ভালোবাসার শুরু এখান থেকেই….

oputanvir
4.8
(106)

নাজিয়া কিছুতেই ব্যাপারটা নিজের মন থেকে বের করে দিতে পারছে না । বারবার চোখের সামনে অপুর চোখ দুটো দেখতেপাচ্ছে যেন । ওর নিজের ভেতরেই সব কিছু কেমন যে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে । এমন কেন হচ্ছে? কেন সে নিজের কাজে মন দিতে পারছে না ? হাতের মগটা ছুড়ে মারলো সামনে । মেঝেতে পড়ে সেটা ছড়িয়ে গেল । শব্দ শুনে হাসান ছুটে এল ঘরে । নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে ম্যাম ? ঠিক আছেন?
নাজিয়া নিজের পিএর দিকে তাকালো না । একভাবে নিজের পিসি মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইলো । এখন কারো দিকে সে তাকাতে চাচ্ছে না । কারো দিকে তাকাতে তার ইচ্ছে করছে না ।
হাসান বলল, ম্যাম স্যারকে কি ডাক দিবো?

কথা শুনে নাজিয়ার মেজাজটা হঠাৎ চড়া হয়ে গেল । সে হাসানের দিকে দিকে না তাকিয়েই বলল, কেন? তাকে কেন ডাক দিতে হবে? তোমাকে বলেছি তাকে ডাকতে? চোখের সামনে থেকে দুর হয়ে যাও ।

হাসান আর কিছু বলার সাহস পেল না । দরজা দিয়ে আবারো বের হয়ে গেল । দরজা টা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনে সামনের দিকে ফিরে তাকালো । নিজের আচরনে নিজেই খানিকটা অবাক হচ্ছে ! এমন কেন আচরন করছে সে ! এতো অস্থির কেন হচ্ছে সে ? কেন?
অপু ওর সাথে একদম খারাপ ব্যবহার করে নি । বরং স্বাভাবিক আচরন করেছে । প্রতিদিন ওর সাথে যেমন নরম আর মিষ্টি ব্যবহার করে ঠিক তেমন ! অথচ ওর রাগ করার কথা ছিল ? ছেলেটা কেন রাগ করে না ওর উপরে ? কেন এই ভাবে ভালোবাসে?
ভালোবাসে?

নাজিয়া নিজে মানতে না চাইলেও জানে না কথাটা সত্য । অপু তাকে ভালোবাসে !
বিয়ের শুরুতে নাজিয়া অপুকে অপছন্দ করে এসেছে কেবল মাত্র বিয়েটা ওর নিজের পছন্দে হয় নি বলে । কোন দিন অপুকে বোঝার চেষ্টা করে নি । এমন কি স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করে নি । কিন্তু অপু ঠিকই তার স্বামী হওয়ার সব কাজ সামলেছে ।

অপুর সাথে বিয়েটা হয়েছে নাজিয়ার বাবার ইচ্ছেতে । নাজিয়া যতই এক জেদী হোক না কেন বাবার সামনে সে খানিকটা অসহায়বোধ করে সব সময় । নাজিয়ার বাবা খালেকুর রহমান নিজেকের মেয়েকে খুব ভাল করেই চেনেন । নাজিয়াকে কিভাবে লাইনে আনতে হয় সেটা তার ভাল করেই জানা ছিল । অপু প্রথমে ওদের কোম্পানীরই একজন এম্প্লোয়ী ছিল । কিভাবে যেন খালেজুর রহমান অপুকে খুব বেশি পছন্দ করা শুরু করলেন । পছন্দটা এতো তীব্র হল যে এক সময়ে নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপার সব কিছু ঠিক করে ফেললেন ।

নাজিয়া প্রথমে কিছুতেই রাজি ছিল না । কিন্তু এক সময়ে বাবার চাপের কারণে রাজি হয়ে গেল । দেখছে শুনতে যোগ্যতায় অপু মোটেই খারাপ ছিল না । কিন্তু তার পরেও নাজিয়া তাকে পছন্দ করলো না । একই বাসায় থাকার পরেও তাদের ঘর আলাদা ছিল । অপু ধৈর্য্য ধরে সংসার করেই যাচ্ছিলো । নাজিয়া কেবল চাইছিলো এক সময়ে এই ধৈর্য্যের বাঁধ তার ভাঙ্গবে ।

কিন্তু আস্তে আস্তে নাজিয়া লক্ষ্য করলো সে অপু ওর কেয়ার নেওয়া শুরু করেছে । ওর কখন কী লাগবে সেটা অপু জানা শুরু করলো সেগুলোর ব্যবস্থা করা শুরু কলো । ওর হাতের কাছে সব কিছু চলে আসতো সময় । বিশেষ করে ওর দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাতো, যেভাব কথা বলতো নাজিয়া বুঝতে মোটেও কষ্ট হত না । নাজিয়া প্রথম প্রথম পাত্তা না দিতে চাইলেও খেয়াল করে দেখলো ওর নিজের মনে একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে ।

কিন্তু গত পরশু সব কিছু কেমন অন্য রকম হয়ে গেল । একটা পার্টিতে গিয়েছিলো ওরা দুজন । সেখানেই নাজিয়ার পুরাতন বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা । রাত একটু বেশি হলে সেখানে ড্রিঙ্ক করা শুরু হয় । সাথে নাচ । নাজিয়ার ড্রিঙ্ক করার অভ্যাস আছে । কয়েক পেগ খাওয়ার পর একটু মাতাল হয়ে সে তার এক্সের সাথে নাচতে চলে গেল অপুকে রেখেই । তখনই ঘটনা ঘটলো । নাজিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে যাচ্ছিলো তখনই চোখ গেল অপুর দিকে । ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে । কী একটা অদ্ভুত চোখে । সেই চোখের তীব্রতা এতো ছিল যে নাজিয়া থেমে গেল । অপুর সাথে কয়েক মুহুর্ত চোখাচোখী হল ! অপু তারপর উঠে গেল । নাজিয়া দেখলো অপু বের হয়ে গেল পার্টি থেকে । নাজিয়ার ঘোর কেটে গেছে ততক্ষনে । সে কিছু সময় বসে রইলো বারের কাছেই । আর কিছু খেল না । নাজিয়ার সেই এক্স বার কয়েক এল ওকে নিয়ে নাচতে চাইলো কিন্তু নাজিয়া কিছুতেই গেল না । তার চোখের সামনে থেকে কিছুতেই অপুর চেহারাটা যাচ্ছে না ।

বাইরে এসে দেখলো অপু কোথাও নেই। একই গাড়িতে এসেছে ওরা । তবে গাড়িটা রয়ে গেছে পার্কিংয়ে । অপু কি বাসায় গেছে ? নাজিয়াও বাসার দিকে রওয়ানা দিল । কলিংবেল চাপতেই অপুই দরজা খুলে দিল । ওর চোখের দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল সে । সেই দৃষ্টির সামনে আর পড়তে চাইলো না মোটেও ।
ঐদিন রাতে চোখের পাতা এক করতে পারলো না নাজিয়া । কেবল ঐ চোখের দৃষ্টি ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে !
নাচতেছিলো ঠিক আছে কিন্তু চুমু খেতে গেল কেন ?
তার যতই পছন্দ না হোক, সে অপুর স্ত্রী !
কিভাবে সে অন্য কারো সাথে এই কাজটা করতে যাচ্ছিলো !
এই দৃশ্য দেখলে যে কোন স্বামীর কষ্ট হওয়ার কথা ! অপুকে সে পছন্দ না তার মানে এই না তো তাকে এই ভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার তার রয়েছে ?

অপু কিন্তু ওর সাথে একদম কোন খারাপ ব্যবহার করে নি । এমন কি এই ব্যাপারে কোন কথাও বলে নি । ওর সাথে এমন আচরন করে চলেছে যেন কোন কিছু হয় নি । সব কিছু আগের মতই রয়েছে । এই ব্যাপারটা নাজিয়াকে আরও বেশি পীড়া দিচ্ছে । যদি একটু চিৎকার চেঁচামিচি করতে অপু, তাহলে নাজিয়ার জন্য ব্যাপারটা হয়তো অন্য রকম হত ।
নাজিয়া তারপর থেকে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না । কোন কাজে মন বসাতে পারছে না ।

অফিস থেকে বের হয়ে গেল । কিছু সময়ে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলো । তারপর সোজা গিয়ে হাজির হল নিজের বাবার বাসায় ।

খালেকুর রহমান এখন কাজ কর্ম থেকে একেবারে অবসর নিয়েছেন । নিজের স্ত্রীর সাথে বাড়িধারার একটা বাংলোবাড়িতে থাকেন । বই পড়ে হাটাহাটি করে আর নিজের স্ত্রীর সাথে গল্প করে সময় কাটে তার । নাজিয়াকে অসময়ে আসতে দেখে তিনি খানিকটা অবাক হলেন । নাজিয়ার মা তো খুব খুশি হলেন । বললেন সে রাতে যেন খেয়ে যায় । জামাই মানে অপু কেন আসে নি সেটা জানতে চাইলো । নাজিয়া বলল যে সে অফিসে ব্যস্ত । অফিসের পরে আসবে ।

খালেকুর রহমান মেয়ের ভাব ঠিকই বুঝতে পারলেন । কিছু একটা সমস্যা যে হয়েছে সেটা মেয়ের চেহারা দেখেই সে আন্দাজ করে নিয়েছিলো । নিজের স্ত্রী চলে যেতে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ব্যাপারটা !
-কী হয়েছে বল আমাকে?
নাজিয়া কিছু সময় চুপ করে থেকে সব খুলে বলল। নাজিয়ার মনে হল সব শোনার পরে তার বাবা তাকে খুব বকা দিবে । তবে তেমন কিছু হল না ! গম্ভীর মুখে খালেকুর রহমান সব শুনলো । তারপর বলল, তোর কেন এমন হচ্ছে ?
-জানি না বাবা ! সত্যিই জানি না । কী যে এক দম বন্ধ অনুভব হচ্ছে !
-তুই কী অপুর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলেছিস?
-না । আমি ওর দিকেই তাকাতে পারি নি ।
-আমার কী মনে হয় জানিস ? হ্যা অপু কষ্ট পেয়েছে সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি । এখন কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস ! কোন ভাবেই সেটা আর ফেরৎ নেওয়ার উপায় নেই ।
-আমি কী করবো?
-ওর সাথে কথা বল । ওকে সরি বল !
-সরি বললে কাজ হবে?
-হবে । অনেকে বলে সরিতে আসলে কিছু হয় না । কথাটা আসলে ঠিক না । সঠিক মানুষের কাছ থেকে একটা কম্লিমেন্ট একটা সরি যে কী পরিমান গুরুত্ব বহন করে সেটা আসলে অনেকেই জানে না । ওর সাথে কথা বল ! দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে । আর অপুকে আমি চিনি । ওর ধৈর্যশীল একটা ছেলে । তোর উল্টো ! এই জন্য তোর জন্য সে পার্ফেক্ট একজন ছেলে ।

সন্ধ্যার দিকে অপু সত্যিই সত্যিই নাজিয়ার বাবার বাড়ি এসে হাজির হল । কিভাবে আসলো সেটা নাজিয়া জানে না । সম্ভবত ওর বাবা কিংবা মা কোন ফাঁকে ওকে খবর দিয়েছে । নাজিয়া সামনে যায় নি । অপু খালেকুর রহমানের সাথে বসে গল্প করছিলো । এতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিলো যেন কিছুই হয় নি । জামাই শ্বশুর বাড়ি এসেছে, শ্বশুরের সাথে গল্প করছে । কত স্বাভাবিক একটা দৃশ্য । নাজিয়া কেবল দুর থেকে দুজনকে দেখে গেল । সামনে গেল না । কিন্তু রাতে খাওয়ার সময়ে একসাথে আসতেই হল । নাজিয়া মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছিলো । যা কথা বলার খালেকুর রহমানই বলে যাচ্ছিলো ।

ফেরার সময়ে তো একই সাথে যেতে হল । গাড়ি অন্য সময়ে নাজিয়া নিজে চালালেও আজকে অপুকেই চালাতে দিলো । নাজিয়া কেবল পাশের সিটে চুপচাপ বসে ছিল । কিভাবে ওর সাথে কথা বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছিলো না। একটা সমান্য সরি বলা যে এতো কঠিন হবে সেটা মোটেও বুঝতে পারে নি সে !

নিজেদের বাসার দরজা খোলার সময়েও নাজিয়া পেছনে চুপ করে দাড়িয়ে ছিল । কি বলবে নাকি বলবে না? সোজা নিজের ঘরে চলে যাবে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না । তখনই অনুভব করলো অপু ওকে জড়িয়ে ধরেছে । ওরা ঘরের ভেতরেই ঢুকে পরেছে কখন সেটাও নাজিয়া খেয়াল করে নি ।

নাজিয়া অপুর বুকের হার্টবিট টা পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলো । ওকে জড়িয়ে ধরেই অপু বলল, তুমি মনে অপরাধবোধ রেখো না, কেমন ! ড্রিঙ্ক ছিলে । কী করতে গিয়ে কী করে ফেলেছো !
অপুর কন্ঠে যে কী ছিল সেটা নাজিয়া নিজেও না । কেবল মাত্র একটা লাইণ ! এই একটা লাইণ শোনার পরে ওর মনে যে কী তীব্র আন্দোলন শুরু হল । মনে হল যেন পুরো শরীর ভেঙ্গে কান্না চলে আসছে । নাজিয়া কিছুতেই সে কান্না আটকাতে পারলো না । হুহু করে কেবল কেঁদে উঠলো । তারপর নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অপুকে । খানিকটা ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল, আমি খুব সরি । খুব বেশি ! আর কোন দিন এরকম করবো না ! কোন দিন !
-বলেছি তো । কিছু হয় নি !
-আমি খুব সরি ।

নাজিয়ার কান্নার বেগ যে বাড়তেই থাকলো । সেটা কিছুতেই আর থামে না । অপু ওকে বাচ্চা মেয়েদের মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো । এক সময়ে ওকেখানিকটা কোলে করে নিয়েই ওর ঘরে গেল । বিছানাতে যখন শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হতে যাবে নাজিয়া ওর হাত ধরলো । তারপর বলল, আজকে যেও না । এখানে ঘুমাও !
-এখানে ঘুমালে অভ্যাস হয়ে যাবে ! তখন আর একা ঘুমাতে ইচ্ছে করবে না ।
-ঘুমিও না !
-সত্যিই তো । পরে কিন্তু মানা শুনবো না ।
-শুনো না ।

অপু এবার আরও একটু কাছে এসে ওর কপালে একটা চুমু খেল । তারপর নাকে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে ওর পাশেই শুয়ে পড়লো । আজকে অনেক দিন পর, অনেক ধৈর্য্যের পর মেয়েটা ওর কাছে চলে এসেছে । ঐদিন ঐ রকম একটা দৃশ্য দেখে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিলো । এতোদিন ধৈর্য্য ধরে ছিল যে এই ভেবে একদিন হয়তো নাজিয়া ওর কাছে চলে আসবে । কিন্তু ঐ ঘটনার পরে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিলো মনের ভেতরেই । ভেবেছিলো হয়তো এই জীবনে আর ওর ভালোবাসা পাওয়া হবে না । কিন্ত আজকে নাজিয়ার বাবার ফোন পেয়ে বুঝতে পারলো যে নাজিয়াও কষ্ট পাচ্ছে । তখনই ঠিক করে ফেলেছিলো যে এই বার সে নিজেই এগিয়ে আসবে । এতো দিন কেবল নাজিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো যে ও নিজ থেকে কখন এগিয়ে আসবে । কিন্তু এবার ওর নিজের এগিয়ে আসার সময় এসেছে ।

নাজিয়া নিজেই এবার নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে এসে অপুকে চুমু খেল । তারপর ……

তাদের ভালোবাসার গল্প এখান থেকেই শুরু হল আবার নতুন করে……..।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 106

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “ভালোবাসার শুরু এখান থেকেই….”

  1. এমন গল্প সারাদিন পড়তে মন চায়।

Comments are closed.