অনেক দিন থেকেই আমার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার স্বভাব। নিজের পরিচিত বিছানায় আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু আজকে সে রকম ভাবে আমার ঘুম ভাঙ্গল না। আজকে চোখ মেলেই আমি আমার ঘরের পরিচিত অফ-হোয়াইট সিলিং দেখতে পেলাম না। বরং সেখানে কালো রংয়ের কনক্রিট দেখতে পেলাম। সিলিংয়ে কোন প্লাস্টার করা নেই। দেখে মনে হল যেন পাথর এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমার মাথা ঘুরে গেল। আমি চারপাশে একবার চোখে বুলিয়ে নিলাম। সাথে সাথে আমার বিস্ময় আরও একটু বাড়ল। আমার মনে হল যে আমার আসলে ঘুম ভাঙ্গে নি। আমি স্বপ্নই দেখছি। কারণ এটা মোটেই হতে পারে না। আমি যেখানে রয়েছি সেখানে আমি থাকতে পারি না। এটা মোটেই সম্ভব না। আমি এখানে কিভাবে এলাম?
অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মনে এসে উকি দিল কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর একটারও জবাবও আমার কাছে নেই। আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না যে আমি এই জেল খানাতে কিভাবে এলাম!
হ্যা সত্যিই তাই, এটা একটা জেলখানা। তিন দিকের কনক্রিটে দেয়াল আর একদিকে লোহার শিক। আমি দ্রুত সেদিকে উঠে গিয়ে বাইরে একটু তাকানোর চেষ্টা করলাম। দেখার চেষ্টা করলাম যে কেউ আছে কিনা কিংবা কিছু চেনা যাচ্ছে কিনা!
সুনশান নিরবতা ছাড়া আর কিছু নেই, কেউ নেই। আমি কয়েকবার চিৎকার করে ডাক দিলাম।
কেউ আছেন?
কেউ নেই। কোন আওয়াজ নেই। কিছু নেই।
আমি নিজের হাতের দিকে তাকালাম। আমার হাতে সব সময়ই একটা মিব্যান্ড থাকে। কিন্তু সেটা এখন আমার হাতে নেই। এখন ঠিক কয়টা বাজে সেটা জানার কোন উপায় নেই। এখন রাত কিংবা সকাল সেটাও আমি জানতে পারছি না। সারি সারি জেলা খানা দেখা যাচ্ছে। করিডোরে মৃদু পাওয়ারের আলো জ্বলছে। আমার সেলে কোন আলো নেই। করিডোরের আলোতে যতটুকু আলো আসছে এই যা। জেলখানার এই জগতটা আমার কাছে আলাদা একটা জগত মনে হল। বাইরের কোন আওয়াজই আসছে না।
সব থেকে বড় যে প্রশ্নটা আমার মনে আসছে সেটা হচ্ছে আমি এখানে কেন? আমি এখানে এলাম কিভাবে? আমার এখানে আসার কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। আমাকে যদি কেউ বন্দি করে নিয়েও আসে, বিশেষ করে আমি যদি পুলিশের কাছে ধরাও পড়ি তবে সেটা তো আমার মনে থাকবে। তাহলে আমি সেটা মনে করতে পারছি না কেন?
তাহলে এটা কি কোন স্বপ্ন?
একমাত্র স্বপ্ন হলেই পুরো ব্যাপারটার একটা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা দাড় করানো যায়! কিন্তু স্বপ্ন কি এতো স্পষ্ট হতে পারে? এতো পরিস্কার আর স্পষ্ট স্বপ্ন আমি এর আগে কোনো দিন দেখি নি। আমি বেশ কিছু সময় লোহার শিক ধরে নাড়াচাড়া করলাম। কিন্তু কোন লাভ হল না। এই জিনিস আমি কোন ভাবেই ভাঙ্গতে বা খুলতে পারব না।
-মিস্টার নাইমুল!
একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজটা আসছে আমার পেছন থেকে। আমি চমকে উঠে পেছনে তাকালাম। তবে সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে আওয়াজটা আবারও হল।
-নাইমুল।
-কে?
কোন জবাব নেই। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আওয়াজটা আবারও বলে উঠল, মন দিয়ে শুনুন। আপনার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে। অনেক মানুষ প্রাণ নির্ভর করছে।
-মানে কী বলছেন এসব। কে আপনি? আমাকে এখানে কেনে এনেছেন? কারা আপনারা?
