দ্য আনএক্সপেক্টেড ব্রাইড (শেষ অংশ)

অপু তানভীরের গল্প
4.8
(49)

নয়

নোরার নিজের ভাগ্যকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । একটু আগেও পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল অথচ এখন পরিস্থিতি একেবারেই অন্য রকম হয়ে গেছে । নোরা আর অরিন এখন হাতিরঝিল থানার একটা বেঞ্চে বসে আছে । ওদের ড্রাইভার মনজুকে হাজতে ভরে রাখা হয়েছে । কি থেকে কি হয়ে গেল নোরার কাছে এখনও কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে । ঠিক স্বপ্নের মত না, দুঃস্বপ্নের মত !

ক্যাম্পাস থেকে ওদের দুজন কে তুলে নিয়ে গাড়িটা চলছিলো বেশ ভাল ভাবেই । অরিন কিছু সময় গাড়ির ছাঁদ খুলে মাথা বের করে দিয়েছিলো । তারপর কিছু সময় চিৎকার চেঁচামিচি করে আবারও গাড়ির ভেতরে এসে বসলো । তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার নাম কি ড্রাইভার সাহেব ?

ড্রাইভার বলল, জি আফা মনজু !

-মনজু সাহেব এই গাড়ির স্পিড লিমিট কত ?

-গাড়ি ভাল আছে আফা । একেবারে মাখন ! আর এখন চালাইলে মনে হইবে গাড়ি উড়তাছে !

-ওকে ওড়ান দেখি আপনার গাড়ি !

-আইচ্ছা আফা !

নোরা কিছু বলতে যাচ্ছিলো তবে অরিনের আগ্রহ দেখে আর কিছু বলল না । ঢাকা শহরের গাড়ির গতি ২০ কিলোমিটারের উপরে ওঠানোর দায় ! সেখানে দেখতে দেখতে গাড়ির গতি বেড়ে দাড়ালো একশতে । গাড়িটা যেন সত্যিই আকাশে উড়ছিলো । নোরার খারাপ লাগছিলো না । কিন্তু ঝামেলা বাঁধতেও দেরি লাগলো না । হঠাৎই একটা পুলিশের সাইরেন শোনা গেল পেছন থেকে । হয়তো ঝামেলা তখনও এড়ানো যেত যদি তখনই গাড়িটা থামানো হত । অরিনের মাথায় কি কাজ করলো কে জানে সে ড্রাইভারকে বলল যে আরও জোরে চালাতে । পুলিশের গাড়ির স্পিড বেশি না । ওদেরকে ধরতে পারবে না ।

কিন্তু ওদের ধারনায় ভুল ছিল । পুলিশের গাড়ি দেখতে যেমনই হোক গতির দিক দিয়ে তারা কম নয় । আধা ঘন্টা রেস খেলার পর ওদের গাড়িটাকে ধরে ফেলল । ওদের কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা থানায় নিয়ে এল । সেখানে আধা ঘন্টা ধরে বসে আছে ওরা । মেয়ে বলেই হয়তো ওদের হাজতে ঢোকানো হয় নি । একটা বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে ।

আদনান এল আরও আধা ঘন্টা পরে । ওসির সাথে কথা বলে ওদে ছাড়াতে অবশ্য খুব বেশি বেগ পেতে হল না । থানার সামনে যখন ওরা বেরিয়ে এল তখন নোরার লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো । অরিনকে ইচ্ছে করছিলো যেন কষে একটা চড় মাড়ে কিন্তু অরিনের এসবের কিছুই স্পর্শ করছে । ও যেন খুব মজা পাচ্ছে । নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছিস বড়লোক জামাই থাকার কত্ত সুবিধা !

-চুপ !

অরিন অবশ্য সেদিকে কোন কান দিল না । আদনানের সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, আমাকে চিনেন তো দুলা ভাই ! আমি হচ্ছি আপনার বউয়ের সব থেকে কাছের বন্ধু ! এই শ্যালিকাকে কিন্তু ভুলবেন না । আমি ওর সব সিক্রেট জানি ।

নোরা পেছন থেকে অরিনের দিকে চোখ গরম করে তাকালো । তবে অরিন সেটা হেসেই উড়িয়ে দিল । আদনান বলল, আপনি হলে ফেরৎ যান এখন । অনেক রাত হয়েছে ।

এই বলেই মনজুর নাম ধরে ডাক দিল । মনজু পেছনে দাড়িয়ে ছিল মাথা নিচু করে ।

-মিস অরিনকে হলে রেখো এসো । দেখো আবার কোন ঝামেলাতে যেন পড়ো না ।

-জি স্যার !

আদনান তারপর নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি আমার সাথে একটু আসবেন ? যদি আপনার কোন সমস্যা না হয় ! কাল তো শুক্রবার আশা করি আপনার ক্লাসের কোন সমস্যা হবে না !

অরিন আবারও বলে উঠলো, আরে কোন সমস্যা নেই ।

আদনানের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলো যে অরিনের কথা শুনে সে বিরক্ত হচ্ছে । তবে মুখে কিছুই বলছে না । নোরার বন্ধু বলেই হয়তো কিছু বলছে না ।

নোরা অরিনকে চলে যেতে দেখলো । তার পরেও কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো আদনানের পাশে । নোরার কেবল মনে হল এখনই বুঝি নোরাকে আদনান বড় করে ধমক দিতে । কিংবা বাসায় নিয়ে গিয়ে খুব বকাবকি করবে ! আদনানের গাড়িটা থানার সামনেই পার্ক করা ছিল । নোরার খুব করে মনে হতে লাগলো যে অরিনের সাথে চলে গেলেই হয়তো ভাল হত । কওন ভাবে যদি বলে ফেলতো যে কাল ওর কাজ আছে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে আটকে রাখতো না ।

আদনান ওর দিকে একটু তাকিয়ে তারপর গাড়ির দিকে হাটা দিল । নোরার কি করা উচিৎ এখন ?

এখানেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি আদনানের পেছন পেছন গিয়ে গাড়িতে উঠবে ।

অবশ্য আদনানের পেছনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই ওর । এখানে এভাবে এই থানার সামনে দাড়িয়ে থাকার কোন মানে নেই ।

গাড়ি যখন চলতে শুরু করলো নোরার তখন মনে হল এখনই বুঝি বকাবকি শুরু হবে । তবে বেশ কিছু সময় চলে যাওয়ার পরেও যখন বকাবকি শুরু হল না তখন নোরা একটু যেন বুকে বল পেল । আদনানের দিকে না তাকিয়ে বলল, আপনি কি মনজুকে চাকরি থেকে আউট করে দিবেন ?

আদনান সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই কি উচিৎ না ?

-ওর তো কোন দোষ নেই । অরিন বলল বলেই তো বেচারা স্পীড তুলেছিল ।

-আপনার ক্ষতি হতে পারতো ? যদি এক্সিডেন্ট হত ?

-হয় নি তো। তাই না ? দেখুন ওকে চাকরি মানুষের ভুল হবেই । মানুষ তো মানুষ । ফেরেস্তা তো নয় । মানুষহ ভুল করবে না তো কে করবে ! আপনি প্লিজ ওকে চাকরি থেকে বের করবেন না । কথা দিন ?

হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল । আদনান গাড়িটা থামিয়ে নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সব সময় অন্যের কথা এতো ভাবেন কেন ? রাস্তার অপরিচিত মানুষকে কেয়ার করেন, অন্যের চাকরির জন্য সুপারিশ করেন । কেন করেন এসব ?

নোরা কি বলবে খুজে পেল না । আদনান একেবারে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে তাই চাইলেও চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না । আদনানের চোখের দিকে তাকিয়েই বলল, জানি না । কেবল মনে হয় আমার অল্প সাহায্যে যদি কারো উপকার হয় তাহলে মন্দ কি ?

আদনান আরও কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো নোরার দিকে । কি যেন খুজছে ওর চেহারার ভেতরে ।

অবশ্য কিছু বলল না । আবারও গাড়িটা স্টার্ট দিল । গাড়ি চালতে শুরু করলে আদনান বলল, আপনাকে এক স্থানে নিয়ে যাই চলুন !

-কোথায় ?

-চলেন । গেলেই দেখতে পাবেন !

নোরা আর কিছু জানতে চাইলো না । তবে লক্ষ্য করলো যে অন্ধকার তখন আস্তে আস্তে কমে আসতে শুরু করেছে । ভোর হচ্ছে । এমন করে কোন দিন নোরা রাতে বাইরে থাকে নি । নোরার হঠাৎ খুব ভাল লাগতে শুরু করলো । পাশে যে মানুষটা রয়েছে সেই মানুষটা আর কেউ নয় তার স্বামী । তার বিয়ে করা স্বামী । এমন ভাবে রাতে লং ড্রাইভে যাওয়ার স্বপ্ন থাকে প্রতিটি মেয়ের । কয়জন এমন সুযোগ পায় ! সেখানে নোরার সাথে হচ্ছে এসব না চাইতেই ।

আদনান বলল, একটা সময় আমি এখানে প্রায়ই আসতাম ।

-এখন আর আসেন না ?

-নাহ ! আসা হয় না অনেক দিন । প্রায় দশ বছরের বেশি !

-দশ বছর ?

-হুম । কি জানি সব কিছু আগর মত আছে কি না ! হয়তো অনেক বদলে গেছে !

তারপর নোরা দেখলো গাড়িটা একটা ছোট ব্রিজের পাশে থেমে গেল । ব্রিজটার পাশে বেশ খানিকটা ফাঁকা স্থান। রাস্তার সোডিয়াম আলো জ্বলছে । তাতেই চারিপাশটা দেখা যাচ্ছে ।

নোরা গাড়ি থেকে নামতে নামতে চারিদিক তাকাতে লাগলো । এই এলাকাতে সে এর আগে এসেছে বলে মনে পড়ে না । তবে এলাকাটায় একটা গ্রাম্য ভাব রয়েছে এখনও । ঢাকার এতো কাছে এরকম স্থান থাকতে পারে সেটা নোরার ধারনা ছিল না । আদনানও গাড়ি থেকে বের হয়ে দাড়ালো । তারপর গাড়ির ঠিক সামনে এসে দাড়ালো । নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে নদীটা দেখছেন না ? এটা কিন্তু বুড়িগঙ্গা শাখা নদি । যখন সূর্য ওঠে তখন মনে হয় যেন নদীর এই পানির ভেতর থেকে সূর্যটা উঠছে । খুব চমৎকার লাগে !

-তাই নাকি ?

-হু ।

-সূর্য উঠতে আরও কত সময় বাকি আছে ?

আদনান ঘড়ির দিকে তাকালো । তারপর বলল, আছে আরও কিছুটা সময় ।

এক সাথে এই রকম একটা অপরিচিত স্থানে আদনানের সাথে সূর্যোদয় দেখা ! ব্যাপারটা ভাবতেই নোরার মনে জুড়ে একটা আনন্দের অনুভূতি ছেয়ে গেল । রাতটা যে এভাবে শেষ হবে সেটাও সে ভাবে নি । আজকের রাতে যেন কোন কিছুই ঠিক থাকছে না । আগে থেকে কিছুই বুঝা যাচ্ছে ।

সত্যিই আজকের রাতে আগে থেকে বুঝা যাচ্ছে না যে সামনে কি হবে । ওদের যে এক সাথে সূর্যোদয়টা দেখা হবে না সেটাও লেখা ছিল । কিছু সময়ের মাঝেই আদনানের ফোনে একটা ফোন এসে হাজির । ফোনের স্ক্রিনটা দেখে আদনানের মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । দ্রুত ফোন রিসিভ করলো । ওপাশ থেকে কিছু শুনতেই আদনানের চেহারা একেবারে পাল্টে গেল মুহুর্তে ।

ফোনটা রেখে নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের এখনই যেতে হবে !

-কি হয়েছে !

-আম্মু !!

আদনানের কন্ঠেই এমন কিছু ছিল যে নোরাকে আর কিছু বলতে হল না । সেই দ্রুত গাড়ির দিকে হাটা ছিল । গাড়িটা ঝড়ের বেগে চলতে শুরু করলো কিছু সময়ের মধ্যেই ….

দশ

আদনান অনেক টা অসহায়ের মত কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । মায়ের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । চিকিৎসার সময়ে হাসপাতালের ভেতরে ডাক্তারেরা সাধারনত কাউকে ঢুকতে দেয় না । কিন্তু আদনানের বেলাতে এসব নিয়ম মানা হয় নি । এই হাসপাতালটার মালিক আদনান নিজে । তাকে বের করে দেওয়ার মত কেউ নেই । কাঁচের বাইরে থেকে মাকে সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে ।

মাঝে মাঝেই আদনানের মায়ের এই শারীরিক অবনতি হয় । তখন কোন ভাবেই তাকে সামলানো যায় না । তখন রেবেকা কাউকে চিনতে পারেন না । কারো কথা শুনেন না । সামনে যা পায় তাই ভেঙ্গে ফেলতে চান । কিছু দেখে যেন প্রচন্ড ভয় পান । সবাইকে দেখেই ভয় পান ।

এই সময়ে তাকে খুব কড়া ঘুমের ঔষধ দিতে হয় । মানুষ স্বাভাবিক যে ঘুমের ইঞ্জেকশনে ঘুমিয়ে পড়ে রেবেকার বেলাতে সেটা কাজ করে না । ডাক্তারেরা বলেন যে যত উচ্চ ডোজ দেওয়া হবে ততই রেবেকার শরীরের জন্য সেটা খারাপ তবে ইঞ্জেকশন না দিয়েও উপায় নেই ।

প্রতিবারই প্রথমে ডাক্তারেরা প্রথমে নানান ভাবে রেবেকাকে শান্ত করার চেষ্টা করে । বিশেষ করে তার মন থেকে ভয়টা দুর করার চেষ্টা করে কিন্তু কাজ হয় না । আজকেও তাই করছিলো । আদনান ঘরের এক পাশে দাড়িয়ে ছিল কেবল । তার খুব বেশি অসহায় লাগছিলো । এতো এতো ক্ষমতা তার অথচ সে কিছুই করতে পারছে না । নিজের সব থেকে কাছের মানুষটার জন্য সে কিছুই করতে পারছে না ।

দুই তিন মাস পরপরই এমন একটা এটাক হয় ।

একজন ডাক্তার এগিয়ে এল আদনানের দিকে । বলল, স্যার সমস্যাটা আরও বাড়ছে । এবার মনে হয় না ১০ মিলিতে কাজ হবে । আরও একটু বাড়াতে হবে ডোজটা । আদনান বলল, তাহলে দিচ্ছেন না কেন এখনও ?

ডাক্তার বলল, কিন্তু স্যার এতে ওনার শরীরের উপর বেশ চাপ পড়বে ।

-তাহলে কি করার আছে ? অন্য কোন উপায় কি আছে ?

ডাক্তার কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না । কিছু সময় দাড়িয়ে থেকে সে আবারও ভেতরে চলে গেল । আদনান একভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো । আচ্ছা ঐদিন যদি ঐ দূর্ঘটনা না ঘটতো তাহলে কি ওর মা এমন হয়ে যেত ? ঐদিন নীতুর সাথে ওর যাওয়ার কথা ছিল । ও নিজে গেলে হয়তো আজকে ও মায়ের সাথে এমন কিছুই হতো না । নিজেকে ওর সব সময় এই কারনেই দোষী মনে হয় । মনে হয় ওর মায়ের জীবনটা এমন নাও হতে পারতো ! কেবল মাত্র ওর কারনেই এমন হয়েছে ! কিভাবে নিজেকে সে ক্ষমা করবে কে?

ডাক্তারকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে দেখলো সে । রেবেকা তখনও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে । কয়েকজন নার্স তাকে ধরে ধরে রাখতে পারছে না । আদনান চাইলো সে এসবের কিছুই দেখবে না কিন্তু সে চোখ সরাতে পারতে না মোটেও । একভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে ।

তখনই একটা অবাক করা কান্ড হল । ও মা হঠাই শান্ত হয়ে গেল । হঠাৎ ঝড়ের পর যখন সব কিছু শান্ত হয়ে যায় ঠিক তেমন ভাবে রেবেকা একেবারে চুপ আর শান্ত হয়ে গেল । এমন কি ডাক্তার নিজেও খানিকটা অবাক হয়ে গেছে । সে এমনটা আশা করে নি । সবাই খানিকটা সময় বোকার মত নিজেদের দিকে তাকাতাকি করছে । আদনান কাঁচের ভেতর থেকেই দেখতে পেল কেউ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে । এবং সেই মানুষটা আর কেউ নয়, নোরা । নোরার দিকে তাকিয়েই যেন রেবেকা একেবারে শান্ত হয়ে গেল । নোরা আস্তে আস্তে রেবেকার দিকে এগিয়ে গেল । তারপর রেবেকার বিছানার পাশে বসলো । আদনান নোরার চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিলো । অনেক দিন এমন মমতাময় চেহারা সে দেখেনি । তার মায়ের জন্য যে কয়জন মানুষ কাজ করে তারা সবাই ঠিক ঠিক নিজেদের দায়িত্ব পালন করে কিন্তু আদনান খুব ভাল করেই জানে যে এই কাজ গুলো করে কারন তাদেরকে টাকা দেওয়া হয় । তাদের মুখে কোন মমতা দেখা যায় না । মাঝে মধ্য করুণা হয়তো দেখা যায় !

কিন্তু নোরার চেহারাতে অন্য কিছু করেছে । আদনান দেখতে পেল ওর মায়ের হাত ধরলো নোরা । তারপর কিছু বলল তাকে । রেবেকা কেবল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো । আদনানের কেবল মনে হল যে মা তার বাধ্য সন্তানকে কিছু বলছে এবং সন্তান সেটা শান্ত ভাবে মেনে নিচ্ছে ।

রেবেকা শা্ন্ত ভাবে বেডে শুয়ে পড়লো । নোরা চোখের ইশারায় ঘরের সবাইকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলল । সবাই চুপচাপ সেটা মেনেও নিল । এমন কি ডাক্তারও ঘর থেকে বের হয়ে গেল ।

আদনান কোন কথা না বলে কেবল তার মা আর নোরার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো । নোরা ওর মায়ের মাথার কাছে বসে আছে । তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । আদনান দেখতে পেল যে ও মা কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল । নোরা তার কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেল । তারপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল । ঘর ছেড়ে বের হতেই আদনানকে দেখতে পেল ।

আদনানের দিকে এগিয়ে এসে বলল, আম্মু এখন শান্ত হয়ে গেছে । ঘুমিয়েছে । আমি বরং এখানে থাকি । জেগে উঠে যদি আমাকে না দেখে তাহলে আবার উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে ।

আদনানের কানে অবশ্য এই কথা গুলোর কিছুই ঢুকলো না । সে একভাবে বেশ কিছু সময় নোরার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । কেন ধরলো ও নিজেই বলতে পারবে না । তবে ওর কাছে মনে হল এই মেয়েটাকে সে যদি এখনই না জড়িয়ে ধরে তাহলে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে ।

যখন নোরাকে ছেড়ে দিল দেখতে পেল নোরার মুখটা লজ্জাতে লাল হয়ে গেছে । আদনানের তখন খানিকটা হুস ফিরে এল । সে নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে গেল । ভুলেই গিয়েছিলো যে ওর সাথে নোরার সম্পর্কটা এখন জড়িয়ে ধরার মত হয়ে ওঠে নি । আর আমাদের দেশে এভাবে সবার সামনে ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরাটা ঠিক স্বাভাবিক ভাবে ধরা হয় না ।

আদনান করিডোরের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ নেই সেখানে । কিভাবে কেউ নেই সেটা অবশ্য ওর মাথায় ঢুকলো না । এমন হতে পারে যে নোরাকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে যারা যারা করিডোরে ছিল তারা সবাই চলে গেছে । হাসপাতালের মালিক তার বউকে জড়িয়ে ধরেছে সেটা কর্মীরা দেখে ফেললে সে খানিকটা বিব্রত হতে পারে । আর আদনানকে কেউ বিব্রত করতে চাইবে না মোটেও ।

আদনান নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি । কেউ দেখে নি অবশ্য !

আদনানের কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে নোরা হেসে ফেলল । নোরার হাসি দেখে আদনানও খানিকটা সহজ হয়ে উঠলো । পাশের বেঞ্চটার দিকে ইশারা করে বলল, আমিও অপেক্ষা করি তোমার সাথে !

নোরার তখনই মনে হল আদনান ওকে তুমি করে বলেছে । একটু আগে যখন ওরা সেই সেতুটার পাশে দাড়িয়ে ছিলো তখনও আদনান ওকে আপনি করেই বলছিলো । এখন তুমি করে বলছে । নোরার এই ডাকটা কেন জানি খুব ভাল লাগলো ।

সকালের রোড উঠেছে অনেক আগেই । নোরা আর আদনান পাশা পাশি বসে রয়েছে বেশ কিছু সময় ধরে । নোরার একটু ঘুমঘুম পাচ্ছে । আদনানের শরীরে একটু হেলান দিয়ে খানিকটা ঢুলুনির মত চলে আসছিলো ওর তখনই ওর নাম ধরে কেউ ডাক ছিল ।

নোরা যখন পুরোপুরি সজাক হয়ে উঠলো তখনই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো ওর বাবা ওর সামনে দাড়িয়ে । ওর বাবাকে সে এখানে দেখবে আশা করে নি । ঠিক তার পেছনেই আদনানের বাবাকে দেখতে পেল ।

নোরার প্রথমে মনে হল আদনানের মায়ের শরীর খারাপ দেখে হয়তো ওর বাবা চলে এসেছে । কিন্তু বাবার চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা মিলল না । ওর বাবা খুব রেগে আছে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে । নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, নোরা চল এখান থেকে !

নোরা কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছিলো না । নোরা বলল, কি হয়েছে বাবা ?

-তুমি আর এখানে থাকবে না ।

-কেন ?

-কেন ! জিজ্ঞেস কর এদের । আসলে আমার নিজেরই ভুল হয়েছে । টাকা থাকলেই সব কিছু মেনে নিতে হবে কেন ?

পেছন থেকে আদনানের বাবা সোবাহান চৌধুরী বললেন, প্লিজ বেয়াই সাহেব একটু বোঝার চেষ্টা করুন !

আতিকুল ইসলাম বললেন আমি কি বুঝবো বলুন? আমার মেয়েটার জীবন এই ভাবে নষ্ট করবেন আমি কোন দিন ভাবি নি । আপনার ছেলের যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো সেটা আমাদেরকে কেন বলেন নি ? কেন বলেন নি আমাদের ? ভেবেছেন টাকা আছে বলে আমরা সব মেনে নেব ? ভুল ভেবেছেন ! আপনি আপনাদের নামে কেইস করবো ! চল নোরা !

আতিকুল ইসলাম নোরার হাত ধরে টান দিতে গেল ।

নোরা কিছু সময় আদনানের দিকে তাকিয়ে রইলো । আদনানের চোখই বলে দিচ্ছে যে ওর বাবা যে বলল যেটা সত্যি । আদনানের আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো !! নোরার হঠাৎ কেমন যেন একটা কষ্ট হতে লাগলো ।

একটু আগে আদনান যখন ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো তখন বুকের মাঝে একটা অজানা আনন্দবোধ শুরু হয়েছিলো অথচ এখন সেটা কষ্টে পরিনত হয়েছে । মনে হচ্ছে যেন খুব কাছের মানুষ ওর সাথে প্রতারনা করেছে !

আতিকুল ইসলাম বললেন, চল নোরা এখানে আর এক মুহুর্ত নয় ! আমরা আজই ফেরৎ যাবো । এদের নামে আমরা কেইস করবো । এরা ভেবেছে কি !

এগারো

নোরা বাবার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, বাবা আমি জানি এ কথা !

পুরো করিডোরে যেন একটা বোমা পড়লো । আতিকুল ইসলাম তো অবাক হলেনই, আদনান সোবাহান চৌধুরী দুইজনই তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকালো নোরার দিকে । নোরা কয়েকটা নিশ্চুপ মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো আদনানের দিকে । তারপর তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ও আমাকে আগেই সব কিছু বলেছে । আমি জানি !

-তুই জানিস ? আর আমাকে বলিস নি ?

-এটা এমন কিছু বলার কথা নয় ! আমি মানুষকে বলে বেড়াবো শুনো শুনো আমার স্বামীর না আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো সবাই শুনো !

আতিকুল ইসলাম মেয়ের দিকে খানিকটা অবাক চোখে তাকালেন । তার মনে হল নোরা কেমন যে অস্বাভাবিক আচরন করছে । নোরা কখনই তার সাথে এমন স্বরে কথা বলে না ।

আতিকুল ইসলাম বললেন, তাই বলে আমি জানবো না ?

-এখন জানলে তো ! এতো রিএক্ট করার কি আছে ! দেখে নেবো জেলের ভাত খাওয়াবো এসবের মানে কি ! আমাকে বিয়ে করেছে আমাকে জানিয়েছে । ব্যাস ! আর ওকে তোমাদের জানাতে মানা করেছি !

আতিকুল ইসলাম আর কিছু বলার সুসোগ পেলেন না । সোবাহান চৌধুরী আতিকুল ইসলামের কাধে হাত রেখে বললেন, আমরা মানছি যে আমাদের অন্যায় হয়েছে । আপনি বরং আমার সাথে আসুন প্লিজ ! মাথা গরম করে কি কোন সমাধান হয় ! মাথা ঠান্ডা করে একটু চিন্তা ভাবনা করা যাক !

আতিকুল ইসলাম আরও কিছু সময় দাড়িয়ে রইলেন । তারপর সোবাহান চৌধুরীর সাথে বের হয়ে গেলেন হাসপাতাল থেকে । আদনান তখনও এক ভাবেই দাড়িয়ে ! নোরাকে সে ঠিক বুঝতে পরছে না । মেয়েটার এমন আচরন সত্যিই তাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েছে । মেয়েটা এমন একটা কথা বলবে সেটা আদনান মোটেই ভাবতে পারে নি ।

আদনান কিছু বলতে গেল । কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো । বলল, ভাববেন না যে আমি কেবল আপনার সাথে থাকার জন্য কিংবা আপনার কারনে মিথ্যা বলেছি । আমি চলে গেলে আম্মুর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কোন দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না !

আদনান চুপ করে কেবল শুনলো কথাটা । একটা কথাও বলল না । নোরা বলল, আম্মু শরীরটা ভাল হয়ে গেলে আমি কি করবো সেটা পরে ভেবে দেখবো । আমাকে কিছু সময় ভাবতে হবে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে !

আদনানের এই সব কথা শুনে মন খারাপ করার কথা কিন্তু আদনান আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো যে ওর মন খারাপ লাগছে না । রবং মনের ভেতরে একটা আলাদা আনন্দ আনন্দ ভাব হচ্ছে । সামনে দাড়ানো এই মেয়েটা কি চমৎকার ভাবেই না তার মায়ের কথা ভাবছে । তার স্বাস্থ্যের জন্য চিন্তা করছে । আদনান নিশ্চিত ভাবে জানে যে নোরার তার মায়ের জন্য এই চিন্তার মধ্যে কোন খাদ নেই । সে এই কাজটা করছে মন থেকে । আদনানের এতোদিন পরে হঠাৎ করে নীতুর কথা মনে পড়লো । তবে তার মন খারাপ হল না । আগে নীতুর কথা মনে হতেই আদনানের মন খারাপ হয়ে যেত । আজকে কেন জানি মন খারাপ হল না ।

নীতু মাঝে মাঝেই বলতো যদি সে কোন দিন মরে যায় তাহলে আদনানের কি হবে ! সে তো কোন দিন আর কাউকে ভালবাসতে পারবে না । আজকে আদনানের মনে হল নীতু ছাড়াও আরেকটা মেয়েকে সে ভালবাসতে শুরু করেছে । তার সামনে দাড়ানো এই মেয়েটাকে সে ভালবাসতে শুরু করেছে ।

নোরা বলল, আমার কথা পরিস্কার হয়েছে ?

আদনান কোন কথা না বলে কেবল মাথা ঝাঁকালো !

নোরা বলল, এখন দয়া করে আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান ! আপনার চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না ।

আদনানের কেন জানি হাসি পেল । এটা তারই হাসপাতাল । তার তার এই হাসপাতাল থেকে তাকেই এই মেয়ে বলছে যে চলে যেতে । অন্য কারো এমন কথা বলার সাহস হত কি না আদনানের ধারনা নেই । আদনানের খুব মজাই লাগলো কথা শুনে । তবে সেখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল । যাওয়ার আগে নোরাকে বলল, তুমি কি খাবে ? সকাল হয়েছে বেশ সময় আগেই । নাস্তা করা হয় নি !

-সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না ! আমার খাওয়া আমি নিজে বুঝবো !

নোরা আদনানের থেকে মুখ সরিয়ে নিল । তারপর একটু আগে যেখানে বসে ছিল সেখানেই গিয়ে বসলো ।

নোরা আদনানকে চলে যেতে দেখলো । করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে সে একজন বয়ের সাথে দাড়িয়ে কি যেন বলল । বয়টা মাথা কাত করে সম্মতি জানালে আদনান আরেকবার ওর দিকে তাকালো । আদনানের চোখে ও কেমন যে একটা আনন্দের ভাব দেখলো । আদনানের মনটা যেন কোন কারনে আনন্দে ভরে উঠেছে । কি কারনে আনন্দ লাগছে সেটা নোরা বুঝতে পারলো না ।

আদনান চলে যেতেই নোরার প্রচন্ড ক্ষধা অনুভুত হল । সেই রাতের বেলা পুলিশের কাছে ধরা পরা । তারপর আদনানের সাথেই নদীর পাশে যাওয়া, ওর মায়ের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া তারপর ওকে দেখে ওর মায়ের শান্ত হয়ে যাওয়া, ওর বাবার এভাবে চলে আসা এবং সবার শেষে ওর নিজের আচরন ! এতো কিছু এক রাতেই হে গেল । পুরো সময়টাতেই ও একটু উত্তেজনাকর অবস্থায় ছিলো । স্বাভাবিক ভাবে কিছুই চিন্তা করতে পারছিলো না । এই জন্যই হয়তো ক্ষুধাটা অনুভব করে নি । এখন সেটা ভাল করেই অনুভব করতে পারছে ।

এই হাসপাতালে নিশ্চয়ই ক্যান্টিন আছে । নোরা উঠে দাড়ালো । এখনই কিছু খেয়ে আসা যাক । আদনানের আম্মু যে কোন সময় জেগে উঠতে পারে । নোরা যখনই উঠতে যাবে তখনই দেখলো সেই বয়টা ওর সামনে এসে হাজির । এই বয়টার সাথেই আদনান একটু আগে কথা বলছিল। বয়টার হাতে একটা প্লেট । ওর জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছে । আদনান তাহলে বয়কে নাস্তার কথাই বলে গিয়েছিলো।

নোরার একবার ইচ্ছে হল এখনই বয়কে রাগ দেখিয়ে বলে যেন খাবার নিয়ে যায় । সে এখন খাবে না । কিন্তু বয়ের সাথে রাগ দেখানোর কোন মানে নেই । আর ও যেহেতু ক্ষুধা লেগেছেই তা খেয়ে ফেলাই ভাল ।

বয় ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম এখানে তেলছাড়া পরোটা আর ডিম ভাজি আছে আর নিহারী নিয়ে এসেছি । সকালে ক্যান্টিনে আরও ব্যবস্থা হয় । রুটি পাওয়া যায়, ডাল আছে । স্যুপও পাওয়া যায় । আপনার কি আর কিছু লাগবে !

নোরা বলল, এমন ভাবে বলছেন যেন আমি যা বলবো তাই নিয়ে আসবেন !

বয় একটু হেসে বলল, চেষ্টা তো করাই যায় । একবার কেবল বলে দেখুন ।

-আচ্ছা যান হরিণের মাংসের ভূনা নিয়ে আসুন । পারবেন ?

বয়ের মুখ খানিকটা কালো হয়ে গেল । বোঝা গেল তাদের স্টকে হরিণের মাংস নেই । নোরা বলল, দিন আপাতত যা নিয়ে এসেছেন তাই দিন ।

বয় তাই দিয়ে ঘুরে চলে গেল ।

নোরা বেঞ্চটার উপরে বসেই তেলছাড়া পরোটা মুখে দিল । পরোটা মুখে দিতে দিতেই নোরার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো । ও যে সব সময় তেল ছাড়া পরোটা খায় এটা এই বয় কিভাবে জানে ? সে তো রুটিও আনতে পারতো ! হয়তো আদনান বলেছে ওকে । কিন্তু আদনানই বা কিভাবে জানলো এটা ?

একটা পরোটা খাওয়া যখন শেষ হয়েছে তখনই একজন ডাক্তারকে ওর দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখলো । ওর সামনে দাড়িয়ে ডাক্তার বলল, ম্যাডামের ঘুম ভাঙ্গছে । আমার মনে হয় আপনি যদি তার সামনে থাকেন তাহলে তাহলে একটু ভাল হয় !

নোরা একবার ডাক্তারের দিকে তাকালো তারপর নিজের সকালের নাস্তার দিকে তাকালো । খাওয়াটা মাঝ পথেই রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না আবার বসেও থাকতে ইচ্ছে করছে না । নোরা প্লেট টা হাতে নিল । তারপর ডাক্তাের পেছন পেছন কেবিনের দিকে হাটতে শুরু করলো ।

বারো

নোরা আস্তে আস্তে হাটতে শুরু করলো ডাক্তারের পেছন পেছন । হঠাৎ ই বুঝতে পারছে ওর গুরুত্ব খুব বেশি বেড়ে গেছে এই সব মানুষ গুলোর কাছে । সবাই তাকে অন্য চোখে দেখছে, সমীহের চোখে । নয়তো এতো হাসপাতালের এই এতো বড় ডাক্তার তাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করছে । নোরার বেশ কয়েকবার অন্য হাসপাতালে যাওয়ার দরকার পড়েছে । সেখানকার ডাক্তার নার্সদের ব্যবহার কোন দিনই এমন ছিল না । আর সরকারী হাসপাতাল হলে তো কথাই নেই ।

নোরা হঠাৎ বলল, ডাক্তার সাহেব !

-জি ম্যাডাম ?

-আম্মুর অবস্থা কেমন এখন?

-আসলে আমরা এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না । তবে গতকালের ব্যাপারটা দেখে আমা সবাই খানিকটা অবাক হয়েছি । ম্যাডামের মাথায় আঘাতটা খুব গুরুতর ছিল । আমরা কোন দিন ভাবি নি যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন । প্রায় দুই বছরের মত তিনি কোমাতে ছিলেন ।

নোরার হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হল কিভাবে এই দূর্ঘটনা ঘটলো । ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না । ডাক্তারের কাছে কথাটা জানতে চাওয়াটা শোভন দেখায় না । ডাক্তার সাহেব বললেন, তবে আমরা এখন খুব আশাবাদী । ম্যাডাম ঠিক হয়ে উঠবেন আশা রাখি ।আপনার সাথে ম্যাডামের খুব গভীর কোন সম্পর্ক রয়েছে । এই জন্যই কাল এমনটা হয়েছে । এমনটা অনেক সময়ই হয় । ম্যাডাম বুঝি আপনাকে অনেক ভালবাসেন ?

নোরা ডাক্তারের দিকে তাকালো। মুখের ভাবটা পরিবর্তন করলো না । সে নিজেও জানে না আদনানের আম্মুর সাথে আসলে তার কি সম্পর্ক আছে । এই মহিলা কিভাবে তাকে এতো আপন ভাবছে সেটাও সে জানে না । তবে এখনও নোরাকে সে নিতু বলেই ডেকেছে । হয়তো নোরাকে সে অন্য কেউ ভেবে নিয়েছে ।

তাহলে নিতুই কি আদনানের আগের স্ত্রীর নাম ? হ্যা এটাই হবে । এটা ওর আগেই ভাবা দরকার ছিল । এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক ।

নোরা যখন রুমের ভেতরে ঢুকলো দেখতে পেল রেবেকা একেবারে জেগে উঠেছেন। উঠে বসেছেন বিছানার উপর । নোরার দিকে চোখ পড়তেই তার চোখ খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তারপর বললেন, তুই একা একাই নাস্তা খাচ্ছিস ?

নোরা খানিকটা চমকে উঠলো । তার শ্বাশুড়ি কন্ঠে কি একটা মায়া রয়েছে সেটা সে ঠিক বুঝতে পারছে না । নোরার কেবল মনে হল রেবেকা যেন ওকে অনেক দিন ধরে চেনেন । খুব কাছের ভাবেই চেনেন ।

রেবেকা আবার বললেন, কই দেখি আমাকে একটু খাইয়ে দে তো ।

নোরা একটু এগিয়ে এল প্লেট নিয়ে, আমার এটোটা খাবেন ?

রেবেকা যেন একটু বিরক্ত হলেন, তারপর বললেন, চড় খাবি একটা ! খাবেন বলছিস কেন ?

নোরা প্লেট থেকে একটু পরোটা ছিড়ে রেবেকার মুখে এগিয়ে দিলেন। রেবেকা বাচ্চা মেয়ের সেটুকু খেতে থাকলেন । একটা সময় নোরা নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে রেবেকাকেই খাওয়া থাকলো । খাওয়া শেষ করে নোরা যত্ন করে রেবেকাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে গেল । তাকে গোসল করিয়ে দিল । রেবেকার নাকি সকাল সকাল গোসল করার অভ্যাস । তারপর নিজেই তার চুপ মুছে দিলো । ভেজা চুপ ড্রাই করে দিল । নোরা হঠাৎ আবিস্কার করলো যে ওর এসব কাজ করতে ভাল লাগছে । রেবেকা ওর দিকে এমন মায়ার চোখে তাকায় যেন মনে হয় ওকে তিনি কত দিন ধরেই না চেনেন ।

আর দুইদিন হাসপাতালে থাকলো তারা । তারপর ডাক্তার রেবেকাকে বাসায় নিয়ে যেতে বললেন । নোরাও চলল তার সাথে বাসায় । এই দুইদিন নোরা হাসপাতাল থেকে নড়ে নি । প্রতি মুহুর্তেই সে রেবেকার সাথেই ছিল । রেবেকার চোখের পাতা খুললেই নোরাকে দেখতে পেত ।

রেবেকাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময় আদনান নিজে এসেছিলো । ডাক্তার তাকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললেন, আপনার ওয়াইফের ভেতরেই আসলে ম্যাডামের সুস্থতা নির্ভর করছে । এই দুইদিন আমরা আসলে তাকে পর্যবেক্ষনে রেখেছিলাম । এই ব্যাপারটা স্পষ্ট যে আপনার মা আর আপনার ওয়াইফের ভেতরে একটা আশ্চর্য বন্ড তৈরি হয়েছে । এটা যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন ।

আদনান কিছু বলল না । এই ব্যাপারটা সে নিজেও জানে । যে কোন ভাবেই নোরাকে সে আটকাবেই । কোন ভাবেই যেতে দিবে না ।

বাসায় ফিরে নোরা খাানিকটা অবাক হয়ে গেল । তারা নিজের বাবা এখনও আদনানদের বাসায় রয়ে গেছে । লনে বসে সে সোবাহান চৌধুরীর সাথে জম্পেস আড্ডা দিচ্ছে । দুদিন আগে এই মানুষটা কি অগ্নি মূর্তি নিয়েই না তাদের সামনে গিয়ে হাজির হয়েছিলো । নোরা সেদিকে তাকিয়ে রইলো একটু চিন্তিত মুখে । তার চিন্তার কারন অন্যখানে ।

সেদিন হাসপাতালে সে তার বাবাকে বলেছিলো যে আদনান তাকে সব কিছুই বলেছে । এবং তাকে বুঝিয়েছিলো যে আদনানের যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো সেটা নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই । কিন্তু আসলে সেটা সত্যি নয় । তার আপত্তি অবশ্যই আছে । সে এই কাজটা করেছিলো কেবল রেবেকার জন্য । কিন্তু এখন ?

পরে আসলে কি হবে সেটা নিয়ে সে মোটেও কিছু ভাবে নি । তখন নোরার কেবল মনে হয়েছিলো যে এখন এখানে থাকাটা দরকার । অন্য কিছু আসলে মাথায় আসে নি । এতো গভীর ভাবে সে ভাবেও নি কিছু । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে কিছু ভাবা দরকার ছিল । এখন তো পরিস্থিতি অন্য দিকে চলে যাবে । ওর বাবার চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সেও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে খুশি মনে ।

রাতে ঝামেলা বাঁধলো বেশ । নোরাকে ঘুমাতে হল আদনানের ঘরে । ঘরে ঢুকে নোরা কিছু সময় বোকার মত দাড়িয়ে রইলো । আদনানের সামনে এসে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে রইলো । আদনান নিজের বিছানার উপর বসে কাজ করছিলো ল্যাপটপে । নোরার যে এখন কি করা উচিৎ সেটা ও বুঝতে পারছে না । বারবার মনে হচ্ছে গতবারের মত এবারও যদি কিছু হয় !

নাহ ! এইবার এমন কিছু আর হবে না । হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই । আবারও মনে হচ্ছে যে হতেও পারে !

যখন এমন দ্বিধান্বিত ওর মনটা তখন আদনান ওর দিকে ফিরে তাকালো । ল্যাপটপটা থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে তাকালো । তারপর বলল, তুমি ইচ্ছে করলে বিছানাতে ঘুমাতে পারো । এই দুইদিন হাসপাতালে ছিলে । তোমার ভাল ঘুম হয় নি আমি জানি ।

নোরা বলল, আপনি কোথায় ঘুমাবেন ?

আদনান বলল, সেটা আমি খুজে নেব । তুমি ঘুমাও এখানেই ।

এই বলেই ওর পাশের ফাঁকা স্থানটা দেখালো ও । তারপর আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল । নোরা আরও কিছু সময় অপ্রস্তুত হয়েই এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলো । সত্যিই গত দুই দিন ওর খুব ভাল করে ঘুমানো হয় নি । হাসপাতাল যতই আধুনিক হোক না কেন হাসপাতালে শান্তিমত ঘুম আসে না । নোরারও আসে নি । আজকে ভেবেছিলো কিছু সময় শান্তিমত ঘুমাবে । সব থেকে ভাল হত হলে চলে যেতে পারলে কিন্তু রেবেকাকে ছেড়ে কেন জানি ওর যেতে ইচ্ছে করছে না । বারবার মনে হচ্ছে যদি ও চলে যাওায়র পরে আবারও সে অসুস্থ হয়ে পড়ে । এই মানুষটার প্রতি কেমন যেন একটা টান অনুভব করছে ও ।

বিছানার এক পাশে আদনান বসে থাকার কারনে নোরা কেন জানি একট অস্বস্থিবোধ করছে । আদনানকে বলতেও পারছে না যে আপনি বিছানা থেকে উঠে যান তো । আমি ঘুমাবো । বিছানাটা আদনানেরই । তারপর এক সময় নিজেকে খানিকটা বোঝালো । আদনান নিজের কাজে বেশ ব্যস্ত । ওর দিক তাকানোর সময় তার নেই । নোরা নিজেই বিছানার ওপাশে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লো ! একটা সময়ে ঘুমিয়েও পড়লো ।

আদনানের কাজ শেষ হতে আরও কিছুটা সময় লাগলো । যখন ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ও একটু আড়মোড়া ভাঙ্গলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে । নিজের কাজে এতোই ব্যস্ত ছিল যে অন্য কিছু তার মনে ছিল না । পাশে শুয়ে থাকা নোরার দিকে চোখ পড়তেই আদনানের কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল । কি নিঃপাপ একটা মুখ । এই মেয়ে নিশ্চিত ভাবে জীবনে কোন অন্যায় করে নি । আদনান কত সময় যে সেদিকে তাকিয়ে রইলো যেটা আদনান নিজেই জানে না ।

কি মনে হল ও এগিয়ে গেল নোরার দিকে । খুব যত্ন করে ওর কপালে একটা চুমু খেল । চুমুটা এতো ভাল লাগলো যে আদনান নিজেই অবাক হয়ে গেল । নিতু ছাড়া আর কাউকে ও কোন দিন কাছে আসতে দেয় নি । এমন কি নোরাকে বিয়ে করে ছিল কেবল মাত্র ওর মায়ের জন্য । কিন্তু এখন কেমন সব বদলে যাচ্ছে । সব কিছু নতুন ভাবে ভাবতে হচ্ছে । নোরা মেয়েটা সব হিসাব বদলে দিচ্ছে ।

আবার হাসপাতালে নোরা বলেছিলো সে চলে যাবে । আদনান নোরার গালে আরেকটা চুমু খেল । তারপর ফিসফিস করে বলল, তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিবো না । কোন ভাবেই না । একজন আমাকে ছেড়ে গিয়েছে । তোমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হবে না !

আদনানের খুব ইচ্ছে করছিলো যে নোরার পাশেই শুয়ে পড়ে । ওকে জড়িয়ে ঘুমায় । কিন্তু সেই ইচ্ছেটা দমন করলো সে ! নোরা যতদিন না নিজ থেকে ওকে আহবান করবে ততদিন সে নোরার কাছে আসবে না । তবে হ্যা এই ভাবে লুকিয়ে চুমু খাওয়া যাবে অবশ্য ! তখনই আদনানের মাথায় একটা বুদ্ধি হল । নোরাকে সে কোন ভাবেই যেতে দিবে না । কোন ভাবেই না ।

আদানন উঠে দাড়ালো । নিজের ফোন বের করে সে কামালকে ফোন দিল । ফোনটা কানে ধরেই দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল ।

আদনান দরজা দিয়ে বাইরে বের হতেই নোরা চোখ খুলে তাকালো । নোরার চোখটা লেগে এসেছিলো । আদনান যখনই তার কপালে চুমু খেল তখনই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে । মানুষটা এতো যত্ন করে ওকে আদর করলো নোরার কেন জানি খুব ভাল লাগলো । নিজের মনের কাছেই একটা সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছিলো । কি আজব একটা ব্যাপার !

তারপর আদনান কি বলল ওকে ! একজন হারিয়ে গেছে আর ওকে সেই সুযোগ দেওয়া হবে না !

আদনানের কন্ঠে কি দৃঢ়তা ছিল সেটা নোরার ভাল লাগলো । সে কোন ভাবেই ওকে যেতে দিবে না । আচ্ছা দেখা যাক সে কি করে তাকে আটকায় !

এটা ভাবতে ভাবতেই নোরা ঘুমিয়ে পড়লো ।

সকালবেলাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে ও বিছানা থেকে নামতে যাবে তখন তীব্র একটা বিস্ময় ওকে ঘিরে ধরলো । সেই সাথে সাথে মনটা তীব্র আনন্দে ভরে উঠলো । ও কত টুকু ঘুমিয়েছে সেটা ঠিক বলতে পারবে না । ভোরের আলো গুটেছে অনেক সময় তবে এখনও রোদ ওঠে নি । উঠবে উঠবে করছে । আদনান যখন বাইরে গিয়েছিলো তখন বেশ রাত । তার মানে খুব একটা সময় হয় নি । এর মাঝেই আদনান এই কাজটা করেছে ।

আদনানের পুরো ঘরটার মেঝেতে লাল আর হলুদ গোলাপে ভর্তি ! হলুদ গোলাপ ওর খুব বেশ পছন্দ ! সেই ফুলই ব্যবহার করা হয়েছে। মেঝেতে গোলাপ দিয়েই নাম লেখা হয়েছে ।

নোরা তোমাকে ভালবাসি !

নোরা কেবল সেই লেখাটার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । ওর কিছুতেই বিছানাকে থামতে ইচ্ছে করছে না । একভাবে তাকিয়ে থাকতে মন চাইছে । গত রাতে আদনান যে বলেছিলো ওকে যেতে দিবে না, সেই কাজটা সে শুরু করে দিয়েছে ! নোরা বিছানার উপরে উপর হয়ে শুয়ে পড়লো আরও কিছু সময় ! তাকিয়ে রইলো বেঝের গোপাল ফুল গুলোর দিকে !

নোরার দিকে তার চেয়ারম্যান ম্যাডাম আরেকবার সরু চোখে তাকিয়ে বলল, আদনান চৌধুরী আসবে তো? না আসলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে নোরা?

নোরার খুব করে বলতে ইচ্ছে হল, ম্যাডাম আমি বললে কেবল আদনান চৌধুরী নয়, তার বাপ, তার শ্বশুর সব চলে আসবে।

লাইনটা মনে হতেই ওর খুব হাসি চলে এল খুব। কথাটা কিন্তু মিথ্যা না। নোরা বললে আদনান তো আসবেই, নোরার শ্বশুর মশাই অর্থাৎ আদনানের বাবাও চলে আসবে।

অনেকদিন আগেই আদনানকে সেমিনারে আনার একটা চেষ্টা চলছিল। কিন্তু তার এপোয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাচ্ছিলো না কিছুতেই। তারপর দায়িত্ব এসে পড়ে নোরার উপর। তখনও আদনানের সাথে নোরার বিয়ে হয় নি।

মাঝে কয়েকটা দিন এই সেমিনারের কথা নোরার একদমই মনে ছিল না। রেবেকাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার দুইদিন পরে ও যখন ক্যাম্পাসে এসে হাজির হল, সেদিনই ওর ডাক পড়লো চেয়ারম্যান ম্যাডামের ঘরে। সেমিনারটার কথা মনে বলতেই নোরার মনে একটা অস্বস্তি দেখা দিয়েছিল। তবে ম্যাডামকে আশ্বাস দিয়েছিল যে আদনান চৌধুরী রাজি হয়েছে আসতে। দিন তারিখ তাকে জানিয়ে দিলেই হবে।

ম্যাডামের মুখে খানিকটা অবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল তখন। নোরার দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল, সত্যিই তো?

নোরা একটু হেসে উত্তর দিয়েছিল, আপনি চিন্তা করবেন না মোটেও।

চিন্তা করার কিছু নেই। আদনান ঠিকই চলে আসবে। কিন্তু আদনানদের বাসায় গিয়ে জানতে পারলো যে আদনান ব্যবসার কাজে কয়দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে। নোরার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন। ম্যাডামকে সে কথা দিয়ে এসেছে যে আদনানকে নিয়ে যাবে। এখন যদি আদনান চলে যায় তাহলে?

নোরা সোজা তার ঘরে গিয়ে হাজির হল। আদনান তখন নিজের কাপড় গোছাতে ব্যস্ত। নোরাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালো। চোখে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো। নোরা কি বলবে বুঝতে পারলো না প্রথমে। আদনানই বলল, কিছু বলবা?

নোরা প্রথমে মাথা নাড়ালো। কিছু বলবে না। এখনই চলে যেতে মন চাইলো। ব্যবসার কাজে সে যখন বাইরে যাচ্ছে তার মানে ব্যাপার টা জরুরি। ওর ডিপার্টমেন্টের সেমিনার থেকে তো অবশ্যই জরুরি।

আদনান বলল, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাও? বলে ফেলো।

-আপনি কবে আসবেন?

-এক দুই সপ্তাহ। কেন?

-খুব জরুরি?

-হ্যা একটু তো জরুরি। তুমি জানো খুব দরকার না পড়লে আমি সাধারণত মাকে একা রেখে যাই না।

-হ্যা। তাই তো। আচ্ছা যান।

নোরা আর দাড়ালো না। ওর কেন জানি মন খারাপ হল খুব। কাল সবার আগে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ম্যামকে সরি বলতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে যখন ম্যাডামকে বলতে যাবে যে আদনানকে সে আনতে পারবে না, তখনই নোরার ফোন বেজে উঠলো। ম্যাডাম তখন কি একটা ফাইল দেখছিল বলে ওকে ভাল করে লক্ষ্য করে নি। চুপচাপ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদনানের আওয়াজ শুনতে পেল। আদনান বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো তুমি কাল আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলে। কেন জানি মনে হচ্ছিলো তুমি চাইছিলে আমি যেন না যাই। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসেছি। তোমার বান্ধবীকে ফোন দিয়ে জানতে পারলা আসল কথা। আমাকে বলা যেত না যে যেও না, আমি জোর গলায় কথা দিয়েছি তোমাকে নিয়ে যাবো।

নোরা কেন জানি হঠাৎ করেই মনটা একদম ভাল হয়ে গেল। আনন্দে মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হল না। ম্যাডাম ততক্ষণে ওকে দেখেছেন ভাল ভাবে। বললেন, নোরা কিছু বলবে?

নোরা একটু হেসে বলল, জি ম্যাডাম। বলতে এসেছি যে আদনান চৌধুরী সামনের শুক্রবার সময় দিয়েছেন।

আদনান তখনও ফোনের ওপাশে। শুনতে পাচ্ছে নোরার কথা।

আজকে সব কিছু সেই মোতাবেক ঠিক করা হয়েছে। ব্যবসা সম্পর্কিত সেমিনার গুলোতে সব সময়ই বেশ ভাল মানুষই হয় কিন্তু আজকে আদনান চৌধুরী আসবে শুনে অডিটোরিয়ামটা একেবারে ভরে গেল সময়ের আগেই। সেমিনার শুরু হওয়ার কথা তিনটায়। তিনটা বাজার দশ মিনিট আগে এসে চেয়ারম্যান ম্যাডাম জানতে চাইলো নোরার কাছে যে আদনান চৌধুরী কত দুর। আসবে তো সে?

তখনই নোরার এই কথাটা মনে হল। সে চাইলে আদনানের বাবা শ্বশুর সবাই চলে আসবে।

ঠিকঠিক তিনটার সময় আদনান প্রবেশ করলো অডিটোরিয়ামে। এবং নোরাকে অবাক করে দিয়ে আদনানের বাবাও সাথে আছে। আদনানের চোখ পুরো অডিটোরিয়াম ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। নোরা জানে ওকেই খুজছে সে। এক সময় দেখতেও পেল। একটু চোখাচোখি হল ওদের।

একটু পরেই সেমিনার শুরু হয়ে গেল। নানা কথা বার্তা আলাপ আলোচনা চললো। আদনান নিজে এই ধরনের সেমিনারে অনেক কথা বলে। নানান টিপস দেয়। কিভাবে ব্যবসা শুরু করতে হবে, কি কি ব্যাপার গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তারপর শিক্ষার্থীদের নানান প্রশ্নের জবাব দেয়। আজকেও সেটার করছিল। এমন সময় হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন করলো, স্যার আমরা জানি প্রতিটি সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে। আপনার আছে কি? কাউকে ভালবাসেন আপনি?

প্রশ্নটা শুনতেই নোরার চোখ চলে গেল আদনানের দিকে। আদনানও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা মুহুর্ত কেটে গেল। তারপর আদনান বলল, হ্যা অবশ্যই আছে। একজন না তিন জন মেয়ে আছে আমার জীবনে।

কিছু সময় দম নিয়ে তারপর বলল, প্রথমজন হচ্ছে আমার মা। তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন এতো দিন তবে এখন ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। তারপর আবদান আছে আমার প্রথম স্ত্রীর।

স্ত্রীর কথা শুনে অডিটোরিয়ামে যেন বোমা পড়লো। আদনান যে বিবাহিত এই কথা খুব কম মানুষই জানে। কিছু গুঞ্জন সৃষ্টি হল। আদনান বলল, এই গল্পটা আমি কখনো করি না কারো কাছে। এতোদিন এড়িয়েই যেতাম। আজকে বলি সবাইকে।

আদনান নোরার দিকে আরেকবার তাকালো । নোরার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগলো । হঠাৎই একটা তীব্র অনুভূতি হতে লাগলো ওর মাঝে !

আদনান মাইক হাতে নিয়ে কথা শুরু করলো আবার । এখনও চোখ নোরার দিকেই রয়েছে ।

আমার মায়ের এনজাইটি ডিস-অর্ডার আছে । অল্পতেই সে প্যানিকড হয়ে যেত খুব বেশি । তখন তাকে সামালো মুশকিল হয়ে যেত । এই জন্যই আমি খুব কম বয়সে বিয়ে করে ফেলি । আমি সব সময় বাসায় থাকতে পারতাম না । বাবা তখন সবে নতুন ব্যবসাতে হাত দিয়েছে । সেও খুব ব্যস্ত ।

বিয়ের কিছুদিন পরেই লক্ষ্য করা শুরু করলাম যে আমার মা আগের থেকে বেশ শান্ত হয়ে গেছে । সব কৃতিত্ব নিতুর । আমার মাকে যে সে কি পরিমান ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে শুরু করলো আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । এই মেয়েটা কেমন কে আমার জীবনেও গাঢ় আসন নিয়ে বসলো সেটা আমি নিজেও জানি না ।

কিন্তু ……

কিন্তু বলে আদনান কিছুটা সময় থামলো । আবারও তাকালো নোরার দিকে । পুরো অডিটোরিয়াম একেবারে নিশ্চুপ হয়ে শুনছে আদনানের কথা । আদনান আবার তার বক্তব্য শুরু করলো ।

সব কিছু ভাল চলছিলো । বাবার ব্যবসাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে । আমি ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বাবার অফিসে গিয়ে হাজির হই । কাজ করি । একদিন বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল । মা সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় খুব আঘাত পেয়ে গেল । তখন আসলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো ভাল ছিল না । মোবাইল ছিল না এভাবে । বাসায় ল্যান্ড ফোন ছিল তবে কোন কারনে সেই ফোন এসে পৌছায় নি । বাসায় একটা গাড়ি রাখা থাকলেও সেখানে কোন ড্রাইভার ছিল না । নিতু অল্প অলপ ড্রাইভিং শিখেছিলো । আমি ওকে শিয়েছিলাম । মাকে নিয়ে গাড়ি বের হতেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল । কি হয়েছিলো আমরা এখনও জানি না ।

তারপর থেকে মা প্রায় দুই বছর কোমাতে ছিল । তারপর জ্ঞান ফিরলেও সে কোনদিন কথা বলে আর !

আমি সম্ভবত সেই শোক ভোলার জন্য বাবার অফিসে খুব বেশি পরিশ্রম করতে শুরু করলাম । গাধার খাটুনি যাকে বলে । আসলে প্রিয়জনকে হারানোর কষ্টের থেকে বড় কষ্ট আর কিছু নেই । দুনিয়ার সব কিছু অর্জন করে ফেললেও যদি সেটা প্রিয়মানুষ গুলোর সাথে ভাগ করে নেওয়া যায় তাহলে সেই অর্জনের কোন মূল্যই নেই । আমি দুই দুইজন কাছের মানুষকে হারিয়েছিলাম । না ঠিক দুই জন না । তিনজন !

লাইনটা শোনা মাত্রই নোরা কেঁপে উঠলো । ওর বুকের ভেতরে কেমন ধকধক করতে লাগলো ।

আদনান বলল, ঐ সময়ে নিতু দুই মাসের প্রেগনেন্ট ছিল । অটোপসি তে এই তথ্য আমি জানতে পারি !

নোরা কেবল অনুভব করলো ওর চোখ বেয়ে পানি বের হয়ে এসেছে । আপনা আপনা আপনি ! সামনে দাড়ানো এই শক্ত আর কঠিন হৃদয়ের মানুষটা এতোটা তীব্র কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে

আমি ভেবেছিলাম হয়তো এই ভাবেই জীবন কাঁটবে । তাই কাজের ভেতরে ব্যস্ত রাখলাম নিজেকে । তারপর আবার জীবনের ছন্দপতন হল । তবে এইবার বলা যায় একটা ভাল হল । আরেকটা মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হল । এবং আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে এই মেয়েটি কি তীব্র ভালবাসা নিয়ে আমার মাকে সামলে নিলো । এতো মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার মায়ের দিকে তাকালো যে আমার কেবল মনে হল যে এই মেয়েটাকে কোন ভাবেই দুরে রাখা যাবে না ।

যেই আমি কোন দিন ভাবিও নি যে অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়বো সেই আমি আবারও প্রেমে পড়লাম । গভীর ভাবে পড়লাম ।

সো যেটা বলছিলাম । তিনজন মেয়ের আমার জীবনে খুব বড় অবদান রয়েছে । একজন তো ছেড়ে চলে গেছে । অতীতের । আমার মা এখনও রয়েছে আমার কাছেই । আর সামনের জন্য হচ্ছে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ।

আদনান যখন কথা শেষ করলো পুরো অডিটোরিয়াম কিছু সময়ের জন্য চুপ করে রইলো । কারো মুখে কোন কথা যেন নেই । আদনান আবার বলল, সরি যে ব্যক্তিগত কথা বলে ফেললাম । এই রকম সেমিনারে কেবল এসব বলা ঠিক না । আমি জানি । তবুও চলে এল । আবারও সরি ।

সেই মেয়েটা কাছে এখনও মাইক রয়েই গেছে । সে মাইকটা হাতে নিয়ে বলল, আপনার সম্পর্কে এতো কিছু জেনে সত্যিই ভাল লাগলো। আমরা কি জানতে পারি সেই মেয়েটি কে ? মানে যাকে আপনি বিয়ে করেছেন ?

আদনান হাসলো একটু । তারপর বলল, হ্যা জানতে পারেন । সে এখন এই অডিটোরিয়ামের ভেতরেই আছে !

কথাটা শুনেই পুরো অডিটোরিয়ামে হইচই পড়ে গেল । কে কে সবাই চিৎকার করে উঠলো !

আদনান সবাইকে হাতের ইশারায় থামতে বলে বলল, বলাই যায় তবে বলল সে খুব লজ্জায় পড়ে যাবে । তাকে আপাতত লজ্জাতে ফেলতে চাচ্ছি না । তবে একদিন জেনে যাবেন অবশ্যই !

সেমিনার শেষ করে বের হতে হতে আরও সময় লাগলো একটু । এই পুরো সময় নোরা একবারও আদনানের সামনে গেল না। নোরার কেমন যেন একটা লজ্জার অনুভূতি হচ্ছে । ঐদিন রাতে ভুল দিয়ে ওর পুরো ঘর সাজানোর পরে নোরা কেবল অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিল । জীবনে এতোটা আনন্দিত সে আর কোন দিন হয় নি । কোন দিন কল্পনাও করে নি কেউ ওর জন্য এমন কিছু করতে পারে । আর আজকে সবার সামনে অকপটে সব কিছু বলে দিল । এমন একটা মানুষকে ছেড়ে সে কিভাবে চলে যাবে ?

কোন ভাবেই কি যেতে পারবে !

-যাবে না ?

নোরা খানিকটা চমকে উঠলো । আপন মনেই ও কি যেন ভাবছিলো । পাশে যখন যে আদনান এসে দাড়িয়েছে সেটা লক্ষ্য করে নি । সবার চোখ এড়িয়ে চলে এসেছে ওর কাছে ।

নোরা এদিক ওদিক তাকালো । ও নিজের ক্লাস রুমে এসে বসে ছিল । সেমিনার শেষ করে আদনান আর ওর বাবা গিয়েছিল চেয়ারম্যান ম্যাডামের অফিসে । সেখান থেকে আদনান ওকে খুজে বের করেছে ।

নোরার হঠাৎ খুব লজ্জা লাগলো । পুরো ক্লাস রুমটাই ফাঁকা হয়ে আছে । আজকে ছুটির দিন । কেবল সেমিনারের জন্য ক্যাম্পাসে ওরা এসেছিললো । সেমিনার শেষ হতে সবাই চলে গেছে যে যার মত । ক্লাস রুমের দিকে আর কেউ আসে নি ।

আদনান বলল, কি হল যাবা না ?

-যাবো । ম্যাডামের সাথে কিছু কাজ ছিল ।

-কাল কর । আজকে চল আমার সাথে ।

নোরা একটু হাসলো । তারপর বলল, আমি আসছি । আপনি যান ।

আদনান কিছু সময় নোরার দিকে তাকিয়ে থেকে এক পা এগিয়ে এল ওর দিকে । তারপর বলল, সবার সামনে তোমার নাম বলে দিলে কি রাগ করতে ?

নোরা চট করেই প্রশ্নটার জবাব দিতে পারলো না । সবার সামনে যদি নামটা বলে দিতো তাহলে নিশ্চিত ভাবেই নোরা লজ্জা পেত । তবে ও কোন অন্যায় তো করে নি । বিয়ে করা নিশ্চয়ই অন্যায় কোন কাজ নয় । নোরা মাথা নাড়ালো । সে রাগ করতো না ।

আদনান বলল, আমি চাচ্ছিলাম যে আমাদের বিয়ের তো কোন অনুষ্ঠান হয় নি । একটা রিসিপশন করা যাক ।

নোরা বলল, এতো তাড়াহুড়া কেন করছেন ?

আদনান বলল, কারন আমি সবাই কে জানাতে চাই যে তুমি আমার বউ !

কথাটা আদনান এমন ভাবে বলল যে নোরার হাসি চলে এল । নোরা হাসি থামিয়ে বলল, কেন ? এখন কেন জানাতে চাচ্ছেন ? বিয়ের সময় তো কোন আগ্রহ দেখান নি ।

আদনান আরেক ধাপ এগিয়ে এল নোরার দিকে । তারপর ওর হাতটা ধরলো । কিছু সময় নোরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কারন আমি সবাই যখন জেনে যাবে তুমি আমার বউ তখন আর আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না । মনে নেই সেদিন আমাকে ভয় দেখিয়েছিলে যে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে !

নোরা কি বলবে বুঝতে পারলো না । সেদিন সে আসলেই রাগের মাথায় কথাটা বলেছিলো । খুব অভিমানও হয়েছিলো আদনানের উপর । সে কেন বলে নি নিতুর নামের মেয়েটার কথা ! ওর যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো এটা কেন লুকিয়েছিলো ওর কাছে ।

আদনান যেন বুঝতে পারলো নোরা মনে মনে কি ভাবছে । আদনান বলল, আমি খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম । ভেবেছিলাম যে তুমি হয়তো সত্যটা জানলে আর বিয়েতে রাজি হবে না । আমি তোমাকে হারাতে চাই নি । কিন্তু দেখো তোমাকে ধরেও রাখতে পারছি না । এতো এতো ক্ষমতা আমার ! কত টাকা ! কিন্তু প্রিয় মানুষের কাছে কত অসহায় ! নিতুও চলে গিয়েছিলো তুমি তো চলে যাওয়ার ভয় দেখাচ্ছো !

আদনানের চোখের দিকে তাকিয়ে নোরার কি হল নোরা বলতে পারবে না । এক পলকে নোরা আদনানের কাছে চলে এল । হাত দুটো দিয়ে আদনানের দুই কানের কাছে আলতো করে চেপে ধরলো । তারপর আদনানের ঠোঁটে গভীর ভাবে চুমু খেল ।

নোরা চুমু খাওয়ার পরে যখন আদনানের চোখের দিকে তাকালো, দেখতে আদনান খানিকটা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । নোরার কেন জানি লজ্জা করলো না মোটেও । আদনানের চোখের দিকে চোখ রেখে বলল, আমি যাচ্ছি না কোথায় ! আম্মু আর আর আম্মুর ছেলেকে ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না !

নোরা তখনও আদনানকে খানিকটা জড়িয়েই ধরে আছে । এমন সময় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল । কেউ যেন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে । নোরা আদনানকে ছেড়ে একটু দুরে সরে দাড়ালো । তারপরই দরজায় কামালকে দেখা গেল ।

-স্যার আপনি এখানে । আমাদের এখনই যাওয়া দরকার । নয়তো ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে !

নোরা কামালের দিকে কৌতুহল চোখে তাকিয়ে বলল, ফ্লাইট !

-হ্যা ! আজকে স্যারের জার্মানি যাওয়ার কথা । এমনিতেও প্রথম মিটিং টা স্যার কোন কারন ছাড়াই ক্যান্সেল করেছে । এবারও যদি ক্যান্সেল হয়ে যায় তাহলে এই ডিলটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে ।

আদনান কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, হয়ে যাক । এই ডিল আমি করবো না । এখন আমি কোথাও যাবো না ।

নোরা আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল, এমন বা্চ্চামী কেন করছেন ? ঘুরে আসুন ।

-না আমি এখন তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না ।

-আচ্ছা ! আমি যদি এখন না যাই ?

-ইস বললেই হল ! জোর করে নিয়ে যাবো !

-যদি আপনি না যান তাহলে আমি কিন্তু যাবোই না আর ঐ বাড়ি । দরকার হলে আম্মুকে নিয়ে চলে আসবো ! আমি কিন্তু খুব জেদি মেয়ে বলে দিলাম ।

আদনান কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই কামাল বলল, ম্যাম আপনি বরং স্যারকে কিছু অগ্রিম চুমু খেয়ে নিন । স্যার মনে হয় তাতে রাজি হবে ! আদনান কামালের দিকে চোখ গরম করে তাকাতে যাবো কিন্তু নোরার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল যে কামালের পরামর্শ ওর পছন্দ হয়েছে । নোরা কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, ট্যুর কদিনের ?

-বেশি না । মাত্র তিন দিনের । যাওয়া আসা নিয়ে আরও দুইদিন ।

-আচ্ছা পাঁচ টা ওকে ! চলবে ?

কালাম বলবে খুব চলবে ম্যাম !

আদানান কামালকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি যাও !

কামাল যেন আশা করেছিল চুমু পর্বটা ওর সামনেই হবে । কিন্তু এমন কিছুই হল না । ওকে চলে যেতেই হল ।

পরিশিষ্টঃ

এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার আগে আদনানের খুব ইচ্ছে হল নোরাকে আরেকবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে । কিন্তু আশে পাশে অনেক মানুষ রয়েছে । ওর বাবা সোবাহান চৌধুরীও রয়েছে । নোরা একা একা আবার বাসায় ফিরে যাবে এই জন্য সেও এসেছে সাথে । নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমি যাই তাহলে । পৌছে ফোন দেব !

-আচ্ছা ।

নোরা হাসলো। তারপর বলল, নিশ্চিন্তে ডিল টা করে ফিরে আসুন । আম্মুকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করবেন না । আমি আছি ।

সব লজ্জার ঝেড়ে ফেলে নোরার কপালে একটা চুমু খেয়েই ফেলল । তারপর বলল, আমি চিন্তা করছি না ।

শ্বশুর মশাইয়ের সামনে যে এই ভাবে আদনান ওকে চুমু খাবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি । লজ্জায় লাল হয়ে গেল ও । আর কোন কথা বেরুলো না মুখ দিয়ে । মনে মনে ঠিক করে নিল এমন লজ্জায় ফেলার জন্য একটা শোধ সে নিবেই । আগে আসুক !

আদনান যাওয়ার সময় কত বার যে পেছন ফিরে চাইলো সেটার কোন হিসাব নেই । নোরার এতো সময় কিছু মনে না হলেও যখনই আদনান চোখের আড়াল চলে গেল কেমন একটা মন খারাপ অনুভূতি এসে ভর করলো ! কি অদ্ভুত ভাবে সে আদনানের বউ হয়ে গিয়েছিলো আর আজকে কেমন করে ওকে ভালও বেসে ফেলেছে । জীবনে এই রকম কত অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে । কিন্তু নোরা কি কখনই ভেবেছিল এমন আনএক্সপেক্টেড মধুর জীবন তার জন্য অপেক্ষা করছে !! 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 49

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “দ্য আনএক্সপেক্টেড ব্রাইড (শেষ অংশ)”

Comments are closed.