জেরিন চোখ মেলে তাকালো । প্রথমে কিছু সময়ে ঠিক বুঝতে পারলো না সে কোথায় রয়েছে । তবে সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ড । সাথে সাথেই মনে পড়লো সব । মনের ভেতরে একটা চাঞ্চল্য জেগে উঠলো । বিছানার বাঁ দিকে ফিরে তাকাতেই তার শাশুড়িকে বসে থাকতে দেখলো ।
জেরিন বলল, আম্মু !
জেরিনের ডাক শুনেই তার শাশুড়ি দ্রুত উঠে এল বেডের কাছে । বলল, এই উঠো না । চুপ চাপ শুয়ে থাকো । তোমাকে একটু আগে কেবিনে দিয়েছে । এখন একদম নড়াচড়া করা যাবে না ।
জেরিন বলল, আপনার ছেলে কোথায়?
সেই কথা যেন তিনি শুনতেই পান নি । তিনি এক মনেই বলে চলেছে, তোমার এপেনডিক্সটা কেটে বাদ দিতে হয়েছে । তোমার যে এতো খারাপ অবস্থা আগে থেকে আমরা কেউ টের পাই নি ।
জেরিন আবার বলল, আপনার ছেলে কোথায়?
এবার শুনতে পেলেন । বললেন, আছে পাসের ঘরে । পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে ।
কথাটা শুনতেই জেরিন বলল, আমি দেখবো ওকে ।
-এখন কোন ভাবেই নড়া চড়া করা যাবে না । চুপচাপ শুয়ে থাকো। সময় হলে দেখবে।
জেরিনের শাশুড়ি দেখতে পেল জেরিনের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে । তিনি পাশে বসে যত্ন সহকারে সেই পানি মুছে দিলেন । তারপর বললেন, ওর কিছু হয় নি । সামান্য মোচড় গেলেছে । কাল রাতে যা ভয় পেয়েছিলাম আমি !
জেরিন জানে কি হয়েছিলো কাল রাতে । খুব ভাল করেই জানে । সন্ধ্যা থেকে কালকে বৃষ্টি শুরু হয় । রাত বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে বৃষ্টির বেগ । তারপর শুরু হয় ঝড় । গাছ পড়ে সব রাস্তা বন্ধ । রাত এগারোটার দিকে জেরিনের হঠাৎ পেট ব্যাথা শুরু হয় । এতো তীব্র যে কোন ভাবেই সেটা সহ্য করতে পারছিলো । তখনই ঠিক হল ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।কিন্তু ঐ ঝড় বৃষ্টির রাতে জেরিনকে কিভাবে হাসপাতালে নেওয়া হবে সেটা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা দেখা গেল !
জাহিদ আর জেরিন সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দুরে থাকে । একে তো পাহাড়ি রাস্তা তার উপরের ঝড়বৃষ্টি । কোন ভাবেই কোন যান বাহনের ব্যবস্থা করা গেল না । এদিকে জেরিনের অবস্থা ক্ষণে ক্ষণে খারাপ হচ্ছে । জেরিন কিছুতেই ব্যাথা সহ্য করতে পারছিলো না । তখনই জাহিদ একটা অসম্ভব কাজ করলো । জেরিনকে প্রথমে রেইন কোর্ট পরালো । তারপর ওর মুখের উপর একটা পাতলা বড় পলিথিন দিলো যাতে মুখে বৃষ্টি না পড়ে । তারপর ওকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির ভেতরে বের হয়ে গেল । জেরিনকে এই দশ কিলোমিটারের পাহাড়ি পথ কিভাবে সে কোলে করে নিয়ে দৌড়েছে সেটা জাহিদ নিজেও জানে না । কেবল সে দৌড়েছে !
জেরিনকে নিয়ে হাসপাতালে পৌছেছে তখন জেরিন কেবম ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে ছিল । ভাগ্যভাল যে ডাক্তারদের কোয়াটার সব হাসপাতাল সংলগ্ন। তাই ডাক্তার পেতে খুব একটা সমস্যা হল না । জেরিনকে পরীক্ষা করেই ডাক্তার বলে দিল যে এপেন্ডিক্স । প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঠিক হল যে সকালেই অপারেশন করা হবে ।
জেরিন তার শাশুড়িকে বলল, আম্মু জানেন কাল যখন আপনার ছেলে আমাকে কোলে করে নিয়ে দৌড়াচ্ছিলো তখন বিড়বিড় করে কী বলছিলো ?
-কী?
-বারবার উপরওয়ালার কাছে দোয়া করছিলো আমার জন্য । আমার পুরো জীবনে আমার জন্য কেউ এভাবে এতো তীব্র ভাবে দোয়া চায় নি । যখন বিদ্যুৎ চমকে উঠছিলো তখন পলিথিনের ভেতর দিয়ে আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম । তার চোখের পানিটা স্পষ্ট আলাদা করে আমার চোখে ধরা পড়ছিলো । তখনই আমার ব্যাথা বেদনা সব কেমন করে যেন গায়েব হয়ে গেল । আমি আর কোন ব্যাথা অনুভব করি নি । কেবল ঐ চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম !
রায়েয়া খাতুন দেখলেন তার ছেলের বউ আবারও কাঁদতে শুরু করেছে । তবে এটা কোন কষ্টের কান্না না । আনন্দের কান্না । মানুষ কাছের মানুষকে চিনতে পারে তার বিপদের সময়ে । মানুষ নিজের ভালোবাসার মানুষের বিপদে অসাধ্য সাধন করে ফেলে । জাহিদও তাই করেছে । নয়তো স্বাভাবিক সময়ে এই কাজটা করা অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিল ।
রাবেয়া খাতুন আবারও ছেলের বউয়ের চোখের জল মুছে দিলেন । তারপর বললেন, সব বিপদ কেটে গেছে । এখন আর কোন চিন্তা নেই । তুমি একটু ঘুমাও । বাবুও ঘুমাচ্ছে । ও জেগে উঠলেই নিয়ে আসবো তোমার কাছে ।
তারপর জেরিনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন । জেরিন আস্তে আস্তে আবার ঘুমিয়ে পড়লো ।