কন্ঠটি আমার সব প্রশ্ন উপেক্ষা করে নিজের মনে কথা বলে চলল। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আওয়াজটা আসছে সিলিং থেকে। সেখানে কোন মাইক্রোফোন লাগানো রয়েছে। এবং সম্ভবত এই মেসেজটা একটা প্রিরেকর্ডেড মেসেজ। তাইয়া মার প্রশ্নের কোন জবাব পাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। আমি তাই আর কোন প্রশ্ন করলাম না।
-আমরা বোমা মেরে এই পুরো শহরটাকে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। আপনার সেলের ঠিক উল্টোদিকের দিকে একটা নিউক্লিয়ার বোমা রয়েছে। মোটামুটি ১০ কিলোমিটারের রেডিয়াসের পুরো এলাকা ধ্বংস করে দিবে এই বোমা। আমরা সেইভাবেই পরিকল্পনা করেছি।
আমার কাছে এটা সতিই সত্যিই স্বপ্নই মনে হল। এসব হয় নাকি আবার! আমি সেলে থাকা পাথরের বিছানার উপরে বসলাম। হাত দিয়ে বিছানাটা স্পর্শ করে দেখলাম। পুরো বিছানা এতো বাস্তব মনে হল। স্বপ্নের জিনিসপত্র এতো বাস্তব অনুভব হয় না। এটা স্বপ্ন হতে পারে না। কোন ভাবেই এটা স্বপ্ন হতে পারে না। আওয়াজটা আবারও কথা বলতে শুরু করল।
-আপনার সেলের পেছনের দিকে একটা চাবি আপনি পাবেন। এই একটা চাবি দিয়েই আপনি নিজের সেলের দরজা সহ সামনে যতগুলো দরজা আছে সব খুলতে পারবেন। আপনি চাইলে এখনই এই জেলখানা থেকে চলে পারবেন। আগামী পনের মিনিটের ভেতরে যদি আপনি এই জেল খানার দরজাগুলো খুলে বের হতে ছাদে যেতে পারেন তবে সেখানে দেখবেন আপনার জন্য একটা হেলিকাপ্টার অপেক্ষা করছে। সেটাতে চড়ে আপনি নির্দিষ্ট একটা দুরুত্ব পৌছাতে পারবেন যেখানে এই বোমার আঘাত আপনাকে মেরে ফেলবে না। হেলিকাপ্টার আপনার জন্য ১৫ মিনিট অপেক্ষা করবে। তারপর সে চলে যাবে।
আমি এক লাফে বিছানার পেছনে চলে গেলাম। সেখানে সত্যিই একটা চাবি রয়েছে। আমি সেটা হাত দিয়ে দ্রুত দরজার দিকে যেতে যাবো তখনই কন্ঠটা আবারও কথা বলে উঠল।
-তবে এই শহরের মানুষদেরকে বাঁচানোর একটা সুযোগ আপনার কাছে আছে। আপনি যদি এখনই ঐ সেলের দরজা খুলে বোমটা ডিফিউজ করার চেষ্টা করেন তবে মিনিট বিশেকের ভেতরেই আপনি বোমার নিউক্লিয়ার অংশটুকু খুলে আলাদা করে ফেলতে পারবেন। সেই ক্ষেত্রে বোমা ফাঁটবে ঠিকই তবে তখন সেটা আর নিউক্লিয়ার বোমা থাকবে না। সেটার ইফেক্ট শুধু মাত্র এই জেলখানার ভেতরেই থাকবে।
আমি থমকে দাড়ালাম। আমার বুকের মধ্যে একটা অচেনা অনুভূতি হতে শুরু করেছে। আওয়াজটা আবারও বলা শুরু করল।
-সেই ক্ষেত্রে আপনি মারা যাবেন তবে পুরো শহর বেঁচে যাবে। আপনি হয়তো ভাবছেন যে আপনি হয়তো পুরো বোমাটা ডিফিউজ করতে পারবেন, তবে এটা আগেই বলে দিই যে এই কম সময়ের ভেতরে আপনার পক্ষে কোন ভাবেই পুরো বোমাটুকু ডিভিউজ করা সম্ভব না। তবে আপনি নিউক্লিয়ার অংশটুকু আলাদা করতে পারবেন। এখানে আপনাকে আরেকটা কাজ করতে হবে। মূল বোমা থেকে ইউরেনিয়াম আলাদা করে সেই ইউরেনিয়ান টুকু বয়ে আপনাকে এই জেলখানার একেবার শেষ মাথায় নিয়ে যেতে হবে। সেখানে একটা সেফ খুজে পাবেন। ইউরেনিয়ামের এই অংশটুকু সেই সেফের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে যাতে এই বোমার আঘাত ওটার গায়ে না লাগে। আর একটা ব্যাপার মনে রাখবেন সব সময় লাল তার কাটবেন।
আমি চাবি নিয়ে দরজার খুললাম। তারপর সোজা করিডোর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাকে যে কোন ভাবে হেলিকাপ্টারের কাছে পৌছাতে হবেই। এই শহর আমাকে কিছু দেয় নি। এই শহরে আমার কেউ থাকে না। এই শহর আমার প্রতি তীব্র নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। এই শহর আমার জন্য কিছুই করে নি তাহলে এই শহরে বাঁচাতে আমি কেন মরবো? নিচে যদি বাঁচি তবে বাবার নাম। আমার বাবা মা ভাই বোন কেউ এই শহরে থাকে না।
আমি করিডোরের মাথায় গিয়ে দরজার চাবি ঢোকাতে পারলাম না। আমি কেবল অনুভব করলাম আমি আবারও পেছন দিকে দৌড়াতে শুরু করেছি। ফিরে এসেছি সেই আগের সেলের কাছে। তবে উল্টো দিকের সেলতা খোলার চেষ্টা করছি। একবার চাবি ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেল। আমি আলো আধারিতে আমি বিশাল বড় বোমাটা দেখতে আমার কাছে বড় ভয়ংকর মনে হল!
আমি স্থির ভাবে বোমাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল। এই বোমাটা যদি এখন ফাঁটে পুরো শহরের মানুষ মারা যাবে। দুই কোটি মানুষ একেবারে মারা যাবে।
তারপর পরের পনের মিনিট কিভাবে যে সময় কাটলো আমি জানি না। বোমাটার গায়ে কোন টাইমার নেই। তাহলে কিভাবে বুঝব যে কখন এটা ফাঁটবে? এতো কিছু ভাবার সময় নেই। তারিখে দেখলাম বোমার পাশেই একটা স্কু ড্রাইভার আর কেচি রাখা ছিল। আমার জন্যই রাখা ছিল এটা। আমাকে আগে চেষ্টা করতে হবে! আমি সেটা দিয়ে কেবল পাগলের মত একটার পর একটা ধাপ খুলে ফেলতে শুরু করলাম। যতগুলো তার ছিল তার ভেতরে কেবল লাল তারটা কেটে দিচ্ছিলাম। একটা সময় আবিস্কার করলাম যে মূল বোমার অংশটুকু ইউরেনিয়াম লেখা অংশটুকু আলাদা হয়ে গেছে। কত সময় পার হয়েছে আমি জানি না। এমন হতে পারে এখনই এই বোমাটা ফেটে যেতে পারে।
আমার এখন কাজ হবে এই ইউরেনিয়ামের ডিব্বাটা নিয়ে করিডোরের শেশের দিকে যেতে হবে। হাত দিয়ে তুলতে গিয়েই আমার খবর হয়ে গেল। কম করে হলেও এটার ওজন চল্লিশ কেজি হবেই। ত্রিশ কেজির গ্যাসে সিলিন্ডার আমি স্বাভাবিক ভাবেই তুলতে পারি। আমার ৬০ কেজির প্রাক্তন প্রেমিকাকে অনায়াশেই কোলে নিয়েছি। সেই হিসাবে এই চল্লিশ কেজির বক্সটাও আমি বহন করে নিতে পারব।
তবে ব্যাপারটা সহজ হল না। আমি যতই দ্রুত চাই না কেন আমার পক্ষে সেই ভল্টে নিয়ে যাওয়া সম্ভবত হল না। বারবার কেবল মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি বোমাটা ফেটে যাবে? এই বুঝি ফেটে গেল! কয়েক কদম যেতেই যেন অনন্তকাল লেগে যাচ্ছিল। আমার বারবার কেবল মনে হচ্ছিল যে তীরে এসে তরী ডুবলে চলবে না। যেটার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিচ্ছি সেই কাজটাই যদি ঠিক মত না হয় তাহলে সব কিছু বৃথা চলে যাবে।
আমি ভল্টে যখন ইউরেনিয়ামটা রাখলাম তখন আমার শরীর ক্লান্তিতে ভরে গেছে। আমি ভল্টের পাশেই বসে পড়লাম । এখন যদিও একটা চেষ্টা করা যায় বের হওয়ার তবে কেন জানি মনে হল বের হওয়ার জন্য দৌড় দিলেই শেষ হয়ে যাবে। আমি যখন সেই বোমার সেলের কাছে যাবো তখনই ফেটে যাবে। তার চেয়ে বরং এইখানেই বসে থাকি। এই ভল্টের কাছে বসে থাকি কিছু সময়।
আচ্ছা এই যে কাজটা করলাম সেটা কি ঠিক হল?
