ইশানার গল্প

4.9
(15)

আমি আমার জীবনে এই রকম পরিস্থিতিতে পরি নি। পুরো হলের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি টিভির মাধ্যমে পুরো দেশের মানুষ আমাকে দেখছে। এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, আমার হাতে ইশানার লাল স্যান্ডেল জোড়া!
আমার মনের ভেতরে একটা লজ্জা আর অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমার মনের অন্য একদিকে কেন জানি ভালও লাগছে, একটা আনন্দবোধ হচ্ছে। বিশেষ করে ইশানার আনন্দ দেখে আমার ভাল লাগছে। মেয়েটা যে এতো খুশি হবে সেটা আমি ভাবি নি।

ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশোনায় ভাল ছিলাম। আমার বড়দুই ভাইবোনও ভাল ছিল তবে আমি তাদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। এসএসসি পরীক্ষায় পুরো দেশের ভেতরে আমি সেকেন্ড হয়েছিলাম। আমাদের এলাকার অনেকে এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। ছাত্র জীবনে বাবামায়ের তাদের ছেলেমেয়েদের বলে না যে ওমুকের পাধোয়া পানি খেয়ে, মূলত আমি ছিল সেই ছেলে যার পা ধোয়া পানি খেতে বলা হত! আমি ছিলাম একেবারে আদর্শ ছেলে। আমার কারণে অনেকে শান্তিমত দুষ্টামী করতে পারত না, খেলাধুলা করতে পারত, তাদের পড়াশোনা করতে হত, এই কারণে এলাকার ছেলেমেয়েরা আমাকে ঠিক পছন্দ করত না।
তবে একজন ঠিকই আমাকে পছন্দ করত। ইশানা জাবিন। ছোট বেলা থেকেই আমরা প্রতিবেশি ছিলাম। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতাম। আমার থেকে বছর পাঁচেক ছোট ছিল ইশানা।
আমাদের দেখা সাক্ষাত হত নিয়মিতই। যে কোন বাহানাতে ইশানা কেমন যেন আমার সাথে কথা বলতে চাইতো। আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হত না। তবে কোন এক কারণে মা ইশানাকে পছন্দ করত না। সম্ভবত ইশানা পড়াশোনার থেকে গান নাচের দিকে ঝোক ছিল বেশি। আমি মাকে বলতাম যে সবাইকে যে ভালো পড়াশোনা করতে হবে এমন কোণ মানে নেই। যার যে কাজে মেধা রয়েছে সে সেই কাজ করবে। মেসির মা যদি তাকে বলত যে ভালো করে পড়াশোনা করে ডাক্তার হও তবে আজকে আর্জেন্টিনা কি আরেকটা কাপ জিততে পারতো! তবে মা আমার এই কথা কান দিত না।
তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে ইশানার গানের গলা ভাল ছিল। সেই সাথে ও দারুণ নাঁচতেও পারত। ওর বাবা মা অন্যদের মত না। ইশানা গান আর নাচ শেখাতে শুরু করল বেশ ভাল ভাবেই।
ইন্টারের পরে আমার এডমিশন পরীক্ষা ভাল হল না। আমার ইচ্ছে ছিল ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হব তবে আমার চান্স হল চট্টগ্রাম মেডিকেলে। আমার অবশ্য তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। চট্টগ্রাম যাওয়ার আগের দিন আমার সাথে ইশানার দেখা হল ছাদে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারছিলাম যে তার মন খারাপ। আমার মনে হল আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি এই কারণে মেয়েটা মন খারাপ করেছে। আমার অবশ্য তখন এসবের দিকে মন দেওয়ার সময় ছিল না। আমার লক্ষ্য ছিল সামনের দিকে যাওয়া। অন্য যে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করার কোনো মানেই নেই। তাই সেদিন আমি ইশানার সেই মন খারাপ পুরোপুরি উপেক্ষাই করেছিলাম। তার মনের কথা বুঝতে চেষ্টাই করি নি।
তারপরের গল্পটা ছিল সংক্ষিপ্ত। আমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। কেবল ছুটিতে ঢাকাতে আসতাম। সেই সময়েও বই নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। এদিকে ইশানা ততদিনে বেশ ভালই এগিয়ে গেছে। কলেজে উঠতেই ওর চেহারা আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে সেই সাথে গান নাচ তো রয়েছে। পুরো দুস্তর রকস্টার হয়ে উঠেছে। আমি ওর কথা মাঝে মাঝে শুনতাম। আমি যখন বিসিএস পাশ করে চাকরিতে ঢুকেছি তখন ইশানা পুরো দেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। অনেকগুলো গান বের হয়েছে যেগুলো খুবই হিট হয়ে গেছে। আমি মায়ের কাছ থেকে শুনেছি যে ইশানা বাবার বাসা ছেড়ে নিজের বাসায় উঠেছে।
বাবার বাসা ছেড়ে ওঠার পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। ইশানাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা স্ক্যান্ডেল ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া ইশানা একটু খোলামেলা পোশাকও পড়ত। ওর বেশ কিছু ছবিও ইন্টারনেটে আছে। এই সব কথা আমি জানতে পারতাম আমার মায়ের কাছ থেকে। আমি বাসায় এলেই সে নানান ভাবে ইশানার বদনাম আমার কাছে করত। কেন করত সেটা আমি বুঝতে পারি। ইশানাকে যে সেই ছোট বেলা থেকে আমাকে পছন্দ করত সেটা আমার মা ভাল করেই জানত। সে কখনই চায় নি আমি ইশানার দিকে ধাবিত হই। তাই আমাকে সে সব সময় ইশানার কাছ থেকে দুরে রাখতে চেয়েছিল।
এরপর আরও সময় পার হয়েছে। আমি কর্ম জীবনে আরও একটু থিতু হয়েছি। বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে যদি আমি বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এই সময়ে বিয়ে করার কোন মানে নেই। এমন সময়ে ইশানা সাথে আবারও আমার দেখা হল।
ইশানা চট্টগ্রামে কোন একটা কনসার্টে গিয়েছিল সম্ভবত। আমি জানি না ঠিক। আমি তখন সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ডিউটি করি। আমার দায়িত্ব যদিও ইমার্জেন্সিতে ছিল না তবে সেদিন একজন নার্স ছুটে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। কেন নিয়ে গেল সেটা আমি টের পেলাম একটু পরে। আজকে সব জুনিয়র ডাক্তাররা ছিল। সিনিয়র বলতে কেবল আমি একা ছিলাম। আর রোগী এসেছে একজন বিখ্যাত মানুষ। যদি এদিক ওদিক কিছু হয়ে যায় তবে এর দায়ভার পুরো হাসপাতালের উপরে পড়বে।
আমি কেবিনে ঢুকতেই দেখতে পেলাম ইশানাকে। ইশানাও আমাকে দেখে খানিকটা থমকে গেল। আমাকে সে এখানে আশা করে নি। সে জানত যে আমি এই শহরেই থাকি। তবে আমিই সে তার চিকিৎসা করতে এসে হাজির হব সেটা ভাবে নি। তার চেহারা দেখেই আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম।
তারপরই আমাদের মধ্যে আবারও যোগাযোগ শুরু হল। সে নিজ থেকেই আমার ফোন নম্বর নিল। আমি সেদিন আবার অবাক হয়েই খেয়াল করলাম যে মেয়েটা এখনও আমাকে পছন্দ করে । সেই ছোট বেলার পছন্দ মেয়েটা এখনও, এতো বিখ্যাত হওয়ার পরেও ধরে রেখেছে।
আমি সেদিন বাসায় গিয়ে ইশানার ব্যাপারে বেশ কয়েকটা আর্টিক্যাল পড়লাম। কয়েকটা ইন্টারভিউ দেখলাম। তারপর ব্যাপারটা আবিস্কার করলাম। বেশ কয়েকটা জায়গাতে ইশানা আমার কথা উল্লেখ করেছে একেবারে খোলাখুলি ভাবে। আমার নাম উল্লেখ করে না তবে সেই মানুষটা যে আমি সেটা বুঝতে আমার কোন অসুবিধা হয় নি।
ইন্টারভিউয়ার তাকে প্রশ্ন করেছে যে আপনার প্রেমিক কে বা কোনো সম্পর্কে আছেন কিনা, তখন ইশানা বলেছে সে কোন সম্পর্কে নেই। তারপরের প্রশ্ন এসেছে প্রেম করবেন না বা না করার কারণ কী ! তখন ইশানা উত্তরে বলেছে যে ছোট বেলা থেকেই সে একজনকে পছন্দ করে। তার প্রতিবেশি ছিল। কিন্তু ছেলেটা কোন দিন তাকে পাত্তা দেয় নি। এমন কী, এখন এসেও না। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে কোন দিন ইশানার মনেই ধরে নি। হয়তো প্রেম হয় নি এই কারণেই।

