হয়তো এভাবেই লেখা ছিল

oputanvir
4.6
(59)

মুমুকে যেদিন প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছিলাম ও কেবল হেসেছিল । তবে সেই হাসির ভেতরে একটা প্রশ্রয়ের ভাব ছিল । যার অর্থ হচ্ছে আমি এখনই তোমার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছি না তবে তোমাকে বাতিলও করে দিচ্ছি না । লেগে থাকো কাজ হলেও হতে পারে । একই অফিসে কাজ করার সুবাধে আমাদের দীর্ঘ সময় একই সাথে থাকতে হত । সকালের মর্নিং কফি থেকে শুরু করে দুপুরের লাঞ্চ বিকেলের স্ন্যাকস আর সাথে মাঝে মাঝে সন্ধ্যা কিংবা রাতের ডিনার । এভাবেই আমাদের দিন এগিয়ে যেতে শুরু করলো ।

তারপরেই সেই দিনটা এল । সেদিন বাইরে খুব মেঘ করেছিলো । আমরা যখন অফিসে ঢোকার পরপরই প্রবল বৃষ্টি শুরু হল । এই রকম আবহাওয়াতে কাজ কর্ম খুব একটা হয় না । আমাদের অফিসের পক্ষ থেকে দুপুরে সকল এপ্লোয়ীদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা হত । ঠিক হল যে আজ যে আজকে খিচুরী রান্না হবে । আমরা সবাই হইহই করে উঠলাম । তবে এসব আনন্দের আমেজের ভেতরে মুমুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও কেমন যে উদাস হয়ে জানালার দিয়ে বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ওর এই বিষণ্ণতা আমার চোখ এড়ালো না । অবশ্য আমি সামনে যেতেই নিজের মুখে একটা হাসি নিয়ে এল । সব কিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো যেন ।

দুপুরের পরে বৃষ্টি কমে এলেও একেবারে বন্ধ হয়ে গেল না । আমরা যখন বিকেলে অফিস থেকে বের হলাম তখন শরীর ভিজিয়ে দেওয়ার মত বৃষ্টি না পড়লেও একটু একটু পড়ছিল । সাথে আমাদের যদিও ছাতা ছিল তবে কেন জানি সেটা মেলে ধরলাম না । আমি আর মুমু পথ দিয়ে হাটতে শুরু করলাম । ঢাকা শহরের একটা অলিখিত নিয়ম হচ্ছে বৃষ্টি হলেই এখানে জ্যামের পরিমান বেড়ে যায় হঠাৎ করে । আমি আজও ঠিক বুঝতে পারলাম না এর পেছনের কারণটা । বৃষ্টিতে পথ ঘাট কি সরু হয়ে যায় যে গাড়ি চলতে পারে না ! উপরওয়ালাই ভাল করে জানেন ।

সেদিন আমরা তাই বাসে কিংবা সিএনজিতে ওঠার চেষ্টা করলাম না । একটু হেটে সামনে থেকে রিক্সা নেওয়ার পরিকল্পনা করলাম । হঠাৎ মুমু বলল, আসো ঐ পার্কে গিয়ে একটু বসি ।
অফিসের পাশে একটা পার্ক রয়েছে মানুষের হাটার জন্য । এছাড়া বেশ কিছু ছাউনিও রয়েছে । অন্যান্য দিন এই সময়ে এই ছাউনিতে মানুষজন ভর্তি হয়ে থাকে তবে আজকে দেখলাম লোকজন নেই বললেই চলে । সম্ভবত সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে এখানে কেউ আসে নি । নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে সবার কাছে । একটা ছাউনির নিচে বসলাম । মুমুর চেহারায় আমি আবারও সে বিষণ্ণতাটা দেখতে পেলাম যেটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম আজকে সকালে অফিসে । এবার কেন জানি মনে হল ওকে আমি কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারি ।

-কী হয়েছে বলবে আমাকে?
মুমু চোখ তুলে তাকালো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আমার আগে একটা প্রেম ছিল ।
আমি জানতাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মুমু একটা ছেলেকে ভালোবাসতো । ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস ছিল । এমন কি ওদের পরিবারও ব্যাপারটা জানতো । ঠিক ছিল যে পড়াশোনা শেষ করে ওরা বিয়ে করবে । কিন্তু সেটা আর হয় নি । আমি কেবল এই টুকুই জানি । তবে আমি কোন দিন এর বেশি মুমুর কাছ থেকে জানতে চাই নি । মুমুও বলে নি ।
মুমু আবারও বলল, নাদিমের সাথে আমার ব্রেকআপ কেন হয়েছিলো জানো?
আমি মাথা নাড়ালাম । আমার জানার কথা না ।
-না সে প্রতারক ছিল না । খুব প্রবল ভাবেই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । আমার কাছ থেকে এমন কিছু চায় নি যা চাওয়াটা স্বাভাবিক ছিলনা । সব পুরুষের যা চাওয়ার থাকে ।
-তাহলে কেন হয়েছিলো ব্রেক আপ !
-কারণ আমি কখনই মা হতে চাই নি ।

আমি প্রথমে কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । মা হতে না চাওয়ার মানে কি ! আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার মনের ভাবটা মুমু একটু ধরতে পারলো । সে বলল, না কোন শারীরি সমস্যা নয় । আমি চাইলেই মা হতে পারবো । আমি আসলে মা হতে চাই না । বিয়ের পরেও না । তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে চাও তোমাকেও এই শর্ত মেনে নিতে হবে । যদি না করতে চাও তবুও কোন সমস্যা নেই । আমি তোমাকে ব্লেম করবো না । কোন দোষ দিবো না ।

আমি বললাম, কাল বিয়ে করা যাবে?

মুমু এবার আমার দিকে তাকালো একটু গভীর ভাবে । সম্ভবত আমার কাছ থেকে এই রকম প্রশ্ন সে আশা করে নি । বলল, তুমি কোন দিন বাবা হবে না সেটা নিয়ে কোন সমস্যা নেই তোমার?
-আপাতত না । এখনও সব থেকে তুমিই বেশি গুরুত্বপূর্ন ।
-কিন্তু এক সময়ে মনে হবে যে একটা সন্তান দরকার । বুড়ো বয়সে নাতিনাতনি দরকার ।
-তোমার দরকার নেই?
-জানি না ।
-সেটা দেখা যাবে । যা হবে দুজন মিলে ঠিক করা যাবে । যদি না চাও আমি কখনই ফোর্স করবো না । তো কাল বিয়ে করা যাবে?

মুমু আরও কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এখনই চল ।
-আজকেই !
-হ্যা ।

আমি ওর হাত ধরলাম । তারপর চললাম মগবাজারের দিকে ।

বিয়ে করেছি শুনে বাসায় প্রথমে কিছু সময় বকাবকি করলো বটে তবে কেউ খুব একটা আপত্তি করলো না । এমনিতেও তারা আমার বিয়ে দিতে চাইছিলেন । তাই বিয়ে নিয়ে তাদের আপত্তি উঠলো না ।

তারপরের সময় গুলো আমাদের একসাথে আনন্দে কাটলো বেশ । কয়েক বছর সংসার করার পরেই আশে পাশ থেকে এবার বাচ্চা নেওয়ার জন্য কথা কানে আসতে লাগলো । একটা সময়ে আমারও মনে হল যে এবার একটা বাচ্চা নেওয়া দরকার ।
আমি যখন মুমুকে কথাটা বললাম, দেখলাম যে ও মোটেও অবাক হল না । তবে ওর চোখ মুখে একটা বিষণ্ণ ভাব আমি ঠিকই দেখতে পেলাম । মুমু তখন পরিস্কার ভাবেই জানিয়ে দিল যে ও ঐদিকে যাবে না ।
আমি কারণ জিজ্ঞেস করলাম, ও উত্তরে কিছুই বলল না ।

তবে এটাই আমাদের ভেতরে বিবাদের কারণ হতে শুরু করলো । একটা সময়ে প্রতিদিনও ঝগড়া হতে শুরু করলো । এবং মুমু আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য বাসা ছেড়ে চলে গেল । যদিও প্রতিদিন আমাদের অফিসে ঠিকই দেখা হত । মাস খানেক এভাবে আলাদা থাকার পরে আমি আসলে আবিস্কার করলাম যে মুমুকে ছাড়া কেমন যেন আমি অসহায় হয়ে গেছি । কাজ কর্মে মন বসছে না কোন কিছুতেই ভাল লাগছে না । নিজের মনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে মুমুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম ওদের বাসায় । আমাকে দেখে ওদের বাসার লোকজন অবশ্য খুব একটা অবাক হল না । বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হবে, স্ত্রী রাগ করে বাবার বাসায় চলে যাবে এসব আসলে সাধারণ ঘটনা ।

রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত মুমু আমার সামনে এল না । রাতে শোবার সময় আমি নিজে ওর শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম । ও তখন নিজের বিছানায় বসে বই পড়ছিলো । রাতে ঘুমানোর আগে প্রায়ই ও বই পড়ে । আমি চুপচাপ খাটে উঠে ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। মুমু একটু পরে বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বলল, এখানে কি ঘুমানোর জন্য এসেছো?
-হুম ।
-তাহলে এখানে ঘুমাও আমি অন্য ঘরে যাই ।
-তোমাদের বাসায় তো আর ঘর নেই ।
-সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে ।
-আমি আসলে তোমার সাথে ঘুমাতে এসেছি ।
-কেন? আমি কি ঘুমের ঔষধ ?
-আমার জন্য ঐ রকমই !
-আচ্ছা তাহলে তোমার ঘুম আসে নি এই জন্য এসেছো ?

আমি উঠে বসালম । তারপর ওর দিকে এগিয়ে আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । ভেবেছিলাম যে মুমু হয়তো রাগ দেখাবে কিংবা সরিয়ে দিবে তবে তেমন কিছুই করলো না । প্রশ্রয় পেয়ে আমি আরও একটু এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । আর ভালোভাবে জড়িয়ে ধরলাম । একটা সময়ে প্রবল ভাবে ওকে আদর করতে শুরু করলাম । দেখলাম মুমুও তাতে সাড়া দিল প্রবল ভাবে । সম্ভবত আমার মত ও নিজেও বড় তৃষ্ণার্থ ছিল । আজকে এই কবছরে আমরা কখনই এতো দিন একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা ছিলাম না ।

-ঘুমিয়ে গেছো?
আমি মুমুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিলাম ওর বুকে মাথা রেখে । মুমু বলল, না ।
-আমার বাচ্চাটাচ্চার দরকার নেই । শুধু তুমি হলেই চলবে । এই কদিনে আমি আমি কেবল এটাই উপলব্ধি করেছি । আমি আর কখনই এই কথা তোমাকে বলল না ।
-ঠিক তো !
-হ্যা । এটা নিয়ে আমাদের মাঝে আর কোন কথা হবে না কখনো ।

আবারও আমাদের জী্বন আগের মত হয়ে গেল । বাসা অফিস ঘুরেবেড়ানো ভালোবাসাবাসী । আমি নিজের মনকে বুঝিে নিয়েছিলাম যে সব ইচ্ছে সবার পূরণ হয় না । এটাই জীবন । কিন্তু আমাদের জীবনে তখনও কিছু হওয়ার বাকি ছিল ।

সেদিন মুমু অফিসে যায় নি । ওর বাবার শরীর খারাপ থাকার কারণে সেখানে গিয়েছিলো । আমি ওকে বাবার বাসায় নামিয়ে অফিসে গিয়াছিলাম । রাতটা ওবাড়িতেই থাকবে বলে জানালো । পরদিন অফিস শেষ করে যখন বাসায় এসে হাজির হলাম তখন দেখি মুমু নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে । ওর চেহারা দেখেই মনে হল যে কিছু একটা হয়েছে । আমার মনে হল যে ওর বাবার সম্ভবত খারাপ কিছু হয়েছে ।
আমি বললাম,আব্বু কিছু হয়েছে ?
মমু চোখ তুলে তাকালো । তারপর বলল, না আব্বু ঠিক আছে ।
-তাহলে ? তোমার চেহারা এমন কেন লাগছে?
-আমি প্রেগনেন্ট!

আমি প্রথমে ব্যাাপরটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । একটু সময় লাগলো । বললাম, কী !
-হুম।
-কিভাবে ? আই মিন নিশ্চিত হলে কিভাবে?
-কাল মা কিভাবে জানি বুঝে গেল । আজকে টেস্ট করালাম । পজেটিভ !
একটু একটু লম্বা বিরতি নিয়ে বললাম, এখন ? কী করবে?

মুমু আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো । তারপর বলল, আজকে সারাদিন আমি কেবল এই নিয়ে ভাবছি জানো । প্রথমে মনে হয়েছিলো এই বাচ্চা আমি রাখবো না । কিন্তু ….
-কিন্তু ?
-কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে আমার কেবল মনে হচ্ছে আমার শরীরের একটা অংশ এটা । একেবারে নিজের ! এই যে অনুভূতি তোমাকে বোঝাতে পারবো না ! আমি ….. আমি…..।

আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । তারপর বললাম, তুমি যাই করতে চাও না কেন আমি তোমার সাথে আছি । ঠিক আছে!
-আমি জানি !

আমার মনের ভেতরে তখন অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ এসে যুক্ত হয়েছে । এভাবে আমার জীবনে এই ব্যাপারটা ঘটবে আমি কখনই ভাবি নি । হয়তো কপালে আমাদের এই লেখা ছিল । এভাবেই সব কিছু ঘটবে সেটা লেখা ছিল !

গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ কিংবা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। লিংক পাবেন এই ওয়েব সাইটের নিচে ডান দিকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 59

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “হয়তো এভাবেই লেখা ছিল”

  1. কারণটা জানলে ভাল্লাগতো!!!

Comments are closed.