দ্য আনএক্সপেক্টেড ব্রাইড (প্রথম অংশ)

4.9
(38)

ছুটির দিন গুলোতে বুক স্টোরে ভীড়টা একটু বেশি থাকে । এই দিনে তাই নোরাকে একটু বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় । বই চেক করে দেখা, সেগুলো দাম মিলিয়ে মূল্য রাখা । তাছাড়াও মাঝে অনেক গ্রাহকদের বই খুজেও দিতে হয় মাঝে মাঝে । নোরার অবশ্য কাজ গুলো করতে বেশ মজাই লাগে । সব সময় বইয়ের ভেতরে থাকাটা ওর মন্দ লাগে না । তবে অন্যান্য দিন গুলোতে ভীড় থাকে কম । তখন একটু অবসর সময় কাটানো যায় ।

তবে আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ন অন্য রকম । নোরা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুটা সময় । তারপর সেখান থেকে মুখ সরিয়ে ঠিক ডান দিকে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো । তারপর আবারও স্ক্রিনের দিকে তাকালো । স্ক্রিনে আদনান চৌধুরীর একটা ছবি বের করা রয়েছে । ডিপ ব্লু রংয়ের সুট পরা । স্যুটের ভেতরে পরেছে হাকলা গোলাপী রংয়ের একটা শার্ট সেই সাথে ডিল ব্লু টাই। কালার কম্বিনেশনটা অন্য কারো ক্ষেত্রে হলে বড় হাস্যকর লাগতো কিন্তু আদনান চৌধুরীকে রাজপুত্রের মত লাগছে । সেই দিকেই নোরা কিছু সময় কেবল তাকিয়ে রইলো । ওর এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই ছেলেটাই এখন এই বুক স্টোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।

ভাবা যায় ?

গতকালকেই সে জানতে পেরেছে এই ছেলেটা ওদের বুকশপে এসে হাজির হয় । ও হয়তো চিনতেও পারতো না যদি না অরিন ওকে বলতো ! নোরার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা । নোরার পরিবার থাকে বগুড়াতে । নোরা ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে। মাস শেষে বাবা ওকে বেশ ভাল পরিমান টাকায় দেয় তবুও নোরা একেবারে পায়ের উপর পা তুলে, সম্পর্ন খচরটা বাবার উপরে চাপিয়ে দিতে চায় না । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শুরু থেকেই কিছু করার চেষ্টা করেছিলো । প্রথম কিছু দিন টিউশনী করিয়েছিলো । তবে বুঝতে পেরেছিলো যে টিউশনি ব্যাপারটা তার সাথে ঠিক যাচ্ছে না । অন্য কিছু করার চেষ্টা করছিলো তখনই এই অনিন্দ্য বুক স্টোরে চাকরিটা পেয়ে যায় । নোরার দায়িত্ব হচ্ছে বিকেলের দিককার কাস্টমার সামাল দেওয়া । বিশেষ করে কাউন্টার সামলানোর দায়িত্ব ওর । ছোট বেলা থেকেই বই পড়ার একটা অভ্যাস আছে তার । এতো বড় একটা বইয়ের দোকানে ঘন্টা ৬ থাকাটা মোটেও মন্দ হবে না ।

প্রথমে ওর বাবা অবশ্য একটু আপত্তি করেছিলো তবে ওর বাবা যখন নিজে বুক স্টোরে এসে হাজির হয় তখন খানিকটা মন গলে যায় তার । অভিজাত এক বইয়ের দোকান । এখানে আসা যাওয়া মানুষ গুলোও সব অভিজাত শ্রেণীর । তারপর আর সে আপত্তি করে নি ।

এরপর থেকে এই বুকস্টোরেই কাজ করছে সে । ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবীরাও মাঝে মাঝে এখানে এসে হাজির হয় । কাজের ফাকে গল্প চলে । গতদিন অরিন এসেছিলো । কাজের ফাঁকে গল্প চলছিলো দুজনের মধ্যে সেই সময়েই অরিন বুকস্টোরে আসা একজন ছেলের দিকে নির্দেশ করে বলে, এই এটা আদনান চৌধুরী না ?

নোরা অরিনের দেখানো মানুষটার দিকে তাকালো । আদনান চৌধুরীকে কে জানে চেনে । বিশেষ করে ওর বয়সী সব মেয়েদের ক্রাশ হচ্ছে এই আদনান চৌধুরী । দেশের বিখ্যাত ব্যবসায়ী । সব চেয়ে ইয়াং এন্ট্রাপ্রেনার ! কত ধরনের ব্যবসা যে তার আছে তার কোন হিসাব নেই । মাত্র ৩১ বছর বয়স কিন্তু এরই মধ্য সাফল্যের চুড়ান্ত শিখড়ে পৌছে গেছে ।

তাকে চেনার আরেকটা কারন হচ্ছে, মাঝে মধ্যেই তাকে পত্রিকার পাতায় দেখা যায় । সুদর্শন হওয়ার কারনে প্রায়ই মডেলিং করে । দেশের বিখ্যার প্রায় গুলো ক্লডিং ব্রান্ডের এম্বাসেডর সে । যদিও মডেলিং করে কেবল শখ থেকে । মাঝে মাঝে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার এটেন করে । বিশেষ করে বিজনেস সেমিনার গুলোতে তাকে ডাকা হয় । সেখানে সে বক্তব্য দেয় । সব মিলিয়ে একটা মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ হওয়ার জন্য যা যা দরকার সবই তার ভেতরে আছে ।

তবে আদনান চৌধুরীর বদনামও আছে অবশ্য । বাজারে গুজব আছে যে মানুষ হিসাবে সে খুবই রাগী, প্রচুর বদমেজাজী আর একগুয়ে ! তার আশে পাশের মানুষ গুলো তাকে জমের মত ভয় পায় । এই বদনাম শুনে অবশ্য মেয়েরা তার উপর ক্রাশ খাওয়া বন্ধ করে নি ।

নোরা কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে অরিনকে বলেছিলো যে মোটেই না । এই লোকের বই পড়ার মত সময় নেই । কত ব্যস্ত সে ! নোরা ভেবেছিলো কাউন্টারে এসে পেমেন্ট করার সময় তাকে জিজ্ঞেস করবে । কিন্তু ওদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে ছেলেটা কোন বই না কিনেই চলে গেল । অনেকেই এই বুকস্টোরে আসে কেবল বই পড়ার জন্য কিংবা ছবি তোলার জন্য ।

নোরা অরিনকে বলেছিলো, এই ছেলে কোন ভাবেই আদনান চৌধুরী হতে পারে না । একটু চেহারার অবশ্য মিল আছে এই যা ! আদনানা চৌধুরী চশমা পরে না এই চোখের চোখে একটা চশমাও দেখা যাচ্ছে ।

কিন্তু আজকে আবার যখন ছেলেটাকে বুকস্টোরে আসতে দেখলো নোরা তখন খানিকটা কৌতুহলী হয়েই তার চেহারার দিকে তাকাতে লাগলো । এবং সত্যিই সত্যিই মনে হতে লাগলো ছেলেটার চেহারা আসলেই আদনান চৌধুরীর মত । একেবারে সেই রকম । চেলাকা কেবল ফরমাল ড্রেস না পরে ক্যাজুয়াল ড্রেস পরেছে বলেই হয়তো এমন মনে হচ্ছে । সামনের এই ছেলেটাকে ফরমাল ড্রেস পরিয়ে দিয়ে চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলেই সবাই তাকে আদনান চৌধুরী বলেই ধরে নিবে ।

আজকে অবশ্য ছেলেটা বেশ কিছু বই কিনলো । কাউন্টারে এসে বিল পেমেন্টের সময় নোরা হঠাৎ বলল, আপনার বিলটা ৫ হাজার ক্রস করেছে । আপনার কাছে কি মেমবার শীপ কার্ড আছে ?

যদিও নোরা খুব ভাল করেই জানে এই ছেলে এই প্রথম এই বুক স্টোরে এসেছে ।

ছেলেটা হাসলো । তারপর বলল, মেমবারশীপ কার্ড তো নেই । এটা থাকলে কি সুবিধা ?

-এটা থাকলে আপনি পুরো বিলের উপর আলাদা ৫% ডিসকাউন্ট পাবেন !

-আচ্ছা । আমাকে একটা কার্ড দেওয়া যাবে ?

-এই জন্যই জানতেই চাইলাম । একবারে বিল ৫ হাজারের বেশি হলে আমরা তাকে এই মেম্বারশীপ কার্ড দেই ।

-আচ্ছা তাহলে তো ভালই ।

নোরা ছেলেটার দিকে একটা ফর্ম এগিয়ে বলল, এই টা একটু ফিলআপ করে দিন প্লিজ !

ছেলেটা ফর্মটা ফিলাপ করে দিল । নামটা দেখেই নোরা চমকে উঠলো । সেখানে আদনান চৌধুরীই লেখা ! নোরার মনে হল ও একটা হার্ট বিট মিস করলো ! ওর সামনে সত্যিই সত্যিই আদনান চৌধুরি দাড়িয়ে আছে ।

বিলে নেওয়া শেষ করে যখন যাওয়ার সময় হল তখনই আদনান বলল, মিস নোরা আজকে আসি কেমন !

নোরা এসে বিদায় জানালো !

আদনানের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তখনই ওর মনে ব্যাপারটা ধরা পড়লো । আদনান চৌধুরী ওর নাম জানলো কিভাবে ? ও নিজের নাম বলে নি । আর ওর যত দুর মনে পরে অন্য কোন কর্মচারিও ওর নাম ধরে ডাকে নি । তাহলে ?

ওর নামটা কিভাবে জানলো ?

পর্ব দুই

সব কাজ শেষ করে বুকস্টোর থেকে বের হতে হতে রাত আট টা বেজে গেল । ছুটির দিন গুলোতে আরও একটু দেরি হয় । গল প্রভোস্টের সাথে আগে থেকেই নোরা কথা বলে নিয়েছে । এই জন্য ওর খুব একটা সমস্যা হয় না । নোরা বরাবরই পড়াশুনাতে বেশ ভাল । তাই স্যার ম্যাডামদের সুনজরে পড়তে খুব একটা সময় লাগে না । এই অনুরোধ টুকু তারা ঠিকই রাখে ।

বুক স্টোরের সামনে এসে দাড়ালো । ওর হলটা এখান থেকে খুব বেশি দুরে নয় । চাইলে হেটেই যাওয়া যায় । পুরো রাস্তা যখন জ্যাম হয়ে থাকে তখন রিক্সা না নিয়ে ও বরং হেটেই চলে যায় । কিন্তু নোরার আজকে হাটতে ইচ্ছে করছে না । কয়েক কদম হেটে গেলেই রিক্সা পেয়ে যাবে । নোরা সেদিকেই হাটতে শুরু করলো । তবে ওকে থামতে হল কয়েক কদম হাটার পরেই । একজন মানুষ ওর ঠিক সামনে এসে দাড়িয়ে । সুট টাই পরা একটা ছেলে । ছেলেটার বয়স কত হবে এই অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারলো না । চোখে মুখে একটা কনফিউজড ভাব রয়েছে ।

-গুড ইভিনিং মিস নোরা ! আপনি কেমন আছেন ?

নোরা একটু না অবাক হয়ে পারলো না । এই লোকটা ওর নাম জানলো কিভাবে ? একটু আগে ঐ আদনান চৌধুরীও ওর নাম ধরেছিলো ! এখন আবার এই লোকটাও ওর নাম ধরে ডাকছে । এই শহরের সবাই ওর নাম জেনে বসে আছে নাকি ? নাকি হঠাৎ করেই ও খুব বিখ্যাত কেউ হয়ে গেছে !

নোরা নিজেকে সামলে নিল মুহুর্তেই । তারপর বলল, আমি ভাল আছি । কিন্তু আপনি কে ?

ছেলেটা এবার একটু হাসলো । তবে মুখ থেকে সেই কনফিউজড ভাবটা গেল না । বলল, আমার নাম কামাল । আমি আদনান স্যারের সেক্রেটারি !

আবারও সেই আদনান !

ব্যাপারটা কি হচ্ছে নোরা আসলে কিছুই বুঝতে পারছে না । কি হচ্ছে ওর সাথে !

কামাল নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে আমাদের স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান ? উনি ঐ যে ঐ গাড়িতে বসে আছেন ! আপনি প্লিজ চলুন আমার সাথে ?

নোরা কিছু সময় কামাল নামের এই মানুষটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, আপনার স্যার কথা বলতে চায় তাকে আসতে বলুন আমার কাছে ? আমি কেন যাবো ?

নোরা কেন যে এই কথাটা বলল সেটা ও নিজেই জানে না । অন্য কেউ হলে এক কথাতেই গাড়ির দিকে দৌড়ে যেত । আদনান চৌধুরী তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে এটা তো একেবারে স্বপ্নের মত একটা ব্যাপার । আর ও কিনা ভাব নিয়ে বলল যে আদনান চৌধুরীকেই ওর কাছে আসতে । কামালও সম্ভবত নোরার কাছ থেকে এমন কথা ঠিক আশা করে নি । কিছু সময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো । তারপর ঘুরে পেছনে দৌড় দিলো ।

নোরা কামালের এই দৌড় দেওয়াটা আশা করে নি । ছেলেটা কোন কারনে কনফিউজড হয়ে আছে । এবং নোরা তাকে আরও বেশি কনফিউজড করে দিয়েছে । নোরার এখন কি করা দরকার ?

এখানেই অপেক্ষা করবে নাকি রিক্সার জন্য হাটা দিবে ? নাকি গাড়িটার দিকে একটু এগিয়ে যাবে ! শেষে যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানেই দাড়িয়ে রইলো । অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না । ঠিক দুই মিনিটের মাথায় আদনান চৌধুরী ওর সামনে এসে হাজির হল । পেছনে কামাল সেই পাংসু মুখে দাড়িয়ে আছে । সম্ভবত এখনও এইটা মেনে নিতে পারছে না যে নোরা তার বসকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে ।

নোরা নিজেও খানিকটা অবাকই হল । ও ভেবেছিলো ওর এই কথা শুনে হয়তো আদনান চৌধুরী চলে যাবে নয়তো আবারও কামালকে পাঠাবে । এভাবে নিজেই নেমে আসবে সেটা সে ভাবে নি । আদনান চৌধুরী ওর সামনে এসে দাড়ালো । এইবার অবশ্য নোরা নিজের ভেতরে একটু দ্বিধ দ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু করলো । কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ।

আদনান চৌধুরী বলল, আপনার হলের গেট সম্ভবত নয়টায় বন্ধ হয় ! তাই না ?

নোরা কেবল মাথা ঝাকালো ।

-চলুন আপনাকে পৌছে দেই । নয়তো দেরি হয়ে যেতে পারে !

নোরা মৃদুর স্বরে বলল, সমস্যা নেই । আপনি বলুন আপনার কি কথা ।

-যেতে যেতেই বলি ! খুব বেশি সময় লাগবে না । নাকি আমার গাড়িতে উঠতে সমস্যা আছে । ভয় পাবেন না । আপনার কোন ক্ষতি আমি করবো না !

নোরা কিছু সময় কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । ওর সাথে আদনান চৌধুরীর কি এমন কথা থাকতে পারে সেটা ও কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না । ওর হলের গেট কয়টায় বন্ধ হয় সেটাও এই লোক জানে । এর মানে হচ্ছে লোকটা ওর নারী নক্ষত্র সব কিছু জেনে বসে আছে । কিন্তু কেন ? এই এতো বড়লোক মানুষটা ওর প্রতি কেন এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে ? এতো আগ্রহ দেখানোর কি কারন ?

নোরা অবশ্য আর প্রশ্ন করলো না । আদনান চৌধুরীর সাথে সাথে তার গাড়িতে গিয়ে উঠলো । আদনান চৌধুরী ঠিক তার পাশেই বসলো । কামাল উঠতে যাচ্ছিলো গাড়িতে আদনান বলল, কামাল তুমি এখানেই থাকো । আমি যাওয়ার সময় তোমাকে তুলে নিবো !

গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই নোরার মনে হল যে ও অন্য জগতে চলে এসেছে । বাইরে থেকে একটু আওয়াজও আসছে না । ওর সিটের সামনেই একটা ছোট টিভি রয়েছে । সেখানে খবর ছাড়া রয়েছে । তবে কোন আওয়াজ হচ্ছেনা । গাড়িতে চলতে শুরু করেছে নোরা সেটা বুঝতেও পারলো না ।

আদনান চৌধুরী বলল, দুঃখিত এই ভাবে চলে আসার জন্য !

-না ঠিক আছে । আসলে আমি ….

-কিছু বুঝতে পারছেন না ?

-জি ! আপনি আমার সাথে কি কথা বলতে পারেন সেটাই মাথাতে আসছে না আমার !

-আসলে আমি আপনাকে ডিনারে নিয়ে যেতে চাই !

নোরার মনে হল ও যেন কানে একটু ভুল শুনলো । নিশ্চিত ভাবেই এটা কোন ভাবেই সম্ভব না ।এমনটা হওয়ার কোন কারন সে দেখতে পাচ্ছে না । আদনান চৌধুরী যে কিনা কম করেও কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক সেই লোক ওকে ডিনারে নিয়ে যেতে চাচ্ছে !

নোরার মুখের ভাবটাই এমন ছিল যে কেউ ওকে দেখলে ঠিকই বুঝে যাবে যে ও অবাক হয়েছে । নিজের বিস্ময় ও লুকানোর চেষ্টাও করলো না । আদনান বলল, আমি বুঝতে পারছি আসলে আপনি অবাক হয়েছেন । এবং আপনার পূর্ণ অধিকার আছে আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার । আমার সেখানে কিছুই করার থাকবে না । তবে আমি সত্যিই আপনাকে ডিনারে নিয়ে যেতে চাই ।

নোরা বলল, কেন ?

-সেটার পেছনে কারন আছে । সেটা আপনি গেলেই বুঝবেন । বেশি সময় চাইবো না আপনার কাছে । মাত্র ঘন্টা দুয়েক । এটা হলেই হবে । আপনাকে আমি হলের গেট থেকে কিংবা আপনার বুকস্টোর থেকে পিক করে নিয়ে যাবে । তারপর আবার এখানেই ড্রপ করে দিয়ে যাবো ।

-আমি আসলে কারনটা জানতে চাইছি !

-আপনি আমার একটা খুব বড় উপকার করেছেন । সেটার প্রতিদান কোন ভাবেই দেওয়া সম্ভব না আমি জানি । কিন্তু একেবারেও কিছু যদি না করি তাহলে আসলে আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না !

নোরা আবারও অবাক হয়ে গেল । ও আদনান চৌধুরীর কি উপকার করেছে সেটা ও বুঝতেই পারলো না । বলল, আমি আপনার উপকার করেছি ? আপনার নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে কোথাও ! আমি আপনাকে সরাসরি এই প্রথম দেখলাম । না ঠিক এই প্রথম না । গতদিন আপনি বুকস্টোরে এসেছিলেন । সেদিন দেখেছিলাম । আর কোন দিন দেখাই হয় নি আমাদের ।

নোরার তারপর কি যেন মনে পড়লো । তারপর বলল, আমি ঐ বুকস্টোরের মেম্বারশীপ কার্ডটা দিয়েছিলাম । এটা কি আপনি উপকার হিসাবে ধরছেন ?

আদনান খুব শব্দ করে হেসে উঠলো । নোরা খানিকটা অবাক হয়েই আদনানে মুখের দিকে তাকালো । মানুষটা এর আগেও সে দেখেছে পত্রিকার ছবিতে । ইউটিউবে তার কিছু ভিডিও আছে । সব সময় তাকে কেবল গম্ভীরম রাগী আর বদমেজাজী হিসাবেই বিশ্বাস করে এসেছে । কিন্তু এখন আদনানের হাসি দেখে নোরার সব কিছু কেমন ভুল মনে হল । আদানন বলল, ঠিক বলেছেন । ঐটাই কারন !

তারপর আবারও হাসতে লাগলো ।

নোরা বলল, সত্যিই বিশ্বাস করেন আমি কোন ভাবেই আপনার কোন উপকার করি নি । করতেই পারি না !

আদনান এবার নিজের হাসি থামালো । তারপর বলল, আমার সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন ! আপনার নিশ্চয়ই মনে হয় না যে আমি ভুল মানুষের পেছনে এতো সময় ব্যয় করবো ? আপনার হয়তো ধারনা নেই আমি আপনার জন্ম তারিখ স্থান থেকে শুরু করে এই আজকের দিনের একটু আগের ঘটনা পর্যন্ত সব কিছু জানি !

-সিরিয়াসলি ?

-জি !

-আমি সত্যিই খুব খুশি হব যদি আপনি আমার সাথে একটা দিন ডিনার করেন !

নোরা কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা । কবে বলুন ?

-সামনের শুক্রবারে হলে আপনার সুবিধা হবে ?

-আচ্ছা ঠিক আছে ।

-ধন্যবাদ ! আপনার হলের সামনেই আমি গাড়ি পাঠাবো । ঠিক আছে ?

নোরা তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে ওর সাথে এমন কিছু হতে যাচ্ছে । কেন এমন কিছু হচ্ছে ! এমন কিছু তো হওয়ার কথা না । কোন ভাবেই না । আদনান বলল, আপনার হল চলে এসেছে !

-চলে এসেছে ?

কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো আসলেই গাড়িটা হলের সামনেই দাড়িয়ে আছে ।

গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটা চলে যেতে দেখলো ও । মনের ভেতরে একটু দ্বিধা কাজ করছে । ও আদনান চৌধুরীর কি উপকার করতে পারে?

পর্ব তিন

অরিন নোরার দিকে কিছুটা সময় কেবল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো । একটু আগেই নোরা হলে ফিরেছে । একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা অরিনকে বলবে কি না সেটা নোরা কিছু সময় ভাবলো । তারপর মনে হলে এ আর এমন কি ! বরং বলেই দেওয়া যাক ।

যখন সব টুকু বলে শেষ করলো অরিনের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে নোরা হয়তো ওর সাথে ঠোট্টা করছে । কিন্তু যখন বুঝলো যে নোরা মোটেই ঠোট্টা করছে তখন চিৎকার দিয়ে উঠলো ।

অরিনের উত্তেজনা যেন আর শেষই হয় না । নিজেকে কোন মতে শান্ত করে বলল, কিভাবে হল এই সব ?

নোরার নিজেরও জানা নেই কেমন করে এসব কিছু হল । নোরা কেবল জানে যে এই আদনান চৌধুরী ওকে ডিনারে আমন্ত্রন জানিয়েছে । তার ধারনা হয়েছে যে নোরা তার বড় কোন উপকার করেছে । এখন কি যে উপকার করেছে সেটা সে জানে না । আদনান চৌধুরী সেটা এখনও বলে নি । দেখা যাবে নোরাকে সে যখন বলছে সেটা নোরা করেই নি । তখন কি হবে ?

নোরা ঠিক করেছে আগে ডিনারটা খেয়ে নিক । পরেরটা পরে দেখা যাবে ।

অরিন বলল, আচ্ছা তোকে কি একাই ডেকেছে ? দেখ তোর সব কাজের সঙ্গী তো আমিই । আমি যদি সাথে যাই । কেমন হয় ?

নোরা হেসে ফেলল । যেখানে ও নিজেই জানে না কেন ওকে ডিনার করাতে চাচ্ছে, হয়তো যেকোন সময় তার অফিস থেকে কেউ ফোন করে বলবে, শুনুন মিস নোরা আমাদের একটা ভুল হয়েছে । আমরা আসলে অন্য কাউকে আপনার সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলাম । আপনি সেই মানুষটা নন । আপাতত আপনাকে আমরা ডিনার খাওয়াতে পারছি না !

কিন্তু সেটা আর হল না । শুক্রবার যাওয়ার কথা ছিল । শুক্রবার সকালে ওর ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির । ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, গুড মর্নিং মিস নোরা । আপনি কেমন আছেন ?

নোরা জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলো কে বলছেন তবে শেষ মুহুর্তে আর করলো না । মানুষটাকে সে চিনতে পেরেছে । আদনান চৌধুরীর সেক্রেটারি কামাল ।

নোরা বলল, বলুন কামাল সাহেব !

কামাল বলল, আপনি কি একটু আপনার হলের গেটে একটু আসবেন ?

-এখন ?

-জি । আজকে রাতে আপনার ডিনারের সিডিউল আছে ! মনে আছে নিশ্চয়ই ।

-জি মনে আছে ।

-আপনি একটু দয়া করে নিচে নেমে আসুন । স্যার আপনার জন্য কিছু উপহার পাঠিয়েছে ।

-উপহার ?

-জি । মানে আজকে আপনি কোন ড্রেস পরে যাবেন সেই ড্রেস !

নোরা এবার সত্যিই বেশ অবাক হল । ডিনারে দাওয়াত দিয়েছে সেটা না হয় বুঝা যাচ্ছে । কিন্তু তাই বলে একেবারে ড্রেস পাঠিয়ে দিবে ! এটা আবার কেমন কথা ! তবে নোরা কিছু বলল না । কামালের কথা মত নিচে নেমে এল । কামাল নোরার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল । তারপর বলল, এখানে দুইটা ড্রেস রয়েছে আজকের ডিনারের জন্য । আপনার যেটা ইচ্ছে সেটাই পরবেন ।

-আর অন্যটা ?

-ওটাও আপনার । স্যার নিজে পছন্দ করে কিনেছেন !

নোরা হঠাৎ কামালকে বলল, আচ্ছা আপনার কি মনে হচ্ছে না যে আপনার স্যার একটু অস্বাভাবিক আচরন করছেন ?

কামাল প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না নোরা ঠিক কি বলতে চাইছে । তারপর বলল, আসলে আমি নিজেও খানিকটা কনফিউজড । তবে এর পেছনে একটা যুক্তিযুক্ত কারন আছে ?

-কি সেই কারন ?

-আমি বলতে পারবো না । স্যার আপনাকে নিজেই বলবেন । ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় গাড়ি এখানে এসে থামবে । আপনাকে নিয়ে যেতে । ঠিক আছে ?

-আচ্ছা !

ব্যাগটা নিয়ে নোরা হলের ভেতরে চলে গেল । তবে ব্যাগটা সে খুললো না । খুলে দেখলোও না যে ভেতরে কি ধরনের পোশাক দেওয়া আছে । ব্যাপারটা ডিনার পর্যন্ত ঠিকই আছে । কেউ যদি কাউকে ডিনারে আমন্ত্রন জানায় তাহলে সেটা গ্রহন করা যায় । কিন্তু এই ভাবে কারো কাছ থেকে উপহার গ্রহন করাটা নোরার একদমই পছন্দ না । ও যাা আছে সেটা পরেই ও ডিনারে যাবে বলে ঠিক করলো ।

সন্ধ্যা বেলা নোরা একটা সাদা রংয়ের কামিজ পরলো । সাদা লেগিংসের সাথে সাদা ওড়না । নোরা দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও ওর চেহারার মাঝে একটা কোমল স্নিগ্ধ ভাব আছে । প্রথম দেখাতেই মানুষের পছন্দ হয়ে যাওয়ার মত । আর সাদা পোশাকে ওর ভেতরের এই মায়াময় ভাবটা আর বেশি ফুটে ওঠে ।

গেট দিয়ে যখন বের হল কামাল ওকে দেখেই চোখ কপালে তুলে বলল, কি ব্যাপার আপনি স্যারের দেওয়া ড্রেসটা পরেন নি কেন ?

নোরা খুব স্বাভাবিক ভাবে সেই ড্রেসের ব্যাগটা কামালের হাতে দিয়ে বলল, কারন আমি এটা পছন্দ করছি না ।

-মানে ? আপনার ড্রেস পছন্দ হয় নি ?

-আমি ব্যাগটা খুলেই দেখি নি । আমি উনার ডিনার প্রোপোজাল গ্রহন করেছি । কিন্তু এই উপহার গ্রহন করি নি ।

-স্যার খুব রাগ করবেন । আসলে সব কিছু স্যারের মন মত না হলে স্যার খুব রাগ করেন ।

-সেটা আমার দেখার ব্যাপার না । আমি তার এম্লোয়ী নই । তার রাগের ধার ধারবো কেন ?

কামাল কিছু সময় কেবল নোরার দিকে তাকিয়ে রইলো । কেউ যে তার স্যার সম্পর্কে এমন ভাবে কথা বলতে পারে সম্ভবত এটা তার ধরনার বাইরে ছিল । নোরা বলল, গাড়িতে কি উঠবো নাকি ফেরৎ যাবো !

-এ্যা !! না না উঠুন প্লিজ ! আপনাকে না নিয়ে গেলে আমার খবর আছে ! চলুন প্লিজ ! তবে স্যার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে ড্রেস সম্পর্কে তাহলে বলবেন যে আপনি ইচ্ছে করে সেটা পরেন নি ! ঠিক আছে !

নোরা এই কথার কোন জবাব দিল না । নিজেই গাড়ির দদরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বসলো । কামাল উঠে এল একটু পরেই । তবে তার সাথে নয় । কামাল বসলো সামনে সিটে ।

নোরা এর আগে প্যানপ্যাসিফিকে এসেছে একবার । তবে কোন ডিনার প্লান করার জন্য নয় । ওদের ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা বিদেশী সেমিনার এটেন করতে । ভাল স্টুডেন্ট হওয়ার কারনে তাহনিনা ম্যাম ওকেই সিলেক্ট করেছিলো ম্যামের এসিস্ট্যান্ট হওয়ার জন্য । সেই একবারই শেষ । আর এর ভেতরে ঢোকা হয় নি ।

আজকে যখন গাড়িটা ভেতরে প্রবেশ করলো নোরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো স্যুট টাই পরা এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ওর দিকে এগিয়ে এল । ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ওয়েলকাম ম্যাম ! আমি এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রকিবুল হাসান । আসুন ! স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ।

নোরার একটু অস্বস্থি লাগা শুরু করেছে । সত্যিই এমনটা ও আশা করে নি । আর নোরা যে আসবে এই লোকটা কিভাবে জানলো ! ওকে চিনলোই বা কিভাবে ?

অবশ্য ওর সাথে কালাম রয়েছে । তাকে দেখেই চিনতে পেরেছে হয়তো । একটা বড় লবি পার করে ডান দিকে ওরা হাটতে লাগলো । ম্যানেজারের আগে আগে হাটতে থাকা এক বেয়ারা একটা বড় দরজা খুলে দিল । সেটা দিয়ে নোরা প্রবেশ করলো । তবে ম্যানেজার কিংবা কামাল কেউ ই ওর সাথে এল না ।

নোরা ভেতরে তাকিয়ে দেখলো ভেতরে বেশ বড় একটা রুম । ওর হলের ক্যান্টিনের সমান । পুরো রুমের ভেতরে কেবল একটা টেবিল পাতা রয়েছ । টেবিলের দুই পাশে দুটো চেয়ার । আর কিছু নেই । পুরো রুমটা একেবারে ফাঁকা !

একটা চেয়ারে আদনান বসে আছে । ওর দিকে চোখ পড়তেই আদনান উঠে দাড়িয়ে এগিয়ে এল । নোরা বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো । আজকেও আদনান স্যুট পরে নি । ক্যাজুয়াল ড্রেস পরেছে । ওর মত সাদা রংয়ের একটা গেঞ্জি পরেছে । সেই সাথে গাঢ় নেভিব্লু রংয়ের প্যান্ট । পায়ে একটা লোফার । একবার চোখ পড়লে সহজে চোখ সরানো যায় না । নোরা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা দুর করে দিল । বারবার নিজেকে বোঝালো যে নিজের বাউন্ডারী কোন ভাবেই যেন পার না করে ! এটা কেবলই একটা ডিনার আর এর পরে হয়তো আর কোন দিন এই ছেলের সাথে ওর দেখাও হবে না ।

আদনানের সামনে আসতেই নোরা বড় করে এক দম নিল । নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, সরি আপনার পাঠানো ড্রেসটা পরি নি ।

আদনান হাসলো । তারপর বলল, আমি জানি । বুঝতে পারছি কেন পরেন নি । ইটস ওকে । এই সাদাতে আপনাকে চমৎকার লাগছে ।

তারপর নোরাকে আরও অবাক করে আদনান নোরার বসার চেয়ারটা টেনে দিল । নোরার কাছে সত্যিই ব্যাপারটা স্বপ্নের মতই মনে হল। এমন একটা স্বপ্নের ডিনার যে কোন মেয়েই স্বপ্ন দেখে । তাও আবার আদনান চৌধুরীর মত কারো মানুষের কাছ থেকে ।

নোরা বলল, এতো বড় হলরুমে আমরা কেবল দুজন ?

-আই ডোন্ট লাইক টু বি ডিস্টার্ব । পুরোটা বুক করা হয়েছে ।

-কেবল আমার জন্য ?

-হ্যা, মিস নোরা । কেবল আপনার জন্য ।

-আসলে আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না । আমি ….

আদনান হাসলো । তারপর বলল, বুঝতে পারবেন যথা সময়ে । এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই । আসুন আমরা খাওয়া দাওয়া শুরু করি । কি অর্ডার দিবো ।

এই বলে একটা হাত তুললো । কার দিকে হাত তুললো কে জানে নোরা দেখতে পেল সেই রকিবুক হাসান এসে হাজির হল মেনু কার্ড নিয়ে । ওর দিকে কার্ডটা বাড়িয়ে দিল ।

নোরা কি অর্ডার দিবে সে কিছুই জানে । কার্ডে যা যা খাবারের নাম লেখা আছে তার বেশর ভাগই ওর অচেনা । কোন দিন নামই শুনে নাই ।

আদনান বলল, সিলেক্ট করতে সমস্যা হচ্ছে ?

নোরা একটু লজ্জিত ভাবে হাসলো । তারপর বলল, আসলে এই ধরনের খাবার খেয়ে আমি অভ্যস্ত নই । বুঝতেই পারছেন ।

আদানান হাসলো । তারপর রকিবুল হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, দেশীর ভেতরে কিছু চমৎকার আইটেম নিয়ে আসুন । আমরা চেষ্টা করে দেখি ।

-সিওর স্যার !

রকিবুল হাসান চলে যেতেই আদনান বলল, তারপর আপনার পড়াশুনা কেমন চলছে ? বুকস্টোরের ঐ চাকরিটা ভাল লাগে ?

নোরা বলল, আসলে পড়াশুনা ভালই চলছে । আর ঐ চাকরিটা সত্যিই আমি খুব পছণ্দ করি । সারাটা সময় বইয়ের ভেতরে থাকাটা একটা আনন্দের ব্যাপার ! চাকরিটা আসলে আমি করি টাকার জন্য নয় । সারাটা সময় বইয়ের ভেতরে থাকতে পারছি এই জন্য ।

আদনান বলল, আপনি বই অনেক পছন্দ করেন, তাই না ?

-অনেক ।

-আমাদের বাসায় বেশ বড় একটা লাইব্রেরি আছে ।

-তাই নাকি ? আপনিও খুব বই পড়েন বুঝি । ঐদিন তো দেখলাম অনেক বই কিনলেন ।

-আসলে আমি খুব একটা বই পড়ি না ।

-তাহলে ঐদিন যে দেখলাম যে অনেক বই নিলেন !

আদনান হঠাৎ ই কোথায় যেন হারিয়ে গেল । কিছু যেন ভাবছে । নোরার মনে হল ও এমন কিছু বলেছে যেটা আদনানকে অন্য কোথায় নিয়ে গেছে । ও কি এমন কথা বলে দিল !!

আদনান তারপর বাস্তবে ফিরে এল । নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি অন্য কিছু ভাবছিলাম । হ্যা যা বলছিলাম । একদিন আপনাকে আমাদের লাইব্রেরিটা দেখাবো । দেখবেন কত বই আছে । বেশির ভাগই পড়া হয় নি ।

নোরা এই প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলো না । অবশ্য একটু পরেই খাবার চলে এল ।

নোরা যা যা খাবার খেল তার বেশির ভাগই পছন্দ হল না । অদ্ভুত সব স্বাধ খাবার গুলোর । কিন্তু মুখে কিছু বলল না । চুপচাপ খাবার খেয়ে গেল । ডিনার শেষ করে নোরা আদনানকে বলল, এবার কি বলবেন আমি আপনার ঠিক কি উপকার করেছিলাম যার কারনে আমাকে এতো চমৎকার একটা ট্রিট দিলেন ?

আদনান বলল, শুনবেনই ?

-হুম । আমি এই চিন্তাই রাত দিন ধরে করছি । কিছুতেই বের করতে পারছি না ।

আদনান বলল, আমি না বলে বরং আপনাকে দেখাই । কি বলেন ?

-দেখাবেন ?

-চলুন । আশা করি একটু দেরি হলে আপনার খুব একটা সমস্যা হবে না । বেশি সময় লাগবে না ।

নোরা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । তবে ব্যাপারটা না জেনে গেলে ওর মনে কোন দিন শান্তি আসবে না । তাই সে রাজি হয়ে গেল । আদনানের সাথে আবারও গাড়িতে গিয়ে বসলো । ঠিক মিনিট বিশেক পরে গাড়ি থেকে নেমে নোরা বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেল । একটা তিনতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে ওরা । কাউকে বলে দিতে হল না, নোরা ঠিকই বুঝতে পারছে যে এটা আদনানদের বাসা । ওকে এখানে কেন নিয়ে এল সে ? কি দেখাবে ?

পর্ব চার

নোরা কিছুটা সময় বাড়ির সামনে দাড়িয়ে রইলো চুপ করে । ওর মাথায় এখনও ঠিক ঢুকছে না ঠিক কি দেখাতে নোরাকে আদনান এই বাসায় নিয়ে এল !

নোরার চোখে বিস্ময়টা আদনানের চোখ এড়ালো না । সে নোরাকে অভয় দিয়ে বলল, ভয় পাবেন না মিস ! আপনি ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবেন আসলে ঠিক কি কারনে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি । আসুন আমার সাথে !

নোরা আর কিছু না বলে আদনানের পেছন পেছন হাটতে লাগলো । ওর মাথার ভেতরে আসলেই কিছু ঢুকছিলো না । আদনান চৌধুরীকে সম্পর্কে সে যা যা শুনে এসেছে আসলে তার কিছুই মিলছে না । বাজারে আদনান সম্পর্কে যা যা খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কিছুই সে মিলাতে পারছে না । অনেক খবরের মাঝে একটা খবর হচ্ছে আদনান চৌধুরী তার ধারে কাছে একদমই মেয়েদের ঘেষতে দেয় না ।

অন্য সব স্থানে মেয়েদের বেলাতে একটু ছাড় থাকলেও তার বেলাতে ঠিক উল্টো । তার অফিসের মেয়েদের কোন ভুল পেলেই তার জীবন অতিষ্ঠ করে ছেড়ে দেয় ।

এই নিয়ে অনেকের ধারনা জন্মেছে আদনান চৌধুরী ঠিক স্বাভাবিক না । অনেকে মনে করে সে সমকামী ! কি হাস্যকর একটা মনভাব সবার ।

কিন্তু দেখা হওয়ার পর থেকে নোরা কেবল অবাকই হচ্ছে । আদনান চৌধুরী তার প্রতি কোন কারনে খুব নমনীয় আচরন করছে । এটাতে সে অবশ্যই তার এম্লোয়ী কামালকে পর্যন্ত অবাক হতে দেখেছে সে । এটার পেছনের কারন টা কি নোরা সত্যিই বুঝতে পারছে না । আজকে হয়তো জানা যাবে ।

বিশাল ড্রয়িংয়র ভেতরে প্রবেশ করলো ওরা । নোরা দেখতে পেল দুজন মেইড ছুটে এল ওদের দিকে । আদনান অবশ্য ওদের দিকে ঠিক তাকালোও না । নোরাকে দোতালাতে নিয়ে গেল । একটা ডান দিকের কোনার দিকের একটা ঘরের দরজার সামনে এসে থামলো । দরজা সাবধানে খুলল । নোরা ভেতরে ঢুকে চোখ বুলালো চারিদিকে । ঘরটা খুব বেশি বড় নয় । দেওয়া সাদা রং করা । ঘরে খুব বেশি আসবার পত্রও নেই । একটা টেবিল রয়েছে । সেখানে নানান ঔষধ রাখা । তার পাশে দেওয়ালের সাথে সেট করা একটা টিভি । সেটা এখন বন্ধ । তার পাশে দুইটা টুল । দুই টুলের একটা ফাঁকা অন্যটাতে এতো সময় এক কম বয়সী নার্স বসে ছিল । ওদের দেখেই উঠে দাড়িয়েছে । আর উল্টো দিকে একটা সিঙ্গেল খাট । সেখানে এক মাধ বয়সী মহিলা শুয়ে আছে ।

মহিলার চেহারার দিকে তাকাতেই নোরার হঠাৎ করেই সব কিছু মনে পড়ে গেল । এই মহিলাকে সে আগেও দেখেছে । একবার মহিলার দিকে আরেকবার আদনানের চেহারার দিকে তাকালো সে । এই ভদ্রমহিলা যে আদনানের মা সেটা বলে দিতে হল না । আদনান বলল, কিছু মনে পড়ছে কি ?

নোরা মাথা নাড়ালো । তার মনে পড়ছে ।

মাস খানেক আগের কথা । বনানীতে একটা কাজে যেতে হয়েছিলো ওকে । সেখান থেকে ফেরার সময়ই রাস্তার পাশে এই মহিলাকে দেখতে পায় সে । কেমন উদ্ভান্তের মত হাটছিলো । এমনিতে ঢাকা শহরে পাগলের কোন অভাব নেই । পারত পক্ষে নোরা এই সব দিকে খুব বেশি একটা নজর দেয় না । কিন্তু সেদিন নজর না দিয়ে পারে নি । কারন ছিল মহিলার শরীরের পোশাক । ভদ্র গোছের পোশাকের দিকে তাকিয়ে ছিল সে । পা খালি । মুখটা কেমন শুকনো মনে হচ্ছিলো । ও কাছে এগিয়ে গেল । ওকে দেখেই মহিলা ওর চেহারার দিকে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । মনে হল যেন ওকে চেনার চেষ্টা করছে ।

নোরার মনে হল মহিলা সম্ভবত কিছু খেতে চাইছে । মুখটা শুকনো ছিল । সকাল থেকে সম্ভবত কিছু খায় নি । নোরার কি মনে হল নোরা বলতে পারবে না, নোরা মহিলার হাত ধরলো । তারপর তাকে পাশের একটা ফার্স্ট ফুডের দোকানে নিয়ে গেল ।

নোরার সাথে সাথেই ভদ্রমহিলা শান্ত ভাবে হেটে সেই দোকানে ঢুকলো । নোরার কিনে দেওয়া খাবারও খেল একেবারে চুপচাপ । যেন কোন শান্ত বাচ্ছা তার মায়ের কথা মত সব করছে । নোরা তারপর মহিলাকে একজোড়া স্যান্ডেলও কিনে দিল পাশের এপেক্স থেকে । নোরার বুঝতে আসলে অসুবিধা হচ্ছিলো না যে মহিলার মাথায় কিছু একটা সমস্যা আছে । সে স্বাভাবিক নয় ।

নোরারও কেন মহিলার উপর এমন মায়া জন্মালো সেটা নোরা নিজেও জানে না । বিশেষ করে নোরার দিকে যখন সে তাকিয়ে ছিল সেই দৃষ্টিতে আদ্ভুত মায়া ছিল । নোরা চাইলেও সেটা পাশ কাটিয়ে যেতে পারছিলো না । এই ভাবে মহিলাকে রাস্তায় রেখে চলে যেতে মন চাইলো না ওর । তখন মনে হল যে ওর পরিচিত একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে । সেখানেই মহিলাকে রেখে আসবে । কিন্তুদিন সেখানেই থাকুক অন্তত ।

কিন্তু সেটা আর করতে হল না । নোরা যখন সিএনজির জন্য দাড়িয়ে আছে তখনই একটা কালো গাড়ি এসে থামলো ওর সামনেই । গাড়ি থেকে হুড়মুড় করে কিছু মানুষ নামলো । সবাই কোট টাই পরা । তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে ।

একজন ফোনে কাকে যেন বলছে, জি স্যার ম্যাডাম কে পাওয়া গেছে । আমাদের সামনেই আছে ।

একজন নোরার দিকে এগিয়ে এসে বলল, উনার মাথায় একটু সমস্যা আছে । কাউকে ঠিক চিনতে পারে না । বাসা থেকে বের হয়ে গেছে আজকে সকালে ! আমরা খুজে খুজে হয়রান !

নোরা একটু স্বস্থিবোধ করলো । নোরা বলল, আমারও ওনার চেহারা দেখে তাই মনে হয়েছিলো । ওনাকে এক বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাচ্ছিলাম ।

-তার আর কোন দরকার হবে না । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ !

নোরা তখন বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল, খালাম্মা আপনি উনাদের সাথে যান । আপনাকে বাসায় নিয়ে যাবে !

বৃদ্ধা তখন নোরার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, তুই যাবি না আমার সাথে ?

নোরা হাসলো । তারপর বলল, আমি আসবো পরে । আপনি যান !

-আসবি কিন্তু ! আর ফাঁকি দিবি না !

নোরা আবারও হাসলো । তারপর বলল, আচ্ছা আসবো ! আপনি চিন্তা করবেন না ।

নোরা এইবার বুঝতে পারলো কেন আদনান চৌধুরী নোরার প্রতি এতো নমনীয় । নোরা না জেনেই আদনানের মায়ের উপকার করেছিলো । এটারই প্রতিদান সে দিতে চাচ্ছে । আদনান বলল, আপনাকে খুজে পেতে একটু সমস্যা হয়েছে । তবে খুজে পেয়েছি শেষ পর্যন্ত !

নোরা বলল, আমাকে খোজার জন্য এতো কিছু করার দরজার ছিল না । আমি বাদ দিয়ে অন্য কেউ হলে সেও এমনটা করতো !

-মোটেও করতো না । আর আপনাকে খুজে বের করার পেছনে আরেকটা কারন কি জানেন?

-কি ?

আদনান একটু সময় মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, গত এগারো বছর পরে আমার মা কথা বলেছে । আপনাকে যে দুইটা কথা সে জানতে চেয়েছে সেই দুইটাই ছিল তার ১১ বছর পরে বলা কথা !

নোরা খানিকটা অবাক চোখেই তাকিয়ে রইলো আদনানের দিকে । মানুষটার চোখে কেমন পানি টলমল করছে ।

আদনান বলল, আমি আসলে …..

নোরা বলল, আপনাকে কিছু বলতে হবে না আর । আমি বুঝতে পারছি । তা এরপর আর কথা বলেছিলো ?

-না আর বলে নি অবশ্য ।

তখনই ভদ্রমহিলা জেগে উঠলো । নোরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । একভাবে তাকিয়েই রইলো কেবল । নার্স মেয়েটি বলল, স্যার রাতের ঔষধ খাবার সময় হয়ে গেছে ।

আদনান বলল, আচ্ছা । আমরা যাচ্ছি তুমি খাওয়াও । মিস নোরা আসুন । আপনাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি !

নোরা দরজার দিকে পা বাড়ালো । যখনই দরজার বাইরে পা দিতে যাবে তখনই কিছু একটা মেঝেতে পরা আওয়াজ শুনতে পেলো । তাকিয়ে দেখলো একটা ঔষধের বোতল মেঝেতে পরে আছে ।

আদনান আবারও ঘরের দরজার কাছে এল । নোরাকে বলল, কিছু খেতে চায় না । অনেক কষ্ট করে খাওয়াতে হয় !

নোরার সাথে সেদিন খুব শান্ত ভাবে খেয়েছিলো । কোন প্রতিবাদ করে নি । নোরার হঠাৎ কি মনে হল । সে আদনানকে বলল, আমি কি চেষ্টা করে দেখবো ?

আদনান যেন এই কথাটাই বলতে চাচ্ছিলো তবে বলতে পারছিলো না অস্বস্তির কারনে । বলল, শিওর !

সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদনানের মা খুব স্বাভবিক আর বাধ্য মেয়ের মত নোরার হাত থেকে ঔষধ খেয়ে নিল । রাতে নোরা তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন ! নোরা যখন আবার রুম থেকে বের হয়ে এল দেখতে পেল ড্রয়ং রুমে আদনানের সাথে আরেক ভদ্রলোক বসে আছে । ওকে দেখেই বলল, তুমিই তাহলে নোরা ?

-জি !

-আমি আদনানের বাবা !

-আসসালামু আলাইকুম আংকেল !

-ওয়ালাইখুম আসছালাম ! বস রাতের খাবার খেয়ে যাও ।

নোরা হাসলো । বলল, আংকেল আমি খেয়েই এসেছি ।

-ও আচ্ছা আচ্ছা ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম । বয়স হয়ে তো অনেক কিছু মনে থাকে না । যাই হোক । তোমার একটা ঋণ আমাদের উপর রয়েই যাবে । যাক সে কথা । আদনান ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আয় ।

যখন গাড়িট গেট দিয়ে গাড়িটা বের হচ্ছিলো নোরা বাড়িটার দিকে ফিরে আরেকবার তাকালো । ওর কেন যেন মনে হতে লাগলো এই বাসায় ওকে আরও অনেক অনেক বার আসতে হবে !

 পাঁচ

রিসিপশনের মেয়েটা নোরার দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখ করে বলল,ম্যাম আপনার কি কোন এপোয়েন্টমেন্ট করা আছে ?

নোরা আছে মাথা ঝাকিয়ে জানালো যে ওর কোন এপয়েন্টমেন্ট করা নেই । সাথে সাথেই নোরার মনে হল মেয়েটা বিরক্ত হল খুব । এতো অফিসের মানুষ আসছে যাচ্ছে, তাদের দম ফেলার সময় নেই । তার ভেতরে একজন উটকো ঝামেলা এসে হাজির হয়েছে ।

আদনান চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাই । আরে আদনান চৌধুরী কি যেনতেন মানুষ নাকি ! যে এসে বললাম আর দেখা হয়ে গেল !

নোরার এই ব্যাপারটা আগেই ভাবা দরকার ছিল । এমন হুট করে চলে আসাটা মোটেই উচিৎ হয় নি । অবশ্য আজকে ওর এখানে আসার পেছনে একটা কারন রয়েছে । নিজের জন্য ও এখানে আসে নি । এসেছে অন্য একজনের জন্য । তার পরেও এভাবে আসাটা উচিৎ হয় নি । আদনান চৌধুরীকে সে চেনে কিংবা আদনান তাকে চিনে সেটা এই মানুষ গুলোর কোন ভাবেই জানার কথা না । নোরা বললেও তারা বিশ্বাস কেন করবে ?

মেয়েটা বলল, দেখুন ম্যাম এই ভাবে তো এপোয়েন্টমেন্ট ছাড়া আদনান স্যার কারো সাথে দেখা করেন না ! আর এই ভাবে ফোন করা যাবে না । উনি খুব রাগ করবেন !

নোরা কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো চুপ করে । সামনে বসা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে মেয়েটা খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে ওর এভাবে দাড়িয়ে থাকা নিয়ে । তবে সেই মেকি হাসি হাসি ভাবটা এখনও লেগে আছে । এটা সব সময় থাকবেই ।

নোরা বলল, আচ্ছা আদনানের সেক্রেচারি কামালকে কি একটা ফোন দেওয়া যায় ? ওকে কেবল বলুন যে নোরা এসেছে । আমার নাম বললেই হবে !

রিসিপশন মেয়েটা এবার নোরার দিকে একটু ভাল করে তাকালো । কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করছে । তাদের বসকে এভাবে নাম ধরে ডাকাছে এটা খুব একটা স্বাভাবিক মনে হল না মেয়েটার কাছে । নোরা সেটা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলো । তবে মেয়েটা ঠিকই ফোনটা হাতে নিলো ।

নোরা শুনতে পেল মেয়েটা বলছে, জি স্যার ! নাম বলছে নোরা !

কিছু সময় নিরবতা ! তারপর মেয়েটা বলল, জি স্যার জি….. জি ! জি আচ্ছা !

মেয়েটা ফোন রেখে নোরার দিকে তাকালো । ততক্ষণে মেয়েটার মুখের ভাবটা বেশ বদলে গেছে । নোরার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ ! আপনাকে নিতে লোক আসছে ! আসলে আমি বুঝতে পারি নি যে আপনি আদনান স্যারের বন্ধু ! দয়া করে কিছু মনে করবেন না !

নোরা হাসলো একটু । তারপর ফিরে গিয়ে বসলো সোফার উপর !

তবে কিছু সময় পরে নোরা সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গেল যখন দেখতে পেল স্বয়ং আদনান চৌধুরী নিচে নেমে এসেছে ওকে রিসিভ করার জন্য । নোরা অবশ্য এটা আশা করে নি । আদনান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আরে আপনি আসবেন আমাকে বলবেন না ?

নোরা একটু হেসে বলল, ফোন নাম্বার নেই তো আমার কাছে ?

-কি বলেন ! দেই নি আপনাকে ?

-জি না !

-খুব ভুল হয়ে গেছে দেখছি । যাক সমস্যা আসুন প্লিজ !

রুমের ভেতরে নোরা আর আদনান ছাড়াও আরও কয়েকজন মানুষ রয়েছে । কামালও ছুটে এসেছিলো আদনানের পেছন পেছন । রিসিপশনের মেয়েটা আর গার্ডদের দুইজন অবাক হয়ে দেখছিলো তাদের আদনান স্যারকে । এতো নমনীয় কন্ঠে সে কোন মেয়ের সাথে কথা বলছে এটা ভাবতেই ওরা অবাক হয়ে যাচ্ছে ।

আদনানের পেছন পেছনে যখন মুল অফিস বিল্ডিংএ প্রবেশ করলো ওরা নোরা দেখতে পেল সবাই কেমন যেন ফ্রিজ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে । এমন দৃশ্য ওরা দেখে ঠিক অভ্যস্ত নয় বুঝা যাচ্ছে পরিস্কার !

আদনান নোরাকে নিয়ে বেশ ব্যস্তই হয়ে গেল । ওকে ভিআইপি গেস্ট রুমে নিয়ে আপ্যায়ন করতে শুরু করলো । নোরার এবার সত্যিই সত্যিই অস্বস্তি লাগা শুরু করলো । এই মানুষ ওকে দেখে এমন কেন করছে সেটা বুঝতে পারছে না । এটা তার সাথে ঠিক যাচ্ছে না !

আদানান এক সময় বলল, এখন বলুন আপনি এখানে হঠাৎ কি মনে করে !

নোরা কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, আমি আসলে এসেছি দুইটা কারনে !

-বলুন !

-আমাদের ডিপার্টমেন্ট আগামি মাসে একটা সেমিনার করতে যাচ্ছে এসএমই নিয়ে ! আসলে আমরা আশা করছিলাম যে আপনি যদি সেখানে আসতেন মানে যদি আপনার কোন ফাঁকা সিডিউল থাকতো আর কি ! আসলে ম্যাম আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে শহরের বড় কোন ব্যবসায়ীকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য । আমি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না ! অবশ্য আপনাকেও খুব ভাল করে চিনি না । দুইবার আমাদের দেখা হয়েছে । আপনার কি সময় হবে ?

আদনান হেসে ফেলল । তারপর বলল, আপনি এত সংকোচ নিয়ে কেন বলছেন ? আমাকে টাইম সিডিউলটা দিয়ে দিন আমি ঠিক ঠিক চলে আসবো !

নোরা বলল, অনেক ধন্যবাদ । কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না !

আদনান বলল, আরেকটা কাজ ?

নোরা এবার একটু দম নিলো । এই কথাটা সে ঠিক কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না । আদৌও বলা ঠিক হবে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না ।

আদনান আবার বলল, কই বলুন !

-আমি আসলে আপনাকে ফাতেমা নার্সের ব্যাপারে অনুরোধ করতে এসেছিলাম !

নামটা শুনতেই আদনানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল ! সে খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, তার আপনার সাথে কিভাবে পরিচয় ?

-গত সোমবার সে আমার হলে এসেছিলো ? কিভাবে এসেছিলো আমি জানি না । আমার খোজ পেয়েছে কিভাবে সেটাও জানি না ।

-তারপর ?

-খুব কান্নাকাটি করতে শুরু করলো । তার দুইটা মেয়ে কলেজে পড়ে । একেবারে বেকার হয়ে গেছে সে । আপনার রিপোর্টের কারনে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে ।

আদনান বলল, সে কি করেছে নিশ্চয়ই জানেন ?

-জি জানি !

-তারপরেও রিকোয়েস্ট করতে এসেছেন ?

নোরা একটা লম্বা দম নিল । তারপর বলল, দেখুন আমি জানি ঐদিন ফাতেমা নার্সের অসতর্কতার কারনেই আপনার মা বের হয়ে গিয়েছিলো । সেটা তার ভুল । এখন ভুল মানুষ করবেই । কিন্তু সেই ভুল থেকে বড় ক্ষতি হওয়ার আগেই সেটা ঠিক করে নেওয়া হয়েছে । এখন আপনি যদি প্রতিশোধ নেন তাহলে বেচারি কোথায় যাবে ? আপনার প্রতিশোধ সইবার মত ক্ষমতা শক্তি কি তার আছে ? বলুন আছে ?

আদনান কিছু চুপ করে রইলো । তারপর বলল, ওকে আমি দেখবো ব্যাপারটা !

-অনেক ধন্যবাদ !

নোরা দেখতে পেল আদনানের মুখে আবার হাসি দেখা দিয়েছে । একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে ।

নোরা চলে যাওয়ার পর আদনান কামালকে ডেকে পাঠালো নিজের কেবিনে ! কামাল খানিকটা ভীত মুখে কেবিনে এসে হাজির হল ।

আদানান প্রথমে কিছু কাজের কথা বলার পরপরই বলল, নোরার খবর ফাতেমা কিভবে পেল ?

কামাল কি বলবে ঠিক বুঝলো না । বলল, তাই নাকি স্যার ? কি জানি কিভাবে পেল ? আমি তো জানি না !

-সত্যিই জানো না ?

-খোদার কসম স্যার আমি জানি না !

-ওকে খোজ লাগাও কিভাবে পৌছালো !

-জি স্যার ! আমি খোজ নিচ্ছি !

আদনান আবারও নিজের কাছে মনযোগী হয়ে গেলেও দেখতে পেল কামাল তখনও দাড়িয়ে আছে । আদনান বলল, কি বলবা ?

-স্যার একটা প্রশ্ন ছিল মনে । যদি অভয় দিতেন তো বলি !

-বল !

-আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে আমি যতদিন ধরে আপনাকে চিনি আর মিস নোরার প্রতি আপনার আচরন যেরকম ….. আমি আসলে কিছু মেলাতে পারছি না !

আদনান প্রশ্নটা শুনে কিছু যেন নিজেই অবাক হয়ে বসে রইলো । তারপর বলল, আমি নিজেও জানি না আসলে ! সত্যিই জানি না ।

কামাল আর কিছু জানতে চাইলো না । চলে গেল ।

কামাল চলে যাওয়ার পরেও আদানান বেশ কিছুটা সময় চুপ করে বসে রইলো কেবল । নোরার প্রতি ওর আচরনটা এমন কেন হচ্ছে ! সে তার মাকে খুজে পেয়েছে । তাকে ভাল ভাবে ট্রিট করেছে । নোরাকে দেখে ওর মা এতো দিন পরে কথা বলেছে !এটা কি একটা কারন হতে পারে ? অথবা ঐদিন আদনানের মা যেভাবে নোরার হাতে শান্ত ভাবে ঔষধ খেলো এটা দেখে কি এমন আচরন আসছে !! আদানন বুঝতে পারছে না । নাকি নোরাকে দেখে ওর কারো কথা মনে পড়ছে !

আদনান জোর করে চিন্তাটা দুর করে দেওয়ার চেষ্টা করলো । সেই কথা সে কিছুতেই মনে করতে চায় না । সেই কথা মনে হলেই কেবল কষ্ট পেতে হবে ওকে । কত রাত আবার নির্ঘুম কাটাতে হবে কে জানে !

ছয় 

সোবাহান চৌধুরীর এখন খুব বেশি কাজ কর্ম নেই । দিনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি কাটান বই পড়ে আর গান শুনে । যদিও কোম্পানীর চেয়ারম্যান পদে এখনও তিনি অধিষ্ঠিত, তবে কবে শেষ অফিসে গিয়েছেন সেটা সে মনে করতে পারেন না । সব কিছু তার ছেলে আদনান খুব ভাল ভাবেই সামাল দিচ্ছে । তার হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছেন তিনি । যদিও একেবারে পরিপূর্ন নিশ্চিত জীবন তার আসে নি । বিশেষ করে ১১ বছরের আগের ঐ দুর্ঘটনার পর জীবন কিছুটা অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলো ।

সেই ঘটনার পর থেকে তিনি এক প্রকার তার স্ত্রীকে হারিয়েই ফেলেছিলেন । তারা হাসিখুশি আর চঞ্চল ছেলে একেবারে বদলে গেল । সে কিছুটা সময় দুজনের মধ্যে যোগসুত্র ছিলেন । বাসার ভেতরে কেবল সেই একমাত্র স্বাভাবিক ছিল সেই সময়ে । আদনান তারপর থেকেই অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল অফিসের কাজে মনযোগ দিয়েছিলো । মাত্র ওর তখন ২০ বছর বয়স । নিজের পড়াশুনাও সে শেষ করে নি । নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য সব কাজ সে করেছিলো কেবল মাত্র নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য !

আজকে অনেক দিন পরে সোবাহান চৌধুরী আবারও খানিকটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে । অন্তত তার মনে হচ্ছে যে এমন একজন কে পাওয়া গেছে যাকে দিয়ে সম্ভবত তার ছেলে আদনান এবং স্ত্রী রেবেকাকে আবার স্বাভাবিক করা যাবে ! নোরা নামের মেয়েটার উপর এই দুইজনেরই একটা আলাদা প্রভাব আছে ।

নোরাকে দেখেই রেবেকা গত ১০ বছরের মাঝে প্রথম কথা বলেছে । গতদিন আদনান নার্স ফাতেমাকে আবার কাজে নিয়োগ দিয়েছে কেবল এই নোরার অনুরোধে । আদনানের উপর নোরার প্রভাবটা কেমন সেটা দেখার জন্যই সোবাহান চৌূধুরী নিজে ফাতেমাকে ডেকে নোরার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো । তাকে বলেছিলো সে নোরা যদি তার হয়ে কোন ভাবে আদনানের কাছে অনুরোধ করে তাহলে হয়তো সে আবার তার চাকরি ফিরে পেলেও পেতে পারে । যদিও সোবাহান চৌধুরী নিজে খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না । তবে তার ধারনা সঠিক হয়েছে । ব্যাপারটা সোবাহান চৌধুরীকে খুবই আশান্বিত করে তুলেছে । এই ব্যাপারেই সে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা থেকে এতো দুর চলে এসেছে ।

আতিকুল ইসলাম কেবল কিছু সময় সোবাহান চৌধুরীর দিকে কিছু সময় অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো । তার যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে সোবাহান চৌধুরীর মত শিল্পপতির তার সরকারী কোয়াটারের ড্রয়িং রুমে বসে আছে । এখানে আসার কারনটাও সে একটু আগে তাকে ব্যাখ্যা করে করেছে । সোবাহান চৌধুরী তার ছেলের আদনানের সাথে নোরার বিয়ে দিতে চান । এবং সেটা যতদ্রুত সম্ভব !

এতো ভাল প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার আসলে কোন কারন নেই । তারপরেও আতিকুল ইসলামের সংশয় ঠিক যাচ্ছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে এতো এতো যোগ্য মেয়ে থাকলে কেন তার মেয়ে নোরা ! এমন কি এখনও নিজের পড়াশুনাও শেষ করে নি।

সোবাহান চৌধুরী অবশ্য নোরার সাথে তার পরিবারের পরিচয় হওয়ার ঘটনাটা সবিস্তারেই বর্ণনা করেছে । তার বক্তব্য হচ্ছে টাকা পয়সার অভাব তার নেই । টাকাওয়ালা মেয়ে তার চাই ও না । তার দরকার একজন মায়াময়ী মেয়ে । আর এই হিসাবে নোরার থেকে ভাল আর কেউ হতেই পারে না ।

আতিকুল ইসলাম আরও কিছু সময় শংসয় প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েই গেলেন । তবে একটাই শর্তই দিলেন যে তার মেয়ে পড়াশুনা শেষ করতে চায় । এই সময়ে বিয়ে হয়ে গেলে হয়তো সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে । কোন ভাবে যদি বিয়েটা ওর পরীক্ষার শেষ পর্যন্ত আটকানো যায় । সোবাহান চৌধুরী বললেন, বিয়ের পরে সে হয়ে যাবে আমার মেয়ে । আর আমার মেয়েকে কি আমি পড়াশুনা করাবো না । তার কিছু করতে হবে না । তার জীবন যেমন ছিল তেমনই থাকবে । কেবল তার বিয়ে হবে । আর কিছু না ! আপনি প্লিজ মানা করবেন না ।

-তারপরেও । আসলে বিয়ের পর আসলে এসব এক থাকে না ।

সোবাহান চৌধুরী কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা আপনি মেয়ের বাবা । আপনার কথা আমাকে শুনতেই হবে । তবে আমার কথাটাও শুনুন একটু । দুজনের কথাই থাকুক !

-যেমন ?

-আপাতত ওদের বিয়েটা হয়ে যাক ! ঘরোয়া ভাবে ! কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই। নোরার পড়াশুনা শেষ হলে আমরা তখন ওকে আনুষ্ঠানিক ভাবেই আমাদের ঘরে তুলে নিবো । কেমন হবে ? আসলে বুঝতেই পারছেন যে এখনকার যুগে কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না । আমি কোন ভাবেই নোরাকে হাতছাড়া করতে চাই না । কোন ভাবেই না ।

আতিকুল ইসলাম এবার আর না করতে পারলেন না । সোবাহান চৌধুরী যে নোরাকে পুত্রবধু করেই তবে এই বাড়ি ছাড়বেন সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয় নি ।

ঠিক এক সপ্তাহের মাঝে নোরার সাথে আদনানের বিয়ে হয়ে গেল পারিবারিক ভাবে । নোরার বাবা আর মায়ে ঢাকাতে গিয়ে হাজির হলেন । নোরাকে নিয়ে হাজির হলেন আদনানদের বাসায় । নোরা তখন কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল । ও এতোটাই অবাক হয়েছিলো যে কোন কথা বলার ভাষা খুজে পাচ্ছিলো না ।

সারা জীবন নোরা বাবার আদরের মেয়ে ছিল । বাবা কোন দিন তার উপর কোন কথা চাপিয়ে দেন নি । আজকে যখন ওকে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করলেন নোরা কিছুতেই না করতে পারলো না ।

এদিকে আদনানও একটা কথা বলল না । পুরোটা সময় কেবল গম্ভীর হয়ে বসে ছিল । কাজী সাহেব যখন কবুল বলতে বলল সে শান্ত ভাবেই কবুল বলল । রেজিস্ট্রি খাতায় সই করে দিল । ওর মাথার ভেতরে তখন ঝড় চলছে ।

কাজটা সে কেন করছে ?

কেন অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করছে ?

ও নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলো জীবনে আর অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করবে না । তাহলে কেন আজকে সই করার সময় ওর হাত একবারও কাঁপলো না ! নোরা নামের এই মেয়ের মাঝে এই অদ্ভুত ব্যাপার আছে । কিন্তু সেটা কি আদনান বলতে পারে না ।

রাতের বেলা যখন বাসর ঘরে ঢুকলো আদনানের মনে হচ্ছিলো যেন স্বপ্ন দেখছে । বিছানার ঠিক মাঝখানে নোরা বসে ছিল মাথায় ঘোমটা দিয়ে । দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথেই আদনানের মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো । খুব পরিচিত এই দৃশ্য । প্রতিরাতে এই দৃশ্যটাই তার চোখের সামনে এসে হাজির হয় । এই দৃশ্যটা তাকে ঘুমাতে দেয় না রাতের পর রাত ! তখন মাথার উপর খুব বেশি জোর পরে !

হঠাৎই পুরো জগতটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এল । মাটিতে মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার আগ দিয়ে ঝাপসা ভাবে আদনান কেবল দেখতে পেল বউ সাজে নোরা ওর দিকে এগিয়ে আসছে । তারপর আর কিছু মনে নেই ওর !

সাত

অরিন কিছু সময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নোরার দিকে । ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না নোরার কথা । অবশ্য এমন কথা যে কারো বিশ্বাস হওয়ার কথা না । অরিন নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই সত্যি বলছিস ?

নোরা নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ছিল । ফেসবুকের টাইম লাইন চেক করছিলো । অরিনের দিকে না তাকিয়েই বলল, তোকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ ? আর আমি এতো বড় একটা মিথ্যা কেন বলবো শুনি ?

অরিন আরও কিছু সময় নোরার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো জোরে ! এতো জোরে যে পাশের ঘর থেকে দু তিন জন মেয়ে ছুটে এল !

-কি হয়েছে কি হয়েছে ?

নোরা বিরক্ত হয়ে একবার অরিনের দিকে তাকালো । তারপর মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল , আরে কিছু না । এই গাধাটা তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়েছে । মেয়ে দুটো হাসতে হাসতে চলে গেল । অরিন এরপর নোরাকে চেপে ধরলো । তারপর বলল, বল বল ! কিভাবে হল এসব ! আমি তো কিছুই জানি না এসবের !

নোরা মনিরট থেকে মুখ তুলে অরিনের দিকে তাকালো । তারপর বলল, আমি নিজেই কিছু জানি ? আমার নিজেরই এখন বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাও আবার আদনানের সাথে !

দুইদিন আগে নোরার সাথে আদনানের বিয়ে হয়েছে । নোরা এই ভাবে কারো বউ হয়ে যাবে সেটা নোরা কোন দিন ভাবে নি । তাও আবার আদনানের বউ যে হবে সেটা তো কোন দিন ভাবেই নি । কিন্তু বউ হয়ে গেছে এটাই হচ্ছে সব থেক বড় কথা । এটা এখন আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই । অবশ্য এতে নোরা যে অখুশি সেই কথা সে বলতে পারবে না । নিজের মনের কাছেই প্রশ্ন করে দেখেছে । কোন উত্তর সে পায় নি । তার মানে এই না যে সে আদনানকে বিয়ে করতে পেরে খুব আনন্দিত হয়েছে । আসলে ওর নিজের ভেতরে এমন কিছুই অনুভূত হচ্ছে না । কেবল অবাক হয়েছে খুব । এমন ভাবে কেন সে আদনানের বউ হয়ে গেল । কেবল মাত্র ঐদিন ওর মাকে সাহায্য করেছে বলেই । মায়ের প্রতি ছেলের এতো ভালবাসা ! এটা অবশ্য নোরাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে । মা ভক্ত ছেলে !

কিন্তু সব থেকে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে বাসর রাতে আদনান এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেল কেন ?

কি হাস্যকর একটা ব্যাপার !

এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কি কোন কারন আছে ?

নোরা একবার শুনেছিলো ওর এক বান্ধবীর বড় বোন নাকি এই ভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো বাসর রাতে । অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো । বর যখন কাছে আসতে যাচ্ছিলো তখন নাকি ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো । পরে সেটা নিয়ে কি হাসাহাসি । বেচারি সেই ঘটনা নিয়ে এখনও লজ্জায় লাল হয়ে যায় !

আদনান যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো নোরা প্রথমে ভেবে পায় নি কি করবে ! প্রথমেই মনে হয়েছিলো তখনই দৌড়ে যায় বাইরে । কাউকে ডেকে নিয়ে আসে ! কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল । এই ঘটনা যদি বাইরে কেউ জানে তখন বেচারা সারা জীবন লজ্জা পেয়েই কাটাবে । এতো বড় কোম্পানীর মালিক এতো মানুষ তাকে চেনে । যদি এই ব্যাপারটা কোন ভাবে মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে আদনান লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না কাউকে ।

এটা ভেবেই আবার দরজা থেকে ফিরে এল । কিছু সময় আদনানের দেহটা বিছানায় তোলার চেষ্টা করলো । কিন্তু কোন লাভ হল না । ওর নিজের এতো শক্তি নেই যে আদনান কে খাটের উপর তুলবে । অবশ্য যেখানে ও ছিল সেখানে নরম কার্পেট দিয়ে মোড়া । তাই খুব বেশি চিন্তিত হল না । বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে এসে আদনানের মাথার নিচে দিয়ে দিল । তারপর নিজেও আদনানের পাশে বসে পড়লো । কিছু সময় তাকিয়ে রইলো আদনানের ঘুমন্ত চেহারার দিকে ।

নিজেও ভেবে পাচ্ছিলো না যে এই সুদর্শন মানুষটা ওর স্বামী হয়ে গেছে !

কিভাবে স্বামী হয়ে গেল !

এটাই বুঝি লেখা থাকে কপালে ! কিভাবে আর কার সাথে যে মানুষের বিয়ে হয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না । নোরা কি সত্যিই কোন ভেবেছিলো এই মানুষটার সাথে ওর বিয়ে হবে ?

নাহ কোন দিন ভাবে নি !

এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেটা নিজেও জানে না । সকালবেলা যখন ঘুম ভাঞ্গলো অবাক হয়ে দেখলো ও খাটের উপর শুয়ে আছে । ওর স্পষ্ট মনে আছে যে আদনানের পাশেই বসে ছিল সে । কোন ভাবেই খাটের উপরে আসে নি । আদনানকে নিচে রেখে ও কোন ভাবেই খাটের উপর এসে ঘুমাতে পারে না ! তার মানে আদনান নিজে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে ?

এই অনুভূতিটা মনে আসতেই একটা লজ্জা লজ্জা অনুভব হল । ঘরে অবশ্য তখন কেউ ছিল না । আদনান ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে গেছে ।

সকালে নাস্তার টেবিলে অন্য সবাই হাজির থাকলেও আদনান ছিল না । জানা গেল সে নাকি সকাল বেলাতেই বেরিয়ে গেছে । তার অফিসে জরুরী কাজ আছে । সোবাহান চৌধুরী খানিকটা বকাবকি করলেন এই ভাবে সকালে চলে যাওয়ার জন্য । সকালের নাস্তাটা অন্তত এক সাথে খাওয়ার দরজার ছিল । তবে নোরার বাবা বলল যে সকালে যাওয়ার আগে নাকি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে । এটা শুনে সোবাহান চৌধুরী খানিকটা শান্ত হলেন । তবে নোরার মনে তখন চলছে অন্য কথা । নোরা নিশ্চিত ভাবেই জানে যে আদনান ওর সামনে না পড়ার জন্য ওভাবে সকাল বেলাতেই বেরিয়ে গেছে । মনে মনে হাসলো কেবল ।

নোরার বাবা মা আরও একদিন ছিল আদনানদের বাসায় । তারপর ওকে রেখে ওরা বিদায় নিল । নোরা তারপরের দিন হলে ফিরে এল । এই দুইদিনে আদনান একবারও বাসায় আসে নি । ওর নাকি বিশেষ কাজ পরে গেছে । ঐদিন রাতেই চট্টগ্রাম যেতে হয়েছে ওকে ! নোরা এবার নিশ্চিত হয়ে গেল যে আদনান লজ্জায় নোরার সামনে আসছে না। নোরা যত সময় আদনানদের বাসায় থাকবে তত সময় আদনান বাসায় আসবে না । নিজের হলে ফেরৎ চলে এল !

***

-স্যার বাসায় যাবেন তো ?

কামালের কথা শুনে আদনান যেন বাস্তবে ফিরে এল । তাকিয়ে দেখলো গাড়িটা ওদের বাসার পথ ধরেছে । সকাল বেলা সব গাড়ি গুলো অফিস পাড়ার দিকে যাচ্ছে । আদনান বলল, না আগে অফিসে চল ! ওখানে কিছু কাজ আছে !

তারপর খানিকটা ইতস্ততঃ ভাবে কামালকে জিজ্ঞেস করলো, বাসায় কি নোরা আছে এখন ?

কামাল সাথে সাথেই বলল, না স্যার ! ম্যাডাম গতকালকে তার হলে ফেরৎ গেছে । তার নাকি কি একটা পরীক্ষা আছে ।

-আচ্ছা ।

আদনান কি যেন ভাবলো । তারপর বলল, আচ্ছা আগে তাহলে বাসার দিকে চল । তারপর না হয় অফিস যাওয়া যাবে ।

কামালের দিকে তাকিয়ে আদনানের মনে হল কামাল হয়তো কিছু আচ করতে পেরেছে । একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করতে শুরু করলো । কালাম কি জেনে যাবে সব ! বাড়ির অন্য সব মানুষ যদি জেনে যায় ?

আর নোরা যদি রাতের কথা ওর বন্ধুদের কাছে বলে ?

এই ব্যাপারটা ভাবতেই ওর মুখটা খানিকটা লাল হয়ে গেল । এই চিন্তাতে ওর গত দুই দিন ঠিক মত ঘুম হয়নি । ওর বাবা ওকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে বকাবকি করেছে । বারবাই আদনানের মনে হচ্ছিলো যে ওর বাবা হয়তো এখন বলবে যে তুই গাধা বাসর রাতে ঐভাবে অজ্ঞান কেন হয়ে গেলি !

সত্যিই কেন এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেল ?

নোরার ঐভাবে বসে থাকতে থেকে অতীতের ঐদিনের কথাটা এইভাবে মনে পড়ে যাবে সেটা আদনান বুঝতে পারে নি । সে কোন দিন এমন একটা দিনের সম্মুখীন হবে সেটাও সম্ভবত ওর ধারনা ছিল না । অন্য কেউ তার বউ হবে এটা ওর অবচেতন মন ঠিকঠাক মেনে নিটে পারে নি । তাই হয়তো এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ।

সকাল বেলা যখন আদনানের ঘুম ভেঙ্গেছিলো দেখেছিল যে ও সেই নিচেই শুয়ে আছে । ওর মাথার নিচে একটা বালিশ দেওয়া । ঠিক ওর পাশেই গুটুসুটি মেরে নোরা শুয়ে আছে । নোরার দিকে তাকিয়ে আদনানের একটা অন্য রকম অনুভূতি হল । দশ এগারো বছর পরে কারো জন্য এই অনুভূতি সে অনুভব করলো । খুব সাবধানে নোরাকে কোলে তুলে নিয়ে সে বিছানাতে শুইয়ে দিল । তারপরই ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল ! আজকে ফেরৎ আসছে ।

বাসায় এসে আদনান আরেকটা কথা জানতে পারলো । সোবাহান চৌধুরী প্রথমে ওকে একটু বকাবকি করলো বটে । তবে শেষে যে কথাটা বলল সেটাতে ওর মনটা আসলেই ভাল হয়ে গেল । এই দুইদিন নোরা নাকি প্রায় পুরোটা সময়ই ওর মায়ের কাছে ছিল । মায়ের ঘরেই সময় কাটিয়েছে । নিজে হাতে আদনানের মা কে গোসল করিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে । এবং সব থেকে অবাক করার ব্যাপার যে ও খুব শান্ত ভাবেই নোরার প্রতিটি কথা শুনেছে ।

এতোদিন আদনানের মা রেবেকাকে তার ঘরের ভেতরেই খাওয়ানো হত । এই দুইদিনে রেবেকাকে নোরা ডাইনিং রুমে এনে খাইয়েছে । বিকেলে তাকে নিয়ে লনে হাটাহাটি করেছে । সারাটা সময় নোরার হাত ধরেছিল সে ।

সোবাহান চৌধুরী হঠাৎ বলল, তুই কি রাগ করেছিস আমার উপরে ?

আদনান বলল, কেন রাগ করবো কেন ?

-এই যে এই ভাবে তোকে বিয়ে দিলাম !

আদনান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল । কি যেন ভাবলো । সোবাহান চৌধুরী বলল, আমি জানি তুই নীতুকে খুব বেশি ভালবাসতি । এখনও বাসিস কিন্তু এইভাবে আর কতদিন! তোকে মা কে দেখ নোরাকে কিভাবে আপন কে নিয়েছে এক নিমিশেই । আমার কি মনে হয় জানি ? তোর মা খুব জলদি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে !

আদনান বলল, নোরাকে সব কিছু বলেছো কি ?

-না কিছুই বলি নি !

-এটা তাকে বলা দরকার ছিল না কি ?

-হয়তো ছিল ?

-এখন সব শুনে যদি সে চলে যায় ? তখন ?

-যাবে না । দেখিস এই মেয়ে যাবে না ! ওকে ঠিকঠাক মত বুঝিয়ে বলতে পারলে এই মেয়ে ঠিকই বুঝবে !

আদনান আর কিছু বলল না । নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা দিল ।

আট

নোরার ইনকোর্স পরীক্ষা শেষ হল বিকেল বেলা । হল থেকে বের হয়েই কামালকে দেখতে পেল ডিপার্টমেন্টের সামনে দাড়িয়ে থাকতে । ওকে দেখার সাথে সাথে মুখে ৬০ পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠলো । দ্রুত এগিয়ে এল ওর দিকে ।

-পরীক্ষা ভাল হয়েছে ম্যাম ?

কামালের বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে নোরা হেসে ফেলল । তারপর বলল, এটা কে জানতে চাচ্ছে ? আপনি নাকি আপনার স্যার ?

কামাল বলল, স্যার আসলে কিছুই জানতে চাচ্ছেন না । না মানে আপনি এমন করে বিয়ের পরদিনই হলে চলে এলেন পরীক্ষার কারনে । আমি ভাবলাম যে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ন কোন পরীক্ষা হবে । তাই নিজ থেকে জানতে চাইলাম আর কি ?

নোরা বলল, এমন কোন গুরুত্বপূর্ন পরীক্ষা না । না দিলেও কোন সমস্যা হত না ।

-তবুও চলে এলেন !

-হ্যা । আমি যে চলে এসেছি শক দুর করার জন্য !

নোরার কথা শুনে কামাল বেশ অবাক হল । তারপর বলল, শক মানে ? আপনি কি বলছেন ? বিয়ে করে আপনি শকে আছেন ?

নোরা আবারও হাসলো । তারপর বলল, আমি না, আপনার বস !

কামাল যেন এবার আকাশ থেকে পড়ল । অবাক চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো নোরার দিকে । নোরা সেদিকে লক্ষ্য না করে বলল, কেন আপনি খেয়াল করে নি ? আমি নিশ্চত জানি যে আপনার বস আমার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে । দেখলেন না বিয়ের পরদিন সকালেই কেমন করে চট্টগ্রাম পালিয়ে গেল । আমি যদি তার বাসা থেকে না আসতাম তাহলে বাসাতেই আসতো না ।

কামাল প্রতিবাদ করতে গিয়েও করলো না । কিছু যেন তার মনে পড়ে গেল । সত্যিই কিছু সময় সে ভেবে ভেবে দেখলো । আদনান চৌধুরী জরূরী ভিত্তিতে যে চট্রগ্রাম চলে গেল সেই কাজটাতে তার না গেলেও চলতো । কামালকেই পাঠানো যেত । কিংবা জিএম সাহেব কে পাঠালেই কাজ হয়ে যেত । কিন্তু তার বস নিজে নিজে চলে গেল । এমন কি কামাল নিজেও জানতো না । একটু য অবাক হয় নি সেটা সে বলতে পারবে না !

কালাম কোন কথা খুজে পেল না । কি বলবে বুঝতে পারছে না । নোরা বলল, এখন কি জন্য এসেছেন বলুন দেখি ।

কামাল আর কথা না বলে হাতের ছোট প্যাকেট টা নোরার দিকে বাড়িয়ে দিল । নোরা বলল, এটা কি ?

-স্যার পাঠিয়েছে আপনার জন্য ।

-আপনার স্যার কোথায় ?

-স্যার অফিসে !

নোরার একবার মনে হল প্যাকেট টা কামালকে ফেরৎ পাঠিয়ে বলে যে একজনের উপহার সে অন্যের কাত থেকে নেয় না । কিন্তু কি মনে হল সেটা করলো না । হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিল । ভেতরে কি আছে সেটা আন্দাদ করতে ওর খুব একটা অসুবিধা হল না । সেটা হাতে নিয়ে নিজের হলের দিকে হাটা দিল ।

কামাল ওর পিছু পিছু আসতে লাগলো । নোরা যখন বুঝতে পারলো যে কামাল পেছন পেছন আসছে নোরা দাড়িয়ে বলল, আরও কিছু বলতে চান ?

-জি।

-স্যার আপনার ব্যবহারের জন্য একটা গাড়ি পাঠিয়েছে !

-কি ?

-হ্যা । ঐ যে লাল রংয়ের প্রিমিও গাড়িটা দেখছেন গেটের সামনে ওটা আপনার জন্য !

নোরা অন্তত এটা আশা করে নি । নোরা বলল, আমি গাড়ি নিয়ে কি করবো ? আমি গাড়ি চালাতে জানি নাকি ?

কামাল সাথে সাথে বলল, গাড়ির সাথে ড্রাইভার আছএ । সে ২৪ ঘন্টা থাকবে ।

-২৪ ঘন্টা কিভাবে থাকবে । তার খাওয়া ঘুম লাগবে না ।

কামালের চেহারা দেখে মনে হল এটা যেন সে ভেবে দেখে নি । কিছু সময় ভাবলো । তারপর বলল, সেটার সমাধান করা যাবে । দুইজন ড্রাইভার রেখে দিবো তাহলে । ওরা সিফট অনুয়ায়ী ডিউটি দিবে । ১২ ঘন্টা ১২ ঘন্টা !

নোরা বলল, তো ওরা কোথায় থাকবে ? আমার হলের সামনে ? আমি যখন ফোন দিবো এসে হাজির হবে !

-জি । আপনার এক ফোনেই হাজির হবে । এক মিনিটের বেশি সময় নিলে চাকরি নট !

নোরা বলল, শুনুন চাকরি নট করতে হবে না । আপনার বসকে বলে দিন যে গাড়ি লাগবে না । ওটাকে নিয়ে যান ।

-কিন্তু ম্যাডাম …..

-কোন কিন্তু এই গাড়ি নিয়ে যান । আমার গাড়ি পছন্দ হয় নি । লাল রং আমার পছন্দ না !

কামাল বলল, তাহলে কি অন্য …..।

নোরা হাতের ইশারায় কামালকে চুপ করতে বলল। তারপর হাতের ইশারায় গেটের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিল । তারপর নিজে হাটতে লাগলো হলের দিকে । কামাল খানিকটা বোকা আর অসহায়ের মত দাড়িয়ে রইলো । কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । আদনান ওকে খুব ভাল করে বলে দিয়েছে গাড়িটা যেন নোরা নেয় এই ব্যবস্থা করতে । এর অর্থ হচ্ছে যে কোন ভাবেই হোক তাকে রাজি করাতে হবে । কিন্তু সে তো সেই সুযোগই পেল না । ও তো ভেবেছিলো গাড়ির কথা শুনে নোরা ম্যাডাম লাফাতে লাফাতে রাজি হয়ে যাবে নিতে । আস্ত একটা গাড়ি আবার কে না নিতে চায় ! আজিব এই মেয়ে গুলো ! এমন কেউ করে নাকি !

এখন সে কি করবে !

কামালের মতই অরিন যেন আকাশ থেকে পড়লো যখন শুনলো যে নোরা আদনানের দেওয়া গাড়িটা ফিরিয়ে দিয়েছে । রাতের বেলা দূজন বসে গল্প করছিলো । নোরার হাতে নতুন ফোনটা দেখেই জানতে চাইলো কবে কিনলো ! নোরা জানালো যে কিনে নি । আদনান পাঠিয়েছে । সেই সাথে যখন বলল একটা গাড়িও পাঠিয়েছিলো । সে ফেরৎ পাঠিয়েছে !

অরিন কিছু সময় চিৎকার চেঁচামিচি করলো । তারপর বলল, শোন এখন আদনান হচ্ছে তোর স্বামী । তার সব কিছুর উপর তোর অধিকার রয়েছে । ক্ষেত্র বিশেষে আদনানের থেকে বেশি রয়েছে !

নোরা বলল, তার জিনিসের উপরে তার থেকে বেশি অধিকার ?

-অবশ্যই । তোর কিছু দরকার হলে সে দিতে বাধ্য ! নিজের জন্য না কিনলেও তোর জন্য সেটা সে কিনে দিবে । বুঝেছিস ?

-না বুঝি নি । বুঝতে চাই ও না !

অরিন বলল, ইস ! এখন গাড়িটা থাকলে কত ভাল হত । আমি গাড়িতে করে এই রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতে পারতাম !

-তা কিভাবে বের হতাম শুনি !

-সেটা শুনে আর লাভ কি ! গাড়ি তো নাই ।

নোরার হঠাৎ কি মনে হল । সে বলল, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি । তুই বল কিভাবে হল থেকে বের হব !

অরিন বলল, তুই গাড়িটা আনা । আমি বের করছি তোকে !

নোরার নিজের মোবাইল বের করে আদনানকে ফোন দিল । একটু যে সংকোচ লাগছিলো না সেটা বলবে না । তবে এই রাতের বেলা গাড়িতে করে করে ঘুরে বেড়ানোটা আসলে অন্য রকম একটা ব্যাপার হবে ।

ওদের ক্লাসে আরিয়ানা নামে একটা মেয়ে পড়ে । প্রায়ই দেখা যায় রাত দুই টা কি তিনটার সময় সে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভে বের হয়েছে । ঢাকা শহরের বেশ কিছুদিন সে আছে তার পরেও কখনও রাত করে বের হয় নি । এমন কোন সুযোগই আসে নি ।

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হল । কিন্তু কোন আওয়াজ হল না । নোরাও কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, গাড়িটা কি আমার হলের সামনে পাঠানো যাবে এখন ?

নোরা ফোনের ভেতরে একটা নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজ শুনলো । আদনান বলল, আমি বলে দিচ্ছি !

ফোন রেখে অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ি আসছে ! চল দেখি কিভাবে বের হস !

অরিন বলল, চল দেখাচ্ছি ।

বারান্দায় বের হল নোরার মনে হল যেন পুরো হলটা ঘুমিয়ে পড়েছে । তবে ও জানে যে বলতে গেলে প্রায় সবাই জেগে আছে । কেউ কেউ পড়াশুনা করছে নয়তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে । এদের ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর হয়ে যাবে । তার কোন আওয়াজ না করেই ওরা হাটতে শুরু করলো সিড়ি দিকে । প্রধান গেটের কাছে আসতেই দেখলো গেটের দারোয়ান নিজের মোবাইল কি যেন দেখছে গভীর মনযোগ দিয়ে ।

নোরা অবাক হয়ে দেখলো অরিক একটা ১০০ টাকার নোট দারোয়ানের পকেটে ঢুকিয়ে দিল । দারোয়ানের সামনেই একটা ছোট টেবিলের উপরে চাবির গোছা ছিল । সেটা নিয়ে ছোট গেট টার তালা খুলে ফেলল । তারপর চাবিগোছাটা আবার আগের স্থানে রেখে দিল । দারোয়ান তখনও মনযোগ দিয়ে মোবাইলে ভিডিও দেখছে । ওরা সামনে দিয়ে পার হল সেটা যেন দেখলোই না ।

গেটের বাইরে বের হতেই নোরার মনে হল যেন অন্য জগতে চলে এসেছে । রাতের ঢাকা এরকম লাগে ?

প্রতিদিন এই গেট দিয়ে যে ভেতরে ঢোকে । এই রাস্তায় হাটে অথচ এখন এই রাস্তাটা কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে । আশ্চর্য !

অরিন বলল, গাড়ি কোথায় ?

নোরার কিছু বলতে হল না । দেখতে পেল একই সাথে তিনটা গাড়িটা সারি বেধে ঠিক ওদের সামনে এসে থামলো ।

নোরা আর অরিন কিছু সময় একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ী করলো । একজন ড্রাইভার দরজা খুলে হয়ে বের হয়ে বলল, ম্যাডাম, আপনি বলেছিলেন লাল রং পছন্দ নয় তাই এই তিনটা রংয়ের গাড়ি পাঠিয়েছে । নীল, কালো আর সাদা ! আপনি যেটা পছন্দ হবে সেটা আপনার জন্য রাখা হবে !

নোরা কিছু বলতে যাবে তার আগে অরিন বলল, আর যদি তিন টাই পছন্দ হয় ।

ড্রাইভার দাঁত বের করে বলল, তাহলে তিনটাই আপনার ! এখানেই থাকবে !

অরিন বলল, চল এখন কালোটাতে উঠি । কাল সকালে নীলটা চড়া যাবে । আর দুপুর বেলা আমরা চড়বো সাদাতে । আরেকটা গাড়ি থাকলে ভাল হত । বিকেলে চড়তে পারতাম !

নোরা অরিনকে বলল, চুপ থাক তো !

তবে অরিনের ইচ্ছে অনুযায়ী ঠিকই কালো গাড়িতেই উঠলো ।

নোরার কেন জানি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে শুরু করলো । ওর জীবনটা কি আসলেই এমন হওয়ার কথা ছিল ? এতো সৌভাগ্য ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো ?

এতো এতো ভাল ভাল সব কিছু ঘটছে এরপরই খারাপ কিছু ঘটবে না তো ? নোরা জানে না । তবে নোরা এসব নিয়ে আর ভাবার সময় পেল না । অরিন ততক্ষণের ছাদের উপরের কাঁচ খুলে ফেলেছে । নিজের শরীরের অর্ধেকটা বাইরে বের করে দিয়ে চিৎকার করা শুরু করেছে । গাড়ি চলছে খুব দ্রুত ! নোরা কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো । ঢাকা শহরটা ওর কাছে অন্য রকম লাগছে । ওর পুরো জীবনটাই অন্য রকম হয়ে গেছে । সামনে হয়তো আরও অন্য রকম হবে !

শেষ অংশ

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 38

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “দ্য আনএক্সপেক্টেড ব্রাইড (প্রথম অংশ)”

  1. ইন্টারেস্টিং 😍😍
    আরো পর্ব আছে ভাইয়া??

Comments are closed.