তারপরেই ইশানার কাছ থেকেই সেই প্রস্তাবটা এল। প্রস্তাবটা ছিল সে নতুন একটা গান সম্পোজ করেছে। অডিও এরই ভেতরে বাজারে চলে এসেছে। বেশ হিট করেছে গানটা। এখন গানটার একটা মিউজিক ভিডিও তৈরি হবে। ইশানার ইচ্ছে সেই মিউজিক ভিডিওতে মডেল হিসাবে সে আমাকে নিবে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, আরে আমি এসবের কিছু বুঝি নাকি। ইশানা বলল, বোঝার কিছু নেই। আপনার খুব বেশি কাজও নেই। কেবল ডিরেক্টর আপনাকে যা যা বলবে আপনি তাই করবেন। আর কিছু না। প্লিজ প্লিজ!
ইশানা এমন ভাবে অনুরোধ করতে লাগল যে আমি কেন জানি রাজি হয়ে গেলাম। আমার মনে হল যে ইনাশার সাথে একটা মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করলে কী আর হবে। আমিও নতুন জিনিস ট্রাই করার জন্য রাজি হয়ে গেলাম।

দুইদিন পরে আমরা কক্সবাজার গিয়ে হাজির হলাম। আমরা কোলাহল থেকে একেবারে দুরের একটা রিসোর্টে চেক ইন করলাম। প্রথম দিন আমাদের স্যুটিং বেশ ভাল হল। সত্যি বলতে আমাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছিল না। ইশানা খুবই চমৎকার নাচতে পারে। ওয়েডিং ড্রেস পরে ওকে চমৎকার লাগছিল। আর সব থেকে বড় করা ইশানাকে আমার বড় খুশি মনে হচ্ছিল। বাচ্চারা যেমন পছন্দের কিছু পেলে খুশিতে আটখানা হয়ে যায় ইশানাও ঠিক একই ভাবে আনন্দিত ছিল। ওর এই আনন্দ দেখে আমার ভাল লাগছিল।
সারা দিন ধরেই আমাদের স্যুটিং হল। রাতে আড্ডা শেষে আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম। কালকে আমাদের আরও একটু কাজ বাকি আছে। সেটা শেষ হলেই আমরা আবার যে যার জায়গাতে চলে যাব। আমিও আবার আমার আগের স্থানে ফেরত যাব। আমি আমার এখানে আসার কথাটা আমার মাকে বলি নি। আমি জানি যে মা এটা জানতে পারলে মোটেই ভাল ভাবে নিবে না। মা ইশানাকে মোটেই পছন্দ করে না। তবে আশার কথা হচ্ছে মা এই মিউজিক ভিডিও দেখবে বলে মনে হয় না।

আমি বিছানাতে শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছিলাম এমন সময়ে ইশানার মেসেজ এল ফোনে। আমাকে সে বাইরে বীচে যেতে বলছে। আমারও অবশ্য ঘুম আসছিল না। নতুন জায়গাতে আমার সহজে ঘুম আসে না। আর আমাদের রিসোর্টটা একেবারে সমুদ্রের কাছেই। সমুদ্রের গর্জন বেশ ভাল ভাবেই শোনা যাচ্ছে। আমি বাইরে বের হয়ে এলাম।

বালির উপরে হাটতে হাটতে চারিদিক দেখার চেষ্টা করলাম। এটা রিসোর্টের প্রাইভেট বীচ। এখানে বাইরের মানুষ আসবে না রিসোর্টের মানুষ ছাড়া। আর কলাতলী বীচ থেকে এটা বেশ খানিকটা দুরে। আশে পাশে অন্য কোন রিসোর্টও নেই। তাই এখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা নেইও। আমি আরেকটা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম ইশানাকে। সে গোসল করছে সমুদ্রের পানিতে। এই রাতের বেলা সাঁতার কাটছে। আমি বীচচেয়ারে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। চাঁদের আলোতে আমি ওকে সাঁতার কাটতে দেখছিলাম। একটু পরেই সে যখন আমার দিকে উঠে এল তখন আমার একটু খাবি খাওয়ার মত অবস্থা হল। কারণ ইশানা বিকিনি পরে সাঁতার কাটছিল। সেটা পরেই উঠে আসছে। সত্যি বলতে কি, টিভি স্ক্রিনে এই পোশাকে যতই মেয়েদের দেখি না কেন বাস্তবে এমন ভাবে কাউকে দেখাটা এতোটা সহজ নয়। ইশানা যে এভাবে আসবে আমি বুঝি নি। অবশ্য নেটে ওর এই খোলামেলা ছবি আরও প্রচুর রয়েছে। আমার মা ওকে যে পছন্দ করে না এটাও তার একটা কারণ।
ইশানা আমার পাশের বীচ চেয়ারে এসে বসল। তোলায়ে দিয়ে মাথা মুছল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে এলাম?
আমি তখন ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছি। সেদিকে তাকিয়েই আমি বললাম, নাহ। আমার আসলে ঘুম আসছিল না। নতুন জায়গাতে আমার ঠিক এতো সহজে ঘুম আসে না।
ইশানা বলল, আমার অবশ্য এই সমস্যা নেই। যারা মিডিয়াতে থাকে তাদের এই সমস্যা থাকলে চলে না। তাই না?
-হ্যা তা সত্য।
ইশানা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, আসুন সমুদ্রের আরেকটা কাছে গিয়ে বসি।
-আরও কাছে?
-হ্যা। আসুন আসুন। আর হয়তো সুযোগ পাবোই না আপনার সাথে এমন কোনো রাত কাঁটানোর। আসুন আসুন!

ইশানা খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার হাত ধরল। তারপর আমাকে টেনে দাঁড় করাল। আমিও ওর সাথে সাথে হাটতে লাগলাম। আমরা সমুদ্রের আরও কিছুটা কাছে গিয়ে হাজির হলাম। এবার ইশানা তোয়ালেটা বালির উপরে বিছিয়ে সেখানে বসে পড়ল। আমিও বসলাম ওর পাশে।

সমুদ্রের ঢেউয়ের পানি একেবারে আমাদের কাছে চলে আসছে। ইশানা কিছুটা সময় সেদিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই বলতে এমন একটা সময় যে কোন দিন আসবে সেটা আমি ভাবি নি। এভাবে রাতের বেলা ইশানার পাশে আমি কোনো দিন বসে সমুদ্র দেখতে পাব সেটা ভাবি নি কোনোদিন।
ইশানা বেশ কিছু সময় সামনের দৃশ্য উপভোগ করার পরে বলল, জানেন আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবি নি আপনার সাথে এমন একটা রাত কাঁটাতে পারব!
রাত কাঁটানো শব্দটা একটু অন্যরকম শোনায়। আমার মনের ভাব মনে হল ইশানা বুঝতে পারল। হেসে উঠে বলল, ভয় নেই, রাত কাঁটানোটা অন্য ভাবে নিয়েন না।
-নিচ্ছি না।
তারপর আরও কিছুটা নিরবতা। হঠাৎ সে আবারও বলতে শুরু করল, আমি ছোটবেলা থেকে আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করতাম। কেন করতাম জানি না কেবল পছন্দ করতাম। এখনও করি। যখন আপনি থাকতেন বাসায় কোনো না কোনো ছুঁতোয় আপনাকে দেখতে মন চাইতো। আপনি হয়তো কোনো দিন খেয়াল করেন নি যে আমি প্রতিদিন বারান্দায় আপনার জন্য অপেক্ষা করতাম কখন আপনি ফিরে আসেন। যেদিন আপনি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে এলেন সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন আমার কাছে কিছু একটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। অথচ দেখেন আপনি কোনো দিন আমার ছিলেনই না। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও আমি এক সময়ে টের পাই যে আন্টি আমাকে পছন্দ করেন না। কেন পছন্দ করেন না সেটা বুঝতে পারি নি।

আমি কী যে বলব সেটা বুঝতে পারলাম না। তাই চুপ করে রইলাম। ইশানা বলল, পরে বুঝেছি যে আমার নাচ গানের ব্যাপারটা আন্টি পছন্দ করতেন না। এক সময়ে আমি নিজে চেষ্টা করেছি খুব ভাল করে পড়াশোনা করার। এসএসসির একটা বছর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম মন দিয়ে পড়াশোনা করার। আশা ছিল যে রেজাল্ট ভাল হলে আন্টি হয়তো আমাকে পছন্দ করবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমার ব্রেন আপনার মত ভাল ছিল না। আপনি জানেন যে আমি এ প্লাস পাই নি। আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল যে আমি হেরে গেছি। আর কোন দিন আপনাকে পাবো না।

ইশানা যে এ প্লাস পায় নি সেটা আমি মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। সেই সাথে আরও অনেক কথাই। ইশানা বলল, আমি ভেবেছিলাম আমি অন্য লাইনে চলে গেলে আপনাকে ঠিক ঠিক ভুলে যাবো, আপনার কথা মনে হবে না আর কিন্তু তেমন কিছুই হয় নি। আমি একটা দিনের জন্য আপনাকে আমার মন থেকে ভুলতেই পারি নি।

আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম ইশানার এম্ন অকপটে সব স্বীকার করে নিতে দেখে। ইশানা বর্তমানে দেশের সব থেকে খ্যাতনামা সেলিব্রেটিদের একজন। ওর সাথে একটা ছবি তোলার জন্য কত মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। একবার ডাক দিলেই যে কেউ তার দিকে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে আসবে সেই আর এই মেয়ে আমাকে পছন্দ করে। আমার কাছে সত্যিই ব্যাপারটা অন্য রকম লাগল। আমি তখনও চুপ করেই আছি।
ইশানা আমার দিকে একটু যেন সরে এল। আমার মনে ওকে প্রশ্রয় দিতে মন চাইল। আসলে চারিদিকের পরিবেশটাই এমন ছিল। এমন পরিবেশে মন প্রশ্রয় দিতেই চায়। আমিও ইশানাকে প্রশ্রয় দিলাম। আর সত্যি বলতে কি ইশানার পাশে বসে থাকতে আমার নিজেরও ভাল লাগছিল। কিছু সময় চুপচাপ আমরা একই ভাবে বসেই রইলাম। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া আর কিছুই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম না।
এক সময় ইশানা আমার হাত ধরল। তারপর বলল, আমি কোন দিন আপনাকে পাওয়ার চেষ্টা কেন করি নি জানেন?
আমার একবার মনে হল যে আমি জিজ্ঞেস করি যে কেন কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করলাম না। আমি এই প্রশ্নের উত্তরটা জানি। আমার মায়ের কারণে। আমি যদি কোন ভাবে ইশানার প্রতি দুর্বল হয়ে যেতাম, ওর সাথে সম্পর্ক তৈরি হত তাহলে সেটা আমার মা কোন দিনও মেনে নিত না। ইশানা এই ব্যাপারটা চায় নি। আমাদের জীবনে এমনিতেও ঝামেলার শেষ নেই তার উপর দিয়ে আরেকটা ঝামেলা বাড়ানোর কোন মানে নেই।
আমি আর ইশানা সমুদ্রের তীরে ওভাবে বসে রইলাম একেবারে সকাল পর্যন্ত। সকালে এক সাথে সূর্যোদয় দেখলাম। ইশানাকে কেন জানি একই সাথে খুব আনন্দিত আবার দুঃখী মনে হল। একটা আনন্দময় বিষণ্ণতা ওকে ছেয়ে রেখেছে যেন।
দুপুরের দিকে আমাদের বাকি কাজ শেষ হয়ে গেল। বিকেলেই আমি রওয়ানা দিলাম আমার কর্মস্থলের দিকে। ইশানা আমাকে শেষবারের মত ধন্যবাদ দিল। জানাল যে জীবনে এমন চমৎকার রাত সে কাঁটায় নি। এমন চমৎকার রাত উপহার দেওয়ার জন্য সে আমাকে কয়েকবার করে ধন্যবাদ দিল।

মিউজিক ভিডিওটা আপলোড হওয়ার পরে সেটা বেশ ভাল রকমের হিট করল। সবাই গানের মডেন নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। এই মডেলটা আসলে কে? কেউই এই মডেলকে চেনে না। আমার সহকারি আমাকে এই ভিডিও দেখিয়ে বলল, স্যার এটা কি আপনি?
আমি তীব্র অবাক হয়েছি এমন একটা ভাব করে বললাম, আরে এটা নাকি! আমার মত খানিকটা চেহারা বলা যায়।
তবে সে এটা মানল না। কারণ কদিন আগেই ইশানা হাসপাতালে এসেছিল। তাই তাকে ভূগোল বোঝানো সম্ভব হল না। হাসপাতালে যে যে ইশানার গান শোনে বা দেখে তারা একে একে সবাই আমার কাছে এসে হাজির হল। সবাইকে সত্যি কথাটা বলতে বাধ্য হলাম। সেই সাথে এটাও জানালাম যে ইশানা আর আমি ছোট থেকে পাশাপাশি বড় হয়েছি। সে আমাকে অনেক আগে থেকেই চেনে। তার বিখ্যাত হওয়ার আগে থেকেই সে আমাকে চেনে।
তবে আমার মা তখনও ব্যাপারটা জানে না। তাই সম্ভবত এখনও আমাকে ফোন দিয়ে কিছু জানতে চায় নি। তবে সব থেকে বড় ব্যাপারটা ঘটল আরও মাস খানেক পরে। আবারও ইশানা আমার সামনে এসে হাজির। এবার এল আরও একটা আবদার নিয়ে। সপ্তাহ খানেক পরেই ন্যাশনাল এওয়্যাদ অনুষ্ঠান হবে। সেটাতে ইশানা পারফর্ম করবে। আমাকেও তার সাথে পারফর্ম করতে হবে। আমি শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কক্সবাজারে ডিরেকটরের কথা মত কাজ করা আর কয়েক হাজার দর্শকের সামনে পারফর্ম করার ভেতরে আকাশা পাতাল পার্থক্য রয়েছে। আমি শুনেই মানা করে দিলাম। তারপরই ইশানা জানাল যে তেমন কিছুই আমাকে করতে হবে না। কেবল মাত্র গানের শেশে এসে নিজের চেয়ার ছেড়ে দর্শকের সামনে এসে দাড়াতে হবে। ব্যাস আর কিছু না। বাকিটা ও নিজেই করবে।
এক সময়ে আমি রাজি হয়ে গেলাম। নির্ধারিত দিনের দুইদিন আগে আমি ঢাকা এসে পৌছালাম। ক্রুদের সাথে আলাপ আলোচনা হল। আমাকে কী কী করতে হবে সেটাও জানাল। যদিও কাজটা একেবারেই সহজ তার পরেও আমার জন্য এই কাজটা বেশ কঠিনই।

তারপরেই সে দিন এসে হাজির হল। আমি সহজ ভাবেই কাজটা করলাম। আমার পেছনে একজন দাঁড়িয়েছিল, সেই আমাকে জানালো যে কখন আমাকে সামনে যেতে হবে। সেই মোতাবেগ কাজ করলাম। একটা ক্যামেরা আমার সাথে সাথেই যাচ্ছিল। তখনই আমি দর্শকের মাঝে চিৎকার শুনতে পেলাম। তারা আমাকে খেয়াল করতে শুরু করেছে। আমাকে বড় স্ক্রিনে দেখানো শুরু করেছে। আমার অস্বস্তি লাগছিল খুব। কিন্তু যখন ইশানা আমার সামনে এসে হাজির হল আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর মুখটা এতো উজ্জ্বল আর আনন্দময় মনে হচ্ছিল যে আমি সব কিছু ভুলে গেলাম। ওর দিকেই কেবল তাকিয়ে রইলাম। আমার সত্যিই ভাল লাগছিল ওর আনন্দ দেখে।
পারফর্মেন্স শেষ হতে সবাই সামনেই ইশানা আমার গালে ছোট্ট করে একটা চুমু খেল। আবারও দর্শকের সারিতে হর্সধ্বনি শোনা গেল। দর্শকের সারিতে যারা বসে ছিল তারা কিন্তু সাধারণ কেউ ছিল না। এরা সবাই মূলত দেশের প্রথম সারির সেলিব্রেটি। আমার কাছে ব্যাপারটা ভালই লাগল। একেবারে রাতারাতি আমি বিখ্যাত হয়ে গেলাম। অনেকে আমার পরিচয় পর্যন্ত বের করে ফেলল এবং তারা এটাও খুজে বের করে ফেলল যে আমরা একই সাথে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বড় হয়েছি এবং এরপরে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে কারো কষ্ট হল না যে ইশানা যে মানুষটাকে নিয়ে কথা বলেছে তার ইন্টারভিউতে সেই মানুষটা আসলে আমি। সবাই যেন ঝাপিয়ে পড়ল পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এবং যথারীতি আমার মায়ের কাছেও খবর চলে গেল!

এই গল্পটা মূলত লেখা হয়েছে মূলত একটা লাইভ মিউজিক পারফর্মেন্স থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। এখানে রইলো সেই পার্ফমেন্সের ভিডিওটা। আর আসল মিউজিক ভিডিওটা। গুড গুডবাই। এই গল্পের আরেকটা পর্ব আসবে সম্ভবত।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

অপু তানভীরের নতুন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে থেকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 15

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *