লোভ করো না

oputanvir
4.7
(36)

রাতে বাসায় ফেরার সময় মিজানুরের রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার অভ্যাস অনেক দিনের । প্রতিদিন তার রাতের শিফট শেষ হয় বারোটার দিকে । তবে ডিউটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে হোটেল থেকে বের হয় না । এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে । বেশি বেশি কাজ করলে ম্যানেজারের চোখে পড়া যায় । ডিউটি শেষের পরেও যদি বেশি সময় থাকা যায় তাহলে সেটা মিজানুরের জন্য ভাল । ম্যানেজার খুশি থাকলে তার চাকরি থাকবে । নয়তো এক কথায় তার চাকরি চলে যাবে ।

রাত দুইটার দিকে বের হয় হোটেল থেকে । হোটেল থেকে মিজানুরের বাসা হেটে যেতে পনের বিশ মিনিটের মত লাগে । মাঝে সে রমিজ মিয়ার দোকানে বসে চা সিগারেট খায় । এই সময়ে এখানে লোকজন থাকে না বললেই চলে । তবে মাঝে মাঝে দল বেধে মানুষ এখানে চা খেতে আসে । টুরিস্ট স্পটের এই এক চিত্র । কখন যে কে কোথায় গিয়ে হাজির হবে সেটা বোঝার উপায় নেই । তবে ঘোরাঘুরির সিজনে অবশ্য সব সময়ই লোকজন থাকে । রাত বেশি হলে সেটা কমে গেলেও থাকে কিছু লোকজন ।

এখন অফ সিজন হওয়ার কারণে মিজানুরের হোটেলে গেস্টদের সংখ্যাও কম । গেস্টের সংখ্যা কম হলে হোটেল থেকে কর্মচারী কমিয়ে দেওয়া হয় । অনেকেই এই সময়ে ঘরে বসে থাকে । তবে মিজানুরকে বসে থাকতে হয় না । ম্যানেজার সব সময় মিজানুরকে কাজে রাখে । এই কারণেই মিজানুর ডিউটি শেষ হওয়ার পরেও অনেক সময় কাজ করে ।

রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে এসে মিজানুর দেখতে পেল আজকে সেখানে কেবল একটা মানুষ বসে রয়েছে । মিজানুর যেখানে প্রতিদিন বসে লোকটা সেখানেই বসে রয়েছে । পাশে একটা চায়ের কাপ । হাতে মোবাইল । লোকটার চোখ মোবাইলেই নিবদ্ধ ।
মিজানুরের মেজাজটা একটু খারাপ হল । নিজের পছন্দের জায়গাটাতে বসতে না পারার জন্য মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে রইলো কিছু সময় । খুব ইচ্ছে হল যে লোকটা কে বলে যে উঠে অন্য কোথায় বসতে । তবে সেটা বলতে পারলো না । লোকটার চেহারা দেখে ঠিক সাহসও হল না । কেমন একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে লোকটা একমনে তাকিয়ে রয়েছে নিজের মোবাইলের দিকে ।

মিজানুর অন্য একটা বেঞ্চে বসলো । তারপর রমিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, চাপা একটা চা দ্যান । কড়া লিচার । চিনি কম । আর হালকা দুধ ।
প্রতিদিন মিজানুর এই কথাই বলে । যদিও তার বলার দরকার পড়ে না কারণ রমিজ মিয়া ঠিক জানে যে মিজানুর কেমন চা খায় । দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই রমিজ সেটা বানাতে শুরুও করে দিয়েছে । অর্ডার দেওয়ার সাথে সাথেই চা চলে এল ।

রমিজ সেখানে একটা চুমুক ডিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো । ব্যাঞ্চন লাইট । এটা ইদানীং খাওয়া শুরু করেছে । এখন অবশ্য হাতে বেশ টাকা পয়সা এসেছে । তাই ওর মনে হয়েছে যে একটু দামি সিগারেট খাওয়াই যায় ।

সিগারেট ধরানোর সাথে সাথেই দোকানের বসা অন্য লোকটা ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো । তারপর নিজেও একটা সিগারেট বের করলো । মিজানুর মনে মনে একটু হাসলো । অন্যকে সিগারেট ধরাতে দেখলে মানুষের সিগারেটের তৃষ্ণ পায় প্রায়ই ।

মিজানুর দেখলো লোকটা সিগারেট মুখ নিলেও সেটা ধরাচ্ছে না । সম্ভবত আগুন নেই ।
মিজানুর একটু হেসে বলল, ভাইজানের কি দিয়াশলাই লাগবো?
লোকটা তখনও কিছু বলল না । এক ভাবে কী যেন ভাবলো । তারপর সিগারেটটা আবারও প্যাকেটে ভরে ফেলল । বলল, কাজের সময় সিগারেট ধরানো ঠিক না ।
কথাটা কাউকে উদ্দেশ্য করে নয় বরং আপন মনেই যেন বলল সে । মিজানুর ব্যাপারটা ঠিক বুঝলো না । এই রাতের বেলা আবার কাজ কিসের !
মিজানুর আরেকবার সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিল । চুমুক দিতে যাবে তখনই লোকটা মিজানুরের দিকে তাকিয়ে বলল, চন্দন ফকিরের খোজ দিতে পারো মিজানুর?

মিজানুর একটা বড় রকমের ধাক্কা খেল । সামনে বসা লোকটা ওকে চেনে । ওর নাম ধরে ডাক দিলো । এমনটা হতে পারে । হয়তো লোকটা ওর হোটেলেই উঠেছে । কিন্তু চন্দন ফকিরের নাম কিভাবে জানে সে । আর মিজানুরের সাথে যে তার পরিচয় আছে সেটা তো এই লোকের জানার কথা না । তাহলে কিভাবে জানে !
মিজানুর বলল, কী কইলেন?
-শুনতে পাও নি?
মিজানুরের গলা থেকে যেন কোন স্বর বের হল না প্রথমে । একটা দলা পাকানো থুতু এসে জমা হল গলার কাছে । কথা যেন আটকে আসতে শুরু করলো । মিজানুর কোন মতে বলল, আমি চিনি না ।
-চেনো না । সত্যি বলছো?
-হ্যা । আমি চিনি না ।

মিজানুর মনে একটা কু ডেকে উঠলো । তার মনে হল যে এখানে থাকাটা তার জন্য নিরাপদ হবে না । চন্দন ফকিরের সাথে তার নাম জড়ানো ব্যাপারটা মিজানুরের কাছে ঠিক ভাল মনে হচ্ছে না । সে দ্রুত চা শেষ করলো । সিগারেটটা হাতে নিয়েই দোকান থেকে বের হয়ে গেল । এমন কি চায়ের দামও দিতে ভুলে গেল । অবশ্য রমিজ মিয়া চায়ের দাম চাইলো না । কালকে দিলে দিতে পারে । তবে রমিজ কিংবা মিজানুরের কারোরই জানা নেই যে এই চায়ের দাম দেওয়ার সুযোগ মিজানুর আর পাবে না ।

মিজানুর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো নিজের বাড়ির দিকে । হেটে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না সে জানে । দ্রুত তাকে বাসায় চলে যেতে হবে । কিন্তু মিজানুর প্রায় আধা ঘন্টা ধরে হাটার পরে নিজের বাসায় পৌছাতে পারলো না । কেবলই মনে হতে লাগলো যেন সে একই স্থানে ঘুরে ফিরে বারবার আসছে ।

-মিজানুর !
মিজানুরকে এবার থামতে হল । তার পরিচিত রাস্তা তার কেমন অপরিচিত মনে হতে লাগলো । মনে হল যেন সে অন্য কোন জগতে চলে এসেছে । মনের ভেতরে একটা তীব্র ভয় এসে জড় হল তার ।
মিজানুর দেখলো চায়ের দোকানের সেই লোকটা তার সামনে এসে দাড়িয়েছে । মুখে একটা জলন্ত সিগারেট । মিজানুরের সামনে এসে বলল, সিগারেটটা ধরিয়েই ফেললাম । বুঝেছো?
-কে কে আপনি ?
-আমি? আমাকে চিনতে পারছো না?
-না ! কে আপনি ?
-তুমিই তো আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছো মিজানুর । না চিনলে কিভাবে হবে?
-আআমি !
-মনে নেই? মনে কর ! তোমার শরীরের রক্ত লেগে আছে আমার শরীরে… মনে কর মিজানুর !

মিজানুর তীব্র একটা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সামনের লোকটার দিকে । তার মাথায় কোন কথা আসছে না । কিছুই যেন বুঝতে পারছে না । রক্তের কথাটা মনে হতেই কিছু যেন তার মনে আসতে গিয়েও আসলো না ।
লোকটা আবার বলল, চন্দন ফফির । রক্ত ! এবার মনে পড়েছে ?

