তোমাকে বিয়ে করবোই

4.5
(24)

মীরার সাথে আমার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে গেল। বাসা থেকে ওদের জানিয়ে দেওয়া হল যে এই বিয়ে হবে না। আমি এসবের কিছুই জানি না। চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই আমার বাসা থেকে বিয়ে দেওয়ার একটা তোড়জোড় চলছিল। মেয়ে খোজা হচ্ছিল। কিন্তু মনের মত মেয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু তো কেবল মেয়ে আমার মনের মত হলে চলবে না, মেয়ে হতে হবে সবার মনের মত। মেয়ের পরিবার হতে হবে সবার মনের মত। বেশ কিছু দিন চলে যাওয়ার পরে যখন সবাই বুঝল যে সবাই পছন্দ করে এমন মেয়ে আসলে পাওয়া সম্ভব না তখনই মীরার খোজ পাওয়া গেল। এক কথায় সবার পছন্দ হল। 

সত্যি বলতে কি মীরাকে সব থেকে আমার নিজের পছন্দ হল। জীবনে যে আমি প্রেমট্রেম করি নি সেটা না। তবে তাদের কারো বেলাতেই আমার ঠিক মনে হয় নি যে এই মেয়ের সাথে জীবন কাটানো যায় কিন্তু মীরার সাথে কয়েকবার দেখা হওয়ার পরে আমার এই কথা মনে হল। 

মীরার সাথে আমার পরিচয় এই বিয়ের সুবাদে নয়। এরও আগে। আমাদের অফিসের সকল কার্যক্রম আগে যে ব্যাংকের মাধ্যমের হত সেই ব্যাংকটার সার্ভিস নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। তাই অফিস থেকে ঠিক হল যে আমাদের অফিসের সব কার্যক্রম অন্য ব্যাংকে নিয়ে যাওয়া হবে। আর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার উপরে। আমি কয়েকটা ব্যাংকের সাথে কথা বার্তা খোজ খবর নিয়ে একটা ব্যাংক পছন্দ করলাম। 

সেই ব্যাংকে সব কার্যক্রম যাতে সঠিক ভাবে এবং দ্রুত হতে পারে এই জন্য ঐ ব্যাংক থেকে একজন লিয়াজো অফিসার দেওয়া হল। সেই লিয়াজী অফিসার ছিল মীরা। সাপ্তাহ খানেক সময় লাগল সব কার্যক্রম শেষ হতে। এই পুরো সময়ে মীরা আর আমি এক সাথেই থাকতাম সারাটা দিন। লাঞ্চও করা হত একই সাথে। 

এদিকে আবার আমার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছিল। কিভাবে যে মীরার খোজ ওরা পেল সেটা আমরা কেউ জানি না। ঐ কাজ শেষের মাছ দুয়েক পরে আমাদের আবার দেখা হল। আমি তখনও জানি না যে মীরার সাথেই আমার দেখা হবে। আমাদের পরিবারের একজন কমন পরিচিত মানুষের মাধ্যমে মীরার পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। প্রথম আমাদের দেখা হল আমি ওকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। প্রাথমিক খোজ খবর নেওয়ার কাজ আমার বাবা মাই করেছিল তাই আমি এত গা করি নি। আর আমার নিজের ইচ্ছে ছিল যে ছবি টবি না দেখে একেবারে সরাসরিই আমাদের দেখা হোক। 

আমাদের দেখা হয়েছিল সাতাশ নম্বরের আলফ্রাস্কোতে। আমি যখন সেখানে হাজির হলাম মীরাকে দেখে সত্যিই চমকে উঠেছিলাম। অফিসের কাজের সময় আমি মীরাকে ফরমাল নামেই চিনতাম। তার ডাক নাম মীরা সেটা জানতাম না। এখানে তাই আমার মনে বিন্দু মাত্র ধারণাও ছিল না যে এই মীরা আমার পরিচিত হতে পারে। 

বলা যায় সেদিনই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে মীরাকেই আমার বিয়ে করতে হবে। ঐদিন বাসায় এসে মাকে জানিয়ে দিলাম যে এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব। এরপর আমাদের আরো বেশ কয়েকবার দেখা হল। যতই ওর সাথে দেখা হল ততই আমার ওর প্রতি আকর্ষন বাড়লো। আমি মোটামুটি ধরেই নিলাম যে মীরাকে আমি বিয়ে করছি।

তাই যখন বিয়েতা ভেঙ্গে গেল আমার মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু যখন মায়ের কাছ থেকে কারণ জানলাম তখন আমার মেজাজ গরম হল। আমি যখন বললাম, বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার মানে কী? আমার কাছে একবার জানতে চাইবে না?

