তৃষা আজকে একটু অস্বস্তিবোধ করছে । ব্যাপারটা এমন নয় যে এর আগে সে একা আসে এই জেলখানাতে আসে নি । প্রায়ই দেখা যায় প্রফেসর খায়রুল আসতে পারেন না সময়ের অভাবে । তখন কোন পেসেন্টের ফলোয়াপের জন্য কেবল তৃষা এসে হাজির হয় । রুটিন কিছু প্রশ্ন করে কিছু চেকআপ করে তারপর চলে যায় । বাইরে থেকে এদেরকে যত ভয়ংকর মনে হয় জেলাখানাতে তারা আসলে তেমনটা মোটেই নয় । তবে হ্যা এটা সত্যি যে কিছু কিছু কয়েদী অস্বাভাবিক হয় । আজকে তেমনই একজন কয়েদীর চেকাপের জন্য তৃষা এসেছে ।
আজকে তৃষা কালো রংয়ের জিন্স আর নীল একটা টিশার্ট পরে এসেছে । তার উপরে ডাক্তারি এপ্রোন । সাধারণত প্রফেসর খায়রুল থাকলে তৃষা শাড়ি নয়তো সেলোয়ার কামিজ পরে । আজকে অবশ্য এই আটোসাটো পোশাক পরার কারণ আছে । গতবার যখন তৃষা এসেছিল তখন সেই কয়েদীকে বেশ ভায়োলেন্ট মনে হয়েছিল । কয়েকবার নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে যাচ্ছিল । আজকে তাই এমন পোশাক পরেছে যাতে দ্রুত সরে যাওয়া যায় । শাড়িতে নড়াচড়া এতো দ্রুত করা যায় না ।
তৃষাকে দেখে জেলার সাহেব একটু হেসে অভিভাধন জানাল । তারপর ওকে নিয়ে গেল নির্ধারিত স্থানে । সেখানে ওকে অপেক্ষা করতে বলল। জানালো যে একটু পরেই কয়েকী এসে হাজির হবে ।
তৃষা একটু হেসে একটা চেয়ার টেনে বসল । তার সামনে পেসেন্টের ফাইলটা রয়েছে । সেটা টেনে নিল । যদিও সে আগেই এই কেস ফাইলটা পরেছে । তবে আরেকবার চোখ বুলাতে শুরু করল । এই কেসটা মোটেই স্বাভাবিক কিছু না । যদিও ডাক্তারি ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে তবে তৃষার কেন জানি মনে হয়েছে যে এই পেছনে আরও কোন গল্প আছে । এমন কিছু যা স্বাভাবিক না ।
পেসেন্টের নাম হাসান । বয়স ৩৬ বছর । পেশায় ইঞ্জিনিয়ার । তার বিরুদ্ধে মোট ছয়জন কে খুন করার অভিযোগ করেছে । এবং সেটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হয়েছে । তবে সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায় । হাসানের খুনের কোন মোতিভ পাওয়া যায় নি । এমন সব মানুষকে সে মেরেছে যাদের সে আগে থেকে চিনত না । এবং সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এই মানুষ গুলোকে সে মেরে ফেলার পরে তাদেরকে খেয়ে ফেলেছে।
তৃষার মনের ভেতরে সেই অদ্ভুত অস্বস্তিটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল । প্রথমবার যখন এই ফাইলটা পড়েছিল তখন যেমনটা মনে হয়েছিল এখনও সেই একই অনুভূতিটা জাগল । একটা মানুষ অন্য একজনকে খেয়ে ফেলছে । তাও রান্না করে নয়, কাঁচা । এখান থেকেই এটা স্পষ্ট যে রোগী স্বাভাবিক নয় । সে মানসিক ভাবে অসুস্থ । আর মানসিক ভাবে অসুস্থ কোন রোগীকে তো আর ফাঁসি দেওয়া যায় না । এই জন্য তাকে দেখার জন্য ডাক্টার খায়রুলকে ডেকে পাঠানো হয়েছে । তৃষা তারই সহযোগী হিসাবে কাজ করছে । গতদিন যখন সে এসেছিল তখ হাসানকে বেশ ভায়োলেন্ট মনে হয়েছিল । রীতিমত তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো ছিল । আর মুখে একটা লোহার মাস্ক পরা ছিল । কারণটা ছিল ডাক্তারদের নিরাপত্তা । হাসান নাকি এই জেল খানার দুজনকে আক্রমন করে বেশ খানিকটা মাংস তুলে নিয়েছে কামড় দিয়ে । এই জন্য এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা !
আরও মিনিট পাঁচেক পরে হাসান ঢুকল ঘরে । তাকে ঢুকতে দেখেই তৃষার বুকের স্পন্দন একটু বেড়ে গেল আপনা আপনি । যদিও চিন্তার কোন কারণ নেই । হাসানের সাথে দুইজন গার্ড রয়েছে । যথারীতি তার হাতে হ্যান্ডকাফ এবং মুখে সেই লোহার মাস্ক পরানো । তৃষার মুখোমুখী বসানো হল । হাসানকে আজকে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে । আগের দিন তাকে সহজে বসানোই যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল যে কোন বন্য জন্তু । সেই তুলনায় আজকে সে বেশ শান্ত । শান্ত ভাবেই চেহারে বসল । তবে গার্ড দুজন সতর্ক হয়ে রইল ।
তৃষা একজন গার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ওনার মুখের মাস্কটা কি খুলে দেওয়া যায় ?
-সরি ম্যাম এটা খোলা যাবে না ।
-উনি তো আটকানোই রয়েছে।
-সরি ম্যাম । তবুও খোলা যাবে না ।
-এভাবে ফলোয়াপ করা যাবে না । হাতে হ্যান্ডকাফ আমি মেনে নিতে পারি, মুখের লোহার বেড়ি না। যদি ওটা না খোলেন তবে আমি বরং চলে যাই ।
গার্ড কী যেন ভাবল । তারপর মুখের লোহার মাস্কটা খুলে দিল ।
মাস্কটা খুলতেই তৃষা হাসানের পুরো চেহারা দেখতে পেল । শান্ত স্নিগ্ধ চেহারা । এই মানুষটা ছয় মানুষকে মেরে ফেলেছে তারপর তাদের খেয়ে ফেলেছে এটা তৃষার মোটেই বিশ্বাস হয় না । তৃষা সব সময় দেখে এসেছে যে মানুষ নিজের ভেতরের ভয়ংকর দিকটা লুকিয়ে রাখতে পারে না । বিশেষ করে তার চোখ দিয়ে আসল ভেতরকার পশুত্ব ঠিকই বের হয়ে আসে । কিন্তু এই হাসানের চোখ দেখে তৃষা কিছুই বুঝতে পারছে না । তার কাছে হাসানকে এখনও নিরীহই মনে হচ্ছে । একজন প্রমানিত খুনী–এটা তৃষার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে !
হাসান তৃষার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, থ্যাঙ্কিউ !
তৃষা বলল, কেন?
-এই যে আমাকে পশুর মত ট্রিট না করার জন্য । এখানে আমাকে আসলে সবাই পশুই ভাবে !
-কারণটা কি আপনি জানেন যে ওরা কেন এমন ভাবে?
হাসান একটু থামল । তারপর বলল, আমি জানি ।
একটু থামল সে । তারপর বলল, আমি নিজেও যদি ওদের জায়গাতে হতাম তাহলে আমি নিজেও তাই ভাবতাম ।
তৃষা বলল, এই ব্যাপারে আপনার কিছু করার নেই? আপনি তো আমার সাথে একেবারে স্বাভাবিক কথা বলছেন । আপনাকে তো কোন ভাবেই মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে হচ্ছে না ।
হাসান বলল, কারণ আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ নই!
-আপনি যা করেছেন সেটা কি কোন সুস্থ মানুষ করতে পারে?
-না পারে না ।
-তাহলে আপনি কি সুস্থ মস্তিস্কে সেই কাজ গুলো করেছেন ?
হাসান কিছু সময় কি যেন ভাবল । তারপর বলল, আমি যদি বলি যে ঐ কাজ গুলো আমি ইচ্ছেকৃত ভাবে করি নি । করতে বাধ্য হয়েছি তাহলে কি বিশ্বাস করবেন?
তৃষ চট জলদি উত্তর দিল না । তৃষাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, আমি জানি বিশ্বাস করবেন না । আমি কেবল বলতে পারি যে আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ নই এবং আমি ইচ্ছে করে ঐ কাজ গুলো করিও নি।
তৃষা আরও কিছু প্রশ্ন করল হাসানকে । হাসান সেই সব উত্তর স্বাভাবিক ভাবেই দিল । মানসিক বিকৃতির কোন লক্ষ্যণ নেই । ফলোয়াপ শেষ করে তৃষার যখন চলে যাওয়ার সময় হল তখন হাসান বলল, একটা অনুরোধ করব আপনাকে?
-বলুন ।
-আমাকে সুস্থ বলে রিপোর্ট দিবেন ।
তৃষা একটু অবাক হল । বলল, আপনাকে সুস্থ বলে রিপোর্ট দিলে কী হবে আপনি সেটা ভাল করেই জানেন। আপনার ফাঁসি হয়ে যাবে।
-আমিও সেটাই চাই ।
-এটাই চান?
-হ্যা । কারণ আমি যতদিন বেঁচে থাকব আমার সাথে এই অভিশাপটা থাকবে । আমি হয়তো আরও মানুষের ক্ষতি করতে পারি ।
-অভিশাপ ?
-হ্যা অভিশাপ । আপনি বিশ্বাস করবেন না । তাই আপনাকে বলে লাভও নেই । কাউকে বলে লাভ নেই । যে কাজটা আমি নিজে বেঁছে নিয়েছি সেটার জন্য আমি অন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাঁচার যে তীব্র স্পৃহা ছিল সেটাই যে আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নি । এই বেঁচে থাকাও যে দুর্ভিসহ হয়ে উঠবে সেটাও আমি ভাবি নি ।
তৃষা কিছু বুঝতে পারল না । তবে হাসানের মুখের ভাব দেখে এটা বুঝতে পারল যে সে আর কিছুই বলবে না । হাসান চলে যাওয়ার পরেও তৃষা বেশ কিছু সময় বসেই রইল সেখানে । ওর মাথার ভেতরে যেন কিছুই ঢুকছে না । কিছু একটা ব্যাপার যেন মিলছে না কিছুতেই ।
ঠিক সাত দিন পরে তৃষা জানতে পারল হাসান জেলের কক্ষে বিছানার চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে ।
দুই
তৃষা কাছে হাসানের একটা চিঠি এসে পৌছিয়েছে । হাসানের মৃত্যুর খবর পৌছানোর প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পরে চিঠিটা এসে হাজির হয়েছে । হাসানের উকিলের মাধ্যমে চিঠিটা সে পাঠিয়েছে । মৃত্যুর ঠিক আগে সে চিঠিটা লিখেছিল। সম্ভত সুইসাইড নোট ! তবে তৃষা ঠিক বুঝতে পারছে না যে এতো লোক রেখে হাসান কেন ওকেই কেন চিঠি লিখতে যাবে ! মাত্র দুইদিন দেখা হয়েছে ওর সাথে।
খানিকটা দ্বিধা নিয়ে সে চিঠিটা পড়তে বসল।
মিস তৃষা,
এই চিঠি যখন পড়বেন তখন আমি নিশ্চিত ভাবেই মারা গেছি। আমার উকিলকে এই ভাবেই নির্দেশ দেওয়া আছে। আমি জানি অবাক হচ্ছেন। আসলে আপনাকে চিঠি পাঠানোর কোন কারণ নেই। তবে কেন জানি আমার মনে হয়েছে আপনি আমার কথা গুলো বিশ্বাস করবেন। আমার সব কাছের মানুষ গুলোও আমাকে বিশ্বাস করে নি। আমার কাছ থেকে দুরে চলে গেছে ! আমাকে ভয়ংকর খুনী আর পশুর মত দৃষ্টিতে দেখেছে । হয়তো আমি সেটাই তবে সেদিন আপনি আমাকে খানিকটা মানুষের মত দেখেছিলেন । আমার চোখ দেখে আমার মনে হয়েছিল যে আপনি আমাকে খুনী বলে বিশ্বাসই করতে পারছেন না । এটা আমার চোখ এড়াই নি । এটা থেকেই আমার কেন জানি মনে হয়েছে আপনি ঠিকই আমার কথা বিশ্বাস করবেন । যদিও এই গল্পটা বিশ্বাস না করলেও কিছু যায় আসে না । আমি তো চলে গেছি অনেক দুরে । তবুও এই টুকু শান্তি যে আমার !
……
পরবর্তি পর্ব সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে গ্রুপে জয়েন করুন।