কিন্তু ও এটা কিভাবে দিয়ে দিতে বলল। মানে রাজি হল কিভাবে?
নাইরা একটু হাসল। তারপর বলল, রাজি হয় নি। রাজি করিয়েছি।
-মানে?
-দেখতে চাও?
-হ্যা।
-ওকে চল তাহলে?
মিমি সত্যিই জানে না ওর সাথে কী হচ্ছে। সামনের এই মেয়েটিকে চিনে না অথচ তার সাথেই সে বাইকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু আগে এক অপরিচিত লোকের কাছ থেকে একটা ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে। বিশ্বাসই হচ্ছে না। মিমির মন বলছে এখনই এখান থেকে চলে যেতে তবে কিন্তু সেই একই সাথে কৌতুহলী হয়ে উঠছে। রাফি কিভাবে রাজি হল এই ল্যাপটপটা দিয়ে দিতে!
বাইকটা এগিয়ে চলছে। মিমি খেয়াল করল বাইকটা উত্তর মেট্রো স্টেশন পার করে গেছে। এই এলাকাটা একদমই নির্জন। ঘরবাড়িটা নেই। এই মেয়েটা ওকে কোথায় নিচে যাচ্ছে?
ব্লাকমেইল ভাল নয়
