বসিলার এই থানাটা নতুন হয়েছে। আগে এই এলাকার পুরোটা মোহাম্মাদপুর থাকার ভেতরে ছিল। পরে আলাদা হয়ে নতুন থানায় পরিণত হয়েছে । মেহরাবের বন্ধু হিসাবে থানার স্টাফরা আমাকে বেশ ভালই খাতির করে। মেহরাব এখনও থানায় এসে হাজির হয় নি। আজ সকালে হঠাৎ আমাকে ফোন করে আসার কথা বলল। কারণ জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু বলল না। অবশ্য এখানে আসার সাধারণত একই রকম হয়ে থাকে। তাই এটা নিয়ে আর কথা বাড়াই নি।
গতকাল বিকেলে নিকিতা যখন আমাকে তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য বলছিল তখন আমি রাজি হয় নি। তাকে নানান ধরনের কথা বলে টালানোর চেষ্টা করেছিলাম। রাজি হতে চাই নি। কিন্তু মেহরাবের জন্য এই কাজটা আমি মাঝে মাঝে করে থাকি। নিকিতা আমাকে বলেছিল আমিও নিয়ম ভাঙ্গছি। কাল রাতে নিকিতার এই কথা নিয়ে আমি ভেবেছি। আমি কেন এক কথাটাই রাজি হয়ে গেলাম না ? তখন ওমন গড়িমসি আমি কেন করছিলাম ?
আমি সত্যিই মনে করি যে একজন মানুষকে যখন করবস্ত করানো হয় তখন তার এই বস্তু জগতের সাথে সব বন্ধন শেষ হয়ে যায় । তখন তাদের আর বিরক্ত আর বিরক্ত করা উচিত না । যে কথা তারা বলে যায় নি সেই কথা আর না শোনাই উচিৎ। কিন্তু মেহবারের অনুরোধে আমি যে কাজটা করি সেটার বেলায় বলা যায় যে ওরা এখনও এই জগত ছেড়ে চলে যায় নি । যাওয়ার পথে আসে কেবল । এই জন্য তাদের যাত্রা পথে তাদের সাথে দুই একটা কথা বলে নেওয়া কোন অন্যায় নয়। একবার যখন তারা গন্তব্যে পৌছে যাবে তখন আর তাদের বিরক্ত না করলেই হল। আমি জানি মনকে বোঝানোর জন্য এটা আমারই তৈরি একটা অযুহাত । আমরা আমাদের মনকে বোঝানোর জন্য অনেক কিছুই নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে নি।
মেহরাব আমাকে দশটার দিকে আসতে বলেছিল। থানাতে এসে শুনি কার সাথে নাকি কথা বলতে গেছে। অবশ্য আমার আসার কথা বলে গেছে। তাই ওর এসিস্ট্যান্ট আমাকে সরাসরি মেহরাবের রুমে নিয়ে বসাল । একটু পরে এক কাপ চা এসে হাজির । যদিও চা জিনিসটা আমার খুব একটা পছন্দ না। আমার কফি পছন্দ। কেউ যখন জিজ্ঞেস করে যে আমি চা খাবো কিনা তখন আমি সব সময়ই সবিনয়ই মানা করি। তবে সরাসরি সামনে এনে রাখলে কাপে একটা দুটো চুমুক দিতে আমার খুব একটা আপত্তি থাকে না।
কাপে চুমুক দিতেই মেজাজ খারাপ হল । একদম চিনি হয় নি। কফি যখন খাই তখনও একটু চিনি বেশি দিই । সরাসরি ক্যাফেইন আমার শরীরে তীব্র প্রতিক্রিয়া করে । তাই একটু বেশি মিষ্টি করে নিতে হয়। চায়ের বেলাতেও বেশি মিষ্টি খাই। এখানে একদম মিষ্টি হয় নি। মনে হচ্ছে শুধু চা পাতির আর গমর পানি মিশিয়ে দিয়েছে। একবার মনে হল যে কাপের চাটুকু ওয়াশ রুমে গিয়ে ঢেলে ফেলে দিয়ে আসি । কিন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হল না।
মোবাইল বের করে মেহরাবকে একটা ফোন দিব কিনা ভাবছি । আমাকে আসতে বলে ও কোথায় চলে গেল কে জানে। অবশ্য আমার এখন কোন কাজ নেই । কাল রাতে অনুবাদের কাজটা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আর দুইদিন এই ভাবে যদি কাজ করি তাহলে শেষ হয়ে যাবে। রফিক ভাই অবশ্য কথা দিয়েছেন যে এটা শেষ হলে নতুন আরেকটা বই আমাকে দিবেন । কবে দিবেন কে জানে।
আমি বসে বসে নিকিতা রহমানের কথা ভাবতে শুরু করলাম । মেয়েটা হঠাৎ তার মৃত বাবার সাথে কী এমন কথা বলতে চায়? কী এমন জানার আছে তার কাছে? এমন অনেক মানুষ থাকে যারা আসলে তাদের কাছের মানুষের সাথে কথা বলতে চায় । কন্ঠেস্বর শুনতে চায় । জরূরী কোন কথা না, শুধু সরাসরি কথা বলতে চাওয়া কেমন আছো কী খাচ্ছো এই টাইপের কথা । কিন্তু আমার বেলাতে তো এসবের কোন উপায় নেই। তারা তো এইসব কথা নিজেরা শুনতে পাবে না । আমি যা বলব সেটাই তাদের মেনে নিতে হবে।
প্রথম যখন আমি ব্যাপারটা টের পেলাম যে আমি আসলেই মৃত মানুষদের সাথে কথা বলতে পারি তখন একটা তীব্র ভয় এসে আমাকে পেয়ে বসেছিল। তখন কোন ক্লাসে পড়ি? ক্লাস সেভেনে সম্ভবত । আমাদের স্কুলের জামিল স্যার মারা গেলেন । উনি গলায় দড়ি দিয়েছিলেন । গলায় দড়ি দেওয়ার কারণটা অবশ্য তখন কেউ জানতো না তবে আমি জানতাম । আমরা সেদিন স্কুলেই ছিলাম । টিফিন পিরিয়ডে হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ল যে আমাদের জামিল স্যার তার বাসায় গলায় ফাঁস নিয়েছেন।
আমরা সবাই ছুটে গেলাম তার বাসায়। তার বাড়িটা স্কুল থেকে কাছেই ছিল । প্রতিদিন দুপুরে, টিফিন পিরিয়ডে জামিল স্যার বাসায়্য যেতেন দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য । স্যার বউও আসতেন এই সময়ে অফিস থেকে । তার বউ কৃষি ব্যাংকে চাকরি করতেন। সেইদিন স্যার স্ত্রীর আসতে একটু দেরি হয়েছিল । তিনি বাসায় এসেই দেখেন যে স্যার শোবার ঘরে ঝুলে আছে। সেখানেই চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করেন। লোকজন এসে হাজির হয়।
আমরা যখন গিয়ে হাজির হলাম তখন স্যারকে নামানো হয়েছে নিচে। কয়েকজন পুলিশও এসে হাজির হয়েছে। সবাই ভীড় করে রয়েছে । সবাই একবার স্যার মৃত শরীরটা দেখতে চাচ্ছে। আমিও ভীড় ঠেলে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম । যখন ঘরের ভেতরে ঢুকে মৃত দেহের দিকে তাকালাম তখনই একটা ধাক্কার মত খেলাম । মৃত দেহটা মেঝেতে মাদুরের উপরে শোয়ানো রয়েছে । তার ঠিক পাশেই স্বয়ং জামিল স্যার মন খারাপ করে বসে আছেন। আমার প্রথমে মনে হল আমি বুঝি ভুল দেখলাম । মনে হল যেন জামিল স্যারের মতই কেউ হয়তো সেখানে বসে আছেন। তার কোন ভাই হবে অথবা কোন আত্মীয় যেকিনা একেবারে স্যারের মত দেখতে । কিন্তু স্যার যখন আমার দিকে ঘুড়ে তাকালেন শূন্য চোখে তখন আমার মোটেই চিনতে ভুল হল না । এটা আসলেই আমাদের স্যারই ছিলেন । আমি ভয়ে মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করতে পারলাম না । সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলাম । তারপর আর আমার কিছু মনে নেই । যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি নিজের বাসায় । তারপর থেকে বাবা একেবারে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন । আমি যেন আর কোন দিন কোন মৃতদেহ দেখতে না যাই। এরপরে আমি দুই বছর কোন মৃতদেহের কাছেও যায় নি ।
যখন ক্লাস টেনে উঠলাম তখন আমি আবার এই ব্যাপারটা আরও ভাল ভাবে উপলব্ধি করলাম । সেই সময় আমি পরিস্কার ভাবে বুঝতে শিখলাম যে আমি সত্যি সত্যি মৃত মানুষকে দেখতে পাই। এবার মারা গেলে আমার পছন্দের বড় মামা । বড় মামা মারা গেল কার এক্সিডেন্টে । বাসায় তখন শোকের ছায়া । মাকে নিয়ে আমি নানার বাড়ি ছুটলাম । মামার মৃত দেহ হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে । সবাই কান্নাকাটি করছে । আমারও মন সিক্ত হয়ে আছে । চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে । আমি মায়ের সাথে মৃতদেহটা যে ঘরে রাখা আছে সেখানে ঢুকলাম। এবং ঠিক সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল যেমনটা জামিল স্যারের সাথে ঘটেছিল। আমি দেখতে পেলাম যে মামা ঠিক তার মৃত দেহের কাছেই বসে আছেন বিষন্ন মুখে । আমি ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম যে তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন । আমাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন শূন্য চোখে।
আবার তখন ভয় পেয়ে চিৎকার করার দরকার ছিল কিন্তু এইবার কেন জানি আমি ভয় পেলাম না। মামাকে অনেক পছন্দ করতাম বলেই হয়তো । মামা উঠে আমার দিকে এগিয়ে এলেন । তারপর জানতে চাইলেন আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি কিনা । আমি মাথা ঝাকালাম কেবল । আমার মাথায় যখন চিন্তার ঝড় চলছে। আমার তখন পেছনের ঘটনা সব মনে পড়ে গেল । আমার দাদীর কথা মনে পড়ল । আমার কাছে আস্তে আস্তে সব কিছু পরিস্কার হতে লাগল । সেই সাথে এটাও মনে হল যে আমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
মামা জানালেন যে তিনি আসলে কাউকেই দেখতে পাচ্ছেন না। সব কিছু কেমন যেন অপিরিচিত মনে হচ্ছে তার কাছে । তিনি বুঝতে পারছেন যে তিনি মারা গেছেন। তিনি যে তার দেহে থেকে আলাদা হয়ে গেছেন এটাও তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু চারিপাশের কোন মানুষজন দেখতে পাচ্ছেন না। কেবল মাত্র আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আমি একটু সরে বাইরে বের হয়ে এলাম। দেখলাম মামা আমার পেছন পেছন পেছন বের হয়ে এল । আমি চাচ্ছিলাম একটু দুরে সরে যেতে যাতে মানুষজন আমাদের কথা বলা যেন কেউ শুনতে না পায়। আমার ইচ্ছে ছিল বাড়ির বাইরে চলে যাওয়া। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরে পেছনে তাকিয়ে দেখি মামা থেমে গেছেন । আসছেন না ।
আমি সেদিন নানা বাড়ির কোণার দিকের একটা দেয়ালের কাছে দাড়ালাম । কানে এয়ারফোন লাগিয়ে এবার কথা বলতে শুরু করলাম যেন কেউ যদি আমাকে কথা বলতে শোনেও তবে বুঝবে যে আমি ফোনে কথা বলছি। সেই থেকেই আমি ভাল ভাবে বুঝতে শিখি যে আমি মৃত মানুষদের সাথে কথা বলতে পারি, তাদের দেখতে পারি।
সেদিন মামার কত কথা বলেছিলাম তার কোন ঠিক নেই। আমি ভেবেছিলাম মামার সাথে আমার এই কথা বার্তা কেবল মাত্র তাকে সমাহিত করার আগ পর্যন্তই হবে । একবার তাকে কবর দিয়ে দিলে তার সাথে আমার আর কথা বলা হবে না। এই ভুল ভাঙ্গল ঐদিন বিকেল বেলাই । মামাকে পারিবারিক কবস্থানেই সমাহিস্থ করা হয়েছিল। আমি বিকেলবেলা সেখানে গিয়ে হাজির হলাম । তারপর কবরের সামনে গিয়ে হাজির হতেই অনুভব করলাম যে আমি মামার অস্তিত্বটা অনুভব করতে পারছি। কী যেন মনে হল আমি একটু মনেযোগ দিয়ে তাকে ডাক দিলাম । এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সে এসে হাজির হল । তার কবরের উপরেই তাকে বসে থাকতে দেখলাম।
এরপর আমার কাছে আরো ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে উঠল । আমি যে কোন মৃত মানুষের সাথেই কথা বলতে পারি সেটাও আমার কাছে পরিস্কার হয়ে উঠল ।
-চল ।
আমি চোখ তুলে দেখি মেহরাব ঘরের ভেতরে ঢুকেছে । আমি নিজের চিন্তায় বিভোর ছিলাম বলে ওকে খেয়াল করিনি।
-কোথায়?
