মুঠক দেবী

4.9
(53)

মায়ের মুখ গম্ভীর দেখে মুনজেরিন বলল, মা এমন করছো কেন শুনি?

মুনজেরিনের মা রাবেয়া খানম বলল, এই ছেলেকে কিভাবে আমরা তোর জন্য পছন্দ করেছিলাম !
-মা বাদ দাও তো ।
-কী বাদ দিবো ! যদি কোন দিন আমার সামনে একে পাই থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো সেদিন !
মুনজেরিন একটু হেসে বলল, আচ্ছা বাবা, দিও ।

রাবেয়া বলল, তুই একটু বস তো আমি আসছি ।
এই বলে তিনি কেবিন থেকে বের হয়ে গেল । মুনজেরিন খুব সাবধানে একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলল । মনটা একটু খারাপ লাগছে । শাহেদকে সে দোষ দেয় না কোন ভাবেই । সে অনেকটাই বাস্তববাদী । একজন মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য নিজের জীবনটাকে আটকে রাখার কোন মানে নেই। শাহেদ যে কাজটা করেছে ঠিকই করেছে । ওদের ভেতরে এক সময়ে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল কিন্তু সেটা এখন আর নেই । তার পরেও শাহেদ যদি আর কটা দিন পরে বিয়েটা করতো তাহলে মুনজেরিনের ভাল লাগতো ! আর খুব বেশি দিন বাকী নেই ওর মারা যাওয়ার । সেটা মুনজেরিন খুব ভাল করেই জানে । শাহেদও জানে । ও চাইলেই পারতো না একটু অপেক্ষা করতে !

আজকে শাহেদের এঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে । এক মাস পরে বিয়ে । একই সাথে ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করার সুবাধে ওদের বন্ধু এবং পরিচিত মানুষ গুলো একে অন্যের পরিচিত । তাই ওর বিয়ের খবরটা মুনজেরিনের কাছে ঠিকই চলে এসেছে । মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু কষ্ট হচ্ছে ।

সময়টা এখন বিকেল । মুনজেরিন জানালার দিকে তাকালো । আস্তে আস্তে দিনের আলো কমে আসছে । শীতের দিন গুলো খুব জলদি শেষ হয়ে যায় । সামনের বসন্তটা কি মুনজেরিন দেখে যেতে পারবে? কিংবা পহেলা বৈশাখটা?
প্রতি বৈশাখে ওদের ক্যাম্পাসে কী দারুন মেলা হয় ! ষেখানে হলুদ কিংবা লাল শাড়ি পরে, হাতে মেহেদী দিয়ে ঘুরে বেড়াতে মুনজেরিনের খুব ভাল লাগে । পেশায় শিক্ষক হলেও ঐদিন আসলে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কোন ভেদাভেদ থাকে না । এই সাথে হাসি আনন্দ আড্ডা সব চলে ! আরেকটা বৈশাখ কি আসবে না?

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । ঘরটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে । একটু পরেই নার্স আসবে । আলো জ্বেলে দিবে । যদিও হাসপাতালে সব সময় আলো জ্বালিয়ে রাখারই নিয়ম । তবে মুনজেরিনের জন্য নিয়মের খানিকটা ব্যতিক্রম করা হয়েছে । মুনজেরিনের কেবিনে মোট তিনটা জানালা রয়েছে । দিনেবেলা সে জানালার পর্দা উঠিয়ে দেওয়া হয় । ঘর আলোকিত হয় । বাড়তি আলোর দরকার পরে না । জানালা খোলার অনুমতি সে চেয়েছিলো তবে সেটা তাকে দেওয়া হয় নি ।

মুনজেরিন কমে আসা আলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ হল। ভাবলো হয়তো ওর মা ফেরৎ এসেছে কিন্তু ঘুরে তাকিয়ে দেখে কুশল এসেছে । ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো । প্রতি উত্তরে মুনজেরিনও হাসলো ।

কুশল মুনজেরিনের স্টুডেন্ট । এবার ফোর্থ ইয়ার । কুশল প্রতিদি্ন ওর সাথে দেখা করতে আসে । কেন আসে সেটা মুনজেরিন খুব ভাল করেই বুঝতে পারে । অন্য সময় হলে হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে সে কড়া কিছু বলতো তবে এখন কিছু বলে না । কুশলের চোখের দিকেই তাকালেই মুনজেরিন বুঝতে পারে যে এই ছেলেটা তাকে ভালোবাসে । সুন্দরীর টিচারের প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা নতুন কিছু না, কম বেশি অনেক ছাত্রই তাদের ম্যামের প্রেমে পড়ে কিন্তু কুশলের ব্যাপারটা কেমন যেন অন্য রকম মনে হয় ।

প্রথম যেদিন এসেছিলো ছেলেটা ওকে দেখে কেমন হুহু করে কেঁদে ফেলেছিলো । সেই চোখে মুনজেরিন কী তীব্র এক বেদনা দেখতে পেয়েছিলো । এমন একটা বেদনা সে শাহেদের চোখে দেখতে চেয়েছিলো । কিন্তু তার ছিটে ফোটাও সেখানে ছিল না । মুনজেরিন তাই কুশককে প্রশ্রয়ই দিয়েছে । ও আসলে মুনজেরিনেরও কেন জানি ভাল লাগে ।

কেমো নেওয়ার জন্য ওর মাথার চুল সব ফেলে দিতে হয়েছে । চেহারাটাও কেমন যে শুকিয়ে গেছে । আগের সেই সৌন্দর্য আর নেই । তারপরেও কুশল কেমন মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে । ওর ব্যাপারটা ভাল লাগে ।
মুনজেরিন বলল, কী ব্যাপার লাভার বয় । আজকে এতো দেরি?
কুশল একটু লজ্জা পেল । তারপর বলল, আজকে এক জায়গাতে গিয়েছিলাম ।
-কোথায় ?
-আছে । তোমাকে বলা যাবে না ! তবে আজকের পর সব কিছু বদলে যাবে !

হ্যা কুশল ওকে তুমি করেই বলে এখন । এখানে আসার দুইদিন পরে এই অনুমুতি চেয়ে নিয়েছিলো । মুনজেরিন কি মনে করে সেই অনুমতি ওকে দিয়েছে । কুশল ওর থেকে খুব বেশি ছোটও না । বছর তিনেকের ছোট হবে । পাশ করার সাথে সাথেই জয়েন করে ফেলেছে মুনতারিন । ওর চেহারার ভেতরে এখনও একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়েছে । ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় এটা অনেকে বিশ্বাস করে না ।
মুনজেরিন বলল, আচ্ছা ? কি বদলাবে?
-তুমি ঠিক হয়ে উঠবে?
-আচ্ছা !
-হ্যা ।

মুনজেরিন হাসতে গিয়েও হাসলো না । কারণ কুশলের চোখে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছে ।
কুশল এগিয়ে এল । বসলো ওর বিছানার পাশে । তারপর প্রথমবারের মত মুনজেরিনের হাত ধরলো । তারপর বলল, বিশ্বাস রাখো। তুমি ঠিক হয়ে যাবে ।

কুশল হয়তো আরও কিছু একটা বলতো তবে রাবেয়া আওয়াজ পেয়ে বলল না । উঠে গিয়ে আবারও চেহারে বসলো । কিছু সময় তাকিয়ে রইলো একভাবে । মুনজেরিনের কেন জানি এই তাকিয়ে থাকাটা বেশ ভাল লাগলো । আচ্ছা ওর যদি শরীর ভাল থাকতো তাহলে কি এই ছেলের সাথে এভাবে এখানে বসে থাকতে পারতো কিংবা একটু আগে এই ছেলেটা যেভাবে ওর হাত ধরলো সেটা কি পারতো?
পারতো না কখনই!

আরও কিছু সময় থেকে কুশল চলে গেল ।

ঐদিন রাতে মুনজেরিন অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো । দেখলো যে সে একটা বনের পাশে দাড়িয়ে রয়েছে একা । বনের অন্য পাশে একটা বড় দীঘি । বন এবং দীঘির মাঝে একটা অদ্ভুত দর্শন মূর্তি দেখতে পাচ্ছে । লতাপাতা দিয়ে অর্ধেকটা ঢেকে আছে । কিন্তু মুর্তিটার চোখ দুটো বড় জীবন্ত মনে হল । মনে হল যেন ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । যেই মূর্তিটা বানান না কেন চোখ দুটো একেবারে জীবন্ত করে বানিয়েছে । যেন সে মনজেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে । ওকে যেন চোখে চোখে কিছু একটা বলছে । মুনজেরিন সেই চোখের ভাষা ঠিকই যেন বুঝতে পারছে । মূর্তিটা যেন তাকে বলছে, তোর অসুখ আমাকে দিয়ে দে ! দিয়ে দে !
মুনজেরিন একভাবে সেদিকেই তাকিয়েই আছে । তারপর মুর্তির কথা মত মুনজেরিন আস্তে আস্তে দীঘিতে নেমে গেল । ঠান্ডা শীতল জল । পুরো শরীর ওকে কাঁপিয়ে দিল। একটা ডুব দিলো সে । যখন ডুব দিয়ে উঠলো তখন মুনজেরিন নিজেকে নিজের কেবিনে আবিস্কার করলো । বুকের ভেতরে একটা তীব্র অনুভূতি হচ্ছে । সেই সাথে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে ।

ওর হাঁসফাস শুনেই রাবেয়া জেগে উঠলো । জলদি ওর কাছে এসে বলল, কী হয়েছে ?
মুনজেরিন কেবল বলতে পারলো আম্মু …..
তারপরই সে জ্ঞান হারারো । রাবেয়া তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে মুনজেরিনের পুরো শরীর ভেজা ! এই বদ্ধ ঘরে বিছানার উপরে মুনজেরিনের শরীর কিভাবে ভিজলো সেটা সে কোন ভাবেই বুঝতে পারলো না !

দুই
দুই সপ্তাহ পরের কথা । আজকে মুনজেরিন বাসায় ফিরে এসেছে । একেবারে সুস্থ হয়ে । ওর শরীরে যে ফোর্থ স্টেজ ক্যান্সার ছিল সেটা একেবারে নেই হয়ে গেছে । ডাক্তারেরা কেবল হতবাক হয়ে গেছে । তাদের মুখে কোন কথা নেই । তারা যেন ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছেন না । এমন কি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুনজেরিনকে বাইরে নিয়ে পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে । এমন টা কোন ভাবেই সম্ভব না । হতে পারে না । কিন্তু হয়েছে ।
মুনজেরিন নিজের ঘরে এসে নিজের বিছানাতে অনেকটা সময় শুয়ে থাকলো । ওর এখনও কেমন যেন সব অবিশ্বাস্য মনে হয় । সত্যিই কি এমনটা হচ্ছে নাকি সে স্বপ্ন দেখছে?
স্বপ্নের কথা মনে হতেই সেদিনের সেই স্বপ্নটা বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মনে । সেই অদ্ভুত দর্শন মুর্তিটার কথা বারবার মনে পড়ছে । আর মনে পড়ছে কুশলের কথা । কুশল সেদিনের পরে আর আসে নি । কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করেছে সে কিন্তু তার ফোন বন্ধ । ছেলেটা ঐদিন কী দৃঢ়তার সাথেই না বলেছিলো মুনজেরিন ঠিক হয়ে যাবে । কিভাবে বলেছিলো?
মুনজেরিনের মন মানতে চাইছে না তবে কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে যে এসবের ভেতরে কুশলের হাত আছে আর ঐ মূর্তিটার হাত রয়েছে । কিন্তু কিভাবে ?
কোন উত্তর নেই । পরের সপ্তাহ থেকেই মুনজেরিন ক্যাম্পাসে যাওয়া শুরু করলো । ওকে পেয়ে সব ছাত্র ছাত্রী খুব খুশি হল । চেহারার লাবন্যও ফেরৎ এসেছে । ক্যাম্পাসে এসে সে কুশলের খোজ করলো কিন্তু সেদিনও কুশলের দেখা নেই । মনের ভেতরে কুশলের জন্য কেমন যেন করতে লাগলো । ছেলেটার কি হল কে জানে ! কোথায় ছেলেটা?

কুশলের দেখা পেল আরও এক সপ্তাহ পরে । কুশল নিজেই ওর অফিস রুমে এসে হাজির । কুশলকে দেখে কানিকটা অবাক হল । চেহারাটা কেমন যেন হয়েছে । চোখের নিচে কালী পড়ে গেছে । অনেক কয় রাত যেন ঘুমায় নি ।
-কোথায় ছিলে তুমি ?
-বাসায় গিয়েছিলাম !
-ফোন বন্ধ কেন? আজিব ! কটবার ফোন দিয়েছি । আর চেহারার এ কি হাল হয়েছে ! আমি যে একেবারে সুস্থ হয়ে গেছি তুমি তো একবারও এলে না !
কুশল বলল, আসলে ম্যাম….
মুনজেরিন হাসলো । তারপর বলল, ম্যাম?
কুশল হাসলো । বলল, আমি জানি । আমি তো বলেছিলামই যে ঐদিনের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে । সব ঠিক হয়ে গেছে !
-আমি এটাই জানতে চাই জানো । তুমি কী করেছো ?
-আমি বললে বিশ্বাস করবেন না ।
-তবুও বল শুনি ।
-এর থেকে ভাল যদি আমি আপনাকে দেখাই । এক জায়গায় যেতে হবে । যাবেন কি?
-চল । কাল তো ক্যাম্পাস বন্ধ । কাল চল!
-জি আচ্ছা !

তিন

মুনজেরিনকে দেখে এখন কেউ বলবে না ও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা । বিশেষ করে ওর চুল এখনও বেশ ছোট । সেই সাথে আজকে ও একটা জিন্স আর টিশার্ট পরেছে । ওকে দেখছে ফার্স্টইয়ারে পড়া মেয়ের মত দেখাচ্ছে । কুশল ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । একটু হেসে বলল, তোমাকে তো আমার থেকে ছোট মনে হচ্ছে ।
মুনজেরিনও হাসলো । কুশল ওকে আবারও তুমি করে বলছে । সম্ভবত গতকাল কাল ক্যাম্পাসে ছিল বলেই আপনি করে বলেছে । ম্যামকে কেউ তুমি করে বলবে ব্যাপারটা নিশ্চিত ভাবেই ভাল দেখাবে না ।

রেন্ট এ কার থেকে একটা আগে থেকেই ভাড়া হয়েছে । সেটাতে করেই ওরা রওয়ানা দিল । মুনজেরিন সত্যিই সত্যিই কুশলের প্রেমিকার মত আচরন করতে শুরু করেছে । কেন করেছে সেটা সে নিজেও জানে না । একটা সময়ে ছিল যে অনেক কিছু চিন্তা করে সে কাজ করতো । কখন কী করতে কার সাথে কেমন আচরন করতে, কোন কাজ করা যাবে না আরও কত কিছু । কিন্তু যখন ঐ মরন ব্যাধীটা ওকে ধরলো তখন মুনজেরিন বুঝতে পারলো যে আসলে জীবনে কোন কিছুই তেমন গুরুত্বপূর্ন না । মরনকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছে সে । এখন কেবল মনে হয় যে ওর মনে যা আসবে সেটা করতে ওর মন চাইবে বাকিটা জীবনে কেবল সে সেটাই করবে । কে কি ভাবলো সেটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবে না ।

এই যে কুশলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওর মা ব্যাপারটা মোটেও ভাল চোখে দেখে নি । যখন হাসপাতালে কুশল আসতো তখন রাবেয়া কিছু বলতো না কিন্তু এখন মুনজেরিন সুস্থ হয়ে গেছে । এখন ছাত্রের সাথে ঘুরে বেড়ানো কথা বলাটা সে মোটেও ভাল ভাবে নিচ্ছে না । গত রাতেও এটা নিয়ে মুনজেরিনের সাথে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে । মুনজেরিন পরিস্কার ভাবে বলে দিয়েছে যে তার সিদ্ধান্ত একান্তই তার নিজের । সকালে বের হওয়ার সময়ও রাবেয়া একটা কথাও বলে নি । গম্ভীর হয়ে ছিল ।

গারি ছুটে চলছে মানিকগঞ্জের দিকে । মুনজরিন এক মনে কথা বলেই চলেছে । পিকনিক পিকনিক একটা ভাব কাজ করছে । প্রায় ঘন্টা তিনেক পরে গাড়িটা এমন এক স্থান থামলো সেখান থেকে সামনে আর গাড়ি যাবে না । কুশল বলল, চল এবার হাটতে হবে !
ড্রাইভারকে বলল, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন । আমরা ঘন্টা খানেকের ভেতরে আবার ফেরৎ আসবো ।

তারপর দুজন হাটতে শুরু করলো ।

মুনজেরিন চারিদিকে দেখতে শুরু করলো । বেশ গাছ গাছালিতে ভর্তি । মানুষজন এখানে খুব একটা আসে না । পা চলা একটা পথ আসে বটে তবে সেটা বেশ সরু । দুই পাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি । এরই ভেতর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলছে । মুনজেরিনের কেমন যেন ভয় লাগছে শুরু করলো । কুশলের দিকে একটু সরে এল সে । তারপর খানিকটা দ্বিধা নিয়ে ওর হাত ধরলো । কুশল ওর দিকে একটু তাকিয়ে তারপর বলল, ভয় নেই । আমি আছি ।

আরও মিনিট দশেকের মত হাটার পরে ওর একটা স্থানে এসে হাজির হল । জায়গাতে আসতেই মুনজেরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । কারণ এই জায়গাটা ওর চেনা । এর আগেও এখানে এসেছে । পাশের দীঘিটাকে সে পরিস্কার চিনতে পারছে । আর …..

মুর্তিটার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠলো । একভাবে যেন মুনজেরিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । কুশলের দিকে আরও একটু সরে এল । কুশল বলল, জায়গা কি পরিচিত মনে হচ্ছে ?
-হুম ।

কুশল ওর হাতটা ধরে বলল, ভয় পেও না । ইনি কারো ক্ষতি করেন না । বরং উপকার করেন । তোমার অসুখ ইনি সারিয়েছেন ।
কুশল আরও কিছু সময় চুপ করে রইলো । একটা গাছের নিচে বসলো ওরা । তারপর কুশল বলতে শুরু করলো । এই দেবীর নাম মুঠক দেবী । প্রায় হাজার বছর আগে এখানে তার একটা মন্দির ছিল । কালের পরিক্রমাতে সেটা বিলিন হয়ে গেছে তবে তার মূর্তিটা এখনও ঠিক আগের মতই আছে ।
মুনজেরিন বলল, ইনি কিভাবে ……
-বলছি ! আসলে মুঠক দেবীর কাছে যা চাওয়া যায় সেটা সে পূরণ করে দেয় । কেবল শর্ত হচ্ছে যা চাইতে হবে সেটা একেবারে মন থেকে হওয়া লাগবে। এবং সেটার জন্য অন্য যে কোন কিছু দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে । আমি জানি একটু বুঝতে পারছো না । তোমাকে বুঝিয়ে বলি । ধর তোমার একটা ফোন পছন্দ হয়েছে । তুমি এখন ফোনটা কিনতে চাও । যেকোন ভাবেই কিনতে চাও । কিন্তু তোমার কাছে টাকা নেই । কিন্তু তোমার ফোনটা চাই ই চাই । সেটার জন্য তুমি যে কোন কিছু ছেড়ে দিতে রাজি আছো । তুমি তোমার পছন্দের ল্যাপটপ টা বিক্রি করে দিয়ে ফোন কিনলে ! এই রকম ভাবে একটা কিছু পেতে হলে আরেকটা ছেড়ে দিতে বে । এই জন্য এই দেবীকে মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে গেল । তার আরাধোনা করা বন্ধ করে দিল । কারণ যখনই তারা কিছু চাইতো, তার বদলে দেবী কিছু নিয়ে নিতো !

মুনজেরিন খেয়াল করলো কুশলের মুখটা কেমন যেন হয়ে গেছে । মুনজেরিন বলল, তুমি খুব চাইতে যেন আমি সুস্থ হয়ে যাই । রাইট ?
-হুম !
-তাহলে তোমার কাছ থেকে কি হারিয়েছে?
-থাক । সেটা শুনতে হবে না ।
-বল ! বলতে হবে ! আমি শুনবো !
-না শুনতে হবে না । আসলে আমি যখন এখানে আসি তখন আমি এই ব্যাপারটা জানতাম না । আমাকে যে বলেছিলো সে বলেছিলো সে কেবল মন থেকে চাইলেই হবে !

মুনজেরিন ওর হাত ধরলো । তারপর বলল, বল প্লিজ !
কুশল অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আমি ছোট বেলা থেকে আমার ছোট মামার বড় ভক্ত ছিলাম । আমাদের সাথে সে থাকতো । তুমি সেদিন সুস্থ হয়ে উঠলো সেদিন রাতে ছোট মামা হার্ট এটাকে মারা গেছেন । এই সময়টা আমি গ্রামে ছিলাম মামার বাড়ি !
মুনজেরিন মুখ ফুটে কিছু বলতে গেল । তাকে থামিয়ে দিয়ে কুশল বলল, না প্লিজ, নিজেকে কোন ভাবেই দোষী ভাববে না । যা ঘটেছে সেটার জন্য কেবল মাত্র আমি নিজে দায়ী । যে মুঠক দেবীর কাছে আবেদন করবে দায় তার । তোমার কোন ভাবেই না ।

চার
কুশলের অনার্স শেষ হওয়ার পরপরই মুনজেরিন ওকে বিয়ে করে ফেলল । দুই জনের বাসা থেকেই আপত্তি ছিল । বিশেষ করে মুনজেরিনের মা তো মোটেই রাজি ছিল না । তবে সবার বাঁধা আপত্তি উপেক্ষা করে ওরা বিয়ে করে ফেলল । ক্যাম্পাসে এই বিষয়টা কয়েকদিন মুখোরোচক আলোচনা ছিল বটে কিন্তু মুনজেরিন এসবের কিছুই গায়ে মাখলো না । চুটিয়ে সংসার শুরু করে দিলো ।

সময় গুলো এগিয়ে যেতে শুরু করলো আপন গতিতে । মুনজেরিনের মনের মাঝে একটা ভয় ছিল যে হয়তো আবেগের বসে নিজের থেকে কম বয়সী ছেলেকে বিয়ে করাটা ঠিক হয় নি, হয়তো কদিন পরে দুজনের এই আবেগই শেষ হয়ে যাবে কিন্তু বিয়ের চার বছর পরেও দুজনের মাঝে কোন পরিবর্তন হল না । ততদিনে কুশলও চাকরিতে ঢুকে পড়েছে । ওরা একেবারে পার্ফেক্ট একটা কাপলে পরিনত হল । আর মুনজেরিনের চেহারার কারণে কোন ভাবেই ওদের বয়সের পার্থক্যের ব্যাপারটা বোঝার উপায় ছিল না যদি না আগে থেকে কেউ না জানতো । সুখেই দিন কেটে যাচ্ছিলো ওদের ।

ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনা ঘটলো । অফিস থেকে ফেরার পথে মুশক খুব বাজে ভাবে দুর্ঘনার শিকার হল । মুনজেরিন যখন হাসপাতালে পৌছালো তখন কুশল কোমাতে চলে গেছে । মাথায় খুব প্রবল ভাবে আঘাত পেয়েছে ।
সব পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষ করে ডাক্তােরে বলা চলে হাল ছেড়েই দিল । মুনজেরিনকে জানিয়ে দিল যে কুশলের আসলে ঠিক হওয়ার কোন আশা নেই । কোমা থেকে সে আদৌও ফিরবে কিনা এর কোন গ্যারান্টি নেই । একটা সপ্তাহ কিভাবে পার হলে মুনজেরিন জানেও না । পুরোটা সময় ও কেবল কুশলের কেবিনের বাইরের দরজা দিকেই তাকিয়ে রইলো । কত মানুষ এল গেল কিন্তু মুনজেরিন নড়লো না ।

একদিন মুনজেরিনের মা মুনজেরিনকে প্রায় জোর করেই বাসায় নিয়ে এল । ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দেওয়ার সময় বলতে লাগলো যে তুই যেভাবে ঠিক হয়েছিলো এইবারও যদি এমন কোন মিরাকেল ঘটতো !

কথা শোনার সাথে সাথে মুনজেরিন মায়ের দিকে ফিরে তাকালো । সাথে সাথেই ওর কিছু মনে পড়ে গেল । সাথে সাথে এও জেনে গেল যে কিভাবে সে কুশলকে রক্ষা করবে ।

পরদিন খুব সকালে গাড়ি নিয়ে নিজেই বের হয়ে গেল কাউকে কিছু না জানিয়ে । জায়গাটা সে চিনতে পারবে কিনা সেটা সে নিজেও জানে না । তবে তাকে খুজে বের করতেই হবে । মানিকগঞ্জ থেকে ভেতরে ঢুকে সেই বন জঙ্গলে ভরা জায়গাতে আসতে একটু বেশি সময়ই লাগলো । যত জনের কাছে জায়গার কথা জিজ্ঞেস করেছে সবাই কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছে । অনেকে কথাই বলতে চায় নি । তবে একজন বৃদ্ধ লোক ওকে সাহায্য করলো । ওর গাড়িতে করেই নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে এল ।
গাড়ি থেকে নেমে বদ্ধ লোক বলল, মা এরপর তোমার একলাইই যাইতে হইবো ।
-জি চাচা । আমি বাকি টুকু চিনে যেতে পারবো ।
-তুমি তো জানো কী করতে যাইতাছো?
-জানি চাচা ।
-হেই কিন্তু নিজের পাওনা ঠিকই নিয়া নিবো । যা চাইবা সাবধানে চাইয়ো !
-জানি চাচা । ওর জন্য যে কোন কিছু ছাড়তে রাজি !

আর পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলো সে । এক সময়ে সেই মুঠক দেবীর কাছে পৌছেও গেল । ঠিক আগের মতই রয়েছে সেটা । ওর দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে রয়েছে ।
কুশল বলেছিলো বাড়তি কোন নিয়ম কানুন নেই । কেবল সামনে বসতে হবে হাত জোর করে । তারপর নিজের ইচ্ছের কথা দেবীকে জানাতে হবে । সাহায্য চাইতে হবে ।

চোখ বন্ধ করে একভাবে কুশলকে চাইলো সে । একেবারে আগের মত করে ! নিজের মন থেকে চাইলো । জীবনের সব কিছুর বিনিময়ে সে কুশলকে আবারও নিজের জীবনে ফেরৎ চাইলো ।
যখন আবারও সে ফিরে আসছে তখন মনের ভেতরে একটা ভয় জড় হয়ে শুরু করেছে । একটু আগে সে কুশলের বিনিময়ে সব কিছু দিয়ে রাজি হয়ে এসেছে । যদি এমন হয় তার বাবা মায়ের কারো কিছু হয়ে যায়? তখন?
কুশল সেদিনের এমন ভাবেই রাজি হয়েছিলো । তার কাছের একজন মানুষ মারা গিয়েছিলো । আজকে যদি ওর খুব কাছের মানুষ মারা যায় ? তখন?
গাড়ির কাছে আসতেই সেই বৃদ্ধলোককে দেখলো অপেক্ষা করতে । তার মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে আছে । সে জানে মুনজেরিন কী করে এসেছে । মুনজেরিনের নিজেরও খানিকটা ভয় করতে শুরু করলো । না জানি কী হবে! কী হারাবে?

গাড়িতে উঠতে না উঠতেই ওর ফোন বেজে উঠলো ।
মায়ের ফোন!
বুকটা ধক করে উঠলো । তাহলে কি আগেই দুঃসংবাদ চলে এল?
কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরলো সে ।
-হ্যালো ।
-কোথায় তুই?
-এই তো । কেন?
-আরে কুশলের জ্ঞান ফিরেছে ।
-সত্যি?
-হ্যা । ডাক্তারেরা বেশ অবাক হয়েছে । ওরা আবার পরীক্ষা শুরু করেছে ।
-তুমি ঠিক আছো মা?
-হ্যা । কেন ? এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
-না এমনি । আব্বু ঠিক আছে?
-হ্যা আমরা সবাই ঠিক আছি । তুই জলদি আয় !
-আসছি ।

কুশলের ঠিক হতে আরও মাস খানেক লেগে গেল । তবে সে একদম সুস্থ হয়ে উঠলো ধীরে । তবে যেটা জিনিস মুনজেরিন অনুভব করলো মুঠক দেবী তার কাছ থেকে কিছুই নিয়ে যায় নি । এমন তো হওয়ার কথা না । কিছু না কিছু সে নেবেই এমনটাই জানতো । তাহলে কি নেয় নি? ওর প্রতি দয়াশীল হয়েছে?
কিন্তু কেন?
কুশলকে সে মুঠক দেবীর কথা বলেছে । কথাটা শুে কুশল খুব বেশি খুশী হয় নি । তবে যখন কয়েক মাস যাওয়ার পরেও কিছু ঘটে নি তখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে । সেও ধরে নিয়েছে যে মুঠক দেবী হয়তো দয়াই দেখিয়েছে ।

পরিশিষ্টঃ

ডাক্তারি রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে মুনজেরিন অনেক টা সময় চুপ করে বসে রইলো । ডাক্তারকে কী বলবে সেটা সে নিজেও জানে না । কুশল চুপচাপ মুনজেরিনের হাত ধরে ওকে কেবিন থেকে বাইরে নিয়ে এল ।
আজকে বুঝতে পেরেছে মুঠক দেবী সেদিন ওর কাছ থেক কী নিয়ে গিয়েছিলো ।
মুনজেরিন কোন দিন মা হতে পারবে না । এই মা হওয়ার ক্ষমতাটাই মুঠক দেবী সেদিক কেড়ে নিয়েছিলো কুশলের জীবনের বিনিময়ে । মুনজেরিনের খুব ভাল করেই মনে আছে কুশলের দুর্ঘটনার কয়েক দিন আগেই ওরা ঠিক করেছিলো একটা বা্চ্চা নেবে । ওদের সংসারে একটা বা্চ্চা হলেই সব দিক দিয়ে পরিপুর্নতা পাবে । কী তীব্র ভাবে মুনজেরিন মা হতে চাইতো । কী এক আকাঙ্খা ! কুশলকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্খার মতই তীব্র !

ফেয়ার ডিল ! মুঠক দেবী ঠিকই তার পাওনা নিয়ে গেছে !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 53

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →