নীরা মায়ের করা প্রশ্নটার না শোনার ভাব করে নাস্তার দিকে মনযোগ দিল। সকালবেলা সে চুপচাপ হয়েই নাস্তা খায় । তারপর অফিসের জন্য বের হয়ে যায়। আজকেও তার একই পরিকল্পনা । এখন মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে দিনটা বকাবকি নিয়ে দিয়ে শুরু হবে যা নীরা চায় না।
নীরার মা আবারও প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিল কিন্তু নীরার বাবার ইশারায় চুপ করে গেল। নীরার বাবা বলল, আজকে অফিস থেকে ফিরবি কখন?
-ঠিক নেই বাবা । কেন কোন দরকার ছিল?
-না এমনি।
নীরার বাবা আর কিছু জানতে চাইল না । নীরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল । সে দ্রুত নাস্তা শেষ করেই বাসা থেকে বের হয়ে এল । আগে রিক্সা কিংবা সিএনজি নিয়ে অফিসে যেত । একটু দূর হলেও নীরা রিক্সাতে চলাচল করতে পছন্দ কর । তবে মেট্রো হওয়ার পর থেকে এখন নিয়মিত মেট্রোতে করে যাতায়াত করে । এখন অফিসে যেতে ওর খুব বেশি সময় লাগে না । তবে মাঝে মাঝে এখনও সে রিক্সাতে করেই যায়। সুমনের বাসাটা ঠিক ওর অফিস আর বাসার মাঝে ছিল । রিক্সাতে করে যাওয়ার দিন প্রায় দিনই সুমন ওর সাথে রিক্সায় উঠে আসত । সুমনের অফিসটাও ছিল ওর অফিস পাড়াতেই । এক সাথে যাওয়ার সময়টুকু নীরার খুব পছন্দের ছিল ।
আজকে মেট্রো স্টেশনে না গিয়ে রিক্সা নিয়ে সরাসরি অফিসের পথ ধরল । এখনও শীত পড়ে নি তবে আসি আসি করছে । রোদ উঠে গেলেও সকালের ঠান্ডা বাতাসটা এখনও পুরোপুরি চলে যায় নি । নীরা সেই ঠান্ডা আমেজটা উপভোগ করতে লাগল ।
রিক্সাটা যখন সুমনদের বাসায় সামনের রাস্তায় এল তখন কী মনে হল রিক্সাওয়ালাকে থামতে বলল। তারপর রিক্সা ভাড়া মিটিতে সে সুমনদের বাসার দিকে হাটা দিল । সুমনের অপারেশনের পরে নীরা এই বাসাতেই থাকত । এখন থেকেই অফিসে যাওয়া আসা করত । এটা নিয়ে ওর মায়ের সাথে কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। এক পর্যায়ে নীরা মাকে হুমকি দিয়েছিল যে যদি এটা নিয়ে আবার কথা তোলে তাহলে সে আর কোন দিন বাড়িতেই আসবে না । তারপর নীরার মা আর কিছু বলত না ।
আজকে প্রায় মাস ছয়েক হল সুমন মারা গেছে । তারপর থেকে এই বাসায় আর আসা হয় নি। আজকে এই অফিস যাওয়ার সময়ে কেন আসল সেটা নীরা জানে না । কলিংবেল বাজানোর পরেই দরজা খুলে গেল । সুমনের বোন সুমি দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে একটু অবাক হল । খুশিও হল খুব !
-নীরাপু, তুমি !
-তোকে না ভাবী ডাকতে বলেছি।
-ইস আসছে ভাবী আমার । তা ভাবী হলে এতো দিন পরে আসছো কেন শুনি?
নীরা একটু হাসল । তারপর সুমিকে জড়িয়ে ধরল ।
-আম্মু কোথায়?
-মা রান্না ঘরে । চল ।
রান্না ঘরে সুমনের মা নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন । নীরাকে দেখে খুশিই হলেন। নীরা এই বাসায় না আসলেও সুমনের মায়ের সাথে নিয়মিত কথা হয় ফোনে।
আজকে আর নীরা অফিস গেল না । দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া করল এক সাথে । তারপর সুমন যে ঘরটায় থাকতে সেখানে গিয়েই শুয়ে পড়ল । এতোদিন পরেও সুমনকে হারানোর একটা কষ্ট তার ভেতরে ঠিক রয়ে গেছে ।
সুমনের সাথে নীরার পরিচয়টা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ে। প্রেম হতে সময় লাগে নি । সব কিছু এতো চমৎকার ভাবে চলছিল যে বলে বোঝানো যাবে না । কিন্তু তখনই ওদের জীবনে কালো ছায়া নেমে এল । তখন ওরা দুজনের বিয়ের প্লানিং করছিল । সেই সময়ে সুমনের ক্যান্সার ধরা পরল । নীরার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না । নীরার এখনও বিশ্বাস হয় না । মনে হয় যেন সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে । একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে যে সব কিছু আগের মতই আছে।
যখন সুমনের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেল, কেমো দিয়েও কাজ হচ্ছিল না তখন সুমন আর ঝামেলায় যেতে চাইল না । সে জানাল যে বাকি দিন গুলো একটু শান্তিতে থাকতে চায় । নীরা সেই পুরোটা সময় সুমনের সাথেই ছিল ।
বিকেল বেলা যাওয়ার সময় হলে সুমনের মা নীরাকে নিয়ে বাসার ঝুল বারান্দায় গিয়ে বসলেন । শেষ সময়টাতে সুমন এখানে বসে থাকত । নীরাও ওর সঙ্গ দিত নিয়মিত । নীরা বুঝতে পারছিল যে আজকে সুমনের মাও তাকে একই কথা বলবে। তার নিজের মায়ের সাথে সুমনের মায়ের কথা হয় সেটা নীরা জানে ।
-এভাবে আর কত দিন?
-আম্মু আপনিও এই কথা শুরু করলেন?
-আরে বোকা মেয়ে, আমরা তো চেয়েছিলাম তুমি আমাদের এখানেই থাকো আজীবন। কিন্তু উপরওয়ালার লিখন কে খন্ডাবে । দেখ সবাই আমরা আমাদের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এটাই নিয়ম । তুমি এখনও আটকে আছো । শোক কর, সেটা ঠিক আছে কিন্তু তার জন্য এভাবে এক স্থানে আটকে থাকার কোন মানে নেই।
নীরা কী বলবে বুঝতে পারল না।
-ঐ ছেলেটার কথা মনে আছে?
-কে?
-ঐ যে তোমার অফিসে চাকরি করে।
-ফয়সাল?
নীরার চট করেই ফয়সালের কথা মনে হল । নীরা যখন প্রথম অফিসে জয়েন করে তখন ফয়সালের সাথে ওর পরিচয়। ওর অফিসেই কাজ চাকরি করত । কয়েকমাসের ভেতরে নীরা বুঝতে পারে যে এই ছেলেটা ওর প্রেমে পড়েছে । প্রথমে একটু বিরক্তই হয়েছিল। কিন্তু ফয়সাল ছেলে হিসাবে চমৎকার । তাই বিরক্ত না হয়ে তাকে বুঝিয়ে বলার সিদ্ধান্ত নিল সে । তখন সুমনের অবস্থা একটু ভাল । থাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছে সে। একদিন ফয়সালকে নিয়ে সে সুমনদের বাসায় এসে হাজির হল । তাকে ওর ভালবাসার কথা জানাল । ফয়সাল সেদিন ঠিকই বুঝেছিল ।
সেদিন ফয়সালের সাথে কিছু সময়ও কাটিয়েছিল সে । ঠিক তার এক সপ্তাহ পরে ফয়সাল চাকরি ছেড়ে দিল । যাওয়ার আগে নীরাকে ছোট একটা চিঠি লিখেছিল সে ।