মেহবার নিজের ড্রায়ার খুলে কিছু যেন খুজতে শুরু করল। কয়েকটা ড্রয়ার তারপর ফাইল পত্র ঘেটে দেখল। মুখের ভাবটা দেখে বুঝতে পারলাম যে জিনিসটা সে খুজে পায় নি। তারপর সেটার আশা বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকাল ।
-চল, যাওয়া যাক।
-আমাকে ডেকে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?
-উপর থেকে ডাক এসেছিল । যেতেই হল । চল আগে স্পটে যাওয়া যাক ।
আমি মেহরাবের সাথে থানা থেকে বের হয়ে এলাম । মেহরাবের বাইকটা থানার সামনেই দাড় করানো । দেখলাম সেখানে চাবি দেওয়া রয়েছে । ঢাকার রাস্তায় এভাবে চাবি দেওয়া বাইক রাখার সাহস কারো হবে বলে মনে হয় না । অবশ্য পুলিশের বাইক চুরি করবে এমন সাহস কারো নেই। প্রতিটা এলাকায় প্রতিটা চোখের খবর পুলিশ জানে ।
আমি মেহরাবের বাইকে চেপে বসলাম । মেহবার বাইক চালানোর সময় হেলমেট পরে না । পুলিশ হয়ে নিজেই নিয়ম মানে না । অবশ্য এর জন্য ওকে কোন জরিমানা গুনতে হয় না । আমাকেও তাই হেলমেট পরতে হল না ।
যাওয়ার পথেই মেহরাব জানাল বসিলা ব্রিজের পাশের এক বাসায় এক মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। সুইসাইড কেস । মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । পুলিশ গিয়েই দরজা খুলেছে। বাসায় সেই সময় কেউ ছিল না। তার স্বামী অফিসের কাজে গাজীপুর ছিল । পুলিশ ফোন পেয়ে সে দ্রুত বাসায় ফিরে আসে ।
-লাশ কে দেখেছে?
-লাশের পাশের বাসায় এক মেয়ে দেখেছে। তার ঘরের বারান্দা আর মেয়েটা যে ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছে সেই ঘরটা পাশা পাশি । সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে হাজির হয় সে। তখনই খোলা জানালা দিয়ে দেখতে পায় সে সিলিংয়ের সাথে মেয়েটা ঝুলে আছে। সেই চিৎকার দিয়ে মানুষ জড় করে তারপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
আমি একটু কল্পনা করার চেষ্টা করলাম । সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম আর সেখানেই দেখতে পেলাম পাশের বাসার ঘরে একটা মানুষ ঝুলে আছে।
-তা এটা তোর কাছে সুইসাইড কেন মনে হচ্ছে না ? আমাকে কেন দরকার পড়ল?
-জানি না । হয়তো সুইসাইডই। আর যদি মার্ডার হয় তবেও সেটা তদন্ত করলেই বের হয়ে যাবে। তবে যখন আমাদের হাতে উপায় রয়েছে তখন আগে থেকে ব্যাপারটা জানলে তো সমস্যা নেই। তাই না?
-তুই দেখি দিন দিন কুড়ে হয়ে যাচ্ছিস । আমিই যদি তোর কাজ করে দিব শ্লা তুই ক্যান বেতন নিবি ?
-ইস । প্রমান কে বের করে শুনি? তোর কথা কোর্টে খাটবে? বরং তোর কথা শুনলেই মাথার ভেতরে একটা প্রেসার থাকে। তন্ময় মার্ডার কেসের কথা মনে নেই?
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। কারণ কথাটা ও ভুল বলে নি । ঝামেলা যে বেশি হয় মাঝে মাঝে সেই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বছর দুয়েক আগের কথা । তখনও মেহরাবের প্রোমোশন হয় নি। তন্ময় মার্ডার কেসে প্রমান পত্র সব ইঙ্গিত করছিল খুনটা করেছে তন্ময়ের কাছের বন্ধু সফিক। একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল সে। এমন কি পুলিশের রিমার্ন্ডে সফিক সেটা স্বীকার করেও নিয়েছে। কিন্তু মেহবারের কি যেন ঠিক মনে হচ্ছিল না। সে আমাকে মর্গে নিয়ে গেল । সেখান থেকে তন্ময় আমাকে জানাল যে খুন করেছে তার প্রেমিকা রিমি। মেহরাবের সে রিমিকে খুনী প্রমান করতে জান বের হয়ে গিয়েছিল । ও তখন পুরো ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়ে রিমির পেছনে লেগেছিল । একবার তো আমার নিজের কাছে মনে হল যে আমি হয়তো ভুল করেছি। হয়তো মৃত্যুর পরেও মানুষ মিথ্যা বলতে পারে । আমার নিজের কাছেই মনে হচ্ছিল যে হয়তো আমারই ভুল হয়েছে । তবে শেষ পর্যন্ত মেহরাব প্রমান যোগার করতে পেরেছিল । অন্য কেউ যদি হত তাহলে এতো ঝামেলায় কেউ যেতই না।
আমরা বাড়িটার সামনে এসে থামলাম । বাড়ির মুখেই বেশ কিছু মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে । একটা পুলিশের গাড়িও দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই বাসার চার তলাতে মেয়েটার লাশ পড়ে রয়েছে। আমরা ভীড় ঠেলে উপড়ে গিয়ে হাজির হলাম। মেহরাব জানালো এখনও ফরেনসিক টিম আসে নি। এমন কি ফটোগ্রাফারও আসে নি। সাধারণ সুইসাইট কেস নিয়ে কারো খুব একটা তাড়াহুড়া নেই। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকেছে । তারপর থেকে আর কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয় নি । এই কারণে সব কিছু আগের মতই রয়েছে। আগের বেশির স্পটে আমি যখন গিয়েছিই তখন দেখেছি যে পুরো জায়গায় মানুষ জিগগিজ করে । এখানে আত্মিয় স্বজনেরা এখনও এসে পৌছায় নি। তা এখনও সব কিছু বহাল তবিয়াতে আছে।
লাশের ঘরে ঢুকে আমি একটু অবাক হলাম । প্রতিবারই আমি দেখি যে লাশের পাশেই মানুষের আত্মা বা রহু বা এস্ট্রোফর্মটা উদাস হয়ে বসে থাকে ।কিন্তু এই লাশের পাশে সেটাকে কোথাও আমি দেখতে পেলাম না।আ মেয়েটার লাশ একটা বিছানার চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
আমার চেহারার ভাগ দেখে মেহরাবও খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম । তারপরেই আমার চোখ গেল রান্না ঘরের দিকে । সেখানে একজন চুলাতে কিছু চড়িয়েছে মনে হল ।
এদিকে মানুষ মারা গেছে আর বুয়া রান্না বসিয়েছে?
তখনই মনে হল, না ওটা বুয়া হতে পারে না। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে । রান্না ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা আমার দিকে ফিরে তাকাল । একটু চমকে উঠল । আমাকে সে এখানে আশা করে নি । কিংবা আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছে ।
-আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে পাচ্ছি? আর আপনিই বা আমাকে কিভাবে দেখতে পাচ্ছেন?
বুঝতে পারলাম যে মেয়েটা এরই ভেতরে বুজতে পেরেছে যে সে মারা গেছে। এই ব্যাপারটা অনেকেই মানতে পারে না শুরুতে । মেয়েটাকে কিছু রান্না করার চেষ্টা করতে দেখলাম। আমি বললাম, আপনি কী রান্না করছেন?
মেয়েতি উত্তর দিল না। নিজের কাজ চালিয়ে গেল। আমার মামা বলেছিল যে সে যেখানে আছে সেটা এই পৃথিবী থেকে একদম আলাদা । কেমন অন্ধকার আবছায়া অবস্থা। ঘর বিল্ডিং গুলো একই রকম তবে দেখলে মনে হবে যেন অন্য কোন জগতে চলে এসেছে। মেয়েটাও সম্ভবত সে অন্য জগতের রান্না ঘরে ঢুকে কিছু রান্না করার চেষ্টা করছে যা আমি দেখতে পাচ্ছি না।
-আপনি সুইসাইড কেন করলেন?
মেয়েটা ঘুরে তাকাল। তার চোখে আমি কেবল একটা নিভু নিভু দৃষ্টি দেখতে পেলাম । মেয়েটা শান্ত চোখে বলল, আমার স্বামী আমাকে খুন করেছে। আমি সুইসাইড করি নি।
-কী কারণ সে আপনাকে খুন করল ?
-কারণ আমি ওকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম । ওর উপর থেকে অনেক থেকে আমার মন উঠে গিয়েছিল। আমি ওকে বারবার ডিভোর্সের কথা বলছিলাম। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই ঠিক করেছিলাম যে পালিয়ে যাব। ওর চলে যাওয়ার পরপরই আমাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ।
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলাম ।
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার চেহারার দিকে তাকিয়েই সে বুঝে ফেলল যে সে আমাকে এখানে আনার সিদ্ধান্তটা মোটেই ভুল ছিল না ।
-হাসব্যান্ড?
-হ্যা ।
-গুড । চল বেটাকে ধরা যাবে । এবার চল এখান থেকে।
-আবার কোথায়? এখানকার কাজ তো শেষ । আমার তো দরজার নেই ।
মেহবার বলল, না কাজ এখনও শেষ হয় নি । আমাদের আরও কিছ কাজ হয়েছে।
আমি মেহরাবের কথা কোন অর্থই খুজে পেলাম না। মেহরাবের সাথে আমার আর কী কাজ হতে পারে? মেহরাব আমার বন্ধু মানুষ। আমি যে অল্প কয়জন মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাত করি তাদের ভেতরে মেহরাব একজন। মেহরাবের কাজ ছাড়াও আমরা মাঝে মধ্য এখানে সেখানে বসে আড্ডা মারি । তবে এটা কেবলই আমাদের দুজনের সময় থাকলেই। সেটা সাধারণত সন্ধ্যা বা রাতের দিকেই হয়ে থাকে । দিনের বেলা বিশেষ করে এই সকাল বেলা আমাদের যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই আমি সাধারনত ওর কোন কেস নিয়ে সাহায্য করেছি। তারপর সোজা আবার নিজের বাসার দিকে হাটা দিয়েছি। আজকে আবার মেহরাব আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
আমি বললাম, আরেকটা কেস নাকি?
-না । ব্যাপারটা সিরিয়াস ।
আমি মেহরাবের মুখটা বেশ গম্ভীর দেখলাম । ওর মুখের ভাব দেখেই আমার মনে হুল যে কিছু একটা সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে। মেহরাব এতো সিরিয়াস তো হয় না সাধারণত ।
-কী বিষয় বল দেখি।
-তোর উপর সরকারের উপর মহল থেকে নজরদারি শুরু হচ্ছে ।
আমি ঠিক যেন বুঝতে পারলাম না মেহরাব কী বলল। আমার উপর সরকারের উপর মহল থেকে নজরদারি শুরু হচ্ছে ! মানে কি এই কথাটার !
বড় গল্প লেখা চলছে । দেখা যাক কতদুরে গিয়ে শেষ হয় ।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
সরাসরি মেসেজ পাঠাতে চিঠি.মি এপ ব্যবহার করুন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.