ভালোবাসার শুরু এখান থেকেই….

oputanvir
4.8
(107)

নাজিয়া কিছুতেই ব্যাপারটা নিজের মন থেকে বের করে দিতে পারছে না । বারবার চোখের সামনে অপুর চোখ দুটো দেখতেপাচ্ছে যেন । ওর নিজের ভেতরেই সব কিছু কেমন যে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে । এমন কেন হচ্ছে? কেন সে নিজের কাজে মন দিতে পারছে না ? হাতের মগটা ছুড়ে মারলো সামনে । মেঝেতে পড়ে সেটা ছড়িয়ে গেল । শব্দ শুনে হাসান ছুটে এল ঘরে । নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে ম্যাম ? ঠিক আছেন?
নাজিয়া নিজের পিএর দিকে তাকালো না । একভাবে নিজের পিসি মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইলো । এখন কারো দিকে সে তাকাতে চাচ্ছে না । কারো দিকে তাকাতে তার ইচ্ছে করছে না ।
হাসান বলল, ম্যাম স্যারকে কি ডাক দিবো?

কথা শুনে নাজিয়ার মেজাজটা হঠাৎ চড়া হয়ে গেল । সে হাসানের দিকে দিকে না তাকিয়েই বলল, কেন? তাকে কেন ডাক দিতে হবে? তোমাকে বলেছি তাকে ডাকতে? চোখের সামনে থেকে দুর হয়ে যাও ।

হাসান আর কিছু বলার সাহস পেল না । দরজা দিয়ে আবারো বের হয়ে গেল । দরজা টা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনে সামনের দিকে ফিরে তাকালো । নিজের আচরনে নিজেই খানিকটা অবাক হচ্ছে ! এমন কেন আচরন করছে সে ! এতো অস্থির কেন হচ্ছে সে ? কেন?
অপু ওর সাথে একদম খারাপ ব্যবহার করে নি । বরং স্বাভাবিক আচরন করেছে । প্রতিদিন ওর সাথে যেমন নরম আর মিষ্টি ব্যবহার করে ঠিক তেমন ! অথচ ওর রাগ করার কথা ছিল ? ছেলেটা কেন রাগ করে না ওর উপরে ? কেন এই ভাবে ভালোবাসে?
ভালোবাসে?

নাজিয়া নিজে মানতে না চাইলেও জানে না কথাটা সত্য । অপু তাকে ভালোবাসে !
বিয়ের শুরুতে নাজিয়া অপুকে অপছন্দ করে এসেছে কেবল মাত্র বিয়েটা ওর নিজের পছন্দে হয় নি বলে । কোন দিন অপুকে বোঝার চেষ্টা করে নি । এমন কি স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করে নি । কিন্তু অপু ঠিকই তার স্বামী হওয়ার সব কাজ সামলেছে ।

অপুর সাথে বিয়েটা হয়েছে নাজিয়ার বাবার ইচ্ছেতে । নাজিয়া যতই এক জেদী হোক না কেন বাবার সামনে সে খানিকটা অসহায়বোধ করে সব সময় । নাজিয়ার বাবা খালেকুর রহমান নিজেকের মেয়েকে খুব ভাল করেই চেনেন । নাজিয়াকে কিভাবে লাইনে আনতে হয় সেটা তার ভাল করেই জানা ছিল । অপু প্রথমে ওদের কোম্পানীরই একজন এম্প্লোয়ী ছিল । কিভাবে যেন খালেজুর রহমান অপুকে খুব বেশি পছন্দ করা শুরু করলেন । পছন্দটা এতো তীব্র হল যে এক সময়ে নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপার সব কিছু ঠিক করে ফেললেন ।

নাজিয়া প্রথমে কিছুতেই রাজি ছিল না । কিন্তু এক সময়ে বাবার চাপের কারণে রাজি হয়ে গেল । দেখছে শুনতে যোগ্যতায় অপু মোটেই খারাপ ছিল না । কিন্তু তার পরেও নাজিয়া তাকে পছন্দ করলো না । একই বাসায় থাকার পরেও তাদের ঘর আলাদা ছিল । অপু ধৈর্য্য ধরে সংসার করেই যাচ্ছিলো । নাজিয়া কেবল চাইছিলো এক সময়ে এই ধৈর্য্যের বাঁধ তার ভাঙ্গবে ।

কিন্তু আস্তে আস্তে নাজিয়া লক্ষ্য করলো সে অপু ওর কেয়ার নেওয়া শুরু করেছে । ওর কখন কী লাগবে সেটা অপু জানা শুরু করলো সেগুলোর ব্যবস্থা করা শুরু কলো । ওর হাতের কাছে সব কিছু চলে আসতো সময় । বিশেষ করে ওর দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাতো, যেভাব কথা বলতো নাজিয়া বুঝতে মোটেও কষ্ট হত না । নাজিয়া প্রথম প্রথম পাত্তা না দিতে চাইলেও খেয়াল করে দেখলো ওর নিজের মনে একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে ।

কিন্তু গত পরশু সব কিছু কেমন অন্য রকম হয়ে গেল । একটা পার্টিতে গিয়েছিলো ওরা দুজন । সেখানেই নাজিয়ার পুরাতন বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা । রাত একটু বেশি হলে সেখানে ড্রিঙ্ক করা শুরু হয় । সাথে নাচ । নাজিয়ার ড্রিঙ্ক করার অভ্যাস আছে । কয়েক পেগ খাওয়ার পর একটু মাতাল হয়ে সে তার এক্সের সাথে নাচতে চলে গেল অপুকে রেখেই । তখনই ঘটনা ঘটলো । নাজিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে যাচ্ছিলো তখনই চোখ গেল অপুর দিকে । ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে । কী একটা অদ্ভুত চোখে । সেই চোখের তীব্রতা এতো ছিল যে নাজিয়া থেমে গেল । অপুর সাথে কয়েক মুহুর্ত চোখাচোখী হল ! অপু তারপর উঠে গেল । নাজিয়া দেখলো অপু বের হয়ে গেল পার্টি থেকে । নাজিয়ার ঘোর কেটে গেছে ততক্ষনে । সে কিছু সময় বসে রইলো বারের কাছেই । আর কিছু খেল না । নাজিয়ার সেই এক্স বার কয়েক এল ওকে নিয়ে নাচতে চাইলো কিন্তু নাজিয়া কিছুতেই গেল না । তার চোখের সামনে থেকে কিছুতেই অপুর চেহারাটা যাচ্ছে না ।

বাইরে এসে দেখলো অপু কোথাও নেই। একই গাড়িতে এসেছে ওরা । তবে গাড়িটা রয়ে গেছে পার্কিংয়ে । অপু কি বাসায় গেছে ? নাজিয়াও বাসার দিকে রওয়ানা দিল । কলিংবেল চাপতেই অপুই দরজা খুলে দিল । ওর চোখের দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল সে । সেই দৃষ্টির সামনে আর পড়তে চাইলো না মোটেও ।
ঐদিন রাতে চোখের পাতা এক করতে পারলো না নাজিয়া । কেবল ঐ চোখের দৃষ্টি ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে !
নাচতেছিলো ঠিক আছে কিন্তু চুমু খেতে গেল কেন ?
তার যতই পছন্দ না হোক, সে অপুর স্ত্রী !
কিভাবে সে অন্য কারো সাথে এই কাজটা করতে যাচ্ছিলো !
এই দৃশ্য দেখলে যে কোন স্বামীর কষ্ট হওয়ার কথা ! অপুকে সে পছন্দ না তার মানে এই না তো তাকে এই ভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার তার রয়েছে ?

অপু কিন্তু ওর সাথে একদম কোন খারাপ ব্যবহার করে নি । এমন কি এই ব্যাপারে কোন কথাও বলে নি । ওর সাথে এমন আচরন করে চলেছে যেন কোন কিছু হয় নি । সব কিছু আগের মতই রয়েছে । এই ব্যাপারটা নাজিয়াকে আরও বেশি পীড়া দিচ্ছে । যদি একটু চিৎকার চেঁচামিচি করতে অপু, তাহলে নাজিয়ার জন্য ব্যাপারটা হয়তো অন্য রকম হত ।
নাজিয়া তারপর থেকে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না । কোন কাজে মন বসাতে পারছে না ।

অফিস থেকে বের হয়ে গেল । কিছু সময়ে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলো । তারপর সোজা গিয়ে হাজির হল নিজের বাবার বাসায় ।

খালেকুর রহমান এখন কাজ কর্ম থেকে একেবারে অবসর নিয়েছেন । নিজের স্ত্রীর সাথে বাড়িধারার একটা বাংলোবাড়িতে থাকেন । বই পড়ে হাটাহাটি করে আর নিজের স্ত্রীর সাথে গল্প করে সময় কাটে তার । নাজিয়াকে অসময়ে আসতে দেখে তিনি খানিকটা অবাক হলেন । নাজিয়ার মা তো খুব খুশি হলেন । বললেন সে রাতে যেন খেয়ে যায় । জামাই মানে অপু কেন আসে নি সেটা জানতে চাইলো । নাজিয়া বলল যে সে অফিসে ব্যস্ত । অফিসের পরে আসবে ।

খালেকুর রহমান মেয়ের ভাব ঠিকই বুঝতে পারলেন । কিছু একটা সমস্যা যে হয়েছে সেটা মেয়ের চেহারা দেখেই সে আন্দাজ করে নিয়েছিলো । নিজের স্ত্রী চলে যেতে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ব্যাপারটা !
-কী হয়েছে বল আমাকে?
নাজিয়া কিছু সময় চুপ করে থেকে সব খুলে বলল। নাজিয়ার মনে হল সব শোনার পরে তার বাবা তাকে খুব বকা দিবে । তবে তেমন কিছু হল না ! গম্ভীর মুখে খালেকুর রহমান সব শুনলো । তারপর বলল, তোর কেন এমন হচ্ছে ?
-জানি না বাবা ! সত্যিই জানি না । কী যে এক দম বন্ধ অনুভব হচ্ছে !
-তুই কী অপুর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলেছিস?
-না । আমি ওর দিকেই তাকাতে পারি নি ।
-আমার কী মনে হয় জানিস ? হ্যা অপু কষ্ট পেয়েছে সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি । এখন কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস ! কোন ভাবেই সেটা আর ফেরৎ নেওয়ার উপায় নেই ।
-আমি কী করবো?
-ওর সাথে কথা বল । ওকে সরি বল !
-সরি বললে কাজ হবে?
-হবে । অনেকে বলে সরিতে আসলে কিছু হয় না । কথাটা আসলে ঠিক না । সঠিক মানুষের কাছ থেকে একটা কম্লিমেন্ট একটা সরি যে কী পরিমান গুরুত্ব বহন করে সেটা আসলে অনেকেই জানে না । ওর সাথে কথা বল ! দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে । আর অপুকে আমি চিনি । ওর ধৈর্যশীল একটা ছেলে । তোর উল্টো ! এই জন্য তোর জন্য সে পার্ফেক্ট একজন ছেলে ।

সন্ধ্যার দিকে অপু সত্যিই সত্যিই নাজিয়ার বাবার বাড়ি এসে হাজির হল । কিভাবে আসলো সেটা নাজিয়া জানে না । সম্ভবত ওর বাবা কিংবা মা কোন ফাঁকে ওকে খবর দিয়েছে । নাজিয়া সামনে যায় নি । অপু খালেকুর রহমানের সাথে বসে গল্প করছিলো । এতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিলো যেন কিছুই হয় নি । জামাই শ্বশুর বাড়ি এসেছে, শ্বশুরের সাথে গল্প করছে । কত স্বাভাবিক একটা দৃশ্য । নাজিয়া কেবল দুর থেকে দুজনকে দেখে গেল । সামনে গেল না । কিন্তু রাতে খাওয়ার সময়ে একসাথে আসতেই হল । নাজিয়া মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছিলো । যা কথা বলার খালেকুর রহমানই বলে যাচ্ছিলো ।

ফেরার সময়ে তো একই সাথে যেতে হল । গাড়ি অন্য সময়ে নাজিয়া নিজে চালালেও আজকে অপুকেই চালাতে দিলো । নাজিয়া কেবল পাশের সিটে চুপচাপ বসে ছিল । কিভাবে ওর সাথে কথা বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছিলো না। একটা সমান্য সরি বলা যে এতো কঠিন হবে সেটা মোটেও বুঝতে পারে নি সে !

নিজেদের বাসার দরজা খোলার সময়েও নাজিয়া পেছনে চুপ করে দাড়িয়ে ছিল । কি বলবে নাকি বলবে না? সোজা নিজের ঘরে চলে যাবে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না । তখনই অনুভব করলো অপু ওকে জড়িয়ে ধরেছে । ওরা ঘরের ভেতরেই ঢুকে পরেছে কখন সেটাও নাজিয়া খেয়াল করে নি ।

নাজিয়া অপুর বুকের হার্টবিট টা পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলো । ওকে জড়িয়ে ধরেই অপু বলল, তুমি মনে অপরাধবোধ রেখো না, কেমন ! ড্রিঙ্ক ছিলে । কী করতে গিয়ে কী করে ফেলেছো !
অপুর কন্ঠে যে কী ছিল সেটা নাজিয়া নিজেও না । কেবল মাত্র একটা লাইণ ! এই একটা লাইণ শোনার পরে ওর মনে যে কী তীব্র আন্দোলন শুরু হল । মনে হল যেন পুরো শরীর ভেঙ্গে কান্না চলে আসছে । নাজিয়া কিছুতেই সে কান্না আটকাতে পারলো না । হুহু করে কেবল কেঁদে উঠলো । তারপর নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অপুকে । খানিকটা ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল, আমি খুব সরি । খুব বেশি ! আর কোন দিন এরকম করবো না ! কোন দিন !
-বলেছি তো । কিছু হয় নি !
-আমি খুব সরি ।

নাজিয়ার কান্নার বেগ যে বাড়তেই থাকলো । সেটা কিছুতেই আর থামে না । অপু ওকে বাচ্চা মেয়েদের মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো । এক সময়ে ওকেখানিকটা কোলে করে নিয়েই ওর ঘরে গেল । বিছানাতে যখন শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হতে যাবে নাজিয়া ওর হাত ধরলো । তারপর বলল, আজকে যেও না । এখানে ঘুমাও !
-এখানে ঘুমালে অভ্যাস হয়ে যাবে ! তখন আর একা ঘুমাতে ইচ্ছে করবে না ।
-ঘুমিও না !
-সত্যিই তো । পরে কিন্তু মানা শুনবো না ।
-শুনো না ।

অপু এবার আরও একটু কাছে এসে ওর কপালে একটা চুমু খেল । তারপর নাকে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে ওর পাশেই শুয়ে পড়লো । আজকে অনেক দিন পর, অনেক ধৈর্য্যের পর মেয়েটা ওর কাছে চলে এসেছে । ঐদিন ঐ রকম একটা দৃশ্য দেখে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিলো । এতোদিন ধৈর্য্য ধরে ছিল যে এই ভেবে একদিন হয়তো নাজিয়া ওর কাছে চলে আসবে । কিন্তু ঐ ঘটনার পরে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিলো মনের ভেতরেই । ভেবেছিলো হয়তো এই জীবনে আর ওর ভালোবাসা পাওয়া হবে না । কিন্ত আজকে নাজিয়ার বাবার ফোন পেয়ে বুঝতে পারলো যে নাজিয়াও কষ্ট পাচ্ছে । তখনই ঠিক করে ফেলেছিলো যে এই বার সে নিজেই এগিয়ে আসবে । এতো দিন কেবল নাজিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো যে ও নিজ থেকে কখন এগিয়ে আসবে । কিন্তু এবার ওর নিজের এগিয়ে আসার সময় এসেছে ।

নাজিয়া নিজেই এবার নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে এসে অপুকে চুমু খেল । তারপর ……

তাদের ভালোবাসার গল্প এখান থেকেই শুরু হল আবার নতুন করে……..।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 107

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “ভালোবাসার শুরু এখান থেকেই….”

  1. এমন গল্প সারাদিন পড়তে মন চায়।

Comments are closed.