তাহিরা নিজের মোবাইলের নোটিফিকেশন গুলো বার কয়েক চেক করলো কেবল । লাইকের প্রতিটা নাম ভাল করে খেয়াল করে দেখলো । কয়েক দিন আগেও ওর প্রতিটা ছবিতে একটা নির্দিষ্ট নাম সব সময় থাকতো কিন্তু আজ তিন দিন ধরে নেই । এমন কি শুভ ওর একটা স্টোরিও দেখে নি । এমন কেন করছে ছেলেটা ?
ওর উপরে রাগ করলো কেন? ঐ কারণে কি তাহলে রাগ করে আছে সে?
তাহিরা ফেসবুকের সার্চ অপশনে গেল । একেবারে প্রথম নামটাই শুভর । সেখানে ক্লিক করতেই শুভর প্রোফাইলে গিয়ে হাজির হল সে । শেষ স্টাটাসটা তিন দিন আগের । সেখানে শুভ একটা ছোট কথা লিখেছে । ”যে মেয়ে নিজের লম্বা চুল কেটে ফেলতে পারে সে মানুষ খুন করতে পারে।”
স্টাটাসটা যে ওকে উদ্দেশ্য করেই লেখা সেটা তাহিরা সেদিনই বুঝেছিলো । কারণ আগের দিন সে নিজের চুল কাটিয়েছে পার্লার থেকে । আগে বেশ লম্বা চুলই ছিল তাহিরার । ওর চুল একটু বেশি ঘন । লম্বা চুলে ওকে দেখতে বেশ লাগে । তবে কেবল ভাল লাগলেই তো আর চলবে না । যার লম্বা চুল কেবল সেই বোঝে যে এটা সামলানো কত ঝামেলার কাজ । লম্বা চুল দিয়ে অনেক কাজ করা যায় না । যদিও তাহিরা খুব বেশি কাটে নি তারপরও স্পষ্টই সেটা আমার থেকে ছোট হয়েছে । এই চুপ নিয়ে কলেজে যাওয়ার পরেই শুভর চোখে পড়েছে সেটা । তাহিরা শুভর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলো যে শুভ রাগ করেছে ।
তারপর যখন স্টাটাসটা দিল তখন তাহিরার বুঝতে মোটেই বাকি থাকলো না যে শুভ ওর চুল কাটার ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করে নি । মনে মনে তখন খানিকটা বিরক্ত হয়েছিল বটে । ওর নিজের চুল ও কাটবে নাকি রাখবে এটা নিয়ে অন্য কারো কথা থাকতে পারে না মোটেও । এমনটাই মনে হয়েছিলো তখন । কিন্তু শুভ যখন রাগ করে ওর থেকে দুরে রয়েছে তখনই টের পেল যে শুভ রাগ অভিমান ওর কাছে খুব বড় কিছু । কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে শুভ কিন্তু তাহিরার বয়ফ্রেন্ড নয় । এমন কি ওরা কলেজে কালে ভাদ্রে কথা বলে একে অন্যের সাথে । কিন্তু তাহিরা খুব ভাল করে জানে যে শুভ ওকে অসম্ভব পছন্দ করে । এবং তাহিরাও একই ভাবেই ওকে পছন্দ করে । ওরা কেউ কাউকে নিজেদের এই পছন্দের কথা বলে নি অথচ ওরা জানে ।
শুভ ওকে সোস্যাল মিডিয়াতে খুব ভাল করেই ফলো করে । ওর যেকোন স্টাটাস, যে কোন ফটো সব কিছু সে দেখে সবার আগে । লাইক কিংবা লাভ দেয় সবার আগে । ছবিতে বেশির ভাগই লাভ রিএকশন থাকে । এমন অনেক বার হয়েছে কেবল মাত্র শুভর জন্যই আলাদা ভাবে কাস্টমাইজ করে তাহিরা ছবি আপলোড দিয়েছে । ক্লাস রুমে একে অন্যের সাথে চোখাচোখ চলে, একটু হাসি ইশারায় কত কথা বলে দুজনে । এভাবেই ওদের দুষ্ট মিষ্ট প্রেমের খেলা চলছিলো । তাহিরা বেশ মজাই লাগে । অনেক দিন ধরেই শুভর সাথে এমনটা করে যাচ্ছে । নিজের দরকারেই । সব কিছু ঠিক মত চলছিল। কিন্তু চুল কাটার পরে সব বন্ধ আপাতত । তাহিরার একটু অস্থির লাগা শুরু করলো । কেবলই মনে হতে লাগলো যে শুভ আবার রাগ করে না চলে যায় । এক সময়ে আর থাকতে না পেরে নিজেই মেসেজ পাঠালো শুভ মেসেঞ্জারে । সেখানে ছোট্ট করে লিখলো, সরি আর কখনও কাটবো না চুল ।
মেসেজটা পাঠিয়েই মনে কাজটা কি ঠিক হল? তখনই মনে হল যে মেসেজটা আনসেন্ট করে দেয় কিন্তু ততক্ষনে মেসেজ সীন হয়ে গেছে । এখন আর রিমুভ করে কোন ভাল নেই । একটু পরে শুভর কাছ থেকে উত্তর এল, কী চমৎকার চুল ছিল ! কেটে ফেলে কী হল শুনি?
তাহিরা উত্তরে লিখলো, লম্বা চুপ সামলানো কত ঝামেলা তা জানো ! নিজের তো নেই কিভাবে বুঝবে শুনি?
-পরিচর্যা করতে কষ্ট হলে আমাকে বলো, আমি তেল দিয়ে দিবো !
তাহিরা লিখলো, ইস শখ কত !
-শখ ! তা বলতে পারো !
এভাবে একের পর এক কথা চলতেই লাগলো । তাহিরা যখন নিজের মোবাইল থেকে চোখ সরালো দেখলো প্রায় চার ঘন্টা ওরা মোবাইলে চ্যাটিং করেছে । নিজের কাছেই অবাক হয়ে গেল সে । মনে মনে কেবল মনে হল যে চুল কেটে ভালই হল । এতো শুভর সাথে কেবল লুকোচুরির সম্পর্ক ছিল তবে এখন সেটা সরাসরি চলে এসেছে । এখন শুভ ওর সাথে সরাসরি কথা বলা শুরু করেছে ।
পরের সপ্তাহে তাহিরা নিজ থেকে শুভকে মুভি দেখার কথা বলল । একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলল অবশ্য । এতো জলদি এসব কি ঠিক হবে ! ভেবেছিলো যে শুভ হয়তো রাজি হবে না তবে রাজি হয়ে গেল সাথে সাথে । যদিও একটু চিন্তিত রইলো সে । ওদের এক সাথে মুভি দেখার ব্যাপারটা কলেজের বন্ধুরা যদি জানতে পারে তাহলে কেমন ভাবে নেবে কে জানে !
দুই
শুক্রবারে বসুন্ধরাতে একটু ভীড় থাকে । শুভ যতবার এখানে শুক্রবারে এসেছে ততবারই কারো না কারো সাথে দেখা হয়ে গেছে । আজও সম্ভবনা আছে কেউ ওদের দেখে ফেলবে । একটু চিন্তা করার চেষ্টা করলো যে যদি কেউ ওদের দেখে ফেলে তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে ! ওদের ব্যাপারটা এখনও শুভ কাউকেই বলে নি । শুভ আরো কিছু ভাবতে যাচ্ছিলো তখনই তাহিরাকে দেখতে পেল । দেখেই ওর চোখ কপালে উঠলো । মেয়েটাকে বেশির ভাগ সময়েই শুভ দেখেছে কলেজ ড্রেসে । কোচিংয়ে যখন দেখেছে তখনই সাধারণ ভাবেই কিন্তু আজকে তাহিরাকে একেবারে অন্য রকম লাগছে । আকাশী আর হলুদ রং মিশিয়ে একটা কামিজ পরেছে, একই রংয়ের ওড়না । সেই সাথে নিচে সাদা লেগিংস । পায়ে ফ্লাট স্যান্ডেল। চুল গুলো খোলা । মুখে হালকা মেকাপ তবে ঠোঁটে বেশ গাঢ় করেই লিপস্টিক দেওয়া । শুভ যেন একেবারে স্থান কাল পাত্র ভুলে কেবল তাকিয়ে রইলো তাহিরার দিকে ।
তাহিরা যখন একেবারে সামনে চলে এল তখনও তাকিয়েই রইল শুভ । শুভর এভাবে তাকিয়ে থাকাটা তাহিরাকে লজ্জায় ফেলে দিলো । মুখে একটা লাল আভা দেখা দিল মুহুর্তেই । চোখ নামিয়ে বলল, চল টিকিট কেনা যাক !
-আমি কিনেছি । ভেতরে গিয়ে বসবে?
-এখনই ?
-হ্যা ওখানে গিয়ে বসি বরং । এখানে যে কেউ দেখে ফেলতে পারে !
তাহিরা একটু হেসে দিয়ে বলল, ভয় পাচ্ছো !
-না না ভয় না আসলে …..
-আসলে কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পড়ে যাবে?
শুভ কিছু সময় যেন ভাবলো কী বলবে । তারপর বলল, না । আমি মোটেও লজ্জা পাবো না ।
-দ্যাটস গুড ! আমি কিন্তু বাসায় বলেছি যে আমি মুভি দেখতেই এসেছি ।
-আমিও তাই ।
মুভি শুরু হওয়ার পরে বেশ মজার একটা কাণ্ড হল । ওরা একটা ভুতের মুভি দেখতে বসেছিলো । এক পর্যায়ে এমনটা মুখ স্ক্রিনের সামনে এসে হাজির হল হঠাৎ যে হলের ভেতরে অনেকেই চিৎকার দিয়ে উঠলো । সব থেকে জোরে সম্ভবত তাহিরাই দিয়েছিল । সেই সাথে শুভর একটা হাতও চেপে ধরেছিলো ।
তবে যখন শান্ত হল, ভয়টা একটু কাটলো তখনও শুভর হাত সে ছেড়ে দিলো না । মুভির বাকিটা সময় সেই হাত ধরেই রইলো । মুভি শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ।
তিন
রিক্সায় যখন দুজন একসাথে উঠলো তাহিরা এবার নিজ থেকেই শুভ হাত ধরলো । মুভির ভেতরে যখন তাহিরা প্রথম হাত ধরেছিলো শুভর বুকের ভেতরে যেন একটা লাফ দিয়ে উঠেছিলো। আজকে এক সাথে মুভি দেখা হবে গল্প হবে এক সাথে কিছু সময় কাটানো হবে এমনটা ভেবেছিলো শুভ । তবে এভাবে যে হাত ধরে ফেলবে সেটা শুভ ভাবে নি । তারপর রিক্সাতে ওঠার পর থেকেই যে হাত ধরে আছে সেটা যেন শুভ মনে আরো আনন্দের বন্যা বয়ে দিল । আজকে যে এক সাথে এতো কিছু ঘটবে সেটা কে জানতো । তবে ঘটনা ঘটার যেন আরো কিছু বাকি ছিল ।
রিক্সাতে থাকার সময়েই চারিদিকে একটু বাতাস দেওয়া শুরু করলো । কয়েকদিনের গরমের পর এবার বৃষ্টি আসবে । যখন তাহিরাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে যাবে তখন তাহিরা শুভ হাত ধরে বলল, এই বৃষ্টির ভেতরে যেতে হবে না ।
-চিন্তা করবে না । চলে যাবো ।
-না । এখন ঝড় আসবে । এই সময়ে যেতে হবে না । বাসায় এসো !
তারপর একপ্রকার জোর করে শুভকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল বাসায় । শুভ খুব অস্বস্তি নিয়ে তাহিরাদের বাসায় ঢুকলো । বারবার মনে হচ্ছে তাহিরার মা বাবা ওকে এভাবে বাসায় ঢুকতে দেখে কী না কী মনে করে । কলিংবেল যখন বাজালো তখনও তাহিরা শুভর হাত ধরেই রয়েছে ।
শুভ একবার নিজের হাতটা একটু টান দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো তবে অবাকখয়েই দেখলো যে তাহিরা ওর হাত ছেড়ে দিলো না । এবং তার থেকেও অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে তাহিরার শরীরে বেশ শক্তি রয়েছে । শুভ ভাবতে পারে নি ওর শরীরে এতোটা শক্তি থাকবে ।
শুভ বলল, তোমার আম্মু দেখলে !
-তো কী হবে ?
-না মানে !
-আরে এতো ভেবো না তো !
এই কথা শেষ হতে না হতেই দরজা খুলে গেল । শুভ দেখলো দেখতে বেশ কম বয়সী একজন মহিলা দাড়িয়ে রয়েছে ওদের সামনে । চেহারাতে তাহিরার সাথে মিল রয়েছে । এটাই যে তাহিরার মা সেটা আলাদা ভাবে বলে দিতে হল না । তবে ইনি তাহিরার মা না হয়ে বড় বোন হলে ভাল হত !
তাহিরার মা শুভর দিকে তাকিয়ে বলল, আরে শুভ দেখি !
শুভ সালাম দিলো । তখনও হাতটা তাহিরার হাতে ধরা ! শুভর মনে প্রশ্ন জন্মালো যে ও যে শুভ সেটা তাহিরার মা কিভাবে জানলো ! তারপরই মনে যে তাহিরাই হয়তো ওর ছবি দেখিয়েছে । সেখান থেকেই চিনে ।
তাহিরার মা হাসলো । তারপর বলল, এসো এসো ভেতরে এসো । বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে ! বাসা যাবে কিভাবে !
শুভ কেন জানি তাহিরার মায়ের এই হাসিটা ভাল লাগলো না । কেন লাগলো না সেটা শুভ বলতে পারবে না তবে লাগলো না । ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই দরজাটা বেশ শব্দ করেই বন্ধ হয়ে গেল ।
ভেতরে ঢুকতেই একটু যেন অবাক হল শুভ । ভেতরে আসবার পত্র বলতে কিছুই নেই । কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । তাহিরা ওকে হাত ধরে সোফার উপরে নিয়ে বসালো । শুভ দেখলো তাহিরার মা চোখের ইশারাতে তাহিরাকে যেন কিছু বলল । তারপর ঘরের ভেতরে চলে গেল । তাহিরা শুভ কে নিয়ে সোফার উপরে বসালো । এবং তারপর শুভকে অবাক করে দিয়ে শুভর ঠোঁটে চুমু খেল গভীর ভাবে । এই রকম ড্রয়িং রুমে বসে যে সবার সামনে তাহিরা যে এভাবে ওকে চুমু খেতে পারে সেটা শুভ ধারণার বাইরে ছিল । তবে এই নরম ঠোঁটের চুম্বন থেকে নিজেকে সে কোন ভাবেই মুক্ত করতে পারলো না । আরো যেন গভীর ভাবে সেই চুম্বনের ভেতরে ডুবে গেল । যদি যে এভাবে ডুবে না যেত তাহলে সে দেখতে পেল তাহিরার মা রান্নাঘর থেকে ধীরে ধীরে সোফার সামনে চলে আসছে !
পরিশিষ্টঃ
-ছেলেটাকে আরো কয়েকদিন বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল আমার ! কয়েকটা দিন প্রেম প্রেম খেলা করতে মন্দ লাগছিলো না । তবে আজকেই যে এমন সুযোগ চলে আসবে ভাবি নি ।
তাহিরা শুভর নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । দেহটা প্রায় সাদা হয়ে গেছে । শরীর থেকে সব রক্ত শুষে নেওয়া হয়েছে । এখনও সেই কাজ চলছে । মনের ভেতরে একটা সুক্ষ অপরাধবোধ যেন কাজ করছে। তবে চিন্তাটা জোর করে দুরে ঠেলে দিলো । ঘোড়া যদি ঘাসেরই প্রেম করে তাহলে খাবে কি !
তাহিরার বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত মানুষের রক্তের দরকার । এই রক্ত শরীর থেকে না খেলে সে শরীরে শক্তি পায় না । তাই তো বাধ্য হয়েই মানুষকে ডেকে নিয়ে আসতে হয় যদিও এই কাজটা বেশির ভাগই তার মা করে । তবে মাঝে মাঝে তাহিরা নিজেও নিয়ে আসে শিকার ! তবে আজকে পেত ভরে শুভর রক্ত খেয়েও যেন মনে শান্ত এল না । শুভকে মনে মনে পছন্দ করতে শুরু করেছিলো সে ।