মা বলল, এই মেয়েকে এই বাড়ির বউ করে আনা যাবে না।

-কিন্তু কেন?

-এই মেয়ে বেয়াদব। বড়দের সম্মান করে না।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। এমন একটা কথা মা কেন বলল ঠিক বুঝলাম না।  বললাম, এই কথা তোমরা কোথা থেকে জানলে? কে বলল তোমাদের?

-কেউ বলে নি। তোর বড় মামা গিয়েছিল এই মেয়ের ব্যাংকে। এই মেয়ে ঠিক মত সালাম দেয় নি তাকে, ভাল করে কথাও বলে নি। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছে।

আমি কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। বুঝতে পারছিলাম যে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। নিজেকে শান্ত করে বললাম, মামাকে কে বলল মীরার অফিসে গিয়ে তার খোজ খবর নিতে?

-তা নিবে না? দেখবে না মেয়ে কেমন?

-সে তো আর বিয়ে করবে না। বিয়ে করব আমি। 

মা যেন এবার চটে গেল, শোনা পলাশ বড়দের মুখে মুখে কথা বলবি ! আমরা কি তোর খারাপ চাই? তোর মামা কি খারাপ চেয়েছে কোন দিন? এই মেয়ে এই বাড়িতে এলে ঘরে অশান্তি বাঁধবে!

আমি বললাম, ওকে এই বাড়িতে মীরা আসবে না। তবে আমি যদি বিয়ে করি তবে মীরাকেই বিয়ে করব। কথা এখানেই শেষ। 

দুদিন পরে আমি মীরার সাথে দেখা করলাম। যদিও আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ ছিল যে মীরা হয়তো আমার সাথে দেখা করবে না। তবে দেখা করল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম যে ওর নিজের মন খারাপ। আমার যেমন ওকে পছন্দ হয়েছিল মীরার নিজেরও আমাকে পছন্দ হয়েছিল। মীরাই সেদিনের ঘটনা আমাকে বলল। এক পর্যায়ে আমি যখন দৃঢ় কন্ঠে বললাম, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। 

আমার কন্ঠে এতোটাই দৃঢ়তা ছিল যে মীরা নিজেও সম্ভবত একটু চমকে গিয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে এই বিয়ে করাটা ঠিক হবে না।

-তোমার কাছ থেকে যা শুনলাম তারপর আমি কোন ভাবেই এই বিয়ে থেকে পিছু যাবো না। কোন ভাবেই না। হ্যা তুমি যদি আমাকে মানা করে দাও তবে আমি তো আর জোর করতে পারব না। তবে তোমাকে একটা কথা দিচ্ছি যে যদি তোমাকে বিয়ে করতে না পারি তবে আমি এই জীবনে আর বিয়েই করব না।

মীরাকে এবার আমি সত্যিই দোটানায় পড়তে দেখলাম। আমি খানিকটা নাটকীয়তা করেই ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, যদি এই হাত না ধর তাহলে আমি এখনই চলে যাবো। আর কখনই তোমাকে বিরক্ত করবো না। তবে যদি হাত ধত তবে কথা দিচ্ছি যে এই হাত ছেড়ে দিবো না কোনো দিন।

মীরা আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল, বাসায় সামলাতে পারবে?

-ওটা তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও। বাসার লোকজনকে কিভাবে টাইট দিতে হয় সেটা আমি জানি। তোমার বাসায় আপত্তি নেই তো !

-সামলানো যাবো!

আমার মুখে হাসি ফুটল। আমি নিজ থেকে এগিয়ে গিয়েই মীরার হাত ধরলাম। 

বাসায় আমি পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিলাম যে আমি মীরাকেই বিয়ে করবো। যদি বাসার মানুষ রাজি হয় তবে ভাল তা না হলে আমি আলাদা বাসা ভাড়া করে মীরাকে সেখানে নিয়ে উঠব। পরের শুক্রবারে দেখলাম বড় মামা এসে হাজির আমাদের বাসায়। আমি যে মীরাকে বিয়ে করতে বদ্ধ পরিকর সেটা সে জেনেছে এবং এই বিয়ে ঠেকাতে সে আমাদের বাসায় এসে হাজির হয়েছে। আমি সেদিনও মীরার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখি। 

বাসায় এসে দেখলাম সবাই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। আমি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম মা আমাকে ডাক দিল!

-পলাশ এখানে এসে বস।

আমি বসলাম না। সোফার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখে একটা ভাব যে যা বলার জলদি বল আমার কাজ আছে।

-কোথায় গিয়েছিলি?

আমি কিছু লুকানোর চেষ্টা না করে বললাম, মীরার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

-তুই তাহলে ঐ মেয়েকে বিয়ে করবিই?

-হ্যা। ঐ মেয়েকে বিয়ে করব। 

-ঐ বেয়াদব মেয়ে এই বাড়ির বউ হবে না।

আমি স্থির হয়ে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। বড় মামাও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আব্বা অবশ্য নির্বিকার। তার এসব নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্চা নেই। মা যা বলবে সে তাতেই রাজি। 

আমি বললাম, তোমার বাড়ি তুমি বলতেই পারো এই বাড়ির বউ সে হবে না তবে মীরাকে বেয়াদব বল না। কারো সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে নি।

-তুই বলতে চাস তোমার মামার সাথে ঐ মেয়ে খারাপ ব্যবহার করে নি?

আমি এবার শান্ত গলায় বললাম, তুমি কি মামার কাছে জিজ্ঞেস করেছো যে মামা কেন মীরার ব্যাংকে গিয়েছিল? তার সেখানে যাওয়ার কোন কথা না। সে গিয়েছিল কেন জানো? তার সেই ব্যাংকে একাউন্ট রয়েছে এবং সেখান থেকে সেখানে লোনের জন্য গিয়েছিল যেই লোন রিজেক্ট আগেই দুইবার রিজেক্ট হয়েছে। যেই সে জানতে পেরেছে মীরার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে সেই সে আবারও গিয়েছে সেখানে। ওটা তো মীরার ডিপার্টমেন্ট না আর মীরা যখন তার এই অবৈধ রিকোয়েস্ট শুনতে চায় নি তখন সে হয়ে গেছে বেয়াদব? আমি নিজের তার রিস্কি লোন রিকোয়েস্ক রাখতাম না। 

আমি দেখতে পেলাম যে মামার মুখ লাল হয়ে গেছে । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বড়দের সাথে মুখে মুখে কথা শিখে গেছিস দেখছি!

-আমি সত্য কথা বললাম কেবল ! এটাতে যদি মুখে মুখে কথা হয়, যদি বেয়াদবী হয় তাহলে আমার কিছু করার নেই।

তারপর মামা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঐ মেয়ে যদি এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে তবে এই বাড়িতে আমি আর আসব না।

আমার মা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, আপনার বোনের বাড়ি, আপনি আসবেন কি আসবেন সেটা একান্তই আপনার নিজের সিদ্ধান্ত। 

তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, মীরা যখন তোমার মামার সামনে থেকে চলে গেছো জানো? মামা মীরাকে হুমকি দিয়ে বলেছেন যে এই লোন যদি স্যাংসন না করে দেয় তবে আমার সাথে তার বিয়ে হতে দেবে না।

এই কথা শোনার পরে দেখলাম মায়ের মুখে একটা দ্বিধা দেখা গেল। এদিকে মামার মুখ আরও লাল হয়ে গেছে। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি তো মীরাকে বিয়ে করবই। এতে কে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে বা না রাখবে সেটাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।

আমি আর কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা দিলাম। আমার আর কিছুই বলার বা জানার নেই।

পরিশিষ্ট

আমাদের বিয়েটা একা একা করতো হল না। আমার আর মীরার জেদের কাছে দুই পরিবার আবারও বিয়ে সম্মত হল। আমার পরিবার থেকে যখন বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয় তখন পরে মীরার পরিবার একটু অপমানিতবোধ করেছিল। তাই তারাও বেকে বসেছিল বিয়ের জন্য। তবে মীরা যখন জানালো যে বিয়ে আমরা একা একাই করব তখন তার আর আমার পরিবার আবারও এক জায়গায় এসে বিয়ের আয়োজন করে আলোচনার মাধ্যমে। 

বিয়ে বেশ ধুমধাম করেই হল। আমাদের আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সবাই বিয়েতে এসে হাজির হল। তবে আমার বড় মামা বিয়েতে এলেন না। তাতে অবশ্য আমাদের মনে কোন দুঃখের কারণ ছিল না।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 24

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →