তৃষার মনে হল কেউ যেন ওর কানের ফিসফিস করে কিছু বলছে ! ফিসফিস করে অদ্ভুত সব শব্দ করে ওর কানের কাছে বলে যাচ্ছে । সেই সব শব্দমালা ভয় যেমন জাগাচ্ছে একই সাথে মনের ভেতরে একটা কৌতুহলের জন্ম দিচ্ছে । তৃষার ভুত কিংবা অলৌকিকে ভয় নেই যদিও অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন সে এর আগেও হয়েছে। সে এসবে ভয় পায় নি কখনও । আজও পেল না । তার সব চিন্তা কেবল তার বাবাকে নিয়ে । বারবার কেবল মনে হচ্ছে এখানে বাবাকে নিয়ে এসে সে কি ভুল করল? ওর কি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ?
তৃষার চোখ মেলে তাকাল । চোখ মেলে থাকার পরেও কিছু সময় অন্ধকার দিকে তাকিয়ে রইল । যখন পুরোপুরি বুঝতে পারল ও কোথায় আছে তখন একটু অবাক না হয়ে পারল না । হাতের স্মার্টওয়াচটা সামনে নিয়ে এল । সময়টা দেখল ।
একটা সাতান্ন !
ও এতোটা সময়ে ঘুমিয়েছে !
সেই ছোট বেলা থেকেই তৃষার ঘুমের একটু সমস্যা রয়েছে । ঢাকায় নিজের বিছাতেও ওর ঘুম আসতে আসতে রাত তিনটা চারটা বেজে যায় । আর নতুন পরিবেশে তো ঘুম আসেই না । সেখানে ও এতো জলদি ঘুমিয়ে পড়ল!
কবীর শেখ ওকে বলেছিল যে সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এখানে জেনারেটর চলে । তৃষার স্পষ্ট মনে আছে যে যখন সে বিছানাতে শুয়েছিল তখন তখনও আলো জ্বলছিল। তার মানে তখনও এগারোটা বাজে নি । অপুর সাথে ফোনে কিছু সময় কথা বলার পরে সে একটা বই নিয়ে বসেছিল । তারপর আর কিছু মনে নেই । বইটাকে সে নিজের শরীরের পাশেই পেল ।
এতো সকালে সে ঘুমিয়ে পড়ল তাও আবার নতুন জায়গাতে!
একটু অবাক না হয়ে সে পারল তৃষা । ওর ঘুম কিভাবে চলে এল?
তৃষা উঠে বসল । অন্ধকারের ভেতরে হাতড়ে নিজের মোবাইলটা খুজে নিল । সেটার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে ঘরের চারিদিক দেখার চেষ্টা করল । সব কিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কোন কোন অস্বাভাবিকতা নেই কিন্তু তারপরেও তৃষার মনের ভেতরে কেমন একটা অচেনা অনুভূতি জেগে আছে ! এই অনুভূতিটা নিরাময়ের ভেতরে ঢোকার শুরু থেকেই ।
হাসানের চিঠিতেও ঠিক এই একই কথা লেখা ছিল। সে বলেছিল যে সব সময় ওর মনে হত যে কোন একটা অশুভ কিছু তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। কোন একটা অশুভ স্থানে চলে এসেছে। তৃষারও ঠিক এমন অনুভূতি হচ্ছে এইখানে ঢোকার পর থেকেই। নাকি হাসানের চিঠি পড়ার কারণেই তৃষার এমন একটা অনুভূতি জাগছে !
তৃষা বারান্দায় নেমে এল। এখান থেকে বাড়ির সামনের দিকটা দেখা যায়। ওর বাবা রয়েছে পেছনের দিকে। এখান থেকে সেটা দেখার উপায় নেই। তৃষা সামনের দিকে তাকাল। হাওরের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের দুরে একটা আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে ।
তৃষা সেদিকে তাকিয়ে রইল । অপু কি ওখানে রয়েছে?
ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট বন্ধ করে ফোন দিল অপুকে । নেটওয়ার্কের অবস্থা খুব একটা ভাল নয় তবে রিং ঢুকল এবং প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে রিসিভ হল ।
-কী খবর ?
-তোমার খবর কী? কোন সমস্যা হয়েছে?
-আরে না । সব ঠিক আছে । তুমি কি সামনের দিকে । আলো জ্বলছে বোটে ?
-হ্যা। দেখা যাচ্ছে ? দাঁড়াও !
তৃষা তাকিয়ে দেখল আলোটা বন্ধ হয়ে গেল । তারপর আবার জ্বলে উঠল আবার বন্ধ হল ! তৃষা একটু হেসে বলল, হ্যা তোমাকে দেখা যাচ্ছে । শুনো এদিকে সব ঠিক আছে । তুমি শুয়ে পড় । আমিও শুয়ে পড়ছি !
তৃষা ফোনটা রাখতে যাবে ঠিক তখনই মনে হল কিছু যেন একটা আওয়াজ শুনতে পেল । খুব বড় ডানা ছাপটানোর আওয়াজ । যেন বড় কোন পাখি উড়ার আওয়াজ । এবং ঠিক তার পরেই থপ করে কিছু যেন পড়ল । আরও ভাল করে বললে কেউ যেন ভারী পা নিয়ে উপর থেকে নামল নিচে ।
তৃষা তখনই অনুভব করল যে হঠাৎ করেই চারিদিকটা যেন আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে এল । ব্যাপারটা তৃষা খুব ভাল করেই টের পেল । সেই একই সাথে চারিদিকে যেন ঠান্ডা একটা বাতাস বইতে শুরু করল এবং এক সময়ে রীতিমত ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। তৃষা সত্যিই অবাক না হয়ে পারল না। কদিন আগে গ্রীষ্মকাল শেষ হয়েছে। এখন তো কোন ভাবেই এমন শীত পড়ার কথা না ! নাকী হাওরের আবহাওয়াই এমন ?
তৃষা আরও কিছু সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে রইল তবে কিছুই সে দেখতে পেল না । কিছু সময় পরেই তৃষা অনুভব করল যে ওর চোখে তীব্র ঘুম নেমে আসছে । কিছুতেই সে নিজের চোখে খোলা রাখতে পারছে না । এমন কেন হচ্ছে?
এখান খাবারে কি কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল? এটা ছাড়া আর কোন কারণ কি হতে পারে?
তবে তৃষা আর খুব বেশি সময় ভাবার সময় পেল না । কোন মতে নিজের বিছানার গিয়ে হাজির হল। তারপর ওর চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।
তৃষার ঘুম ভাঙ্গল সকালে ।
সকালের নাস্তা তৃষা ওর বাবার সাথে খেল । তৃষার বাবা জানালো যে কাল রাতে একজন ডাক্তার এসেছিলেন তাকে দেখতে ।
তৃষা বলল, কখন ?
-সময় তো দেখি নি । তবে অনেক রাতে !
-জেনারেটর বন্ধ হওয়ার আগে নাকি পরে?
-পরে । আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । এমন সময় মনে হল শীত লাগছে । পায়ের কম্বলটা দেখে আগে আমার কাছে অদ্ভুতই মনে হয়েছিল কিন্তু এমন শীত পরে রাতে । এই জন্যই এটা রাখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম । সেটা জড়িয়ে নিতে যাবো এমন সময় কেউ একজন দরজায় টোকা দিল । নরম স্বরে ভেতরে আসার অনুমুতি চাইল । নিজের পরচয় দিন দ্বিন মোহাম্মাদ বলে । নামটা আমার মনে পড়ে গেল সাথে সাথেই ।
-তারপর?
-তারপরই আর কি । তিনি ভেতরে এলেন। তার হাতে একটা লন্ঠন ছিল । সেটার আলোয় ঘর আলোকিত হল । তিনি লন্ঠনটা আমার টিটেবিলের পাশে রেখে আমার সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন। কেমন আছি এই টাইপের । আমার হাতের পালস চেক করলেন। তারপর নিজের পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বের করে দিলেন আমার হাতে । বললেন সেটা এক ঢোকে খেয়ে ফেলতে । আমি তাই করলাম ।
-কেমন স্বাদ ছিল?
-হোমিওপ্যাথি ঔষধের মত।
-আর কিছু ?
-না আর কিছু না । উনি কেবল ঐ ঔষধই খেতে বললেন । এক সময়ে আমি অনুভব করলাম যে আমার খুব ঘুম আসছে । এতোটাই ঘুম আসা শুরু করল যে আমার ঠিক মনেও নেই যে কখন ডাক্তার দ্বিন মোহাম্মাদ চলে গেলেন ।
তৃষা একটু অবাকই হল । কারণ এই একই ধরনের ঘুম সে নিজেও অনুভব করেছে ।
-তবে?
-তবে কী?
-তবে আমার কেন জানি সব কিছু ঝাপসা মনে হয়েছে । একবার মনে হচ্ছে যেন সত্যিই ডাক্তার এসেছিল আমাকে পরীক্ষা করেছে আরেকবার মনে হচ্ছে যে আমি সব স্বপ্নের ভেতরে দেখেছি। কেমন যেন অস্পষ্ট !
তৃষা বাবাকে খাইয়ে বাইরে বের হয়ে এল । তখনই আরেকটা ছেলের সাথে তৃষার দেখা হল । গতদিন এক ঝলক দেখেছিল। তৃষা নিজেই এগিয়ে গেল কথা বলার জন্য ।
-আপনারা কতদিন ধরে আছেন এখানে?
-আজকে চলে যাব। আজকে আমাদের চিকিৎসা শেষ !
-তাই নাকি?
-হ্যা ।
-আপনার কে আছে এখানে? মানে কে ছিলেন?
-মা ?
-কী হয়েছিল ওনার !
-ব্লাড ক্যান্সার ! আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম । জানি এখান থেকে যাওয়ার পরে কী হবে?
কথা বলতে বলতে তৃষা দেখল একজন মাঝ বয়সী সম্য সুন্দর চেহারার মহিলা ঘর থেকে বের হয়ে এল । ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল কেবল । তৃষা দেখল ব্যাগ নিয়ে ওরা একাই বের হয়ে গেল গেট দিয়ে । কাউকে দেখতে পেল না । এমন কি কবীর শেখকেও না। সকালে কবীর শেখ নিজেই নাস্তা নিয়ে এসেছিল । এরপর সে নিজেকে নিজের ঘরে বন্দি করেছে । যাওয়ার আগেই সে জানিয়েছিল যে এই সময়টা তার ঘুমের সময় । অফিসের পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বলেছে যে ওটা কিচেন। কিছু খেতে চাইলে ওখানে খাবার পাওয়া যাবে । দুপুরে খাবার নিয়ে লোক আসবে ।
যখন ওরা চলে গেল তখন তৃষার বুঝতে পারল যে পুরো ক্লিনিকে এখন কেবল ওরা তিন জন। আর কেউ নেই । বাবার কেবিনে একটু উকি দিয়ে তৃষা দেখতে পেল তিনি ঘুমাচ্ছেন । তৃষা একেবারে নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করল । অপুকে ফোন দিতে চাইল বটে কিন্তু কোন ভাবেই ফোনের নেটওয়ার্ক পেল না । ইমার্জেন্সী কমিউনিকেশন ডিভাইসটা আছে তবে সেটা এখন ব্যবহার করার কোন মানে নেই। তৃষা পুরো ক্লিনিকটা খুজে দেখতে শুরু করল।
কিন্তু বিশেষ কিছুই সে খুজে পেল না । একদম সাধারণ একটা বাড়ি মনে হল এটাকে । কোন বিশেষত্ব নেই। খুব সাধারণ একটা বাড়ি । আর কিছু নেই । এখানে বিশেষ কিছু নেই । এমন কি এটা দেখলে হাসপাতালও মনে হয় না । হাসপাতালের কোন লক্ষন এখানে নেই । কিছু নেই । তাহলে এখানে কী হচ্ছে ? কিভাবে হচ্ছে?
রাতের বেলা কী হয় সেটা তৃষাকে জানতেই হবে এবং এটা করতে ওকে কোন ভাবেই রাতের খাবার খাওয়া চলবে না । কারণ রাতের খাবারের ভেতরে নিশ্চিত ভাবে ঘুমের ঔষধ মেশানো থাকে ।
রাতের ঠিক সেই কাজটা করলো । বাবার সাথে দেখা করে এসেই তৃষা নিজের ঘরে ঢুকল । রাতের বেলা যখন খাওয়া দিয়ে দিয়ে তৃষা সেই খাবার খেল না । আজকে সে জেগে থাকবে। কাল সে কী শুনেছিল সেটা আজকে সে নিজের চোখেই দেখবে।
কিন্তু তৃষা অবাক হয়ে খেয়াল করতে শুরু করল যে ওর ঘুমে চোখে লেগে আসছে । সে কিছুতেই জেগে থাকতে পারল না । বিছানাতে শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল । তবে ঘুমের মাঝেই তৃষা অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করল । সেই থপ করে মাটির উপরে পড়ার আওয়াজটাও শুনতে পেল এক সময় । তবে আজকে আর সে বারান্দায় যেতে পারল না । বিছানা থেকে উঠতেই পারল না । বিছাতে শুয়েই ঘুমের ঘোড়ে অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেল । মনের ভেতরে একটা তীব্র অস্বস্তি জেগে উঠল । সেই সাথে কেবল মনে হল যে এখানে ভয়ংকর কিছু একটা হচ্ছে । তার বাবাকে এখানে নিয়ে আসা ঠিক হয় নি। মোটেই ঠিক হয় নি ।