জগিং শব্দটা আসলে শব্দটা বিত্তবানদের বেলাতে খাটে ভাল । আমার কাছে সেটা হচ্ছে সকাল/বিকালের হাটাহাটি । এখন শিরোনামে তো আর হাটাহাটি প্রেম লেখা যায় না । তাই লিখলাম জগিং । ঘটনার সুত্রপাত গত বছর লকডাউনের সময় । সকাল কিংবা বিকাল, হাটাহাটি আমার কোন কালেই পছন্দ ছিল না । কিন্তু বাধ্য হয়ে এই কাজ শুরু করতে হয়েছে । গত বছর যখন লক ডাউন দিল তখন থেকে শারীরিক পরিশ্রম একেবারে বাদ হয়ে গেল । সারা দিন বাসার ভেতরে থাকতে হত, বাইরে বের হওয়ার উপায় ছিল না । কাজের ভেতরে ছিল সারাদিন খাওয়া ঘুমানো আর বই পড়া । ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কারণে বিছানাতে বসেই ল্যাপটপ দিয়েই কাজ হয়ে যেত । ঘর থেকে বের হওয়া লাগতো না একদম । এমনিতে তো সুখেই ছিলাম কিন্তু কয়েক মাস পার হওয়ার পরে একদিন খেয়াল হল যে পেট টা কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে গেছে । আমি কেবল আশ্চর্যজনক চোখ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম । হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে শুরু করলাম । তারপর বুঝতে পারলাম যে ঘটনা সত্য । আমার খানিকটা ভুড়ি দেখা দিয়েছে । বুঝলাম যে এই কয়মাস কেবল খাওয়া আর ঘুমানোর কারণে এই জিনিসের উদয় হয়েছে ।
যারা স্বাস্থ্যবান মানুষ, তাদের একটু আধটু ভুড়ি কোন ব্যাপার না । বরং সেটা ভালই লাগে । কিন্তু আমার মত চিকন মানুষের জন্য ভুড়ি ব্যাপারটা বড় জঘন্য । যে কোন ভাবেই এই জিনিস কমাতে হবেই । সেই জন্য শারীরিক পরিশ্রম করা শুরু । সকালে তো ঘুমের কারণে যাওয়া হয় না । বিকেলে হাটাহাটি শুরু করলাম । প্রতিদিন বাসা থেকে সন্ধ্যার আগ দিয়ে বের হই । হেটে হেসে ধানমণ্ডি ৩২ এর পাশের যে ছোট পার্কটা আছে সেখানে যাই । কয়েক চক্কর মারি । তারপর আবার একই ভাবে ফিরে আসি । এভাবে প্রতিদিন হাটাহাটি চলতে লাগলো । একটা সময়ে আমি আবিস্কার কারলাম যে এই প্রতিদিন পার্কে হাটতে আসি, আমার কয়েকজন চেনা মুখ হয়ে গেছে যারা নিয়মিত এই পার্কে আসে একই সময়ে ।
প্রথমে কথা বলি এক জনের । লোকটা আমার থেকে বয়সে ৭/৮ বছরের বড় হবে । শরীর স্বাস্থ বেশ ভাল । মাথায় চুলের পরিমান খবই কম । একেবারে টাকই বলা চলে । প্রতিদিন সে হাফ প্যান্ট পরে আসে । সাথে পরে হাটাকাটা বড় গলা সেন্ডো টিশার্ট । হাতে তার মোবাইল থাকে । কানে থাকে হেড ফোন । প্রতিদিন আমি যখন হাটি আমাদের প্রতিবার মুখোমুখি দেখা হয় । আমি নিশ্চিত আমাকেও সে খেয়াল করেছে ।
এরপর একজন বৃদ্ধ মানুষের কথা বলি । বয়স অনেক হবে । মাথা ভর্তি সাদা চুল । দাড়িও সাদা । প্রায় প্রতিদিন আসেন তিনি । তবে তার পায়ে সম্ভবত কোন একটা সমস্যা আছে । একটু খুড়িয়ে খড়িয়ে হাটেন । তবে হাটা বন্ধ করেন না । আমি যেখানে দুই চক্কর মারি সেখানে তার এক চক্কর মারা হয় । তারপরেও তিনি থামেন না । হাটতে থাকেন ।
আরেক ভদ্রলোককে আসতে দেখি নিয়মিত । তবে তিনি আসেন আমার যাওয়ার সময় হল । অনেক লম্বা । অন্তত ছয়ফুট এক দুই তো হবেনই। মাথা ভর্তি কালো চুল । মুখে দাড়ি ভর্তি । তবে এই চুল আর দাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে এগুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । ফুটবল প্লেয়ার মার্সেলোকে চিনেন না? তার চুল যেমন খাড়া খাড়া ছড়ানো এই ভদ্রলোকের চুলও তাই । একেবারে ছড়িয়ে রয়েছে । দুর থেকে দেখলেই তাকে চেনা যায় । ইনি হাটেন বেশ দ্রুত । শরীরে বাড়তি মেদ নেই । মাঝে মাঝে তার সাথে এক পিচ্চি মেয়ে আসে । সম্ভবত তার নিজের মেয়ে হবে ।
এক বৃদ্ধ দম্পতি আসেন । তারা গুটুর করে গল্প করেন আর হাটেন । মাঝে মাঝে একে অন্যের হাত ধরে হাটেন । মাঝে মাঝে বসে বসে বিশ্রাম নেন । আবার হাটেন ।
এরপর আসে এক মেয়ে । মেয়েটা আমার থেকে ছোট হবে । একটু হেভি শরীরের গঠন । মেয়েটা খুব সিরিয়াসলি হাটে । নিজের ওজন কমাতে খুব চেষ্টা করে দেখেই বোঝা যায় । আমাকে যতবার ক্রস করে ততবারই দেখি বেচারির জোড়ে জোড়ে দম নিচ্ছে । হাটতে তার একটু কষ্ট হচ্ছে তবুও তার ওজন কমানো চাই ই চাই ।
একদল ছেলে আছে প্রায়ই । তবে তারা নিয়মিত না । এদের বয়স কম । এরা হাটে না । এরা দৌড়ায় । পুরো পার্ক এরা দৌড়ে কাটায় ।
দুইজন কলিগ আসে হাটতে । কলিগ বললাম কারণ এরা একে অন্যকে আপনি বলে সম্মোধন করে সব সময় । যতবার এদেরকে ক্রস করে গেছি ততবার এরা অফিসের গল্পই করে । দুইজন হাটে আর গল্প করে । সেই ধারণা থেকে বললাম ।
রোজার আগে আরও কয়েকজন কে নিয়মিত আসতে দেখতাম । তবে রোজার পরে তাদের আর দেখি না । এক ইয়াং দম্পত্তিকে ইদানীং আসতে দেখছি । স্বামীর বয়সটা আমার থেকে একটু বড় হবে তবে স্ত্রীর বয়স আমার মত । এরা পাশাপাশি হাটে বটে তবে এরা খুব একটা কথা বলে না একে অন্যের সাথে ।
আরেকজন আসে পার্কে । লোকটা মাঝ বয়সী । বেশ লম্বা। তবে তার সাথে আসা মেয়েটার বয়স কম । বলা যায় লোকটার বয়সের অর্ধেক । লোকটা সম্ভত কোন সরকারী বড় অফিসার । অফিসার না হলেও তার যে অনেক টাকা সেটা তার আচরন দেখে বোঝা যায় । এরা স্বামী স্ত্রী হতে পারে আবার নাও পারে । এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না । মেয়েটার বয়স আরেকটু বেশি হলে হয়তো অনুমান করা সম্ভব হত । এই দুজনের সাথে একজন কাজের লোক থাকে । সে এদের পেছন পেছন হাটে ।
এবার আসি আমার ক্রাশ কন্যার কথায় । মেয়েটাও প্রায় নিয়মিত আসে । প্রথম যেদিন মেয়েটাকে দেখেছিলাম সেদিন মেয়েটা একটা নীল আকাশি রংয়ের টিশার্ট পরে ছিল আর সাথে কালো প্যান্ট । চুল গুলো ছিল পনি টেইল করে শক্ত ভাবে বাঁধা। কানে ইয়া বড় একটা হেড ফোন ছিল । মোবাইলটা হাতে নিয়ে হাটছিল । যতবার আমি চক্কর মারতি একে অন্যকে ক্রস করে যাচ্ছি । মেয়েটার সাথে প্রতিবার দেকখা হচ্ছে, চোখাচোখি হচ্ছে । এরপর প্রতিদিন মেয়েটার সাথে দেখা হচ্ছে । মেয়েটার গোলগাল চেহারা । মুখে একটা স্নিগ্ধ ভাব রয়েছে । মেয়েটা যেদিন হাটতে আসে সেদিন আমার হাটার আগ্রহ অনেক গুনে বেড়ে যায় কিন্তু যেদিন আসে না সেদিন কেন জানি আর হাটতে ইচ্ছে করে না । এই যেমন মেয়েটার সাথে যতবার চোখচোখি হয় মনে হয় আরও একটা চক্কর বেশি মারবো আজকে । এভাবে একদিন হাটতে গিয়ে আমি ৫টা চক্কর মেয়ে ফেলেছিলাম পার্কের । যেখানে গতদিন মেয়েটা আসে নি । দুই চক্কর মেরে বাসায় ফিরে এসেছি । এই জন্য জনৈক ভদ্রলোক বলেছে, একজন মেয়ে নিয়মিত জগিং করলে অন্তত ১০ জন ছেলের স্বাস্থ্য ভাল করতে পারে । এখানে ১০ জন না হোক একজনের কথা তো নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ।
পার্কে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে । আমি হাটতে থাকি আর তাদের কে দেখি । মাঝে মাঝে তাদের কথা বার্তা কানে আসে । তবে সব চেয়ে যেটা চোখে সেটা হচ্ছে সবাইকে কেমন যেন সুখী মনে হয় । কেউ পার্কে আসছে বন্ধুকে নিয়ে, কেউ বা ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে, কেউ বউকে আর কেউ পরিবারকে নিয়ে । কেউ বসে বসে গল্প করছে কেউবা হাটতে হাটতে গল্প করছে । পার্কে প্রতিদিন দুইদল আসে প্রতিদিন গিটার নিয়ে । তারা গান করে । তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই গান শোনা হয় । গত পরশু দিন একটা ভাল দল এসেছিলো । ওরা জলের গান করছিলো । এতো চমৎকার ওদের গলা । আমি হাটা থামিয়ে কিছু সময়ে শুনলাম । মন ভাল হয়ে গেল ।
পার্কে বেশ কয়েকটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটা আছে । এখানে নিয়মিত খেলা হয় । এই গরমের ভেতরেও যে এটা ব্যাডমিন্টন খেলে এটা দেখে আমি অবাকই হই । আরেকদল আসে যারা খেলে ক্রিকেট । শর্ট পিচে প্রতিদিনই এদের খেলতে দেখি । মাঝে মধ্যে বল চলে আসে আমাদের কাছে । আমি সেটা তুলে তাদের দিকে ছুড়ে দেই ।
বিয়ের সিজনে আরেকটা ব্যাপার হত । শীত কালে দেখলাম প্রায়ই জামাই বউ সেজে গুজে পার্কে এসে হাজির হচ্ছে । সাথে থাকতো তাদের ফটোগ্রাফার । এরপর পার্কের স্থানে বিভিন্ন পোজে তারা ছবি তুলতো ।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা এখন এদের নিয়েই কাটে । এই মানুষ গুলোর আমার সব যেন পরিচিত । প্রতিদিন তাদের সাথে দেখা হয় । আমি যেমন এদের দেখি । এরাও আমাকে দেখে । যদিও আমরা একে অন্যকে চিনি না, জানি না কোথায় থাকি তারপরেও যেন আমরা একে অন্যকে চিনি । দিনের একটা সময়ে আমরা এক সাথে হই । এক জায়গাতে হাটাহাটি করে । একদিন দেখা যাবে আমার ক্রাশ কন্যার সাথে আমার কথা হচ্ছে । সে আমাকে ডেকে বলছেন শুনুন আপনি প্রতিদিন আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না । নয়তো পুলিশে ধরিয়ে দেব বললাম ।