মাঝে মাঝেই ক্লাস শেষ করেও আমার ক্যাম্পাসে আরও কাজ থাকে । সেদিনও ক্লাসের শেষে আমাদের স্যারদের একটা মিটিং ছিল । সামনে আমরা একটা সেমিনার করতে যাচ্ছি সেই ব্যাপারেই চেয়ারম্যান স্যার আমাদের সাথে আলোচনা করছিলো । মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল । আমি আরও কিছুটা সময় রুমে কাটিয়ে যখন বের হতে যাবো তখনই নিকিতার ফোন এসে হাজির ।
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম । কারন এই সময়ে নিকিতা খুব দরকার না হলে ফোন করে না । ওর সাথে আমার বেশির ভাগ দিনেই কথা হয় রাতের বেলা । সকল শেষ করে ও ফোন দেয় । মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ও আমাকে মেসেজ করে । আমিও তাই করি । আমি জানি ও কি পরিমান ব্যস্ত থাকে সারা দিন । ওকে বিরক্ত করি না তাই । কিন্তু এই বিকেল বেলা ওর ফোন পেয়ে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না । এর আগেরবার অসময়ে ফোন করে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তারপর কি হুলস্থুল ব্যাপার ঘটে গেছে । যদিও ব্যাপারটা এখন খানিকটা শান্ত । আজকে আবার কি হবে কে জানে !
আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিকিতা বলল
-কি খবর মাই ডিয়ার বয়ফ্রেন্ড ! এখন ক্যাম্পাসে ?
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । আমি যে এখন ক্যাম্পাসে আছি এটা ও জানে । এমন কি আমি কোন রংয়ের শার্ট পরে আছি এই খবরও ওর কাছে আছে । আমি মাঝে মাঝেি ভুলে যাই যে আমার প্রেমিকা সাধারন কেউ নয় । আমি বলল
-হ্যা । তুমি কোথায় ?
-তুমি যেখানে আমি সেখানে !
-মানে কি !
-কোন মানে ফানে নাই । তোমাদের ক্যাম্পাসের বটতলায় আসো !
-তুমি এখানে !!
একটু অবাক হলাম যদিও এর আগে নিকিতা কয়েকবার এসেছে আমার ক্যাম্পাসে । আমার অফিসেই এসেছে । মুখে ওড়না দিয়ে পর্দা করে এসেছে । কেউ ওকে চিনতে পারে নি । আকজেও নিশ্চয়ও সেভাবেই এসেছে । মাঝে মাঝে এই মেয়ের সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারি না । অবশ্য তার পরেই নিজের মনকে বুঝ দেই যে এই মেয়ে পারে না এমন কোন কাজ নেই ।
আমি কাজ কর্ম দ্রুত শেষ করে বটতলার দিকে হাটা দিলাম । কিন্তু বটতলার কাছে গিয়ে বেশ বড় রকমের একট ধাক্কা খেলাম । নিকিতা আসলেই সেখানে একটা টুল পেতে বসে আছে । আমার অবাক হওয়ার কারন হচ্ছে নিকিতা আজকে তার মুখ ঢাকে নি । আশে পাশে সবাই তাকে দেখতে পাচ্ছে । কিন্তু কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না । নিকিতার আশে পাশে ওর সিকিউরিটিকেও দেখতে পেলাম ।
এখন ক্যাম্পাসে ভীড় অনেকটা কম । সবাই ক্লাস করে চলে গেছে । কিছু রাজনৈতিক ছেলে মেয়েরা আছে । আর অল্প কিছু সাধারন ছেলে মেয়েরা । সেই অল্প ভীড়ের মাঝে সেই ছাত্র নেতা কামাল আফসারকে দেখতে পেলাম । আমাকে দেখে সে যেন আরও অবাক হয়ে গেছে ।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না । এই মেয়ের মাথায় এখন কি চলছে কে জানে ! আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । আমাকে দেখতেই ওর মুখে হাসি দেখা গেল । ওর পাশে বসে থাকা একটা টুল এগিয়ে দিল । আমি চুপচাপ বসলাম । নিকিতা বলল
-কি ব্যাপার এমন মুখ করে রেখেছো কেন ?
-সিরিয়াস লি ? এই ভাবে ?
-হোয়াট ! কি হয়েছে ? আর কত লুকাবো বল ! আর ভাল লাগছে না । মন্ত্রী হয়েছি তো কি হয়েছে ! আমার পছন্দ অপছন্দ নেই?
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । নিকিতা বটতলার ফুচকা মামার দিকে তাকিয়ে বলল
-মামা দুইটা ফুচকা দিবেন ! একটাতে ঝাল দিবেন বেশি আরেকটা তে একদম কম । মাস্টার সাহেব আবার ঝালে খেতে পারে না !
দেখতে পেলাম ফুচকাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো । যেন ঝাল খেতে না পারাটা কত মজার একটা ব্যাপার ! আমি কেবল তাকিয়ে আছি আশে পাশে । নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ব্যাপার অন্য দিকে তাকিয়ে আছো কেন ? আমার চেহারা পছন্দ হচ্ছে না !
-না মানে ….
-কোন মানে ফানে করবা না তো ! লোকে কি ভাবলো এতো কিছু ভাবলে হবে !
আমরা যখন ফুচকা খেতে শুরু করলাম তখন দেখলাম আমার ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে এগিয়ে এল ধীর পায়ে । মেয়েটা একটু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে । ভেবেছিলাম সিরিউরিটি ওকে আটকাবে তবে আটকালো না । আমাদের সামনে এসে নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল
-ম্যাম, আপনার অনেক বড় ফ্যান আমি । সত্যি বলতে আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে আমরা যদি রাজনীতিতে আসি তাহলে দেশের অবস্থা চাইলেই বদলানো সম্ভব ! আপনার সাথে কি একটা ছবি তুলতে পারি প্লিজ !
নিকিতা হসলো ! তারপর বলল
-আরে এতো ভয় পাচ্ছো কেন ? আজকে আমি এই মন্ত্রী নই বরং তোমাদের স্যারের উমম…. তোমরা কি বল যেন হ্যা জিএফ হয়ে এখানে এসেছি ।
মেয়েটির মুখের হাসি এবার বিস্তৃত হল । মেয়েটি বলল
-আমি সত্যিই আপনার মত হতে চাই । আপনার মত কাজ করতে চাই ।
-ভেরি গুড । কই ছবি তুলবে না ? আসো !
মেয়েটা ছবি তুলে চলে গেল । দেখতে পেলাম তারপর আরও অনেকেই এগিয়ে এল । এমন কি সেই ছাত্রনেতা কামাল সাহেবেও এগিয়ে এল।
পুরো বিকেলটা নিকিতা ওখানেই কাটালো । রাতে অনলাইনে আবারও ঝড় বয়ে গেল । তবে এবার দেখলাম মানুষ সমালোচনা করছে না । বরং প্রসংশা করছে । একজন এতো ক্ষমতাবান মানুষ হয়ে একটা বিকেল সাধারন ভাবে তার পছন্দের মানুষের সাথে গাছের নিচে বসে ফুচকা খাচ্ছে গল্প করছে ! এটা এর আগে কেউ ভাবতে পেরেছিলো !! কেউ পারে নি । নিকিতা সেই কাজটাই করেছে । সত্যিই বলতে কি এর ফলেই ওর জনপ্রিয়তা যেন আরও বাড়তে লাগলো । সেই সাথে আমিও বিখ্যাত হয়ে গেলাম । আমার ফেসবুকে ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়তে লাগলো হুহু করে ! পথে ঘাটে অফিসে সবাই এখন আমার দিকে অন্য চোখে তাকাতে লাগলো । আমার কাছে সব কিছু যেন অন্য রকম লাগছিলো । সত্যি বলতে কি এই হঠাৎ করে টক অব দ্য টাউন হতে পেরে আমার খারাপ লাগছিলো না ।
কিন্তু এতো সবার মাঝে একজন মানুষ ঠিক খুশি ছিল না । সেটা হচ্ছে আমার মা । সে রাজনীতিবীদদের একজন পছন্দ করে না । তবুও নিকিতার আচরন আর আমার নিকিতার প্রতি আগ্রহ দেখে সে চুপ করে ছিলো । কিন্তু নিকিতার আসল পরিচয় জানতে পেরে সে খানিকটা হপ করে রয়েছে । সরাসরি না করছে না তবে ঠিক হ্যাও করছে না ।
নিকিতা মাঝে দুবার এসেছে আমাদের বাসায় । তবে আমার আশা আছে যে মায়ের মন আমি আর নিকিতা মিলে গলিয়ে ফেলবো । নিকিতার খুব জলদিই বিয়ে করার ইচ্ছে । আগামী ইলেকশনের কাজে নামার আগেই সে চাচ্ছে যে বিয়েটা করে ফেলতে । আমারও কোন আপত্তি নেই ।
সব কিছু ঠিকই চলছিলো । এর মাঝে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলো । একদিন কুরিয়ারের মাধ্যমে আমার কাছে একটা বক্স এসে হাজির । বক্সটা খুলতেই দেখি তারপর ভেতরে একটা ছোট সেলফোন । চাইনিজ মোবাইল । কম দামী । একটা সীম ভরা আছে ওতে । কিছু সময় খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেটার দিকে । আমাকে ফোন গিফট করবে কে ? তাই আবার এই ভাবে ?
ফোনের ভেতরে একটাই মাত্র নাম্বার সেভ দেখেলাম । সেখানে লেখা “কল মি”
কোন কিছু না ভেবে ডায়াল বাটনে চাপ দিলাম । কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হল । আমি হ্যালো বললাম । কিছু সময় নিরবতার পরে ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম
-আপনার জীবন হুমকির মুখে ।
নিশ্চিত ভাবেই একটা মেয়ে কন্ঠ । তবে মেয়েটা সম্ভবত নিজের কন্ঠ লুকাতে চাইছে । আমি বললাম
-মানে ? কি বলছেন !
-শুরুন বেশি কথা বলা যাবে না । হয়তো ট্টেস করে ফেলবে । কেবল এই কথা বলছি খুব সাবধানে থাকবেন । এই ফোনটার কথা কাউকে বলবেন না । আপনার আসল ফোনে আড়িপাতা হয় তাই এই ভাবে আপনাকে সাবধান করলাম । আমি আবার ফোন করবো ! সাবধান !
আর কাউকে বলবেন না এই ফোনের কথা । কাউকে না !
বলেই ফোনটা কেটে গেল । আমি আবার ফোন দিলাম । কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেলাম । কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । নিকিতাকে কি জানাবো এই ফোনের কথা ?
কিন্তু তখনই মনে হল ফোনকারী কাউকে না জানাতে বলেছে । অবশ্য নিকিতা আমাকে আগেই সাবধান করেছে । আমি যেহেতু নিকিতার সাথে আছি তাই বিরোধী দলের কাছে আমি এখন একটা টার্গেটে পরিনত হয়েছি । আমার পেছনে সব সময় চর লাগিয়ে রাখার পেছনেও এই একটা কারন আছে । আমি খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলাম । আমার কি বিপদ হতে পারে ! বুঝতে পারছি না !
Comments are closed.