আমার সাইকেলরা এবং তাদের নিয়ে গল্প

অপু তানভীর
4.8
(16)

সাইকেল জিনিসটা আমার বরাবরই পছন্দের । ছোটবেলা থেকেই এই সাইকেল ব্যাপারটা পছন্দ । এখনও পর্যন্ত আমার এই পছন্দের ব্যাপারটা রয়েছে । যখন খুব একা লাগে কিংবা মন খারাপ লাগে তখন সাইকেল নিয়ে বের হই । এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই । সাইকেল রাইড দেওয়ার পরে বাসায় যখন ফিরে আসি তখন মন ভাল হয় । বৃষ্টির ভেতরে সাইকেল চালানোর ব্যাপারটা সব থেকে মজার । কত কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই সাইকেলকে কেন্দ্র করে । আমার প্রথম ডেটিংয়ের গল্পের সাথেও এই সাইকেল জড়িতো । সেটা তো পড়েছেন আশা করি ।

আমার বড় ভাই প্রতি বছর একটা করে নতুন সাইকেল কিনতো । তারপর সেটা ভেঙ্গে চুড়ে দুমড়ে মুচড়ে আবার নতুন আরেকটা কিনতো । সে ক্লাস থ্রি তে থাকতে সাইকেল চালানো শিখে ফেলেছিলো । আমার অবশ্য শিখতে বেশ দেরি হয়েছিলো । কারণ ছিল আমি আঘাত পাওয়া ভয় পেতাম । তাই একেবারেই সাইকেল চড়া হত না । কিন্তু স্বপ্ন ঠিকই ছিল যে একদিন শিখবো সাইকেল চালানো ।

একটু বড় হয়ে আমাকেও একটা সাইকেল কিনে দেওয়া হল । সাইকেলটা সাইজে একটু ছোট । সাইকেলে পাতার ডিজাইণ করা । সাইকেলটার ব্যাপারে আমার এই মনে আছে আপাতত । সাইকেলে কোন প্রকার গিয়ার ছিল না । আমার মনে আছে তখনকার সময়ে সাইকেলটার দাম ছিল ৩৩০০ টাকা । তবে এই সাইকেলটা আমি ঠিক মত চালাতে পারি নি । আমার বড় ভাই ই সাইকেলটা চালাতো । সেই চালিয়ে সাইকেল পুরোনো করে ফেলল । আমি আঘাত পাওয়ার ভয়ে সাইকেল চালানো শিখতে পারলাম না । ক্লাস ফাইভে থাকাকালীন সময়ে সেটা কেন হয়েছিলো ।

এরপর একটা সময় আমি ঠিক ঠিক সাইকেল চালানো শিখে গেলাম । এই গল্পটা বেশ মজার । তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি । একদিন কি মনে হল যে আজকে আমি সাইকেল নিয়ে বের হলাম বাড়ির পাশের মাঠে । এতোদিন একা একা আমি সাইকেল নিয়ে বের হয় নি কোন দিন । মাঝে মাজে কেবল বাসার ভেতরে সাইকেলটার উপরে বসে থাকতাম । কিন্তু বাইরে বের হতাম না । হয়ে লাভ কি ! সেইদিন কি মনে হল বের হয়ে গেলাম । মাঠে এসে দেখি আমার বড় ভাই ক্রিকেট খেলছে । তার কি মনে হল সেও এগিয়ে এল । আমাকে সিটের উপরে বসিয়ে বলল, চালাবি সামনের দিকে তাকিয়ে । পেছনে তাকাবি না । আমি পেছনে আছি । আমি সিটে উঠে তাই শুরু করলাম । প্যাডেল মারলাম সাইকেল চলল । আমি জানি পেছনে আমার বড় ভাই আছে । সে ধরে আছে বলে আমি চলেছি । কিছু সময় চালানো পরে পেছনে খেয়াল করে দেখি বড় ভাই নেই । আমি একা একাই চালাচ্ছি । তখনই আমি পড়ে গেলাম । ঠিক পড়ে গেলাম না পা দিয়ে মাটিয়ে ঠাই দিয়ে দাড়ালাম । তবে তখন মনে আত্ম বিশ্বাস চলে এল । এতো এতো দিন পরে আমার মনে হল যে পারবো খানিকটা ।

আমার সমস্যা ছিল মূলত সাইকেলে প্রথম দিকে ওঠা । সেইটাই আমি পারতাম না । মাঠে একটা শোয়ানো আম গাছ ছিল । সেই আম গাছের পাশে সাইকেলটা দাড় করিয়ে সেটার উপরে এক পা রেখে সাইকেল উঠলাম । তারপর পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে সাইকেলটা বাড়িয়ে দিলাম সামনের দিকে । এভাবের প্রাক্টিস চলল অনেক টা সময় । পুরো সকাল থেকে তারপর দুপুরের একটু পরে থেকে পুরো বিকেল সন্ধ্যা পর্যন্ত । তখন সাইকেল চালানো শেখার তীব্র আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসেছে । সন্ধ্যা হতে হতে আমি সাইকলে সামনের দিকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা বেশ ভাল করে রপ্ত করে ফেললাম বটে । কিন্তু সাইকেলে প্রথমে ওঠাটা তখনও বাগে আসে নি । সেটা আয়ত্তে আসতে বেশ সময় লেগেছিলো ।

বেশ কিছু সময় সাইকেল দিয়ে প্রাক্টিস চলল । একদিন সকালে সাহস করে সাইকেল নিয়ে প্রাইভেট পড়তে চলে গেলাম । বাড়ি থেক বেশ খানিকটা দুরে । প্রায় চার কিলোমিটার, প্রধান রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালানোর সময় ভয় যে করছিলো না সেটা মোটেও না তবে উত্তেজনা কাজ করছিলো বেশ । তবে সেইদিনই প্রথম এক্সিডেন্ট করলাম । কোন গাড়ির সাথে নয় অবশ্য । একজন মানুষের সাথে । লোকটা রাস্তার পাশ দিয়েই হাটছিলো । আমি তাকে পেছন দিয়ে ধাক্কা মেরে দিলাম ! তবে সে ভাল ছিল । আমাকে একটু ধকম দিয়ে আর কিছু বলল না । আর বলল যে আমি যেন আর না বের হই সাইকেল নিয়ে !

ক্লাস এইটে উঠে নতুন সাইকেল এল হাতে । আমাদের বাসায় তখন একজন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) কর্মকর্তা ভাড়া থাকতো । তখন বর্ডার থেকে সাইকেল আনা যেত কম খরচে । ক্যাপ্টেন নামে খয়েরী রংয়ের সাইকেল তখন খুব প্রচলন । সেই সাইকেল আমার জন্য নিয়ে আসা হল । সাইকেলটার দাম ছিল সম্ভবত ১৭৫০ টাকা ।

সাইকেল টা আমি চালিয়েছি ক্লাস টেন পর্যন্ত । তবে এই সাইকেলেও আমি একবার এক্সিডেন্ট করেছিলাম । আমার তখন ক্যাপ পরার অভ্যাস ছিল । একদিন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি । ক্যাপ পরা ছিল । নিচের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলাম । সামনে দেখি নি । আমাদের এলাকাতে ভারি মাল পত্র নিয়ে ভ্যান গাড়ি গুলো রং সাইড দিয়ে চলত তখন । কেন চলতো কে জানে । সেই রকম রং সাইড দিয়ে এক ভ্যান আসছিলো । সেই ভ্যানের সাথেই আমি ধাক্কা মেরে দিলাম । আমার পায়ে ব্যাথা লেগেছিলো বেশ খানিকটা । তবে সাইকেলটার সামনের অংশটা একেবারে তুবড়ে গিয়েছিলো ।

ক্লাস টেনে ওঠার পর নতুন আরেকটা সাইকেল হাতে এল । এটা আমার মামার সাইকেল । আমি তখন বড় হয়ে গেছি । ছোট সাইকেল চালানো যায় না । অন্য দিকে মামা সাইকেল নিয়ে কেবল মোড়ে যায় আর কোথাও যায় না । তাই সে তারটা আমাকে দিয়ে আমারটা সে নিয়ে গেল । সাইকেলটা ছিল এলজি বাটারফ্লাই কোম্পানির ডাবল রডের সাইকেল !

এই সাইকেলটার দাম ছিল মাত্র ৪০ টাকা । এই সাইকেল টা পাওয়া নিয়ে একটা মজার গল্প রয়েছে । আমার বড় মামা তখন আমার আব্বার সাথেই কাজ করতো । আব্বা জয়পুর হাটের বিডিআর (বিজিবি) ক্যাম্পের রেশন কন্ট্রাক্টর । বিজিআর ক্যাম্পে এনোয়াল ফাংশনের আয়োজন করা হয় । প্রতিটি ক্যাম্পেই হয় । সেখানে সিভিলিয়ানদের প্রবেশাধিকার না থাকলেও কন্টাক্টর হওয়ার সুবাধে বাবা আর মামা এবং তাদের পরিবারের ছিল । মামা সেখানে গিয়েছিলো । একটা খেলায় অংশ গ্রহন করেছিলো । হাউজবাম্পার নামে একটা খেলা । খেলাটা সম্পর্কে অনেকের ধারণা থাকার কথা । সেই খেলাতেই জয়ী হন মামা । পুরস্কার হিসাবে এই সাইকেলটা পান !
এই সাইকেলটা আমি ঢাকাতে আসার আগ পর্যন্ত চালিয়েছিলো । আমার হোম টাইনের এমন কোন রাস্তা নেই যেখানে এই সাইকেলের টায়ার চিহ্ন পরে নাই ।

ঢাকাতে আসার পরে অবশ্য সাইকেল চালানো কমে গিয়েছিলো । বিশেষ করে এতো ভীড়ের ভেতরে সাইকেল চালাতে একটু ভয়ই করতো । সেটা আরও বাড়িয়ে দিল যখন একবার সাইকেল এক্সিডেন্ট করলাম । তখন টিউশনী শুরু করেছি । স্টুডেন্টের সাইকেল ছিল । কী মনে হল একদিন ওর সাইকেলটা নিয়ে বাসায় ফিরতে মন চাইলো । সেটা নিয়ে রওয়ানা দিলাম । রুপসী বাংলার মোড়ের কাছে এসে এক বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করলাম । যদিও সেটা বড় কিছু ছিল না তবে পায়ের কাছে কেটে গেল । আর সাথে সাথে মনে ভয় ঢুকে গেল সাইকলে চালানোর ব্যাপারে । তারপর অনেক দিন আমি সাইকেল ধরি নি । সাইকেল পরে কিনে নিয়েছিলাম । মাঝে মধ্যে এলাকার ভেতরে টুকটাক চালাতাম ! কিন্তু সেটা বেশি দিন টিকে নি । বাসার নিচ থেকে সাইকেলটা চুরি হয়ে গেল । সাইকেল চালানোর আবারও বন্ধ হয়ে গেল ।

এরপর ২০১৭ সালে বানিজ্য মেলা থেকে দুরন্ত সাইকেল কিনে ফেললাম হুট করেই । সাইকেল যদিও তখন ভয় করতো চালাতে । তবে তখন মেইন রোড এড়িয়ে চলতাম । গলি খুজে খুজে বের করতাম । সাইকেলটা চালিয়েছিলাম প্রায় বছর খানেক । এরপর ডিসেম্বরে সাইকেলটা বিক্রয় ডট কমে বিক্রি করে দিলাম ।

নতুন আরেকটা সাইকেল কিনলাম । ভেলোজ ৬০৩ মডেল । এই সাইকেল টা আমি মনের সুখে চালিয়েছি । খুবই চমৎকার একটা সাইকেল । চালিয়ে সব সময় মজা পেয়েছি । প্রায় টানা তিন বছর এক টানা চালিয়েছি ।

সাইকেল কেনার সময় যখন সাইকেল টা সেট করা হচ্ছিলো তখন এই ম্যাও মশাই ছিল সেখানে

বর্তমানে যে সাইকেলটা চালাই সেটা হচ্ছে টোটেম । সাইকেলটার সাথে বড় বেশি আবেগ জড়িয়ে আছে ! সেই গল্প অন্য কোন দিন ।

আজকে সাইকেল নিয়ে লেখার কারণ হচ্ছে গতকাল সন্ধ্যার দিকে আমার বাসার নিচ থেকে দুইটা সাইকেল চোরে নিয়ে গেছে । আমি তখন সাইকেল নিয়ে বাইরে ছিলাম । শুক্রবারে আমি সাধারণত বাসায় থাকি । ছুটির দিন আমার । কিন্তু গতকাল পরিচিত একজন বলল যে তার বাসায় যেতে । কী একটা জরূরী কাজ আছে । একবার ভেবেছিলাম সপ্তাহ একটা দিন ছুটি পাই । একটু শুয়ে বসে কাটাই কিন্তু না । আজকেও যেতে হবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আসলেই জগতে যা কিছু হয় ভালর জন্যই হয় । যদি আমি কাল তার কথা মত তার বাসায় না যেতাম তাহলে দুইটা সাইকেলের বদলে চোরে আমার সাইকেলটাও নিয়ে যেত ।

একটু পরে আবার সাইকেলের দোকানে যাবো ভাবছি । আমার সাইকেলে বর্তমানে ৫ টাকা লক মারা থাকে । আরও দুইটা লক কিনে আনবো ভাবছি । এইসাইকেল টা কোন ভাবেই আমি হারাতে চাই না । টাকার কোন ব্যাপার না । এই সাইকেলের সাথে অনেক বড় কিছু জড়িয়ে রয়েছে । সেটা নিয়ে কিছুদিন পরেই লিখবো আশা করি ।

আজকের সাইকেল কথন এই পর্যন্তই !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 16

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “আমার সাইকেলরা এবং তাদের নিয়ে গল্প”

  1. ভেলোজ টা কেনার আগে আমাকে নক দিছিলেন ?
    আমি অবশ্য এখনো আগেরটা চালাই। কোর প্রজেক্ট ২.০ ।বিক্রি করতে মন চায় না।। থাকুক না ও ওভাবেই সারাজীবন। আরেকটা কিনবো কিনবো করে কেনা হয় নাই। তবে কিনবো এবার বেশ ভালো কোন ব্রান্ডের।

Comments are closed.