একটা সময়ে রিমি ভুতের গল্প খুব পছন্দ করতো । বিশেষ করে রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে ভুতের গল্পের বই পড়তে বেশ মজা লাগতো । কিন্তু বিয়ের পর থেকে সেই অভ্যাসটা একেবারে বাদ দিতে হয়েছে । বিয়ের আগে যখন পুরোটা সময় বাসায় থাকতো, সব সময় ঘরে কেউ না কেউ থাকতোই ওর সাথে । ছোট ভাই ছিল, নয়তো মা থাকতো পাশে । বাসায় একলা হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না । কিন্তু বিয়ের পর থেকে ব্যাপারটা আর আগের মত থাকে নি । শিহাব অফিসের পর সোজা বাসায় চলে আসলেও দিনের একটা বড় সময় ওকে বাসায় থাকতে হয় একেবারে একা । কাজের লোক কাজ করে দিয়ে চলে যায় । মাঝে মাঝে এমন নির্জন হয়ে যায় বাসাটা যে মনে হয় যেন এই দুনিয়াতে সে কেবল একাই রয়েছে । তখন ভুতের গল্প গুলো একে একে মনে হতে থাকে । তাই ভুতের গল্প একেবারে পড়া বাদ দিয়ে দিয়েছে ।
শিহাব চাকরি বদল করে চলে এসেছে চট্টগ্রাম । নতুন বাসায় উঠে, সব কিছু গুছাতে গুছাতেই সপ্তাহ খানেক সময় পার হয়ে গেল । সাহায্যের জন্য রিমির ফুপুশ্বাশুড়ি আর দেবর এসেছিল সাথে। তবে তারা কাজ কর্ম শেষ করে চলে গেছে । এখন বাসায় বলতে গেলে তারা দুইজন । শিহাব দিনের বেশির ভাগ সময়েই থাকে অফিসে । আসতে আসতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায় । বেলা এগারোটার দিকে একজন কাজের মহিলা আসে । সে দুপুরের পরে চলে যায় । বলা যায় দুপুরের পর থেকে শিহাব আসা পর্যন্ত রিমি একেবারে একা ।
রিমিদের বাসাটা দুই তলা । নিচ তলাতে আরও এক ভাড়াটিয়া থাকে সে শুনেছি তবে এখনই তাদের কারো সাথে দেখা হয় নি । মুল রাস্তা থেকে বাসা টা একটু ভেতরে চলে এসেছে । বলতে গেলে আশে পাশে আর কোন বাসা নেই । দুই পাশে ফসলের মাঠ । এক পাশে রাস্তা আর অন্য পাশে একটা ডোবা বড় পুকুরের মত রয়েছে । ব্যাস এই হচ্ছে নতুন পরিবেশ । কত ভেবেছিলো যে চট্টগ্রাম যাচ্ছে টিলার উপরে বাসা নেবে কিন্তু কোথায় কি ! এই দৃশ্য রিমির পরিচিত । বিয়ের আগেও এই রকম ফসলের মাঠ দেখা যেত বাসার জানালা থেকে । এমন নি বিয়ের পর যখন ওরা সাভারে থাকতো তখনও পরিবেশটা এমনই ছিল ।
আজকে সন্ধ্যা হতেই রিমি শিহাবের জন্য এক কাপ কফি বানালো । নিজের জন্যও । কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো শিহাব যেন একটু দেরি করছে । ফোন দিতে গিয়েও দিল না । চাইলেই তো প্রতিদিন সময় মত অফিস থেকে বের হওয়া যায় না । শিহাবের কাফি টুকু ফ্লাক্সে ঢেকে রেখে রিমি নিজের কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলো । সুন্দর বাতাস দিচ্ছে । কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে ।
এই সময়ে টুপ করে বিদ্যুৎ চলে গেল । পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে গেল । রিমির মনে হল একবার উঠে গিয়ে আলো জ্বালাক কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল থাকি কিছু সময় অন্ধকারে । নিজের কাছে ফোন রয়েছে সেটার ফ্লাশ লাইট জানালো যাবে যখন ইচ্ছে । এছাড়া ডাইনিংয়ের উপরেই চার্জার লাইট রাখা রয়েছে । রিমি চুপচা বসেই রইলো । একভাবে তাকিয়ে রইলো সামনের ফসলের মাঠের দিকে ।
দিনের বেলাতে ফসলের মাঠে কিছু মানুষকে দেখেছে কাজ করতে । অবশ্য সন্ধ্যা হতেই সবাই মাঠ ছেড়ে চলে যায় । মাঠের ঠিক মাঝে একটা ছোট কুড়ে ঘরের মত আছে । সেদিকেই চোখ গেল ওর । রিমি একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছে যে তীব্র রোদ থাকলেও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কেউ ঐ কুড়ে ঘরটার কাছে যায় না । অথচ কুড়েটা বিশ্রামের জন্যই বানানো হয়েছে । কেন যায় না কে জানে ! সেদিকেই তাকিয়ে রইলো একভাবে । আর আস্তে আস্তে নিজের মগে চুমুক দিতে দিতে থাকলো । ঠিক তখনই অসংগতিটা লক্ষ্য করলো সে !
কুড়েঘরটার কাছে একটা বড় গাছ দেখা যাচ্ছে । গাছটার নিচেই ঘরটা । আবছায়া আলোতে গাছটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । কিন্তু রিমির স্পষ্ট মনে আছে যে কুড়ে ঘরের আশে পাশে কোন গাছ ছিল না । কেবল কুড়ের আশে পাশে কেন পুরো মাঠেই কোন বড় গাছ ছিল না ! নাকি ছিল?
নিজের মনেই কেমন যেন একটু সংঙ্কিত বোধ করলো ও । কেন করলো সেটা ও নিজেই জানে না । এই কদিনে বেশ কাজের চাপ গেছে যদিও বিকেলটা সে কোন কাজ করতো না । কয়েকবার ছাদে গিয়েছে । সেখান থেকেও মাঠটা দেখা যায় পরিস্কার !
তখন কোন গাছ দেখেছে বলে মনে পড়ছে না । তাহলে গাছ কিভাবে এল?
এমন যখন চিন্তা করছে তখনই আরও একটু অবাক করা ঘটনা দেখতে পেল ও । দেখলো কুড়ে ঘরের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এল । একটা ছেলে । সন্ধ্যার অন্ধকারেও ছেলেটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে । ছেলেটার হাতে দড়ির একটা গোছা ! রিমির যেন দম বন্ধ হয়ে এল । কেন সেটা ও নিজেও জানে না । ওকে আরও একটু অবাক করে দিয়ে ছেলেটা গাছে উঠতে শুরু করলো । তারপর রিমির চোখের সামনেই দেখতে পেল যে ছেলেটা গাছের একটা ডালের সাথে দড়িটা বাঁধছে । রিমি জানে কি করতে যাচ্ছে ছেলেটা । রিমির এখন কি করা দরকার ?
চিৎকার করবে ?
ছেলেটাকে থামাবে?
বেশ দুরে ! আশে পাশে কোন বাড়িও নেই যে ওর চিৎকার কেউ শুনতে পাবে ! আর ও কি নিজে দৌড়িয়ে সেখানে যেতে পারবে ?
রিমি যেন নড়তে ভুলে গেল ! একভাবে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে । কি হতে যাচ্ছে সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছে সে । ছেলেটা গলাতে ফাঁস নিতে যাচ্ছে ।
নিও না । প্লিজ নিও না ।
ছেলেটা লাফ দেওয়ার আগ মুহুর্তে রিমির বারান্দার দিকে ফিরে তাকালো । অন্ধকারে ছেলেটার চোখ দেখা গেল না । রিমি নিজেও জানে তার বারান্দা অন্ধকার হয়ে আছে । ছেলেটা ওকে দেখতে পাবে না । কিন্তু রিমির গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো । সে পরিস্কার বুঝতে পারলো যে ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং সে খুব ভাল করেই জানে যে রিমি ওখানে রয়েছে । তারপরই সে ডাল থেকে ঝাপ দিল ।
রিমি সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো !
-এই রিমি এই রিমি !
রিমি তখনও চিৎকার করেই যাচ্ছে । রিমি চোখ খুলে দেখে শিহাব ওর পাশে বসে ওকে ধরে আছে । রিমি শিহাবকে দেখেই একটু স্বস্তি পেল । সাথে সাথে অবাক হল এই দেখে যে ও নিজের বিছানায় । বারান্দার দিকে ফিরে তাকালো । চারিদিকে আলো জ্বলছে । বিদ্যুৎ চলে এসেছে !
ও কি তাহলে এতো সময়ে স্বপ্ন দেখছিলো?
বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর কি তাহলে সে বারান্দায় বসে নি। বিছানায় এসে শুয়েছিলো । তখনই ঘুম চলে এসেছে । আর ঐ স্বপ্ন দেখেছে ।
শিহাব আবার জানতে চাইলো, এই ভর সন্ধ্যায় কেউ শুয়ে থাকে? দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?
রিমি কোন কথা না বলে উঠে দাড়ালো । তারপর আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো । ভয়ে ভয়ে তাকালো মাঠের দিকে । অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না । চলে আসতে যাবে তখনই এক পাশে কফি মগটার দিকে চোখ গেল । তলানীতে কফি পরে আছে ! তার মানে কফি যে এখানে বসে খেয়েছিলো সেটা সত্য । নয়তো কফি এখানে পড়ে থাকতো না কিছুতেই ।
রিমি আর কিছু ভাবতে পারছে না । তবে অনুভব করলো বুকের ভেতরের ভয়টা কমে এসেছে । শিহাব সামনে রয়েছে বলেই হয়তো । শিহাব আবারও বলল, এমন করে তাকিয়ে আছো কেন শুনি? কি হয়েছে?
-কিছু না ।
-আমি গোসলে ঢুকি । তুমি কি আমার জন্য একটু কফি বানাতে পারবে?
-বানানো আছে । ফ্ল্যাক্সে !
-ওকে গোসলে যাচ্ছি ।
শিহাব চলে গেল ওয়াশরুমে। রিমি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ওর দেহের ভেতরে একটা আন্দোলন খেলে গেল । ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । বুয়া চলে যাওয়ার পর আর বাইরে যাওয়া হয় নি । ও ছিটকানি দিয়ে আটকেছিলো । ভেতর থেকে কেউ না খুলে দিলে কিছুতেই ঢোকা সম্ভব না। তাহলে শিহাব কিভাবে ঢুকলো ভেতরে !
চোখ বড় বড় করে সে তাকালো ওয়াশরুমের দিকে । ভেতর থেকে পানি পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । গুনগুন করে গান গাওয়ার আওয়াজাও শোনা যাচ্ছে । রিমি আর ভাবতে পারছে না । বুকের ভেতরে কাঁপছে । রিমি দৌড়ে গেল দরজার দিকে । নিচ তলার ভাড়াটিয়ার কাছে যেতে হবে । এখানে থাকা যাবে না ।
যখন দরজার ছিটকানি খুলে বাইরে পা বাড়াবে তখনই দেখতে পেল শিহাব সিড়ি দিয়ে উঠছে উপরে । ওর দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে । দ্রুত এগিয়ে এসে ধরলো ওকে । রিমি কোন কথা না বলে কেবল শিহাবকে জড়িয়ে ধরে থাকলো । কত সময়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো সেটা নিজেও জানে না । এক সময়ে মনে হল যে যে ভেতরে ঢুকেছিলো শিহাবের চেহারা নিয়ে সে এখনও রয়েছে ভেতরে ।
শিহাবকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো । তারপর ভয়ে ভয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো । ওয়াশরুমের ফ্লোর ভেজা । গোসল করলে যেমন ভেজা থাকে তেমন ভেজা । রিমি কোন কথা না বলে বিছানাতে বসে পড়লো । ওর মনের ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে । শিহাব ওর পাশে বসতে বসতে বলল, ভয় পেয়েছো?
-হুম ।
-একা একা রয়েছো তো এই জন্য । কাল থেকে আরও আগে আসার চেষ্টা করবো । আর বুয়াকে বলে দিবো যাতে আমি না আসা পর্যন্ত থাকে এখানে । ওকে ?
-আচ্ছা ।
-এখন কি কফি খাবে একটু ? বানাবো?
রিমি বলল, না থাকুক আমি খেয়েছি । তোমার জন্য বানিয়ে রেখেছি ঐ ফ্ল্যাক্সে ।
শিহাব উঠে গিয়ে ফ্ল্যাক্সে নিয়ে এল । ভেতরে উকি দিয়ে দেখলো সেখানে কোন কফি নেই । তখনই রিমির চোখ গেল টিটেবিলের উপর । সেখানে একটা কাপ দেখা যাচ্ছে । ওর নিজের কাপ না । এটা দিয়ে শিহাব কফি খায়।
এই কফির মগ এখানে কেন !!
রিমির শরীরটা আরেকবার কেঁপে উঠলো । কেউ যে এসেছিলো কোন সন্দেহ নেই । শিহাবের রূপ ধরে । গোসল করেছে ওয়াশরুমে তারপর কফিও খেয়েছে ।
রিমি মনে মনে ঠিক করে নিল আর একা একা থাকা যাবে না কোন ভাবেই । কোন ভাবেই থাকবে না একা এই বাড়িতে !
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.