রাতে বাসায় ফেরার সময় মিজানুরের রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার অভ্যাস অনেক দিনের । প্রতিদিন তার রাতের শিফট শেষ হয় বারোটার দিকে । তবে ডিউটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে হোটেল থেকে বের হয় না । এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে । বেশি বেশি কাজ করলে ম্যানেজারের চোখে পড়া যায় । ডিউটি শেষের পরেও যদি বেশি সময় থাকা যায় তাহলে সেটা মিজানুরের জন্য ভাল । ম্যানেজার খুশি থাকলে তার চাকরি থাকবে । নয়তো এক কথায় তার চাকরি চলে যাবে ।
রাত দুইটার দিকে বের হয় হোটেল থেকে । হোটেল থেকে মিজানুরের বাসা হেটে যেতে পনের বিশ মিনিটের মত লাগে । মাঝে সে রমিজ মিয়ার দোকানে বসে চা সিগারেট খায় । এই সময়ে এখানে লোকজন থাকে না বললেই চলে । তবে মাঝে মাঝে দল বেধে মানুষ এখানে চা খেতে আসে । টুরিস্ট স্পটের এই এক চিত্র । কখন যে কে কোথায় গিয়ে হাজির হবে সেটা বোঝার উপায় নেই । তবে ঘোরাঘুরির সিজনে অবশ্য সব সময়ই লোকজন থাকে । রাত বেশি হলে সেটা কমে গেলেও থাকে কিছু লোকজন ।
এখন অফ সিজন হওয়ার কারণে মিজানুরের হোটেলে গেস্টদের সংখ্যাও কম । গেস্টের সংখ্যা কম হলে হোটেল থেকে কর্মচারী কমিয়ে দেওয়া হয় । অনেকেই এই সময়ে ঘরে বসে থাকে । তবে মিজানুরকে বসে থাকতে হয় না । ম্যানেজার সব সময় মিজানুরকে কাজে রাখে । এই কারণেই মিজানুর ডিউটি শেষ হওয়ার পরেও অনেক সময় কাজ করে ।
রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে এসে মিজানুর দেখতে পেল আজকে সেখানে কেবল একটা মানুষ বসে রয়েছে । মিজানুর যেখানে প্রতিদিন বসে লোকটা সেখানেই বসে রয়েছে । পাশে একটা চায়ের কাপ । হাতে মোবাইল । লোকটার চোখ মোবাইলেই নিবদ্ধ ।
মিজানুরের মেজাজটা একটু খারাপ হল । নিজের পছন্দের জায়গাটাতে বসতে না পারার জন্য মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে রইলো কিছু সময় । খুব ইচ্ছে হল যে লোকটা কে বলে যে উঠে অন্য কোথায় বসতে । তবে সেটা বলতে পারলো না । লোকটার চেহারা দেখে ঠিক সাহসও হল না । কেমন একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে লোকটা একমনে তাকিয়ে রয়েছে নিজের মোবাইলের দিকে ।
মিজানুর অন্য একটা বেঞ্চে বসলো । তারপর রমিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, চাপা একটা চা দ্যান । কড়া লিচার । চিনি কম । আর হালকা দুধ ।
প্রতিদিন মিজানুর এই কথাই বলে । যদিও তার বলার দরকার পড়ে না কারণ রমিজ মিয়া ঠিক জানে যে মিজানুর কেমন চা খায় । দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই রমিজ সেটা বানাতে শুরুও করে দিয়েছে । অর্ডার দেওয়ার সাথে সাথেই চা চলে এল ।
রমিজ সেখানে একটা চুমুক ডিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো । ব্যাঞ্চন লাইট । এটা ইদানীং খাওয়া শুরু করেছে । এখন অবশ্য হাতে বেশ টাকা পয়সা এসেছে । তাই ওর মনে হয়েছে যে একটু দামি সিগারেট খাওয়াই যায় ।
সিগারেট ধরানোর সাথে সাথেই দোকানের বসা অন্য লোকটা ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো । তারপর নিজেও একটা সিগারেট বের করলো । মিজানুর মনে মনে একটু হাসলো । অন্যকে সিগারেট ধরাতে দেখলে মানুষের সিগারেটের তৃষ্ণ পায় প্রায়ই ।
মিজানুর দেখলো লোকটা সিগারেট মুখ নিলেও সেটা ধরাচ্ছে না । সম্ভবত আগুন নেই ।
মিজানুর একটু হেসে বলল, ভাইজানের কি দিয়াশলাই লাগবো?
লোকটা তখনও কিছু বলল না । এক ভাবে কী যেন ভাবলো । তারপর সিগারেটটা আবারও প্যাকেটে ভরে ফেলল । বলল, কাজের সময় সিগারেট ধরানো ঠিক না ।
কথাটা কাউকে উদ্দেশ্য করে নয় বরং আপন মনেই যেন বলল সে । মিজানুর ব্যাপারটা ঠিক বুঝলো না । এই রাতের বেলা আবার কাজ কিসের !
মিজানুর আরেকবার সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিল । চুমুক দিতে যাবে তখনই লোকটা মিজানুরের দিকে তাকিয়ে বলল, চন্দন ফকিরের খোজ দিতে পারো মিজানুর?
মিজানুর একটা বড় রকমের ধাক্কা খেল । সামনে বসা লোকটা ওকে চেনে । ওর নাম ধরে ডাক দিলো । এমনটা হতে পারে । হয়তো লোকটা ওর হোটেলেই উঠেছে । কিন্তু চন্দন ফকিরের নাম কিভাবে জানে সে । আর মিজানুরের সাথে যে তার পরিচয় আছে সেটা তো এই লোকের জানার কথা না । তাহলে কিভাবে জানে !
মিজানুর বলল, কী কইলেন?
-শুনতে পাও নি?
মিজানুরের গলা থেকে যেন কোন স্বর বের হল না প্রথমে । একটা দলা পাকানো থুতু এসে জমা হল গলার কাছে । কথা যেন আটকে আসতে শুরু করলো । মিজানুর কোন মতে বলল, আমি চিনি না ।
-চেনো না । সত্যি বলছো?
-হ্যা । আমি চিনি না ।
মিজানুর মনে একটা কু ডেকে উঠলো । তার মনে হল যে এখানে থাকাটা তার জন্য নিরাপদ হবে না । চন্দন ফকিরের সাথে তার নাম জড়ানো ব্যাপারটা মিজানুরের কাছে ঠিক ভাল মনে হচ্ছে না । সে দ্রুত চা শেষ করলো । সিগারেটটা হাতে নিয়েই দোকান থেকে বের হয়ে গেল । এমন কি চায়ের দামও দিতে ভুলে গেল । অবশ্য রমিজ মিয়া চায়ের দাম চাইলো না । কালকে দিলে দিতে পারে । তবে রমিজ কিংবা মিজানুরের কারোরই জানা নেই যে এই চায়ের দাম দেওয়ার সুযোগ মিজানুর আর পাবে না ।
মিজানুর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো নিজের বাড়ির দিকে । হেটে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না সে জানে । দ্রুত তাকে বাসায় চলে যেতে হবে । কিন্তু মিজানুর প্রায় আধা ঘন্টা ধরে হাটার পরে নিজের বাসায় পৌছাতে পারলো না । কেবলই মনে হতে লাগলো যেন সে একই স্থানে ঘুরে ফিরে বারবার আসছে ।
-মিজানুর !
মিজানুরকে এবার থামতে হল । তার পরিচিত রাস্তা তার কেমন অপরিচিত মনে হতে লাগলো । মনে হল যেন সে অন্য কোন জগতে চলে এসেছে । মনের ভেতরে একটা তীব্র ভয় এসে জড় হল তার ।
মিজানুর দেখলো চায়ের দোকানের সেই লোকটা তার সামনে এসে দাড়িয়েছে । মুখে একটা জলন্ত সিগারেট । মিজানুরের সামনে এসে বলল, সিগারেটটা ধরিয়েই ফেললাম । বুঝেছো?
-কে কে আপনি ?
-আমি? আমাকে চিনতে পারছো না?
-না ! কে আপনি ?
-তুমিই তো আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছো মিজানুর । না চিনলে কিভাবে হবে?
-আআমি !
-মনে নেই? মনে কর ! তোমার শরীরের রক্ত লেগে আছে আমার শরীরে… মনে কর মিজানুর !
মিজানুর তীব্র একটা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সামনের লোকটার দিকে । তার মাথায় কোন কথা আসছে না । কিছুই যেন বুঝতে পারছে না । রক্তের কথাটা মনে হতেই কিছু যেন তার মনে আসতে গিয়েও আসলো না ।
লোকটা আবার বলল, চন্দন ফফির । রক্ত ! এবার মনে পড়েছে ?
সাথে সাথেই মনে পড়লো মিজানুরের । এবং মনে হতেই একটা তীব্র ভয় এসে জড় হল মনে । ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলো সে । কিন্তু পা যেন আটকে আছে মাটিতে । একটুও যেন নড়ছে না ।
মাস দুয়েক আগের ঘটনা । মিজানুর যে হোটেলে চাকরি করে সেখানেই এক গেস্টের ব্যাগে অনেক গুলো টাকা দেখতে পায় মিজানুর । এতো তীব্র লোভ জন্মে ওর । কিন্তু মিজানুর জানে যে টাকা গুলো যদি সে নেয় তাহলে ঠিক ঠিক রিপোর্ট করা হবে । তাকে খুজে বের করাটাও খুব একটা কঠিন হবে না । কিন্তু এমন যদি টাকা সে নিল কিন্তু টাকার মালিক রিপোর্ট করলো না, তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই ।
সেদিন রাতে সোজা সে চন্দন ফকিরের কাছে গিয়ে হাজির হয় । তাকে ব্যাপারটা বলতেই সে জানায় সামান্য একটা জ্বীনকে ঐ লোকটার পেছনে লেলিয়ে দেওয়া সম্ভব । তাহলে লোকটার আর কিছুই মনে থাকবে না । দুজন মিলে এই যুক্তি করলো । মিজানুর হোটেলের রুম থেকে লোকটার মাথার চুল আর কাপড়ের অংশ যোগার করলো । তার কাছে মাস্টার কী ছিল । খুব একটা সমস্যা হল না । তারপর রাতে সেটা নিয়ে হাজির হল চন্দন ফকিরের কাছে । মাথার চুল আর কাপড়ের সাথে আরেকটা জিনিস দিতে হয়েছিলো । সেটা হচ্ছে মিজানুরের শরীরের এক ফোটা রক্ত । চন্দন ফকির বলেছিলো যে এই রক্ত থেকেই জ্বীন শক্তি পাবে । এভাবেই জ্বীন ডেকে নিয়ে আসতে হয় ।
মিজানুর চোখ বড় বড় করে কেবল তাকিয়ে রইলো । লোকটা বলল, চন্দন ফকির তোমাকে যা বলে নি সেটা হচ্ছে সে আমাকে ঐ লোকটার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছিলো । যত সময় না তার মৃত্যুর হবে তত সময় তাকে আমি ছাড়তে পারবো না । তবে আমার থেকেও শক্তিশালী একজনকে দিয়ে তার থেকে আমাকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে । এখন বল আমার তো আর যাওয়ার জায়গা নেই এই দুনিয়াতে । আমার একমাত্র বন্ধন এখন তোমার সাথে !
-মা-মানে !
-মানে হচ্ছে চুল আর কাপড় দিয়ে ঐ লোকটার সাথে আটকে ছিলাম আমি । সেই বন্ধন যখন ছুটে গেছে তখন আমি তোমার রক্তের সাথে যুক্ত হয়ে গেছি । আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে প্রাণ নিয়ে যাওয়ার জন্য । এখ একটা প্রাণ না নিয়ে তো আমি যাবো না মিজানুর !
মিজানুর যেন ঠিক মত বুঝতে পারলো না । ওর কাছে সব কিছু কেমন যে ধোয়াসা ঠেকলো । অনেক গুলো টাকা ছিল যার বেশির ভাগই রয়ে গেছে । কিছুই করে নি সে টাকা দিয়ে । কেবল পছন্দের একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলো । আর বউকে একটা কিনেছিলো । এখনও অনেক টাকা রয়ে গেছে ।
-আসো মিজানুর আমাকে মুক্তি দাও । আমাকে যেতে হবে ফিরে !
-না না । না না !
এই বলে মিজানুর দৌড় দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না । খুব শীতল একটা হাত তার হাত চেপে ধরেছে । এই হাত বড় শক্ত আর শীতল !
পরদিন সকালে মিজানুরকে পাওয়া যায় তার বাসা থেকে দুইশ মিটার দুরে রাস্তার পাশে । তার ঘাড়টা কেউ ভয়ানক ভাবে ভেঙ্গে দিয়েছে । মিজানুরের চেহারায় একটা তীব্র আতংঙ্কের রেখা ফুটে উঠে রয়েছে । কোন কিছু কিংবা কাউকে দেখে সে ভয়ানক ভয় পেয়ে তারপর মারা গেছে !
গল্পটার থিমটি মাথায় আসে বাবু ভাইয়ের ইউটিউব চ্যানেল থেকে শোনা একটা গল্প শোনার পরে।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.