পরের দুইতিন তৃষার সাথে একই রকম ঘটনা ঘটার পরেই তৃষা এই ব্যাপারটা বুঝতে পারল যে ঘুমের ঔষধ খাবারের সাথে মেশানো নয় । সেটা পানির সাথে মেশানো । তবে সব থেকে অবার করার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিদিন রাতেই তৃষার ঘুম ঠিকই সেই একই সময়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল তবে পুরোপুরি না। তন্দ্রা ছুটে যাচ্ছিল তবে পুরোপুরি জেগে উঠছিল না । সম্ভবত তৃষার রাতে ঘুম না আসার কারণে এমনটা হচ্ছিল। প্রতি রাতেই সে অনুভব করছিল সেই আওয়াজটা। বড় কোন পাখি যেন ডানা ঝাপটায় । কিছু একটা থপ করে নেমে আসে নিচে ।
ব্যাপারটা নিয়ে সে অপুর সাথে আলোচনা করেছে । অপু নিজেও ব্যাপার নিয়ে খানিকটা নিয়ে চিন্তিত । সে পুরো রাত এই নিরাময়ের উপরে নজর রেখেছ । কিছু আসতে দেখে নি। এবং কাউকে ট্রলারে করেও আসতে আসতে দেখে নি। এই কথা শুনে তৃষার মনে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে সন্দেহ জাগল । অপু ওকে নিশ্চিত ভাবেই বলেছে রাতে সে কাউকেই এখানে আসতে দেখে নি । এবং এই ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত । তাহলে প্রতিদিন রাতে যে দ্বীন মোহাম্মাদ এখানে আসে তাহলে সে কোথা থেকে আসে? কিভাবে আসে?
তৃষাকে আজকে দেখতে হবেই ?
রাত নয়টার ভেতরেই খাবার চলে এল ঘরে । সাথে জগভর্তি পানি । তৃষা পানির জগের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। আজকে ঐ পানি খাওয়া যাবে না মোটেও । আজকে ওকে জেগে থাকতে হবে । আজকে দেখতে হবে ওটা আসলে কিসের আওয়াজ !
আরেকটা ব্যাপার নিয়ে তৃষা বেশ চিন্তিত । তৃষার বাবা এখন সারা দিন ঘুমাচ্ছে । দিনে যতবার যে বাবার সাথে দেখা করতে গেছে ততবারই সে বিছানাতে ঘুমিয়ে রয়েছে । ডাক দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে, চোখে মেলে তাকাচ্ছে তবে তার ঘুম ভাঙ্গছে না । তৃষার মনে হচ্ছে যেন সে ঘোরের ভেতরে রয়েছে । কথা বলেও যেন বলছে না । এটা মোটেও ভাল লাগছে না তৃষার । বারবার মনে হচ্ছে এখান থেকে চলে যেতে আবার বাবাকে সুস্থ করার একটা সম্ভবনাকে সে এভাবে হেলাতে হারাতে চাচ্ছে না ।
তৃষা অপেক্ষা করতে লাগল । আজকে সে সেই তীব্র ঘুমের ভাবটা অনুভব করল না । তবে একটু যেন তন্দ্রার মত ঠিক এল । হালকা ঘুমের একটা ভাব চলে এল । কত সময় ধরে সে এমন ভাবে ঝিমিয়েছে সেটা সে বলতে পারবে না । ঘুমটা ভাঙ্গল প্রতিদিনের মত করেই । বড় কোন ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ শুনেই । সাথে সাথে তৃষা উঠে বসল। ঘুমের ভাবটা কেটে গেল সাথে সাথেই। চট জলদি তৈরি হয়ে নিল সে। ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট রিভালবারটা পকেটে নিল । পরে সেই এয়ারবার্টসটা কানে দিল । মৃদু স্বরে বলল, অপু শুনতে পাচ্ছো?
ওপাশ থেকে সাথে সাথেই শোনা গেল, হ্যা ।
-আমি নিচে যাচ্ছি।
-সাবধানে! আমি আছি খুব কাছেই। একটু পরেই গেটের কাছে পৌছে যাব।
-আচ্ছা ।
এয়ারবার্টসটা খুলে রাখল নিজের পকেটে। একবার ভেবেছিল যে কানেই রাখবে তবে সেটা খুলে পড়ে যেতে পারে । পকেটে থাকলে পরে দরকার মত আবার অপুর সাথে যোগাযোগ করা যাবে। তৃষা লম্বা করে একটা দম নিল ।
তারপর দরজা খুলে বের হয়ে এল ঘর থেকে । এখনো সেই ডানা ছাপটানোর আওয়াজ কানে আসছে । কিছু একটা পুরো বিল্ডিংয়ের উপরে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে।
চারিদিকে চাদের আলো আপছায়া আলো । সব কিছু বেশ ভাল ভাবেই দেখতে পাচ্ছে তৃষা । পকেটে একটা টর্চ রয়েছে । তবে সেটা জ্বালাল না ।
তৃষা সিড়ি নিচে নেমে এল নিচে । ধীর পায়ে । তখনই শুনতে পেল সেই থপ করে নামার আওয়াজ শুনতে পেল । সেটা নেমেছে ওর বাবা যে বিল্ডিং এ আছে সেখানেই ।
তৃষা দ্রুত পা চালাল । কিন্তু একতলা বিল্ডিংটার ভেতরে সে প্রবেশ করতে পারল না । কারন সেটার গেটে তালা দেওয়া ।
এটা যে তালা দেওয়া থাকতে পারে –সেটা আগে থেকেই ভাবার দরকার ছিল। এখন উপায়?
ঠিক সেই সময়ে তৃষার মনে হল কেউ ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে ।
-আপনি এখানে কী করছেন?
কবীর শেখের কঠিন কন্ঠটা তৃষার কানে এল । ঘুরে না দাড়িয়েই তৃষা বলল, আমাকে ভেতরে যেতে হবে?
-এখন কেউ ভেতরে যাবে না । এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে। ডাক্তার দ্বীন মোহাম্মাদ ভেতরে ঢুকেছেন। বাইরে বের হওয়ার সময়ে আমাদের এখানে থাকা চলবে না ।
-আমি ভেতরে যাব। আপনি দরজার তালা খুলে দিবেন ।
-এটা হবে না ।
তৃষা এবার ফিরে তাকাল কবীর শেখের দিকে। তারপর পকেট থেকে পিস্তলটা তাক করল কবীর শেখের দিকে ।
-দরজা খুলুন
-আমি কোন ভাবেই দরজা খুলব না । এখন দরজা খোলা মানে হচ্ছে নিজের বিপদ ডেকে আনা !
-আপনি এমন একজন বিপদজনক মানুষের কাছে আবার বাবাকে ঠেলে দিয়েছেন যার সামনে আপনি নিজে যেতে পারছেন না! আপনি এখনই দরজা খুলবেন । এখনই !
-না ! আর আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই । আমি জানি আপনি গুলি চালাতে পারবেন না ।
এই কথা বলার সাথে সাথে তৃষা গুলি চালাল এবং কবীর শেখের ঠিক কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল গুলিটা ।
তৃষা বলল, ভাববেন না যে মিস করেছি। পরের গুলিটা সরাসরি যাবে আপনার বুকে । দরজা খুলুন ।
তৃষা যে গুলি চালাবে এটা সম্ভবত কবীর শেখ ভাবতেও পারে নি। এবার তার কন্ঠে খানিকটা অনুন্য শোনা গেল । সে বলল, প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন ।
-দরজা খুলবে নাকি এবার সরাসরি গুলি চালাব?
তৃষা দেখতে পেল কবীর শেখ ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল । তারপর তালার চাবি ঢোকাল । তবে সেটা পুরোপুরি খুলে দিল না । তৃষ দেখল এবার কবীর শেখ দ্রুত দুই তলা বিল্ডিংয়ের দিকে দৌড়ে চলে গেল । আরও ভাল করে বললে দৌড়ে পালাল । তার মানে ভেতরে যে আছে সেটাকে কবীর শেখ সত্যি ভয় পাচ্ছে । আর তৃষা এবার নিজের ভেতরেই একটা তাগাদা অনুভব করল । ওকে এখনই ওর বাবার কাছে যেতে হবে ।
গেট খুলে তৃষা দ্রুত এগিয়ে চলল। বাবার কেবিনের সামনে এসে তৃষা থামল একটু। বড় করে একটা দম নিল।
এক ধাক্কায় দরজার খুলে ফেলল ।
ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে । আলোটা আসছে বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলের উপরে রাখা লন্ঠন থেকে। সেই আলোতেই তৃষা সম্ভবত নিজের জীবনের সব থেকে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেল !
তৃষার বাবা নিজের খাটের উপর শুয়ে রয়েছে । তার চোখ বন্ধ। ঠিক তার উপরে একটা অদ্ভুত পাখি জাতীয় প্রাণী। বড় ঈগল পাখির মত তার শরীর । আকারে একজন মানুষের মত বড়। সব কিছু পাখির মত হলেও তার মুখটা পাখির মত নয় । সেটা একজন মানুষের মাথা । আর মাথাটা ঠিক তৃষার বাবার মুখের উপরে । মুখ দিয়ে সেটা যেন তৃষার বাবাকে কিছু করছে ।
তৃষার মনের ভেতরে অদ্ভুত এক ভয় এসে জমা হল। সেই সাথে একটা তীব্র রাগ !
তৃষা আর কিছু না ভেবে সোজা গুলি চালাল ।
গুলিটা লাগল প্রাণীটার শরীরে । ছিটকে গেল সেটা । সেই সাথে তীব্র একটা চিৎকার ভেসে এল । তৃষা আবারও গুলি চালাল । পরপর চারটা !
তৃষার কিছু দেখার দরকার পড়ল না । সে নিজের বাবার কাছে গিয়ে হাজির হল । তাকে ডেকে তুলল । তবে তার কোন হুস হল না । সে যেন ঘোরের ভেতরে রয়েছে । তবে তৃষা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে বাবাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল।
-বাবা ওঠো ! বাবা ওঠো !
তৃষার চোখে গেল সেই অদ্ভুত প্রাণীটার দিকে । সেটা এবার উঠে দাঁড়াবে । তার চোখে তীব্র একটা রাগ । জলন্ত চোখে সে তৃষার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এবারই সেটা উঠে দাঁড়াবে !
তবে সেটা দাড়াতে পারল না । কারণ আরেকটা গুলি এসে লাগল তার শরীরে । ছোট ঘরে গুলির আওয়াজ হল তীব্র !
গুলিটা এসেছে দরজার কাছ থেকে । অপু একটা শর্টগান নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও !
তৃষার মাথায় প্রথম যে প্রশ্নটা এল সেটা হচ্ছে, অপু এখানে কিভাবে এল ? দেওয়াল টপকে?
নাকি দরজা খুলে?
সদর দরজা দিনের বেলা খোলা থাকলেও রাতের বেলা সম্ভবত তালা মেরে রাখা হয় ! এসব ভাবার সময় নেই এখন! এখন এখান থেকে ওদের বের হতে হবে। ঐতো প্রাণীটা আবারও উঠে দাড়াচ্ছে। অপুর শর্টগান আরেকবার গর্জে উঠল । তৃষা দেখল সেটার ধাক্কায় আরেকবার পাখির মত প্রাণীটা ছিটকে গেল দেয়ালের দিকে। অপু এবার নিজেই এগিয়ে এল । তারপর তৃষাকে সাহায্য করল ওর বাবা নিয়ে যেতে !
ওরা বোট পর্যন্ত যে কিভাবে সেটা ওরা নিজেরাও জানে না । তৃষার বারবার কেবল মনে হচ্ছিল যেন এখনই পেছন থেকে সেই প্রাণীটা উড়ে চলে আসবে । ওদের কাউকে ধরে নিয়ে যাবে তবে তেমন কিছু হল না । বোটে ওঠা মাত্র বোট ছেড়ে দেওয়া হল ।
বোট পূর্ণ বেগে চলল কাছের বাজারের দিকে । এখন এই রাতের বেলা মাঝ হাওরের ভেতরে যাওয়ার কোন মানে হয় না । বাজারে পৌছাতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগল তবে তৃষার এ পুরো সময় ধরে মনে হল যে কিছু একতা ওদের মাথার উপরেই যেন ঘোরা ফেরা করছে।
যখন বাজারের ঘাটে পৌছালো তখন ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার একটু ফুরসৎ পেল । তবে তখনও তৃষার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ও নিজের চোখে কী দেখেছে । কেবল তো তৃষা নিজে একা দেখে নি । অপুও দেখেছে ।
অদ্ভুত পাখির মত প্রাণী । তবে মানুষের মাথাওয়ালা । এমন প্রাণী সে কোন পৌরানিক কাহিনীতে পড়ে থাকতে পারে । বাস্তবে কি এমন কিছু থাকে নাকি থাকতে পারে?
কিন্তু দুজন মানুষ কিভাবে একই সাথে কিভাবে ভুল দেখতে পারে?
সকাল বেলা বাজারের মানুষ যখন জানতে পারল যে ওরা ঐ ক্লিনিক থেকে এসেছে তখন ওরাও বলল যে মাঝে মাঝেই ওখান থেকে নাকি অদ্ভুত কিছু একটা উড়ে যেতে দেখেছে । বাজার এবং এই এলাকার সবাই তাই ঐ ছোট দ্বিপটাকে একেবারে এড়িয়ে চলে ।
ফেরার পথে তৃষা নিরাময়ে গিয়ে আবার হাজির হল । অবাক হয়্যে দেখল গেটটা খোলা । অপু খোলা শর্টগান নিয়েই ভেতরে ঢুকল । তৃষা কবীর শেখের সাথে কথা বলতে চাইছিল । কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করল যে ভেতরে কেউ নেই । তৃষা জানে যে কেবল একজনই থাকে এখানে । তবে আজকে ঢুকে মনে হচ্ছে যেন কেউ নেই । কবীর শেখ পালিয়েছে কোন কারণে ।
নিজেদের ব্যাগগুলো নিয়ে নিল। বাবার কেবিনের ভেতরেও ঢুকল ওরা । টেবিল চেয়ার আর বিছানা সব তেমন ভাবেই পরে আছে । তবে গতকাল যে এখানে কিছু হয়েছিল সেটা স্পষ্ট । ওরা আর বেশি সময় দাড়াল না । নিজেদের সব কিছু নিয়ে আবারও হাউজবোটে উঠল ।
পরিশিষ্টঃ
মাস খানেক পরের ঘটনা। তৃষা ভুরু কুচকে তাকিয়ে রয়েছে লাশটার দিকে । চোখে একটা তীব্র বিশ্ময় কাজ করছে। সেই সাথে আশংঙ্কা । লাশটাকে তৃষা চিনতে পেরেছে । এটাই তার চিন্তার কারণ ।
ঐ নিরাময় ক্লিনিকে যে মা আর ছেলে এসেছিল, ওদের যাওয়ার পরের দিন চলে এসেছিল সে ছেলেটির লাশ এটি । এবং সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটার শরীরের বেশ কিছু অংশ খাওয়া । দেখলে মনে হয় কেউ যেন খুবলে খুবলে খেয়েছে ছেলেটির শরীর । এবং তৃষা জানে কে এই কাজ করেছে।
তাহলে ওর বাবাও এমন হবে?
হাসান ঠিক এমন হয়েছিল । এমন ভাবেই সে মানুষের মাংস খেয়ে টিকে ছিল । ওর বাবাও কি এমন হতে চলেছে?
তৃষা নিরাময় থেকে আসার পরপরই ওর বাবার পুরো চেকআপ করিয়েছিল । তীব্র বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করে দেখেছে যে সে ক্যান্সার সেল গুলো অনেকটাই সেরে উঠেছে । পুরোপুরি ঠিক না হলেও এমন স্থানে এখন আছে যেখানে চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। তৃষা তীব্র বিস্মিত হয়েছিল । ডাক্তার খায়রুলও একই রকম বিস্ময় প্রকাশ করেছিল । সাথে সাথেইত আকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে । অপু সাথেই গেছে । সেখানেও রিপোর্ট গুলো বেশ ভালই এসেছে । ক্যান্সারের এই পর্যায় থেকে তার বাবাকে নিরাময় করা সম্ভব। এটা একটা আনন্দের সংবাদ । তবে তৃষার মন থেকে দুঃশ্চিন্তা দূর করতে পারছে না ।
সত্যিই এমন কিছু তার বাবার সাথেও ঘটবে?
গল্পটা এখানেই শেষ আপাতত । এই গল্পের মূল থিম বা লেখার আইডিয়াটা আমার নয় । বাবু ভাইয়ের রেডিও অডিও শো অদ্ভুতুরেতে একটা গল্প শোনার পরেই এই গল্পটা লেখার কথা মাথায় এসেছে । সেখানে একজন নিজের চিকিৎসার জন্য এক অদ্ভুত হাসপাতালে গিয়ে হাজির হয়। এবং সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে যায় । পরে তার ভেতরে এই জান্তব ভাব দেখা যায় । সে মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। কবর থেকে লাশ বের করে মানুষকে খুন করে হলেও খেয়ে সেই মাংস খেতে থাকে।