এক কাপ কফি

oputanvir
4.8
(45)

একটা সময়ে রিমি ভুতের গল্প খুব পছন্দ করতো । বিশেষ করে রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে ভুতের গল্পের বই পড়তে বেশ মজা লাগতো । কিন্তু বিয়ের পর থেকে সেই অভ্যাসটা একেবারে বাদ দিতে হয়েছে । বিয়ের আগে যখন পুরোটা সময় বাসায় থাকতো, সব সময় ঘরে কেউ না কেউ থাকতোই ওর সাথে । ছোট ভাই ছিল, নয়তো মা থাকতো পাশে । বাসায় একলা হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না । কিন্তু বিয়ের পর থেকে ব্যাপারটা আর আগের মত থাকে নি । শিহাব অফিসের পর সোজা বাসায় চলে আসলেও দিনের একটা বড় সময় ওকে বাসায় থাকতে হয় একেবারে একা । কাজের লোক কাজ করে দিয়ে চলে যায় । মাঝে মাঝে এমন নির্জন হয়ে যায় বাসাটা যে মনে হয় যেন এই দুনিয়াতে সে কেবল একাই রয়েছে । তখন ভুতের গল্প গুলো একে একে মনে হতে থাকে । তাই ভুতের গল্প একেবারে পড়া বাদ দিয়ে দিয়েছে ।

শিহাব চাকরি বদল করে চলে এসেছে চট্টগ্রাম । নতুন বাসায় উঠে, সব কিছু গুছাতে গুছাতেই সপ্তাহ খানেক সময় পার হয়ে গেল । সাহায্যের জন্য রিমির ফুপুশ্বাশুড়ি আর দেবর এসেছিল সাথে। তবে তারা কাজ কর্ম শেষ করে চলে গেছে । এখন বাসায় বলতে গেলে তারা দুইজন । শিহাব দিনের বেশির ভাগ সময়েই থাকে অফিসে । আসতে আসতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায় । বেলা এগারোটার দিকে একজন কাজের মহিলা আসে । সে দুপুরের পরে চলে যায় । বলা যায় দুপুরের পর থেকে শিহাব আসা পর্যন্ত রিমি একেবারে একা ।

রিমিদের বাসাটা দুই তলা । নিচ তলাতে আরও এক ভাড়াটিয়া থাকে সে শুনেছি তবে এখনই তাদের কারো সাথে দেখা হয় নি । মুল রাস্তা থেকে বাসা টা একটু ভেতরে চলে এসেছে । বলতে গেলে আশে পাশে আর কোন বাসা নেই । দুই পাশে ফসলের মাঠ । এক পাশে রাস্তা আর অন্য পাশে একটা ডোবা বড় পুকুরের মত রয়েছে । ব্যাস এই হচ্ছে নতুন পরিবেশ । কত ভেবেছিলো যে চট্টগ্রাম যাচ্ছে টিলার উপরে বাসা নেবে কিন্তু কোথায় কি ! এই দৃশ্য রিমির পরিচিত । বিয়ের আগেও এই রকম ফসলের মাঠ দেখা যেত বাসার জানালা থেকে । এমন নি বিয়ের পর যখন ওরা সাভারে থাকতো তখনও পরিবেশটা এমনই ছিল ।

আজকে সন্ধ্যা হতেই রিমি শিহাবের জন্য এক কাপ কফি বানালো । নিজের জন্যও । কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো শিহাব যেন একটু দেরি করছে । ফোন দিতে গিয়েও দিল না । চাইলেই তো প্রতিদিন সময় মত অফিস থেকে বের হওয়া যায় না । শিহাবের কাফি টুকু ফ্লাক্সে ঢেকে রেখে রিমি নিজের কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলো । সুন্দর বাতাস দিচ্ছে । কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে ।

এই সময়ে টুপ করে বিদ্যুৎ চলে গেল । পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে গেল । রিমির মনে হল একবার উঠে গিয়ে আলো জ্বালাক কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল থাকি কিছু সময় অন্ধকারে । নিজের কাছে ফোন রয়েছে সেটার ফ্লাশ লাইট জানালো যাবে যখন ইচ্ছে । এছাড়া ডাইনিংয়ের উপরেই চার্জার লাইট রাখা রয়েছে । রিমি চুপচা বসেই রইলো । একভাবে তাকিয়ে রইলো সামনের ফসলের মাঠের দিকে ।

দিনের বেলাতে ফসলের মাঠে কিছু মানুষকে দেখেছে কাজ করতে । অবশ্য সন্ধ্যা হতেই সবাই মাঠ ছেড়ে চলে যায় । মাঠের ঠিক মাঝে একটা ছোট কুড়ে ঘরের মত আছে । সেদিকেই চোখ গেল ওর । রিমি একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছে যে তীব্র রোদ থাকলেও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কেউ ঐ কুড়ে ঘরটার কাছে যায় না । অথচ কুড়েটা বিশ্রামের জন্যই বানানো হয়েছে । কেন যায় না কে জানে ! সেদিকেই তাকিয়ে রইলো একভাবে । আর আস্তে আস্তে নিজের মগে চুমুক দিতে দিতে থাকলো । ঠিক তখনই অসংগতিটা লক্ষ্য করলো সে !

কুড়েঘরটার কাছে একটা বড় গাছ দেখা যাচ্ছে । গাছটার নিচেই ঘরটা । আবছায়া আলোতে গাছটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । কিন্তু রিমির স্পষ্ট মনে আছে যে কুড়ে ঘরের আশে পাশে কোন গাছ ছিল না । কেবল কুড়ের আশে পাশে কেন পুরো মাঠেই কোন বড় গাছ ছিল না ! নাকি ছিল?

নিজের মনেই কেমন যেন একটু সংঙ্কিত বোধ করলো ও । কেন করলো সেটা ও নিজেই জানে না । এই কদিনে বেশ কাজের চাপ গেছে যদিও বিকেলটা সে কোন কাজ করতো না । কয়েকবার ছাদে গিয়েছে । সেখান থেকেও মাঠটা দেখা যায় পরিস্কার !
তখন কোন গাছ দেখেছে বলে মনে পড়ছে না । তাহলে গাছ কিভাবে এল?

এমন যখন চিন্তা করছে তখনই আরও একটু অবাক করা ঘটনা দেখতে পেল ও । দেখলো কুড়ে ঘরের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এল । একটা ছেলে । সন্ধ্যার অন্ধকারেও ছেলেটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে । ছেলেটার হাতে দড়ির একটা গোছা ! রিমির যেন দম বন্ধ হয়ে এল । কেন সেটা ও নিজেও জানে না । ওকে আরও একটু অবাক করে দিয়ে ছেলেটা গাছে উঠতে শুরু করলো । তারপর রিমির চোখের সামনেই দেখতে পেল যে ছেলেটা গাছের একটা ডালের সাথে দড়িটা বাঁধছে । রিমি জানে কি করতে যাচ্ছে ছেলেটা । রিমির এখন কি করা দরকার ?
চিৎকার করবে ?
ছেলেটাকে থামাবে?
বেশ দুরে ! আশে পাশে কোন বাড়িও নেই যে ওর চিৎকার কেউ শুনতে পাবে ! আর ও কি নিজে দৌড়িয়ে সেখানে যেতে পারবে ?
রিমি যেন নড়তে ভুলে গেল ! একভাবে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে । কি হতে যাচ্ছে সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছে সে । ছেলেটা গলাতে ফাঁস নিতে যাচ্ছে ।
নিও না । প্লিজ নিও না ।
ছেলেটা লাফ দেওয়ার আগ মুহুর্তে রিমির বারান্দার দিকে ফিরে তাকালো । অন্ধকারে ছেলেটার চোখ দেখা গেল না । রিমি নিজেও জানে তার বারান্দা অন্ধকার হয়ে আছে । ছেলেটা ওকে দেখতে পাবে না । কিন্তু রিমির গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো । সে পরিস্কার বুঝতে পারলো যে ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং সে খুব ভাল করেই জানে যে রিমি ওখানে রয়েছে । তারপরই সে ডাল থেকে ঝাপ দিল ।
রিমি সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো !

-এই রিমি এই রিমি !

রিমি তখনও চিৎকার করেই যাচ্ছে । রিমি চোখ খুলে দেখে শিহাব ওর পাশে বসে ওকে ধরে আছে । রিমি শিহাবকে দেখেই একটু স্বস্তি পেল । সাথে সাথে অবাক হল এই দেখে যে ও নিজের বিছানায় । বারান্দার দিকে ফিরে তাকালো । চারিদিকে আলো জ্বলছে । বিদ্যুৎ চলে এসেছে !
ও কি তাহলে এতো সময়ে স্বপ্ন দেখছিলো?
বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর কি তাহলে সে বারান্দায় বসে নি। বিছানায় এসে শুয়েছিলো । তখনই ঘুম চলে এসেছে । আর ঐ স্বপ্ন দেখেছে ।
শিহাব আবার জানতে চাইলো, এই ভর সন্ধ্যায় কেউ শুয়ে থাকে? দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?
রিমি কোন কথা না বলে উঠে দাড়ালো । তারপর আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো । ভয়ে ভয়ে তাকালো মাঠের দিকে । অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না । চলে আসতে যাবে তখনই এক পাশে কফি মগটার দিকে চোখ গেল । তলানীতে কফি পরে আছে ! তার মানে কফি যে এখানে বসে খেয়েছিলো সেটা সত্য । নয়তো কফি এখানে পড়ে থাকতো না কিছুতেই ।

রিমি আর কিছু ভাবতে পারছে না । তবে অনুভব করলো বুকের ভেতরের ভয়টা কমে এসেছে । শিহাব সামনে রয়েছে বলেই হয়তো । শিহাব আবারও বলল, এমন করে তাকিয়ে আছো কেন শুনি? কি হয়েছে?
-কিছু না ।
-আমি গোসলে ঢুকি । তুমি কি আমার জন্য একটু কফি বানাতে পারবে?
-বানানো আছে । ফ্ল্যাক্সে !
-ওকে গোসলে যাচ্ছি ।
শিহাব চলে গেল ওয়াশরুমে। রিমি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ওর দেহের ভেতরে একটা আন্দোলন খেলে গেল । ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । বুয়া চলে যাওয়ার পর আর বাইরে যাওয়া হয় নি । ও ছিটকানি দিয়ে আটকেছিলো । ভেতর থেকে কেউ না খুলে দিলে কিছুতেই ঢোকা সম্ভব না। তাহলে শিহাব কিভাবে ঢুকলো ভেতরে !

চোখ বড় বড় করে সে তাকালো ওয়াশরুমের দিকে । ভেতর থেকে পানি পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । গুনগুন করে গান গাওয়ার আওয়াজাও শোনা যাচ্ছে । রিমি আর ভাবতে পারছে না । বুকের ভেতরে কাঁপছে । রিমি দৌড়ে গেল দরজার দিকে । নিচ তলার ভাড়াটিয়ার কাছে যেতে হবে । এখানে থাকা যাবে না ।
যখন দরজার ছিটকানি খুলে বাইরে পা বাড়াবে তখনই দেখতে পেল শিহাব সিড়ি দিয়ে উঠছে উপরে । ওর দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে । দ্রুত এগিয়ে এসে ধরলো ওকে । রিমি কোন কথা না বলে কেবল শিহাবকে জড়িয়ে ধরে থাকলো । কত সময়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো সেটা নিজেও জানে না । এক সময়ে মনে হল যে যে ভেতরে ঢুকেছিলো শিহাবের চেহারা নিয়ে সে এখনও রয়েছে ভেতরে ।

শিহাবকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো । তারপর ভয়ে ভয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো । ওয়াশরুমের ফ্লোর ভেজা । গোসল করলে যেমন ভেজা থাকে তেমন ভেজা । রিমি কোন কথা না বলে বিছানাতে বসে পড়লো । ওর মনের ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে । শিহাব ওর পাশে বসতে বসতে বলল, ভয় পেয়েছো?
-হুম ।
-একা একা রয়েছো তো এই জন্য । কাল থেকে আরও আগে আসার চেষ্টা করবো । আর বুয়াকে বলে দিবো যাতে আমি না আসা পর্যন্ত থাকে এখানে । ওকে ?
-আচ্ছা ।
-এখন কি কফি খাবে একটু ? বানাবো?
রিমি বলল, না থাকুক আমি খেয়েছি । তোমার জন্য বানিয়ে রেখেছি ঐ ফ্ল্যাক্সে ।

শিহাব উঠে গিয়ে ফ্ল্যাক্সে নিয়ে এল । ভেতরে উকি দিয়ে দেখলো সেখানে কোন কফি নেই । তখনই রিমির চোখ গেল টিটেবিলের উপর । সেখানে একটা কাপ দেখা যাচ্ছে । ওর নিজের কাপ না । এটা দিয়ে শিহাব কফি খায়।
এই কফির মগ এখানে কেন !!

রিমির শরীরটা আরেকবার কেঁপে উঠলো । কেউ যে এসেছিলো কোন সন্দেহ নেই । শিহাবের রূপ ধরে । গোসল করেছে ওয়াশরুমে তারপর কফিও খেয়েছে ।

রিমি মনে মনে ঠিক করে নিল আর একা একা থাকা যাবে না কোন ভাবেই । কোন ভাবেই থাকবে না একা এই বাড়িতে !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 45

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →