মুমুকে যেদিন প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছিলাম ও কেবল হেসেছিল । তবে সেই হাসির ভেতরে একটা প্রশ্রয়ের ভাব ছিল । যার অর্থ হচ্ছে আমি এখনই তোমার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছি না তবে তোমাকে বাতিলও করে দিচ্ছি না । লেগে থাকো কাজ হলেও হতে পারে । একই অফিসে কাজ করার সুবাধে আমাদের দীর্ঘ সময় একই সাথে থাকতে হত । সকালের মর্নিং কফি থেকে শুরু করে দুপুরের লাঞ্চ বিকেলের স্ন্যাকস আর সাথে মাঝে মাঝে সন্ধ্যা কিংবা রাতের ডিনার । এভাবেই আমাদের দিন এগিয়ে যেতে শুরু করলো ।
তারপরেই সেই দিনটা এল । সেদিন বাইরে খুব মেঘ করেছিলো । আমরা যখন অফিসে ঢোকার পরপরই প্রবল বৃষ্টি শুরু হল । এই রকম আবহাওয়াতে কাজ কর্ম খুব একটা হয় না । আমাদের অফিসের পক্ষ থেকে দুপুরে সকল এপ্লোয়ীদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা হত । ঠিক হল যে আজ যে আজকে খিচুরী রান্না হবে । আমরা সবাই হইহই করে উঠলাম । তবে এসব আনন্দের আমেজের ভেতরে মুমুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও কেমন যে উদাস হয়ে জানালার দিয়ে বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ওর এই বিষণ্ণতা আমার চোখ এড়ালো না । অবশ্য আমি সামনে যেতেই নিজের মুখে একটা হাসি নিয়ে এল । সব কিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো যেন ।
দুপুরের পরে বৃষ্টি কমে এলেও একেবারে বন্ধ হয়ে গেল না । আমরা যখন বিকেলে অফিস থেকে বের হলাম তখন শরীর ভিজিয়ে দেওয়ার মত বৃষ্টি না পড়লেও একটু একটু পড়ছিল । সাথে আমাদের যদিও ছাতা ছিল তবে কেন জানি সেটা মেলে ধরলাম না । আমি আর মুমু পথ দিয়ে হাটতে শুরু করলাম । ঢাকা শহরের একটা অলিখিত নিয়ম হচ্ছে বৃষ্টি হলেই এখানে জ্যামের পরিমান বেড়ে যায় হঠাৎ করে । আমি আজও ঠিক বুঝতে পারলাম না এর পেছনের কারণটা । বৃষ্টিতে পথ ঘাট কি সরু হয়ে যায় যে গাড়ি চলতে পারে না ! উপরওয়ালাই ভাল করে জানেন ।
সেদিন আমরা তাই বাসে কিংবা সিএনজিতে ওঠার চেষ্টা করলাম না । একটু হেটে সামনে থেকে রিক্সা নেওয়ার পরিকল্পনা করলাম । হঠাৎ মুমু বলল, আসো ঐ পার্কে গিয়ে একটু বসি ।
অফিসের পাশে একটা পার্ক রয়েছে মানুষের হাটার জন্য । এছাড়া বেশ কিছু ছাউনিও রয়েছে । অন্যান্য দিন এই সময়ে এই ছাউনিতে মানুষজন ভর্তি হয়ে থাকে তবে আজকে দেখলাম লোকজন নেই বললেই চলে । সম্ভবত সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে এখানে কেউ আসে নি । নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে সবার কাছে । একটা ছাউনির নিচে বসলাম । মুমুর চেহারায় আমি আবারও সে বিষণ্ণতাটা দেখতে পেলাম যেটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম আজকে সকালে অফিসে । এবার কেন জানি মনে হল ওকে আমি কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারি ।
-কী হয়েছে বলবে আমাকে?
মুমু চোখ তুলে তাকালো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আমার আগে একটা প্রেম ছিল ।
আমি জানতাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মুমু একটা ছেলেকে ভালোবাসতো । ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস ছিল । এমন কি ওদের পরিবারও ব্যাপারটা জানতো । ঠিক ছিল যে পড়াশোনা শেষ করে ওরা বিয়ে করবে । কিন্তু সেটা আর হয় নি । আমি কেবল এই টুকুই জানি । তবে আমি কোন দিন এর বেশি মুমুর কাছ থেকে জানতে চাই নি । মুমুও বলে নি ।
মুমু আবারও বলল, নাদিমের সাথে আমার ব্রেকআপ কেন হয়েছিলো জানো?
আমি মাথা নাড়ালাম । আমার জানার কথা না ।
-না সে প্রতারক ছিল না । খুব প্রবল ভাবেই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । আমার কাছ থেকে এমন কিছু চায় নি যা চাওয়াটা স্বাভাবিক ছিলনা । সব পুরুষের যা চাওয়ার থাকে ।
-তাহলে কেন হয়েছিলো ব্রেক আপ !
-কারণ আমি কখনই মা হতে চাই নি ।
আমি প্রথমে কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । মা হতে না চাওয়ার মানে কি ! আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার মনের ভাবটা মুমু একটু ধরতে পারলো । সে বলল, না কোন শারীরি সমস্যা নয় । আমি চাইলেই মা হতে পারবো । আমি আসলে মা হতে চাই না । বিয়ের পরেও না । তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে চাও তোমাকেও এই শর্ত মেনে নিতে হবে । যদি না করতে চাও তবুও কোন সমস্যা নেই । আমি তোমাকে ব্লেম করবো না । কোন দোষ দিবো না ।
আমি বললাম, কাল বিয়ে করা যাবে?
মুমু এবার আমার দিকে তাকালো একটু গভীর ভাবে । সম্ভবত আমার কাছ থেকে এই রকম প্রশ্ন সে আশা করে নি । বলল, তুমি কোন দিন বাবা হবে না সেটা নিয়ে কোন সমস্যা নেই তোমার?
-আপাতত না । এখনও সব থেকে তুমিই বেশি গুরুত্বপূর্ন ।
-কিন্তু এক সময়ে মনে হবে যে একটা সন্তান দরকার । বুড়ো বয়সে নাতিনাতনি দরকার ।
-তোমার দরকার নেই?
-জানি না ।
-সেটা দেখা যাবে । যা হবে দুজন মিলে ঠিক করা যাবে । যদি না চাও আমি কখনই ফোর্স করবো না । তো কাল বিয়ে করা যাবে?
মুমু আরও কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এখনই চল ।
-আজকেই !
-হ্যা ।
আমি ওর হাত ধরলাম । তারপর চললাম মগবাজারের দিকে ।
বিয়ে করেছি শুনে বাসায় প্রথমে কিছু সময় বকাবকি করলো বটে তবে কেউ খুব একটা আপত্তি করলো না । এমনিতেও তারা আমার বিয়ে দিতে চাইছিলেন । তাই বিয়ে নিয়ে তাদের আপত্তি উঠলো না ।
তারপরের সময় গুলো আমাদের একসাথে আনন্দে কাটলো বেশ । কয়েক বছর সংসার করার পরেই আশে পাশ থেকে এবার বাচ্চা নেওয়ার জন্য কথা কানে আসতে লাগলো । একটা সময়ে আমারও মনে হল যে এবার একটা বাচ্চা নেওয়া দরকার ।
আমি যখন মুমুকে কথাটা বললাম, দেখলাম যে ও মোটেও অবাক হল না । তবে ওর চোখ মুখে একটা বিষণ্ণ ভাব আমি ঠিকই দেখতে পেলাম । মুমু তখন পরিস্কার ভাবেই জানিয়ে দিল যে ও ঐদিকে যাবে না ।
আমি কারণ জিজ্ঞেস করলাম, ও উত্তরে কিছুই বলল না ।
তবে এটাই আমাদের ভেতরে বিবাদের কারণ হতে শুরু করলো । একটা সময়ে প্রতিদিনও ঝগড়া হতে শুরু করলো । এবং মুমু আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য বাসা ছেড়ে চলে গেল । যদিও প্রতিদিন আমাদের অফিসে ঠিকই দেখা হত । মাস খানেক এভাবে আলাদা থাকার পরে আমি আসলে আবিস্কার করলাম যে মুমুকে ছাড়া কেমন যেন আমি অসহায় হয়ে গেছি । কাজ কর্মে মন বসছে না কোন কিছুতেই ভাল লাগছে না । নিজের মনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে মুমুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম ওদের বাসায় । আমাকে দেখে ওদের বাসার লোকজন অবশ্য খুব একটা অবাক হল না । বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হবে, স্ত্রী রাগ করে বাবার বাসায় চলে যাবে এসব আসলে সাধারণ ঘটনা ।
রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত মুমু আমার সামনে এল না । রাতে শোবার সময় আমি নিজে ওর শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম । ও তখন নিজের বিছানায় বসে বই পড়ছিলো । রাতে ঘুমানোর আগে প্রায়ই ও বই পড়ে । আমি চুপচাপ খাটে উঠে ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। মুমু একটু পরে বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বলল, এখানে কি ঘুমানোর জন্য এসেছো?
-হুম ।
-তাহলে এখানে ঘুমাও আমি অন্য ঘরে যাই ।
-তোমাদের বাসায় তো আর ঘর নেই ।
-সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে ।
-আমি আসলে তোমার সাথে ঘুমাতে এসেছি ।
-কেন? আমি কি ঘুমের ঔষধ ?
-আমার জন্য ঐ রকমই !
-আচ্ছা তাহলে তোমার ঘুম আসে নি এই জন্য এসেছো ?
আমি উঠে বসালম । তারপর ওর দিকে এগিয়ে আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । ভেবেছিলাম যে মুমু হয়তো রাগ দেখাবে কিংবা সরিয়ে দিবে তবে তেমন কিছুই করলো না । প্রশ্রয় পেয়ে আমি আরও একটু এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । আর ভালোভাবে জড়িয়ে ধরলাম । একটা সময়ে প্রবল ভাবে ওকে আদর করতে শুরু করলাম । দেখলাম মুমুও তাতে সাড়া দিল প্রবল ভাবে । সম্ভবত আমার মত ও নিজেও বড় তৃষ্ণার্থ ছিল । আজকে এই কবছরে আমরা কখনই এতো দিন একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা ছিলাম না ।
-ঘুমিয়ে গেছো?
আমি মুমুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিলাম ওর বুকে মাথা রেখে । মুমু বলল, না ।
-আমার বাচ্চাটাচ্চার দরকার নেই । শুধু তুমি হলেই চলবে । এই কদিনে আমি আমি কেবল এটাই উপলব্ধি করেছি । আমি আর কখনই এই কথা তোমাকে বলল না ।
-ঠিক তো !
-হ্যা । এটা নিয়ে আমাদের মাঝে আর কোন কথা হবে না কখনো ।
আবারও আমাদের জী্বন আগের মত হয়ে গেল । বাসা অফিস ঘুরেবেড়ানো ভালোবাসাবাসী । আমি নিজের মনকে বুঝিে নিয়েছিলাম যে সব ইচ্ছে সবার পূরণ হয় না । এটাই জীবন । কিন্তু আমাদের জীবনে তখনও কিছু হওয়ার বাকি ছিল ।
সেদিন মুমু অফিসে যায় নি । ওর বাবার শরীর খারাপ থাকার কারণে সেখানে গিয়েছিলো । আমি ওকে বাবার বাসায় নামিয়ে অফিসে গিয়াছিলাম । রাতটা ওবাড়িতেই থাকবে বলে জানালো । পরদিন অফিস শেষ করে যখন বাসায় এসে হাজির হলাম তখন দেখি মুমু নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে । ওর চেহারা দেখেই মনে হল যে কিছু একটা হয়েছে । আমার মনে হল যে ওর বাবার সম্ভবত খারাপ কিছু হয়েছে ।
আমি বললাম,আব্বু কিছু হয়েছে ?
মমু চোখ তুলে তাকালো । তারপর বলল, না আব্বু ঠিক আছে ।
-তাহলে ? তোমার চেহারা এমন কেন লাগছে?
-আমি প্রেগনেন্ট!
আমি প্রথমে ব্যাাপরটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । একটু সময় লাগলো । বললাম, কী !
-হুম।
-কিভাবে ? আই মিন নিশ্চিত হলে কিভাবে?
-কাল মা কিভাবে জানি বুঝে গেল । আজকে টেস্ট করালাম । পজেটিভ !
একটু একটু লম্বা বিরতি নিয়ে বললাম, এখন ? কী করবে?
মুমু আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো । তারপর বলল, আজকে সারাদিন আমি কেবল এই নিয়ে ভাবছি জানো । প্রথমে মনে হয়েছিলো এই বাচ্চা আমি রাখবো না । কিন্তু ….
-কিন্তু ?
-কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে আমার কেবল মনে হচ্ছে আমার শরীরের একটা অংশ এটা । একেবারে নিজের ! এই যে অনুভূতি তোমাকে বোঝাতে পারবো না ! আমি ….. আমি…..।
আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । তারপর বললাম, তুমি যাই করতে চাও না কেন আমি তোমার সাথে আছি । ঠিক আছে!
-আমি জানি !
আমার মনের ভেতরে তখন অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ এসে যুক্ত হয়েছে । এভাবে আমার জীবনে এই ব্যাপারটা ঘটবে আমি কখনই ভাবি নি । হয়তো কপালে আমাদের এই লেখা ছিল । এভাবেই সব কিছু ঘটবে সেটা লেখা ছিল !
গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ কিংবা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। লিংক পাবেন এই ওয়েব সাইটের নিচে ডান দিকে।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
কারণটা জানলে ভাল্লাগতো!!!