এই শহরের মানুষকে বাঁচিয়ে লাভ হল কী? এর থেকে নিজে বাঁচলেই লাভ হত! কেউ হয়তো আমার কথা জানবেও না। অবশ্য না জানলেই বা কী ! কী বা যায় আসে। আমি তো জানলাম। আমি কিছু সময় নিজের কথা চিন্তা করলাম। যদি আমি সোজা হেলিকাপ্টারের কাছেই চলে যেতাম তবে নিজে বেঁচে যেতাম ঠিকই তবে কী হত? আমি তো ঠিক বেঁচে থাকতাম। এই শহরের কেউ জীবিত থাকত না। কেউ হয়তো জানতোই না যে আমি এভাবে নিজেকে বাঁচাতে চলে গিয়েছিলাম। আর যদি জানতেও পারত তাহলে আমাকে তারা দোষ তো দিতে পারতো না। আমি এই বোমা সেট করি নি। আমি তো কারো ক্ষতি করি নি তাহলে আমাকে ওরা খারাপ কেন ভাবত। তবে আমি কি নিজের কাছে ভাল থাকতে পারতাম?
আমি আরও কিছু ভাবতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনও আমি আওয়াজটা শুনতে পেলাম। মুহুর্তের ভেতরেই একটা তীব আওয়াজের ঢেউ এসে লাগল আমার শরীরে! ব্যাস আর কিছুই মনে নেই আমার !
দুই
চোখ মেলে আমার পরিচিত ছাদ দেখতে পেলাম। সে প্রতিদিন আমার ঘুম সেখানে ভাঙ্গে ঠিক সেখানেই আমি জেগে উঠেছি। সব কিছু আমার কাছে বড় অদ্ভুত মনে হল! ঠিক যেন বিশ্বাস হল না। আমি একটু আগে কোথায় ছিলাম আর কোথায় আছি এখন? মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলাম আমি কি সত্যিই সেখানে ছিলাম নাকি আমি স্বপ্ন দেখেছি?
আমি বিছানা থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকালাম। আয়তানে নিজের চেহায় কোনো প্রকার ক্ষতের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। তাহলে কি সত্যিই আমি স্বপ্ন দেখেছি? স্বপ্ন কি এতো স্পষ্ট হয়?
আমি কিছুই যেন বুঝতে পারলাম না। এটা কিভাবে হল? এতো বাস্তব কিভাবে হয়?
মোবাইলটা বের করে দেখলাম যে আজকে রবিবার। বৃহস্পতিবার আমি অফিস থেকে বের হয়েছিলাম এটা আমার মনে আছে। তবে এর পরে আমি কী করেছি সেটা আমি মনে করতে পারছি না। শুক্র আর শনিবারটা আমি কোথায় ছিলাম সেটা আমি মনে করতে পারছি না।
আমার সাথে আসলে কী হয়েছিল?
পরিশিষ্ট
-এটা কত নম্বর টেস্ট সাবজেক্ট?
-স্যার এটা ১১৫৬ নম্বর।
-রেজাল্ট?
-স্যার পজেটিভ!
-পজেটিভ?
-জ্বী স্যার।
-এর উপর খেয়াল রাখ। আমাদের আরও চারজন দরকার। তারপরেই আমাদের মিশন শুরুহবে।
বৃদ্ধ টেস্ট সাবজেক্ট ১১৫৬ এর লেখা ফাইলটার দিকে ভাল করে তাকালেন। তার মনে একটা আশার আলো উকি দিয়েছে। এতোদিন পরে একজনকে পাওয়া গেছে। আর চারজনকে খুজে বের করতে হবে। তবে তাদের মিশন শুরু করা যাবে।
এই গল্পে টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলোতে বেশ ফাঁক রয়েছে। চাইলেই এই বোমা ডিফিউজের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া যেত তবে সেটাতে অনেক বেশি প্যাঁচাল পাড়তে হত, তাই এই বর্ণনা অতি সরলীকরণ করা হয়েছে।