প্রতীক্ষা

4.6
(25)

সূচির কোন দিন ভাবে নি এই মানুষটার সাথে তার এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। গাড়ি থেকে যখন সে বের হয়ে এল তখন সবার আগেই সূচির উপরেই চোখে পড়েছিল তার। ঠিক একই সময় সূচীর চোখও পড়েছিল তার উপর। সূচি নিজে যেমন চমকে উঠেছিল, মানুষটা তেমন ভাবে চমকে উঠেছিল ওকে দেখে। এখানে সে সূচিকে দেখবে বলে আশা করে নি। সূচিও আশা করে নি এই মানুষটা এখানে থাকবে। এতো জায়গা থাকতে এই মানুষটা এই খানেই থাকতে হবে? আর তার উপর সূচির যে ব্যাপারটা সব থেকে অবাক লাগছে যে এই লোক না ক্যাডার ছিল, এখানে আর্মি অফিসার হল কিভাবে? 

সিপাহী লোকটা ওদের দিকে মনযোগ দেওয়া বন্ধ করে তাদের অফিসের দিকে মনযোগ দিল। একটা বড় স্যালুট ঠুকে সেদিকে তাকালো। অফিসার একবার সবার দিকে মনযোগ দিয়ে তারপর সিপাহীর দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার রশিদ, সমস্যা কী? এরা এখানে কেন?

-স্যার এখানে ক্যাম্প ফাঁকি চলে এসেছে। রুমার পরে এখানে আসা নিষেধ জেনেও এসেছে। এখন এদের দিয়ে কী করব বলেন?

অফিসার আবার সবার দিকে একবার করে তাকাল। তারপর সূচির উপর চোখ স্থির করে বলল, আপনারা কেন নিয়ম ভাঙ্গেন? নিয়ম তো আপনাদের ভালর জন্যই নাকি?

ওদের টিম লিডার, স্যার ভুল হয়ে গেছে। আর এই রকম হবে না।

-আপনাদের গাইড কোথায়? গাইড কে?

-স্যার আপনাদের হাতে ধরা পরার সময়ই সে পালিয়ে গেছে।

সূচি জানে যে আর্মি বা বিজিবির হাতে যখন এই ক্যাম্প ফাণকি দেওয়া টুরিস্ট ধরা পরে, তখন টুরিস্টদের আর্মিরা কিছুই বলে না। তবে গাইডদের বেশ ভাল রকমের মাইর দেয়। তাই গাইডরা পালিয়ে যায় সবার আগে। 

-আপনাদের বিরুদ্ধে কোন একশান নিচ্ছি না, কিন্তু এখান থেকেই ফিরে যান। রুমায় চলে যান এখন। কাল সকালেই ঢাকা ফেরত যাবেন। 

টিম লিডার বলল, স্যার আমরা অনেক আশা নিয়ে এসেছি। এই তো চলেই এসেছি বগালেকে। আজকের দিনটা আমরা বগাতে থাকি। কাল চলে যাব। আপনারাও তো যাচ্ছেন ঐদিকেই। আপনাদের সাথেই না হয় যাই। আর এখন রুমার দিকে যেতে হলে রাত হয়ে যাবে। প্লিজ স্যার।

অফিস আবারও সবার দিকে একবার তাকাল। সূচির দিকে একটু যেন বেশি সময় ধরেই চোখটা স্থির রাখল। তারপর ঘুরে সিপাহীর দিকে তাকিয়ে বলল, এদের রুমায় যেতে কত সময় লাগবে এখন? 

-স্যার আলো তো প্রায় পড়ে এসেছে। যেতে রাত হয়ে যাবে। তবে পা চালিয়ে চললে নিরাপদে যেতে পারবে!

অফিসার আবারও কিছু সময় ভাবল। তারপর বলল, আপনারা যে কী ঝামেলা করেন না! ঘুরাঘুরি নেশা ঠিক আছে কিন্তু ঝুকি বিপদের ব্যাপারটা তো দেখতে হবে, নাকি?

তারপর নিজের মোবাইল বের করে কী যেন দেখলেন। এরপর আবারও বললেন, রশিদ এদের সাথে করে বগাতে নিয়ে চল। কাল সকালেই এদের আবার ফেরত পাঠাবে। আর কোন গাইড এদের নিয়ে এসেছে সেটার খোজ নাও। ব্যাপারটা সাহস কত সেটা আমি দেখতে চাই। 

রুমা রেঞ্জটা অনেক দিন ধরেই টুরিস্টদের জন্য বন্ধ হয়ে আছে। এখানে পাহাড়ি কিছু চরমপন্থীদের সাথে বেশ লম্বা সময় ধরেই ঝামেলা চলছে। তাই টুরিস্টদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই রুট অনেক দিন ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে এতো নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় টুরিস্টরা নিয়ম ভেঙ্গে ক্যাম্প ফাঁকি দিয়ে এই দিকে চলে আসে। সূচিদের গ্রুপটাও সেই একই ভাবে চলে এসেছে। সূচির অনেক দিন থেকেই বগা লেক দেখার ইচ্ছে ছিল। এরই ভেতরে বান্দারবানে বেশ কয়েকবার সে ঘুরে গেছে। বন্ধুদের সাথে যেমন এসেছে, ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমেও এসেছে। এখন কেবল আলীকদম দিকটা ফাঁকা আছে। মাঝে রোয়াংছড়ি খুলে দিয়েছিল, তখন সেখান থেকেও ঘুরে এসেছে। তবে এই রুমা অনেক দিন ধরে বন্ধ। তাই এবার খানিকটা লুকিয়েই এই ইভেন্টে এসেছে। অবশ্য টিমলিডার তাদের আগেই জানিয়েছিল যে এমন কিছু এই ট্যুরে ঘটতে পারে। আর্মির হাতে তারা ধরা পরতে পারে। এই রিস্ক নিয়েই ওরা এসেছিল। এবং ধরাও পরে গেছে। তবে ভাগ্য ভাল ওদের। ওরা বগাতেই যাচ্ছে। আর্মির সাথেই। টিম লিডারকে খুব খুশি মনে হলেও সূচি জানে যে এটা কেন সম্ভব হল। যদি মঞ্জুর সাহেব না থাকত তবে এখান থেকে ওদের ফেরত পাঠানো হত। কেউ মানুক বা না মানুক তার কারণেই ওরা আজকে এই বগাতে যেতে পারছে। 

বগাতে পৌছাতে পৌছাতে অন্ধকার হয়ে গেল। বগালেকে পৌছে দেখা গেল নতুন সমস্যা। বগালেক এক সময় টুরিস্টদের জমজমাট স্পট ছিল। অনেকগুলো কটেজ ছিল এখানে। কিন্তু দীর্ঘদিন এই রুটে টুরিস্ট নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে কোন কটেজে এখন আর থাকার মত অবস্থায় নেই। সব অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বিছানা বালিশ সব ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে আছে। 

এবারও তাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এল মেজর মঞ্জুর। সে সিপাহী রশিদকে ডেকে আবারও নির্দেশ দিল যে আর্মির যে কটেজ রয়েছে সেখানে ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে। রশিদ এই নির্দেশ পেয়ে বেশ অবাকই হল তবে মুখে কিছু বলল না। এখানে টুরিস্ট না এলেও আর্মির লোকজন নিয়মিত ভাবেই আসে। মাঝে মাঝে অফিসার পর্যায়ের কেউ কেউ চলে আসে। তাই আর্মির কটেজটা সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্নই থাকে। ওদের জন্য তিনটা রুম খুলে দেওয়া হল। 

সূচির ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। একটা অস্বস্তিবোধ কাজ করছে ওর ভেতরে। এখানে ওর আসলে কী করা উচিত? মঞ্জুর সাহেবের সাথে গিয়ে কথা বলা দরকার? তাকে কি সরি বলা দরকার? কিন্তু সূচির তো কোনো দোষ ছিল না। সে কেন সরি বলবে? তবে আগের পরিচিত বলে তার সাথে গিয়ে কথা বলা যায়। নাহ! যতই সূচি বলুক তার দোষ নেই তবে তাদের ভেতরে শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে তা মধুর ছিল না। 

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল তখন তখন সূচির কেন জানি ঘুম এল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে কটেজের বারান্দায় আসতেই লেকটার দিকে চোখ গেল। পুরো এলাকাটা একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সূচি এক ভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। একবার ইচ্ছে হল লেকের পাড়ে গিয়ে দাড়াতে। তবে একা একা যেতে কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছিল। তাই কটেজের বারান্দা থেকেই তাকিয়ে রইলো। এমন মনমুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো যে কেউ যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা খেয়ালই করল না। 

-তোমার সাথে এখানে দেখা হবে ভাবি নি।

সূচি একটু চমকে গেল বটে তবে সাথে সাথেই সামলে নিল নিজেকে। সেও বলল, আপনাকে এখানে দেখব ভাবি নি। 

-কেমন আছো তুমি? পড়াশোনা কেমন চলছে?

-ভাল। এবার ফোর্থ ইয়ার। 

-বাইরে যাওয়ার না ইচ্ছে ছিল?

-হ্যা সেটা এখনও আছে। আইএলস এর প্রস্তুতি চলছে।

-গুড। 

এই বলে মঞ্জুর বারান্দা থেকে নিচে নামল। তারপর লেকের দিকে হাটা দিল ধীর পায়ে। যদিও সূচিকে সে আসতে বলে নি তবে সূচির কেন জানি মনে হল যে মঞ্জুর সাহেব চাচ্ছে যেন সূচি তার সাথে লেক পাড়ে যাক। অবশ্য সূচিত নিজেরও তো যেতে ইচ্ছে করছিল তবে একা একা সেখানে যেতে সাহস হচ্ছিল না। এখন একজন মানুষকে সেখানে যেতে দেখে সুযোগটা তার হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে করল না। সেও পায়ে পায়ে এগিয়ে এগিয়ে গেল লেকের পাড়ে।

লেকের পাড়ে বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ রয়েছে। মেজর মঞ্জুর সেখানেই গিয়ে বসল। সূচি একই বেঞ্চে বসলেও মাঝে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলল। কিছুটা সময় কেউ কোন কথা বলল না। আজকে চাঁদের আলোটা খুব বেশি উজ্জ্বল নয় তবে তারপরেও লেকের পানিতে সেই স্বল্প আলোটুকু অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সূচি একভাবে সেদিকেই তাকিয় রইলো কেবল। 

-আমার আজকে এখানে আসার কথা ছিল না।

মঞ্জুরুই প্রথম কথা বলল।

-তাহলে?

-কোন কারণ ছাড়াই। মনে হল যে একবার ঘুরে আসি। আর্মিতে যোগ দেওয়ার পরে আমি ইচ্ছে করেই হিল এরিয়াতে পোস্টিং নিয়েছি। এখানে ইচ্ছে করে কেউ আসতে চায় না। আমি ইচ্ছে করেই এসেছি। যদিও এখানে অফিসারদের ঠিক আসতে হয় না। আমাদের শহরেই থাকতে হয়। তবে আমি মাঝে মাঝে এখানে চলে আসি। এখানে এই পাহাড়ের নির্জনতা আমার ভাল লাগে। আজকেও তেমন ভাবে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এসে হাজির হলাম। পথের মাঝে তোমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল।

-আপনি না ক্যাডার ছিলেন?

-হ্যা ছিলাম।

-তাহলে এখানে?

-আসলে ঐ ঘটনার পরে কেন জানি আর চাকরি করতে ইচ্ছে করে নি। চাকরি ছেড়েই দিয়েছিলাম। তারপর কী মনে হল আর্মির সর্টকোর্সে এপ্লাই করলাম, টিকেও গেলাম। তারপর থেকে এখানেই। 

সূচি কী বলবে ঠিক বুঝল না। কী বলা উচিত সেটাও বুঝল না। ঠিক হোক বা বেঠিক হোক তার কারণেই মঞ্জুর বিসিএসের মত লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, এই কথাটা তার মনে একটা অস্বস্তির অনুভূতি জাগাল। 

-আই এম সরি।

-ডোন্ট বি। তুমি আমাকে পরিস্কার ভাবেই বলেছিলে যে তুমি বিয়ে করতে চাও না। আমি সেটা শুনি নি। আসলে সেই সময়ে আমার ভেতরে একটা দম্ভ চাক করছিল। আমি বিসিএস ক্যাডার, তার আবার প্রশাসন। আমার জন্য দেশের সব মেয়েই পাগল থাকতে বাধ্য। আমার মনভাব এমনই ছিল। 

সূচি সেই সময়ের কথা মনে করতে চায় না। তবে এখানে আসা এবং মঞ্জুর সাহেবের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাওয়ার পর বারবার ঘুরে ফিরে সেই একই কথা মনে হচ্ছে। সূচির মা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। তার মায়ের বিয়েটা হয়েছিল একেবারে কম বয়সে। মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই। আর সূচি দেখতে তার মায়ের থেকেও বেশি সুন্দর ছিল। ক্লাস নাইন থেকেই তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করে। তবে যখন সূচি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তখন এমন একটা বিয়ের প্রস্তাব এল যে সূচির বাবার রাজি হয়ে গেল। ছেলে সবে মাত্র বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকেছে। সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মেয়েদের লাইন লেগে আছে তাকে বিয়ে করার জন্য তবে ছেলে সূচিকে পছন্দ করেছে। তাকেই বিয়ে করবে। সব কিছু প্রস্তুত তবে সূচি বেকে বসল। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। এমন কি সে মঞ্জুরকে ফোন করেও জানিয়ে দিল যে সে এই বিয়েতে রাজি না। সে পড়াশোনা করতে চায়। তখন তাকে আশ্বাস দেওয়া হল যে বিয়ের পরে তার পড়াশোনা বন্ধ হবে না কিন্তু সূচি তাতেও রাজি হল না। তবে এই দেশে বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের মতামত ঠিক নেওয়া হয় না। এই বেলাতেও নেওয়া হল না। অনেকটা জোর করে তাকে বিয়ে দেওয়া হবে। পাত্রপক্ষ আকদ করতে সূচিদের বাসায় এসে হাজির হল। আর তখনই ঘটনা ঘটনা। 

সূচির এক বন্ধুর মা ছিল নারী বিষয়ক এনজিওর লয়ার। তার সাহায্য নিল সে। ঠিক বিয়ের সময়েই তারা এসে হাজির হল। বেশ একটা হুলস্থুর ঘটেছিল সেদিন। শেষ পর্যন্ত আর বিয়েটা হয় নি। বিয়ে না করেই মঞ্জুরের পরিবার ফিরে আসে সেদিন। তাদের হুমকি ধামকিও দিয়ে আসে যে দেখে নেবে! তবে পরে আর এমন কিছুই হয় নি। 

এরপরে সূচি কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হাজির হয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনা সে মনে করতো না আর তবে আজকের পরে আবারও মনে পরছে বেশ ভাল ভাবেই। 

দুই

ওরা ভেবেছিল পরদিন সকালেই ওদের ফেরত পাঠানো হবে। ওদের বগালেক দেখার ইচ্ছে ছিল সেটা পূরণ হয়েছে বিধায় ওদের তাতে মন খারাপের কোনো কারণ ছিল না। তবে সূচির জন্য আরও কিছু যেন অপেক্ষা করছিল। টিমলিডার এসে ওদের একটা চমৎকার খবর দিয়ে গেল। টিম লিডার জানাল যে ক্যাপ্টেন নিজে যাচ্ছেন রিংড়ি ঝরণা দেখতে। চাইলে আমরা তার সাথে যেতে পারি। সবাই হইহই করে উঠল। তবে সূচির কেন জানি মনে হল যে ক্যাপ্টেন মঞ্জুর আরও কিছুটা সময় তার সাথে থাকতে চাইছেন, এই কারণে তিনি এমন একটা প্রস্তাব দিলেন। সূচি এটাও নিশ্চিত যে যদি এই টিমের সাথে সূচি না থাকত তবে ক্যাপ্টেন তাদের ধরা পরার সময়ই ফেরত পাঠাত। 

সূচিরা যখন সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য বের হল তখন তারা একটা নতুন জিনিস দেখতে পেল। তাদের কটেজের ঠিক বাইরেই একটা আর্মি জিপ গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে। এই জিপটা কাল এখানে ছিল না। এমন কি সূচি যখন রাতে ক্যাপ্টেন মঞ্জুরের সাথে লেকের পাড়ে বসে ছিল তখনও এই জিপটা এখানে ছিল না। তাহলে সম্ভবত এটা সকালে এখানে এসেছে।

কে এসেছে সেটা অবশ্য টের পেতে খুব বেশি দেরি হল না। ওরা যখন রওয়ানা দিবে তখন মেজর মঞ্জুরও বের হল। তবে এবার সে আর একা নয়। তার সাথে একজন সুদর্শনা মেয়ে রয়েছে। মেয়েটির পরনে একটা জলপাই রংয়ের আটোসাটো প্যান্ট। উপরে কালো টিশার্ট। চুল বেশি লম্বা নয়। পনি টেইল করে বাঁধা। মেয়েটাও যে আর্মিতে রয়েছে সেটা কেউ বলে না দিলেও সূচির মোটেই বুঝতে কষ্ট হল না। এবং মেয়েটা যেভাবে মেজর মঞ্জুরের শরীর ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে তাতে মোটেই বুঝতে কষ্ট হল না যে এই মেয়ের সাথে মঞ্জুরের কিছু না কিছু চলছে!

মেজর মঞ্জুর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে আপনাদের এখনই ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু আমি নিজেও কিন্তু এখানে কোন অফিশিয়াল বিজনেসে আসি নি। আমিও এসেছি ঘুরতেই। আর নিজে যে কাজ করছি আপনার বেলায় সেই নিয়মের ব্যতীক্রম করাটা ঠিক না। আর এর পরিচিত হোউন, ইনি হচ্ছে ক্যাপ্টেন নাইরা হাসান। বান্দারবানে পোস্টেড। আমার কলিগ!

নাইরা হাসান সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তবে সেই হাসিতে আন্তরিকতা ঘাটতি ছিল। 

সবার আগে দুইজন সিপাহী চলছিল। তারপর মঞ্জুর আর নাইরা। এরপর সুচিদের পুরো দল। আর সবার শেষে দুইজন সিপাহী। এভাবেই তাদের যাত্রা শুরু হল। হাটা শুরুর পরে ব্যাপারটা আরও বেশি পরিস্কার হল সূচির কাছে। নাইরা আর মঞ্জুর কেবল কলিগ নয় তাদের ভেতরে আরও বেশি কিছু চলছিল। নাইরা একেবারে মঞ্জুরের গা ঘেষে হাটছিল। আর নিজের মাঝেই কথায় মসগুল ছিল। ওদের পেছনে যে পুরো একটা টিম রয়েছে সেদিকে যেন ওদের কোন খেয়ালই রইলো না। 

সূচির এই ব্যাপারটাতে কিছু মনে হওয়ার কোনো কথা না কিন্তু বড় অদ্ভুত ভাবেই সূচির এই ব্যাপারটাতে কেমন যেন মনে হতে শুরু করল। মনের ভেতরে একটা সুক্ষ ঈর্ষাবোধ হতে লাগল। নিজের মনের ভেতরের এই অনুভূতি দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। আজকে সকালের আগ পর্যন্তও তার মনের ভেতরে এমন কোন অনূভূতি জাগে নি। এমন কি তার মানে এটাও আসে নি যে মঞ্জুর বিয়ে করে ফেলতে পারে। যখন প্রথমে তার দিকে চোখ পড়ল তখন সেই চোখের দৃষ্টি দেখেই সূচির কাছে মনে হয়েছিল যে এই মানুষটা তাকে এখনও মনে রেখেছে। বছর ছয়েক তো পার হয়ে গেছেই। 

অথচ এই সময়ের ভেতরে মঞ্জুর বিয়ে করে ফেলাটাই বরং স্বাভাবিক ছিল। এখন যখন সেই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই ঘটছে তখন সূচির কাছে ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। এমন কেন হচ্ছে? সূচী সত্যি ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। এমন তো হওয়ার কথা না। 

বিয়েটা ঐভাবে ভেঙ্গে যাওয়ার পরে তার আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই তার উপর খানিকটা বিরক্ত ছিল। এতো ভাল একটা পাত্র সূচি কেন ফিরিয়ে দিল! বিয়ের পরেও তো পড়াশোনা করা যেত! সুচির বাবা প্রথম প্রথম সূচির উপরে বেশ রাগ করে ছিলেন তবে পরে এক সময়ে সেসব ঠিক হয়ে যায়। বছর খানেকের পরেই সেই ঘটনা সূচির জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সূচির মনে এই অদ্ভুত অনুভূতি জাগছে। কেন জাগছে সেটা সূচি জানে না।

চিংড়ি ঝরণাতে তাদের টিমের অনেকেই গোসল করল। সূচি গোসল করল না। এমন কি ঝরণার সৌন্দর্যও তাকে আর বিমোহিত করল না। সে নিজেকে অন্য চিন্তায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলেও তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল মঞ্জুর আর নাইরার দিকে। মঞ্জুর নিজেই নাইরার ছবি তুলে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ওরা এক সাথে সেলফিও তুলছে। এই দৃশ্য দেখে সূচির মোটেই ভাল লাগছিল না। কেন লাগছি না সেটার কোন ব্যাখ্যা নেই। 

ঘন্টা খানেক পরে দলটা আবারও ফিরে চলল। আবারও বগালেকের দিকে। সুচি পুরো রাস্তা অন্যমনস্কই রইলো। তার চোখের সামনে কেবল সেই একই দৃশ্য ঘুরপাক খেতে লাগল । অন্য কিছুই যেন তাকে ছুয়ে দেখছে না। 

দুপুরের খাওয়ার পরে ওদের ফেরার পালা। সূচি আশা করেছিল যে মঞ্জুর বুঝি তার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলবে। তবে সেই রকম কিছুই হল না। যদিও পুরো টিম চাওয়ার আগে মেজর মঞ্জুরের কাছে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিল। মঞ্জুরও সাথে হাসি মুখে বিদায় দিল। একবার সূচির দিকে তাকিয়ে চোখাচোখিও হল তবে সেই পর্যন্তই। ঢাকায় ফেরার পুরো রাস্তা সূচির মন খারাপই হয়ে রইলো। 

তিন

সূচি মাস্টার্সের জন্য পরের বছরই আমেরিকা পাড়ি জমাল। সেখানেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বটে তবে মনের ভেতরে সেই মেজর মঞ্জুরের কথা সে কিছুতেই বের করতে পারে নি। যতই দিন যাচ্ছে ততই সূচির কাছে মনে হচ্ছে যে আজকের এই অবস্থানে সে ঠিক ঠিক চলে আসতে পারত এবং সে চাইলেই মঞ্জুর তার সাথেই থাকত। সে চাইলেই এমনটা হতে পারত। 

কিন্তু তারপরেই সূচির জীবনে একটা বড় ঝড় নেমে এল। ঝড়টা যে এভাবে আসবে সেটা সে মোটেই ভাবতে পারে নি। সূচিত মাস্টার্সটা তখন প্রায় শেষ। সেই সময়ে একটা ঘটনা ঘটল। সূচির সাথে ক্যাপ্টেন নাইরা হাসানের দেখা হল। যদিও নাইরা তখন ক্যাপ্টেন থেকে মেজর হয়ে গেছে। 

ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীরা মিলে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছিল। সেখানেই গিয়েছিল সূচি। এবং তার দেখা হল নাইরা হাসানের সাথে। নাইরা হাসানের সুচির মনে রাখার কারণ ছিল। তবে সূচি মোটেই আশা করে নি যে নাইরা হাসান তাকে মনে রাখবে। তাদের মাত্র সেই অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল। 

কিন্তু সূচি অবাক হয়ে দেখল যে নাইরা ওকে চিনতে পারল। এবং বেশ ভাল করেই চিনতে পারল। তার সাথে কথা বার্তা বলল। সেই জানাল যে তার স্বামী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছে। সব চেয়ে বড় ধাক্কা খেল তখন সূচি তার স্বামীর সাথে পরিচিত হল। তার স্বামী মেজর মঞ্জর নয়। 

সূচিত অবাক হওয়ার ভাবটা দেখে নাইরা যেন বেশ কিছু সময় মজা পেল বেশ। একটু হেসে বলল, তুমি সম্ভবত এখনও আমাদের সেই বগালেকের ব্যাপারটা মাথায় রেখেছ। 

-মানে?

সূচি অনুভব করল যে ওর বুকের ভেতরে একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। 

নাইরা বলল, নাদিমের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আমি যখন ক্যাপ্টেন হই তখনই। তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই। আর …

-আর?

-আর মঞ্জুর আমার কাজিন। 

সূচি আরও একটা লম্বা সময় তাকিয়ে রইলো নাইরার দিকে। ও যেন ঠিকমত চিন্তা ভাবনা করতে পারছে না। 

নাইরা বলল, আমি ওকে ছোট বেলা থেকে চিনি। মঞ্জুরের জীবনে কেবল মাত্র একজন মেয়েই এসেছিল। আর কেউ আসে নি। আর কেউ আসবেও না। 

সূচির মনে হল সে বুঝি আর সহ্য করতে পারবে না। এমন ভাবে কেউ কি কাউকে ভালোবাসতে পারে? সত্যি পারে? পাবে না জেনেও এতো দীর্ঘ অপেক্ষা কি কেউ করতে পারে?

পরিশিষ্টঃ 

বাসটা যখন বান্দরবান বাস স্ট্যান্ডে থামল তখন সকাল সূর্য উঠে গেছে। সূচী বাস থেকে নেমে কিছু সময় কী করবে বুঝতে পারল না। যতবারই বান্দরবান এসেছে ততবারই ওদের সাথে কেউ না কেউ ছিল। সেই মূলত টিম নিয়ে গেছে। কোথায় কী করতে হবে সব সেই বলে দিয়েছে। তাকে নিজ থেকে খুজতে হয় নি। আজকে তাকে নিজ থেকেই খুজতে হবে। 

আজকে তাকে আরও অনেক কিছুই খুজে বের করতে হবে। দীর্ঘ সময় তার জন্য একজন অপেক্ষা করছে, আজকে তাকে খুজে বের করতেই হবে।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

অপু তানভীরের নতুন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে থেকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 25

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →