রিমির দ্বিতীয় আফসোস

4.7
(101)

স্টেশন গেট দিয়ে বাইরে তাকাতেই রিমিকে চোখে পড়লো । হাসি মুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে । প্রায় দুই বছর পরে ওকে সামনা সামনি দেখছি তবে চিন্তে মোটেও কষ্ট হল না । আগের থেকে মনে হল দেখতে আরও একটু বেশি সুন্দরী হয়েছে । চেহারাতে পূর্ণ নারীত্বের ব্যাপারটা আরও ভাল ভাবে ফুটে উঠেছে ।
আমার সামনে এসে রিমি বলল, কি ভেবেছিলেন পালিয়ে যাবেন?
আমি হেসে ফেললাম । সত্যি বলতে কি আমার এমন ইচ্ছাই ছিল । ইচ্ছে ছিল যে আমি কোম্পানীর গেস্ট হাউজেই উঠবো । কাজ কর্ম শেষ করে একদিন ওদের বাসা থেকে ঘুরে আসবো । কিন্তু রিমি যে আমাকে নিতে স্টেশনে চলে আসবে সেটা বুঝতে পারি নি ।
আমি বললাম, আরে না । কি যে বলেন !
-হয়েছে । আর মিথ্যা বলতে হবে না । আসুন ।

আমি কিছু বলতে পারলাম না । ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওর পেছন পেছন হাটতে শুরু করলাম । রিমিকে দেখতে কেন সুন্দর লাগছে সেটা আরও ভাল করে বুঝতে পারলাম । রিমি হাতে মেহেদী দিয়েছে । সম্ভবত কাল রাতেই দেওয়া হয়েছে । এই জন্য হাতের রংটা বেশ পাকা মনে হচ্ছে । সেই সাথে ও পরে এসেছে সাদা রংয়ের একটা কামিজ । সাথে সাদা লেগিংস । সাদা ওড়নার সাথে ওকে দেখতে কেমন যেন মায়াময়ী মনে হচ্ছে ।

মেয়েটা আমার পছন্দের সব কিছু ঠিকঠাক মনে রেখেছে । এখনও কি মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে !
আমি জানি ও এখনও বিয়ে করে নি । বিয়ে করলে আমি খবর পেতাম । আমাদের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ না হলেও মাঝে মধ্যে কথা বার্তা হয় । এই কথার ফাঁকে ও একবারও ওর বিয়ের কথা আমাকে বলে নি । আচ্ছা এমনও কি সম্ভবনা রয়েছে যে মেয়েটা এখনও আমার অপেক্ষায় রয়েছে ?
কিন্তু কেন থাকবে ?
আমি তো তাকে কোন কথা দিই নি । বরং পরিস্কার করেই বলে দিয়েছি আমার মনের কথা ।
স্টেশন থেকে বের হতেই দেখলাম আকাশ বেশ মেঘলা । বৃষ্টি হবে সম্ভবত । রিমি বলল, আকাশ মেঘলা ! তবে মনে হয় না বৃষ্টি হবে !
-কেন?
-এখন এমনই । তবে বৃষ্টি হলেও সমস্যা নেই ।

গাড়িতে উঠে একটু অবাক হতে হল । সাথে কোন ড্রাইভার আসে নি । তার মানে রিমি নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে । বাহ ! এই ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ লাগলো ।
যখন রিমিদের বাসায় পৌছালাম তখন প্রায় নয়টা । আমাকে এগারোটার ভেতরে অফিসে রিপোর্ট করতে হবে । সেখানে আজকে সারা দিন অডিট করতে হবে । মোট তিন দিনের কাজ ।
ঘরের ঢোকার মুখেই রিমির বাবা আতাহার আহমের সাথে দেখা হল । আমাকে দেখে যে সে খুশি হন নি সেটা তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম । অবশ্য খুশি হওয়ার কথাও না । তবে রিমির কারণে কিছু হয়তো বলতেও পারছেন না । আমি তাকে দেখেই সালাম দিলাম । সে সালামের উত্তর নিলো এবং আর কিছু না বলে আমার সামনে দিয়ে বের হয়ে চলে গেল । তার মুখ দেখে মনে হল এখানে না আসলেই সম্ভবত ভাল হত । কিন্তু না এসে পারাও তো গেল না । আসলে রিমির প্রতি আমার সব সময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে । আমার বারবারই মনে হয় যে যদি আমার সাথে রিমির দেখা না হত তাহলে বুঝি মেয়েটার জীবন আজকে অন্য রকম হতে পারতো ।

রিমির মা অবশ্য বেশ আন্তরিক ভাবেই আমাকে গ্রহন করলেন । আমার জন্য আলাদা একটা ঘর ঠিক করাই ছিল । আমাকে অফিস যেতে হবে এগারোটার ভেতরে এই কথা শুনেই রিমি এবং ওর মা তাড়াহুড়া করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল । বলে গেল যে ফ্রেস হয়ে নিতে । তারপর নাস্তার টেবিলে আসতে ।
ফ্রেস হয়ে আমি যখন নাস্তার টেবিলে ফিরে এল তখন সত্যিই অবাক হতে হল । পরোটার ভাজা হয়েছে ঘি দিয়ে । সেটার গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে । আমি ঘিয়ে ভাজা পরোটা পছন্দ করি, এই কথাটা রিমিকে এক সময়ে বলেছিলাম । মেয়েটা সেটা মনে রেখেছে । এছাড়া আলুভাজির সাথে ডিম আর হাঁসের মাংস দেখা যাচ্ছে । আর সাথে কমলার জুস । সকালে এতো কিছু খাওয়ার অভ্যাস আমার নেই । আমার মনে হল যেন আমি এই বাড়ির জামাই । এরা আমাকে জামাই আদর শুরু করেছে । অবশ্য এক হিসাবে বলতে গেলে এই বাড়ির জামাই হওয়ারই কথা ছিল আমার ।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে রিমি নিজেই আমাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে এল । বলল যে বিকেলে এখান থেকে নিয়ে যাবে আমাকে । আমি মানা করলাম ওকে আসতে । বললাম যে আমি নিজেই চলে যাবো । তবে সে শুনবে বলে মনে হল না ।

দুই
ছুটির দিনে আমার বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস সব সময় । ঘুমিয়েই ছিলাম তখন মায়ের ফোন এসে হাজির । আমার মা খুব ভাল করেই জানে যে আমি ছুটির দিন গুলোতে বেলা করে ঘুমাই । এবং সে খুব দরকার না হলে আমাকে ফোন দেয় না সকালের দিকে । কিন্তু সকালের দিকে তার ফোন এসে হাজির । একটু অবাক হলাম । প্রথমে মনে হল হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে । নয়তো এমন সময়ে সে ফোন দিবে কেন ?

আমি তাড়াতাড়ি ফোন ধরলাম ।
-হ্যালো মা ।
-ঘুমাচ্ছিস ?

মায়ের কন্ঠস্বরে কোন প্রকার শঙ্কা কিংবা উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম না । একটু নিশ্চিন্ত হলাম । বললাম, আজকে ছুটি মা ।
-শোন না একটা কথা ।
-কি কথা ?
-আগে বল যে রাগ করবি না ।

তখনই মনে হল যে মা এমন কিছু বলবে যাতে আমার মেজাজ গরম হবে । আমি আগে থেকেই মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম । মা বলল, তোর সুরাইয়া আন্টি আছে না তার ভাইয়ের মেয়ে রিমি নাম ।
-মা তোমাকে আমি বলেছি বিয়ের কথা বার্তা আমার সামনে না বলতে ।
-আরে বাবা শোন না । মেয়েটার ঢাবিতে পড়ে । আর কদিন পরে মাস্টার্স দিবে ।
-তো আমি কি করবো মা !
মা একটু ইতস্তর করে বলল, ওর বাবা আজকে ঢাকা গিয়েছে । তোর বাবা তোর বাসার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে ।
-মা !
-একটু দেখা কর না বাবা ! ওর বাবার সাথে মেয়েও যাবে । রাগ করিস না বাবা ! একটু দেখা কর ! তোকে কোথাও যেতে হবে না । ওরাই যাবে তোর সাথে একটু কথা বলবে ।

আমি কিছু বলতে পারলাম না । কারণ তারা এতোক্ষনে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে । আমার এতো মেজাজ গরম হল কিন্তু কোন কথা বলতে পারলাম না ।

আরও ঘন্টা খানেক পরে আমাকে দেখতে মেয়ের বাবা আর মেয়ে এসে হাজির হল আমার বাসায় । আমি দরজা খুলে দিলাম । দেখলাম কোর্ট পরা এক ভদ্রলোক এবং তার সাথে শান্ত চেহারার এক মেয়ে দাড়িয়ে । আমি সালাম দিলাম । তারপর ভেতরে ঢুকতে বললাম ।

মেয়েটা আমার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল । তারপর মাথা নিচু করে ঘরের ভেতরে ঢুকলো ।

প্রায় দুই ঘন্টা ছিল তারা । নিজেই তাদের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এলাম । সাথে কিছু বিস্কিট আর চিপস ছিল । রিমির বাবা আমার সাথে নানান বিষয়ে কথা বলতে লাগলো । আমি কি করি কোথায় অফিস এই ফ্ল্যাটটা কতদিন হল কিনেছি এইসব । সব মেয়ের বাবারা যে ধরনের প্রশ্ন করে । এর ভেতরে দেখলাম রিমি উঠে গেল । সম্ভবত ওয়াশ রুমে যাবে । ফিরে বেশ কিছুটা সময় পরে ।

যাই হোক সেই দিনের মত তারা বিদায় নিল । আমি ভেবেছিলাম রিমির সাথে বুঝি আমাদের দেখা সাক্ষাত সেইদিনই শেষ । তবে সেই দিন শেষ হল না । ঠিক এক সপ্তাহ পরে মেয়েটা আবারও আমার বাসায় এসে হাজির । আমি ওকে মোটেও আশা করি নি । মেয়েটা খানিকটা লজ্জিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ভেতরে আসবো ?
-আসুন !
ভেতরে সোফাতে বসতে বসতে রিমি বলল, আপনি কি খুব অবাক হয়েছেন আমি এসেছি বলে?
-একটু হয়েছি ।
-আসলে আমি সোজা করে বলি । আমি জানি না আপনার কি মত তবে আপনার ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলির দুই পক্ষেরই মত রয়েছে । আমার বাবা আপনাকে বেশ পছন্দ করেছে।
-আচ্ছা ।
-আপনার বাবার সাথে কথা বার্তা চলছে । কিন্তু আমি চাই যে আমাদের আগে কথা বার্তা হোক । তারপর ….

আমি আসলে কি বলব সেটা খুজে পেলাম না । মেয়েটাকে সরাসরি কিছু বলতে কেমন যেন দ্বিধাবোধ করলো মনে । রিমি বলল, আজকে আসার আরও একটা কারণ অবশ্য আছে ।
-কি কারণ?
-গতদিন আপনার বুকসেলফটা দেখে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিলো । কত বই সেখানে । কয়েকটা বই ধার নিতে চাই । দিবেন কি?
আমি হেসে ফেললাম । বললাম, নিন সমস্যা নেই । কেবল গায়েব করে না দিলেই হল !
রিমি হাসলো । বলল, ভয় নেই যথা সময়ে ফেরৎ দিয়ে যাবো ।

এই ভাবেই রিমির সাথে আমার দেখা হতে লাগলো । মাঝে মাঝে সে বই নিতে আসে আমার কাছে । বই নিয়ে আবার ফেরৎ দিতো । মাঝে মধ্যে আমরা টুকটাক গল্প করতাম । সত্যিই বলতে রিমি চমৎকার একটা মেয়ে । এমন মেয়েকে যে কেউ বিয়ে করতে চাইবে । কিন্তু আমি সেই দলে নেই ।

তিন
কাজ কর্ম শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । বেশির ভাগ কাজই শেষ করে এনেছি। যদিও আরও একদিন দরকার হবে । আমি অফিসের বাইরে আসতেই রিমিদের গাড়িটা দেখতে পেলাম বাইরে । তবে এবার গাড়ির ভেতর থেকে রিমি বের হল না । ওদের ড্রাইভার বের হয়ে এল। আমাকে চিনলো কিভাবে কে জানে । গাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেই দরজা খুলে দিল ।

সন্ধ্যার নাস্তা এল ঘরেই । রিমি নিজেই নিয়ে এল সেটা । আমি তখন সবে মাত্র ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছি । দেখলাম রিমি ট্রে নি য়ে ঘরে ঢুকলো । বিছানার উপরে না রেখে ঘরের সাথে যে বারান্দাটা আছে সেখানে নিয়ে গেল । আমিও সেখানে গিয়ে হাজির হলাম !

আমার রুমটা রিমিদের বাসার পেছন দিকে । পেছন দিকে বেশ কিছু জায়গা । তবে সেখানে ছোট খাটো কয়েকটা গাছ রয়েছে । মাঝ দিয়ে একটা রাস্তা রয়েছে । তারপর বড় একটা পুকুর রয়েছে । পুকুরের ওপাশে ঘন কিছু গাছপালা ! আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললাম, চমৎকার তো জায়গাটা !
রিমি বলল, যখন বৃষ্টি পড়ে তখন এই জায়গাটা এতো চমৎকার লাগে । জানেন আমার বেশ ইচ্ছে একদিন শাড়ি পরে বৃষ্টিতে ঐ পকুর পাড়ে ভিজবো !
আমি এবার রিমির দিকে তাকিয়ে বললাম, চাইলেই তো পারেন ।
রিমির মুখটা একটু যেন কালো হল । তারপর বলল, যার সাথে ভিজতে চেয়েছিলাম সে চায় নি । একা একা ভিজতে ইচ্ছে করে নি ।

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । কারণ সেই মানুষটা যে কে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না । বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল নিরবে । কেউ কোন কথা বলল না । তারপর রিমিই নিরবতা ভঙ্গ করে বলল, তা রাতে কি খাবেন বলুন । কোন স্পেশাল রিকোয়ার্মেন্ট আছে কি?
আমি বললাম, আমি জানি এমনিতেও অনেক বেশি আয়োজন করবেন । সো আলাদা ভাবে বলার কোন দরকার নেই ।
সত্যিই রাতের বেলা আয়োজন হল বিশাল ।

পরের দিনও একই ভাবে দিন চলে গেল । কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা । রাতে ট্রেন ছিল ফেরার । আমার লক্ষ্য ছিল ফিরে যাবো কিন্তু রিমি কিছুতেই আমাকে যেতে দিল না । এক পর্যায়ে বলল, প্লিজ এই অনুরোধটা রাখুন । আমি আপনার কাছে কখনই কোন অনুরোধ করি নি । এই অনুরোধটা রাখুন প্লিজ !

সত্যিই রিমি আমার কাছে কিছুই চায় নি কোন দিন । ঐ সময়ে রিমির সাথে আমার প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেখা হত। রিমি এক সময়ে বুঝতে পারে যে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই না । একদিন সরাসরিই জিজ্ঞেস করলো কথাটা !
-আপনার কি আমাকে পছন্দ না ?

আমি বললাম, আসলে পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার না । মানুষ হিসাবে আপনি চমৎকার একজন মানুষ । যে কেউ চাইবে আপনাকে বিয়ে করতে ।
-কিন্তু আপনি চান না?
-হ্যা ।
-কারণটা কি বলা যাবে?

কিছু সময় চুপ করে থেকে আমি বললাম আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক হয় । ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় ধরেই তার সাথে আমার প্রেম চলে । এরপর একটা সময়ে সে হঠাৎ করে আমাকে রেখে আমেরিকা চলে যায় ।
-তারপর ?
-তার আর কোন পর নেই।
-সে কি বলেছিলো অপেক্ষা করতে ?
-না । যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলো সে আর ফিরে আসবে না ।
-তাহলে?
-তাহলে আমি যে কেন অন্য কাউকে মনের ভেতরে নিতে পারি না আমি নিজেও জানি না । আপনাকে বিয়ে করতে না পারাটা আমার নিজের অপারগতা !

রিমি চুপ করে বসে ছিল । তারপর আসি বলে চলে গেল । আমি ভেবেছিলাম হয়তো আর পরে আসবে না সে । তবে এর পরেও রিমি যতদিন ঢাকাতে ছিল প্রায়ই আসতো । এরপর হঠাৎ করেও কলেজের লেকচারার চাকরি নিয়ে চলে যায় নিজের জেলাতে । তারপর থেকে যোগাযোগ কমে গেলেও মাঝে মধ্যে কথা হত ফোনে । কয়েকবার ওর জন্য বই কুরিয়ার করেছি আমি । ও সেগুলো আবার ফেরৎ দিয়েছে । তাও প্রায় দুই বছরের কথা ।

চার

আরও একটা দিন সে কেন থাকতে বলেছিলো সেটা টের পেলাম পরদিনই । এই দুইদিন আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি হয় নি । পরদিন দুপুরেই ঝুম বৃষ্টি নামলো । আমি নিজের ঘরে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম তখনই দেখলাম রিমি ঘরে ঢুকলো । ওকে দেখে একটু অবাকই হলাম । মেয়েটা আজকে কালো শাড়ি পরেছে । সাথে কালো টিপ । চুল খোলা । আমার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা পরে নিন তো !
-কি এটা !
প্যাকেট খুলতেই দেখলাম, একটা কালো রংয়ের পাঞ্জাবি।
রিমি বলল, আমি এই দিনটার জন্য কতদিন অপেক্ষা করেছি জানেন ! আপনাকে আমি আর কোন দিন বিরক্ত করবো না । কেবল আজকে বৃষ্টিতে চলুন একটু ভিজবেন । কালো শাড়ি আর কালো পাঞ্জাবি ।

ছাতা নিয়ে পুকুর পাড়ে হাজির হলাম । রিমি আমার পাশে পাশেই হাটছিলো । চারিদিকে কেবল বৃষ্টি পড়ার শব্দ । পুকুরে পানিতে বৃষ্টি পড়ার একটা আলাদা শব্দ আছে । আমি মন দিয়ে সেটা শুনতে লাগলাম । এক সময়ে দেখি রিমি নিজের ছাতা ফেলে দিয়েছে । আমারটাও টেনে ফেলে দিলো । একটু সময়ের মাঝেই ভিজে গেলাম । এরপরই রিমি আমার হাত ধরলো । মেয়েটা একভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এই তীব্র বৃষ্টির মধ্যেও আমার রিমির চোখের পানি চিনতে মোটেও কষ্ট হল না ।

আমরা আরও ঘন্টা খানেক বৃষ্টিতেই ভিজলাম । সত্যি বলতে আমার নিজের ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভূতি হল এতো দিন পরে আমার প্রথমবারের মত মনে হল যে রিমির সাথে জীবন শুরু না করাটা কি আমার ভুল ছিল? আমি নিজের কাছে বেশ কয়েকবার এই প্রশ্ন করলাম । এতোদিন অনেক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে কিন্তু এই অনুভূতিটা কোন দিন জাগে নি। কিন্তু রিমির বেলা ঠিকই এই অনুভূতিটা জেগে উঠলো। কেন উঠলো?

সন্ধ্যায় আজকে ভুনা খিচুড়ি রান্না হল । রাত এগারোটাট সময়ে ফেরার ট্রেন । রিমিও চলল আমার সাথে । একটু আগে আগেই রওয়ানা দিয়েছিলাম ।

স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে এক সময়ে রিমি বলল, জীবনে দুইটা আফসোস ছিল । একটা পুরণ হয়েছে । আর আরেকটা বুঝি পূরণ হবে না । তবে ইটস ওকে । সব কিছু পেতে নেই ।
আমি আবারও চুপ করে রইলাম । কথা ঘুরাতে বললাম, নতুন কিছু বই কিনেছি ।
-তাই নাকি? এবার গিয়ে ছবি পাঠাবেন । তারপর পড়া শেষ করে আমাকে কুরিয়ার করবেন !
-আচ্ছা করবো ।

ট্রেন চলে এল । আমি উঠে পড়লাম । রিমি একভাবে আমার দিকে তাকিয়েই রইলো । আমি দরজার কাছে দাড়িয়ে ওকে দেখতে লাগলাম । মেয়েটা কেমন চোখে তাকিয়ে রয়েছে । আমার মনের ভেতরে কেমন যেন লাগছে । বৃষ্টিতে ভেজার সময়কার সেই অনুভূতিটা আবার জেগে উঠলো। এমন সময় ট্রেনের হুইসেল দিল । ট্রেনটা নড়ে উঠলো সাথে সাথে । একটু পরেই চলতে শুরু করলো । ট্রেন একটু চলতে শুরু করার পরেই আমি রিমির ভেতরে চঞ্চলতা খেয়াল করলাম । মেয়েটা কি ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে । আমার একবার ইচ্ছে হল ট্রেন থেকে নেমে যাই । কিন্তু সেটা করলাম না ।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রিমি ট্রেনের সাথে দৌড় লাগালো । আমি চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । ওকে মানা করতে পারলাম না । বুকের ভেতরে কি যে এক আন্দোলন শুরু হল সেটা আমি বলে বোঝাতে পারবো না । এসআরকের সেই মুভির কাহিনীর মত মনে হল । কাজল যেভাবে দৌড় দেয় । রিমিও সেই একই ভাবে দৌড়াচ্ছে ।

তবে রিমি কাজলের মত গাধা না ! কাছের দরজা রেখে দুরের দরজার দিকে দৌড় দিলো না সে । অবশ্য ট্রেন যে গতি পেয়েছে তাতে ও আমার দরজা পর্যন্ত আসতে পারতো না । তবে বগির অন্য দরজা ঠিকই ধরে ফেলল । এবং উঠেও পড়লো । আমি সত্যিই জানি না আমার মাঝে কি হল আমি চট করে ট্রেনের ভেতরে চলে গেল । দেখলাম রিমি বগির অন্য প্রান্তে চলে এসেছে । আমি ওর দিকেই দৌড় দিলাম । কেন দিলাম আমি জানি না । তবে আমার মনের সব বাঁধ সত্যিই ভেঙ্গে গেছে । দেখলাম রিমি নিজেও দৌড়ে এল আমার দিকে । এবং আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো ! সবার সামনেই ! এভাবে সিনেমেটিক ভাবে রিমি আমার কাছে আসবে আমি কল্পনাও করতে পারি নি ! কেবল অনুভব করলাম আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কেবল কেঁদেই চলেছে ।

পরিশিষ্টঃ

রিমির সাথে বিয়ে হল ঠিক একদিন পরেই । ঢাকার ফিরে আসার দিনই । মা আমাকে ফোন করে বলল, সেই পানি তো খেলিই,ঘোলা করে ।

বাসর রাতের সময়ে রিমিকে বললাম, তাহলে তোমার দ্বিতীয় আফসোসও মিটে গেল ।

-হুম ! আমার অনেক দিনের শখ ছিল এমন চলন্ত ট্রেনে উঠবো প্রেমিকার কাছে যাওয়ার জন !
-অ্যা ! আমাকে পাওয়াটা ? ঐ ট্রেনে ওভাবে ওঠাটা ?
-হুম ! তুমি কি ভেবেছো তোমার বিয়ে না করতে পারাটা আফসোস ছিল ! ইস শখ কত !
-কি ! দাড়াও মজা দেখাচ্ছি !
-এই খবরদার কাছে আসবা না বলে দিলাম ! একদম বলে দিলাম …..

কিছু কিছু গল্প কিভাবে যে শেষ হয় কেউ বলতে পারে না !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 101

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “রিমির দ্বিতীয় আফসোস”

  1. কাল্পনিক বলেই হয়তো গল্পগুলোর চরিত্র এমন পূর্ণতা পায়।

    গল্পে ভালোলাগা..

Comments are closed.