নীরা, ভালোবাসা বড় অদ্ভুত। একবার কাউকে ভালোবাসলে তার উপর থেকে মন সরানো বড় কঠিন, ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভব । সেইদন সুমন সাহেবের সাথে কথা বলার পরে আপনার প্রতি আমার ভালবাসা তো কমেই নি বরং আরও বেড়েছে । আমার কেবল মনে হচ্ছে যে সুমন সাহেবকে আপনি যেভাবে ভালবাসেন, ইস আমাকেও যদি এমন ভাবে বাসতেন ! সুমন সাহেব কতই ভাগ্যবান ! কিন্তু একই সাথে আমি আপনার দিকটাও বুঝতে পারছি বেশ ভালভাবেই। তাই আপনাকে রেখেই চলে যাচ্ছি। কারণ চোখের সামনে আপনাকে আমি যতই দেখব ততই আপনার প্রতি আমার আকর্ষন বাড়বে।
তবে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব । যদি দরকার হয় একদম শেষ দিন পর্যন্ত । আমি নিচে একটা ঠিকানা রেখে যাচ্ছি। এটা আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা । আমি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সেখানেই চলে যাচ্ছি। এখন থেকে সেখানেই থাকব । আমি সুমন সাহেবের দীর্ঘায়ু কামনা করি । বিশ্বাস করুন করি। কিন্তু তারপরেও উনার চলে যাওয়ার পরে আপনার কোন দিন যদি মনে হয় যে আপনি আপনার ভালবাসার যৎসামান্য আমাকে দিতে পারবেন, তখন আমার কাছে আসবেন । যদি না দিতে চান তবুও ঠিক আছে । আমি এই আশা নিয়ে থাকব যে আমার ভাগ্যেও সুমন সাহেবের মত ভালবাসা জুটবে ।
সেদিন চিঠিটা পরে নীরার কী মনে হয়েছিল সেটা নীরা জানে না । চিঠিটা সুমন নিজেও পড়েছিল । ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল যে এবার সে খানিকটা নিশ্চিন্ত । আজকে আবার সুমনের মাও ফয়সালের কথাটা বলল।
সুমনের মা বললেন, একবার চেষ্টা করেই দেখো না কেন ! এভাবে জীবন চলবে না ।
-জানি না আম্মু । আমি সত্যিই কিছু জানি না ।
-সুমন আমাকে বলে গিয়েছিল যেন আমি তোমাকে রাজি করাই । বলেছিল যে কিছু সময় দিয়ে তারপর । আমার মনে হয় সুমনের শোক থেকে তোমার এবার নতুন পথে যাওয়া উচিৎ । এটা সুমনেরই ইচ্ছে ছিল । ওর শেষ ইচ্ছে বলতে পার ।
নীরা যখন স্টেশনে নামল তখন প্রায় বিকেল । ঢাকা থেকে সখীপুর স্টেশনে আসতে প্রায় চার ঘন্টা লাগল । দুপুরের আগে ট্রেন ছেড়েছিল । এখন বিকেল । রিক্সাকে ঠিকানা বলতেই চিনতে পারল । যখন একেবারে বাড়িটার সামনে এসে থামল তখনও নীরার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যে নীরা ফয়সালের দেওয়া সেই ঠিকানা মোতাবেগ চলে এসেছে। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে রইল কিছু টা সময় ।
বাড়ির ঠিক সামনে কয়েকটা ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে । কয়েকটা মা ছাগলের সাথে বাচ্চা ছাগল রয়েছে । নীরার কী মনে হল ব্যাগটা এক পাশে রেখে সে ছোট একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল । সাথে সাথে ম্যা ম্যা করে ডেকে উঠল বাচ্চাটা। কোল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করল তবে নীরা ছাড়ল না । আদর করতে থাকল । দেখল আদর পেয়ে সেটা চুপ করে গেল । ভালবাসা টের পেয়ে সবাই কি এমন হয়ে যায় ! নীরা কি সেদিন ফয়সালের ভালবাসা টের পেয়েছিল?
নীরা সত্যিই জানে না । তবে জীবন আসলেই এক জায়গা থেমে থাকার জন্য নয় । কারো জন্যই থেমে সে থাকে না । নীরা দেখতে পেল বাড়ির ভেতরের লোকজন তার উপস্থিতি টের পেয়েছে । একজন বুড়োমত লোক এগিয়ে আসছে তার দিকে ।
নীরাকে কিছু অবশ্য বলতে হল না । বুড়োলোকটা তাকে পথ দেখি বাড়ির ভেতরে নিয়ে এল । সেই জানাল যে ছোট সাহেব মাঠে গেছেন । এখনই ফিরে আসবেন।
হয়তো আরেকটা পর্ব আসবে
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.