সাথে সাথেই মনে পড়লো মিজানুরের । এবং মনে হতেই একটা তীব্র ভয় এসে জড় হল মনে । ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলো সে । কিন্তু পা যেন আটকে আছে মাটিতে । একটুও যেন নড়ছে না ।

মাস দুয়েক আগের ঘটনা । মিজানুর যে হোটেলে চাকরি করে সেখানেই এক গেস্টের ব্যাগে অনেক গুলো টাকা দেখতে পায় মিজানুর । এতো তীব্র লোভ জন্মে ওর । কিন্তু মিজানুর জানে যে টাকা গুলো যদি সে নেয় তাহলে ঠিক ঠিক রিপোর্ট করা হবে । তাকে খুজে বের করাটাও খুব একটা কঠিন হবে না । কিন্তু এমন যদি টাকা সে নিল কিন্তু টাকার মালিক রিপোর্ট করলো না, তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই ।

সেদিন রাতে সোজা সে চন্দন ফকিরের কাছে গিয়ে হাজির হয় । তাকে ব্যাপারটা বলতেই সে জানায় সামান্য একটা জ্বীনকে ঐ লোকটার পেছনে লেলিয়ে দেওয়া সম্ভব । তাহলে লোকটার আর কিছুই মনে থাকবে না । দুজন মিলে এই যুক্তি করলো । মিজানুর হোটেলের রুম থেকে লোকটার মাথার চুল আর কাপড়ের অংশ যোগার করলো । তার কাছে মাস্টার কী ছিল । খুব একটা সমস্যা হল না । তারপর রাতে সেটা নিয়ে হাজির হল চন্দন ফকিরের কাছে । মাথার চুল আর কাপড়ের সাথে আরেকটা জিনিস দিতে হয়েছিলো । সেটা হচ্ছে মিজানুরের শরীরের এক ফোটা রক্ত । চন্দন ফকির বলেছিলো যে এই রক্ত থেকেই জ্বীন শক্তি পাবে । এভাবেই জ্বীন ডেকে নিয়ে আসতে হয় ।

মিজানুর চোখ বড় বড় করে কেবল তাকিয়ে রইলো । লোকটা বলল, চন্দন ফকির তোমাকে যা বলে নি সেটা হচ্ছে সে আমাকে ঐ লোকটার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছিলো । যত সময় না তার মৃত্যুর হবে তত সময় তাকে আমি ছাড়তে পারবো না । তবে আমার থেকেও শক্তিশালী একজনকে দিয়ে তার থেকে আমাকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে । এখন বল আমার তো আর যাওয়ার জায়গা নেই এই দুনিয়াতে । আমার একমাত্র বন্ধন এখন তোমার সাথে !
-মা-মানে !
-মানে হচ্ছে চুল আর কাপড় দিয়ে ঐ লোকটার সাথে আটকে ছিলাম আমি । সেই বন্ধন যখন ছুটে গেছে তখন আমি তোমার রক্তের সাথে যুক্ত হয়ে গেছি । আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে প্রাণ নিয়ে যাওয়ার জন্য । এখ একটা প্রাণ না নিয়ে তো আমি যাবো না মিজানুর !

মিজানুর যেন ঠিক মত বুঝতে পারলো না । ওর কাছে সব কিছু কেমন যে ধোয়াসা ঠেকলো । অনেক গুলো টাকা ছিল যার বেশির ভাগই রয়ে গেছে । কিছুই করে নি সে টাকা দিয়ে । কেবল পছন্দের একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলো । আর বউকে একটা কিনেছিলো । এখনও অনেক টাকা রয়ে গেছে ।
-আসো মিজানুর আমাকে মুক্তি দাও । আমাকে যেতে হবে ফিরে !
-না না । না না !
এই বলে মিজানুর দৌড় দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না । খুব শীতল একটা হাত তার হাত চেপে ধরেছে । এই হাত বড় শক্ত আর শীতল !

পরদিন সকালে মিজানুরকে পাওয়া যায় তার বাসা থেকে দুইশ মিটার দুরে রাস্তার পাশে । তার ঘাড়টা কেউ ভয়ানক ভাবে ভেঙ্গে দিয়েছে । মিজানুরের চেহারায় একটা তীব্র আতংঙ্কের রেখা ফুটে উঠে রয়েছে । কোন কিছু কিংবা কাউকে দেখে সে ভয়ানক ভয় পেয়ে তারপর মারা গেছে !

গল্পটার থিমটি মাথায় আসে বাবু ভাইয়ের ইউটিউব চ্যানেল থেকে শোনা একটা গল্প শোনার পরে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 36

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →