মৃত্যুচোখ – এক
সকালের এই সময় টা তানজিনার কাছে আর আগের মত নেই । একটা সময় ছিল সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গার পরেই সে চলে যেত দক্ষিন দিকের জানলাটার কাছে । জানালার ঠিক পাশেই বড় কড়ুই গাছটা আছে । ডালপালার অনেক যার অনেকতাই চলে আছে জানলা দিয়ে ভিতরে । রীতিমত জানলা আটকাতে কষ্ট হয় ।
তানজিনার মা প্রায়ই চিৎকার করে ডালপালা গুলো কেটে পরিস্কার করার জন্য, তানজিনার জন্য পারে না । আগে মা একটু বেশি চিৎকার করতেন কিন্তু তানজিনার সাথে ঐ দূর্ঘটনা ঘটার পর থেকে খুব বেশি কথা বলেন না । মেয়ে যা বলেন তাই মেনে নেন ।
তানজির এখন সকাল সকালই ঘুম ভাঙ্গে । কিন্তু আগের মত ব্যস্ততা আর নেই । সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকা । সময় কাটানোর জন্য যে ল্যাপটপ টা নিয়ে বসবে সেটারও উপায় নেই ।
ডাক্তারের পরিস্কার নিষেধ আছে, কোন ভাবেই টিভি কিংবা মনিটরের উজ্জল আলোর দিকে এক টানা বেশি সময় তাকিয়ে থাকা যাবে না । বই পড়া যাবে তবে বেশি সময় ধরে না ।
তানজিনার একা একা বেশি সময় ধরে ঘরের ভিতর বসে থাকতে ভাল লাগে না । তবুও কিছু করার নেই । বসে থাকতে হয় । বাবা মায়ের কড়া নির্দেশ । আগে সুস্থ হও তারপর যা ইচ্ছা কর ।
অপুকে একবার ফোন দিবে কি না একটু ভাবলো ।
নাহ । চিন্তাটা বাতিল করে দিল পরক্ষনেই । সবে মাত্র সকাল হয়েছে । জনাবের এতো জলদি ঘুম ভাঙ্গবে না ।
তানজিনার বিছানা থেকে উঠে জানালার দিকে একটু এগিয়ে গেল । রোদ এখনও উঠে নি । তাই বাইরের উজ্জল আলোর পরিমান একটু কম । তবে এখনই সূর্যয়ের আলো এসে হাজির হবে ।
তানজিনা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো । ওর জানলা দিয়ে বেশ খানিকটা আকাশ দেখা যায় সাথে বাইরের রাস্তার বেশ খানিকটা স্থান দেখা যায়, আর রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গা টুকু । চারিপাশে উচু উচু বিল্ডিং থাকলেও কেবল ওর জানালার পাশের এই জায়গা টুকু এখনও সিমেন্টের জঙ্গলে পরিনত হয় নি । তবে কথা কানে আসছে যে দু তিন মাসের ভিতরেই নাকি এখানেও বিল্ডিং বানানোর কাজ শুরু হবে । তখন আর এই গাছটা হয়তো থাকবে না । জানালা দিয়ে তখন হয়তো আর আকাশটাও দেখা যাবে না ।
তানজিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ।
বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ ফাঁকা জায়গাটাতে হাটাহাটি করছে । আর নিজেদের ভিতর খোশ গল্পে মেতে আছেন । প্রায় সবাইকে চেনে সে । তানজিনাদের বিল্ডিংয়েই থাকে কয়েকজন । আর দুতিনজন থাকে আশে পাশে বিল্ডিংয়ে ।
কিন্তু ঐ কালো আলখাল্লা পরা লোকটা কে তো ঠিক চেনা যাচ্ছে না ।
তানজিনা নিজের চোখের উপর আরেকটু জোর দিল ।
দুর্ঘটনা পরে চোখের উপর একটু জোর না দিলে দুরের জিনিস কেমন যেন ঝাপসা লাগে ।
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরেও তানজিনা লোকটাকে চিন্তে পারলো না ।
নাহ । লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না । কালো কাপড় দিয়ে আপদমস্তক ঢাকা । গরমের এই সময়ে কেউ এমন পোষাক পরে থাকতে পারে তানজিনার ধরনার বাইরে ছিল ।
লোকটা বাইরের গড়ন একেবারে ছিপছিপে । কালো আলখাল্লা টা ঢিলাঢোলা হলেও স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ চিকন আর একটু লম্বা । প্রয়োজনের তুলনায় একটু যেন বেশি লম্বা । এমন নম্বা মানুষ সাধারন আজকাল দেখা যায় না।
হঠাৎই তানিজনা একটা বিষয় লক্ষ্য করলো । কালো আলখাল্লা পরা লোকটা পাশের বাসা রইস আঙ্কেলের পিছনেই কেবল ঘুরঘুর করছে । অন্য কারো পিছনে যাচ্ছে না । আরেকটা বিষয় আশ্চর্যের বিষয় অন্য সবার আচরনে মনে হচ্ছে কালো লোকটাকে কেউ যেন দেখতে পাচ্ছে না । কেবল তানজিনা নিজের ঘর থেকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে ।
কেন ?
লোকটার মতলব তো ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না ।
একবার কি আঙ্কেলকে চিৎকার করে সাবধান করে দেবে নাকি ?
তনজিনার নিজের ভিতরেই কেমন একটু দ্বিধা বোধ করলো । ডাকতে যাবে ঠিক তখন তানজিনার চোখে এক অদ্ভুদ দৃশ্য ধরা পড়ো ।
কালো আলখাল্লা পরা লোকটা হঠাৎ করেই নিজের মাথার কালো কাপড়টা সরিয়ে ফেলল । তানজিনা অবাক হয়ে দেখলো কালো কাপড়ের আড়াল থেকে যে মুখটা বেড়িয়ে আসলো সেটা আর কারো নয় স্বয়ং রইস আঙ্কেলে নিজের চেহারা । একি চেহারার দুজন ।।
রইস আঙ্কেল এক জায়গার দাড়ালো । এতোক্ষন একভাবে হেটে সে খানকি টা ক্লান্ত হয়ে গেছে । একটু বিশ্রাম দরকার।
এতোক্ষন কালো লোকটা রইস আঙ্কেলের পিছন পিছন ঘুরছিল কিন্তু এখন লোকটা একেবারে তার সামনা সামনে দাড়িয়ে আছে । কিন্তু রইস আঙ্কেল সেটা দেখতে পাচ্ছে বলে মনে হল না । অন্তত তার আচরনে তো সে রকম কিছু মনে হল না ।
তানজিনা একভাবে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে ।
কিছু একটা হতে চলেছে । তানজিন মনের ভিতর কেবল একটা কথাই মনে হল খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে ।
কয়েক মূহুর্তের নিরবতা । তারপর তানজিনা দেখতে পেল কালো লোকটা মুহুর্তের ভিতরেই সচল হয়ে রইস আঙ্কেলের শরীরের ভিতর ঢুকে পড়লো । রইস আঙ্কেল কয়েক মুহুর্ত একদম চুপ তারপর বুকে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন । আসে পাশে লোকজন তাকে ধরাধরি করে বাসায় নিতে চাইলো কিন্তু তানজিনার মনে হল রইস আঙ্কেল মারা গেছে ।
এমন মনে হওয়ার কোন কারন নেই তবে তানজিনার মনে হল সে মারা গেছে ।
দুই
অপু হাসতে হাসতে বলল
-তো বেসিক্যালি তুমি কি বলতে চাচ্ছ ? তুমি আজরাইল দেখতে পাও ?
তানজিনার মেজাজটা খারাপ হল । মুখ গোমড়া করে বলল
-এই জন্য আমি তোমাকে বলতে চাই নি ।
-আরে আরে রাগ কর কেন ?
-রাগ করবো না ? আমি এই কটা দিন কি পরিমান মানষিক কষ্টের ভিতরে আছি আর তুমি আমার সাথে ফাইজলামি করছো ?
-আচ্ছা তুমি নিজেই একটু ভেবে দেখো তো তুমি কি বলছো ? অন্য কেউ হলে তোমাকে স্রেফ পাগল ভাববে । আর কিছু না ।
-আচ্ছা ঠিক আছে আমি পাগল । পাগলের সাথে প্রেম করতে হবে না তোমার ।
এই বলে তানজিনা আর বসলো না । উঠে পড়তে চাইলো । কিন্তু অপু তাকে উঠে যেতে দিল না । চট করেই তার তার হাত ধরে আবার বসিয়ে দিল । হাসি মুখে বলল
-আমার পাগলই ভাল । বেশি সুস্থ মেয়ের সাথে প্রেম করে মজা নেই । আর তুমি তো পাগল না । মহিলা পাগল । আমার সুইট পাগলী ।
-তুমি ছাড়ো…..।
তানজিনা কথা শেষ করলো না । ওর চোখ আটকে গেল রাজু ভাস্কর্যের ঠিক পাশেই একটা ছেলের দিকে । বিশ বাইশ হবে বয়স । কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ । চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা ।
তানজিনা আর অপু টিএসসির এই পাশটা বসে আছে । তানজিনার মুখের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেতেই অপু বলল
-এই কি হল ?
-ঐ ছেলেটাকে দেখছো ?
-কোন টা ?
-ঐ যে কালো নীল টিশার্ট পড়া কাঁধে ব্যাগ ।
অপু তানজিনার ইশারা লক্ষ্য করে তাকালো । বলল
-ঐ যে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা ।
-হুম ।
-হুম । কি সমস্যা ?
-ওর ঠিক পিছনের একজন কে দেখতে পাচ্ছো কালো আলখাল্লা পরা ।
অপু কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
-আমি কেবল কালো জিন্স পরা ঐ সুন্দরী মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছি । আর কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না ।
-অপু ।
কথার মাঝে কিছুটা বিরতি । তানজিনা বলল
-ছেলেটা এখনই মারা যাবে ।
অপু হয়তো তানজিনার এই কথাটাও উড়িয়ে দিতো হেসে কিন্তু তানজিনার বলার ধরনে দেখে অপু কোন প্রকার হাসি ঠাট্টা করলো না । আরও ভাল করে বলল কারতে পারলো না ।
তানজিনার মত অপুও তাকিয়ে রইলো ছেলেটির দিকে ।
ছেলেটি খানিকটা বেখিয়ালে পথ চলছে । কোন দিকে যেন হুস নেই । হাটার ধরন দেখেই অপু মনে হল আসলে ছেলেটি সুস্থির নেই । দুই পায়ের ভিতর কোন সমন্বয় নেই ।
এই ভাবে হাটতে থাকলে ছেলেটি দুর্ঘটনায় পড়বে ।
অপু উঠতে যাবে তখন তানজিনা অপু হাত চেপে ধরলো ।
কেবল মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয়ে এল
-এখন !!
অপু লক্ষ করলো ছেলেটি হাটতে হাটতে হঠাৎ করেই দুই পায়ের উপর ব্যালেন্স হারিয়ে ঠিক রাস্তাট মাঝে খানে চিৎ হয়ে পরে গেল । আর পরবি তো পড় ঠিক ঐ সময়ে পাশ দিয়ে একটা ল্যান্ড রোভার যাচ্ছিল । গতি খুব বেশি ছিল না কিন্তু ছেলেটি একেবারে চিৎ হয়ে পরেছে । মাথাটা পড়েছে একেবারে চাঁকার নিচে ।
তিন
-তুমি নিশ্চিত এই জায়গা ?
-তাই তো মনে হচ্ছে ।
তানজিনা নিজের আপন মনের বাড়ির চারিপাশে ঘুরে দেখতে লাগলো । আসলেই কি এটা সেই জায়গা ।
আজকে তানজিনা আর অপু বিক্রম পুরের এই সিরাজদিখান নামের এই জায়গাটাতে এসেছে । গ্রামের নামটা ঠিক বলতে পারবে না ।
পুরোনো দুই তলাবাড়ি । টিনের । বেশ বড় । এদিককার বাড়ি গুলো প্রায় সবই টিন দিয়ে তৈরি । বর্ষাকালে এই জায়গা গুলোতে নাকি একেবারে পানি উঠে যায় তাই সহজে কেউ পাকা বাড়ি করতে চায় না ।
তানজিনার হঠাৎ বলল
-আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই জায়গায় আমি এর আগেও একবার এসেছি । কেমন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে ।
অন্য সময় হলে হয় তো অপু হেসে উঠতো কিন্তু আজকে উঠল না । কারন ঢাকা থেকে এতো টা পথ তানজিনার কথা অনুযারী ওরা এসেছে ।
অপু গাড়ী চালিয়েছে তানজিনা চোখ বন্ধ করে একবার বলেছে ডানে যাও একবার বলে বাঁয়ে যাও । আস্তে আস্তে এখানে এসে পৌছেছে ।
কিন্তু অপুর যতদুর ধারনা সে কিংবা তানজিনা কেউ এখানে এর আগে আসে নি । তাহলে সে কেমন করে পথ চিনলো ।
অপু বলল
-তাই ?
-হুম । কেন জানি মনে হচ্ছে এই বাড়িটার পিছনে একটা ডোবা পুকুর আছে ।
অপু তাকিয়ে দেখলো । বাড়ির পিছনের দিকে যাওয়ার কোন উপায় নেই । যেতে হলে হয়তো বাড়ির ভেতর দিয়েই যেতে হবে ।
অপু বলল
-চল ভেতরে যাওয়া যাক ।
বাইরে থেকে বাড়িটাকে যতটা পুরানো মনে হয় ভেতরে আসলে তত টা পুরানো না । বরং বেশ পরিস্কার পরিছন্ন এবং পরিপাটি মনে হচ্ছে । ওদেরকে আসতে দেখেই বাড়ির বারান্দায় বসে থাকা এক মাঝ বয়সী লোক এগিয়ে এলো ।
লোকটা মাথায় ঘন চুল। যার অল্প কিছুতে পাক ধরেছে । চেহরা বেশ সম্ভ্রান্ত ভাব আছে । পরনে একটা কালো খদ্দরের পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি ।
লোকটাই আগে কথা বলল
-আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না ।
-আসলে আমরা ঢাকা থেকে এসেছে । আমি অপু রায়হান । এই আমার বন্ধু তানজিনা । আমরা এসেছি ঢাকা থেকে ।
-আচ্ছা । আসুন ভেতরে আসুন ।
বারান্দায় ওদের বসায় ব্যবস্থা করা হল ।
বাড়ি টা মনে হচ্ছে গ্রামের গেরস্ত পরিবার । অনেকেই দেখা যাচ্ছে আসছে যাচ্ছে । ঘরের ভেতর থেকে কেউ কেউ আবার উকি মারছে । দেখার চেষ্টা করছে ।
ভদ্রলোক নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন । ভদ্রলোকের নাম আব্দুল গাফফার চৌধুরি । এই গ্রামের একজন গেরস্ত পরিবার, জানা গেল ঢাকায় লোকটা আড়তের ব্যবসা আছে । সদর ঘাটে ।
কথা বার্তা বেশ পরিস্কার শিক্ষিত মনে বেশ ।
গাফফার চৌধুরী বলল
-এবার যদি বলতে আপনাদের আসার কারন টা কি ?
অপু একটু যেন অস্বস্তি বোধ করলো । কিভাবে বলবে ঠিক বুঝে উঠে পারলো না । অপুর অস্বস্তি দেখে তানজিনা নিজেই বলল
-আপনাদের বাড়ির পিছনে কি কোন ডোবা আছে ?
গাফফার চৌধুরী খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-আছে । কেন ?
আবারও কিছুটা নিরবতা । তানজিনা বলল
-শুনতে হয়তো আপনার কাছে একটু অবাক লাগবে তবুও বলছি, আপনার পরিবারের কেউ কি কাউকে আই ডোনেট করেছে আই মিন চোখ দান করেছে ?
কথাটা শুনেই গাফফার চৌধুরী কেমন একটু গম্ভীর হয়ে গেল ।
কিছুক্ষন কোন কথা বললেন না । হঠাৎই গাফফার চৈধরীর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো ।
অপু তাড়াতাড়ি বলল
-দেখুন আমরা আসলে আপনাকে হার্ট করার জন্য কিছু বলি নি । আমরা কেবল জানতে চাইছি । যদি ..।
চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল
-না না ঠিক আছে । তোমাদের এই বাড়ির ঠিকানা কে দিয়েছে ?
-আসলে কেউ দেয় নি । তানজিনা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে । আসলে জিনিসটা আজিব শোনাবে কিছুটা তবে মাস তিনেক আগে তানজিনার একটা বড় এক্সসিডেন্ট হয়, সেখানে ওর চোখ দুটো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ভাগ্য ভাল যে সঙ্গে সঙ্গেই ডোনার পাওয়া গেছিল । এখন আমাদের মনে হচ্ছে মানে তানজিনার মনে হচ্ছে ডোনারটা এই বাসার কেউ ছিল ।
এই কথা বলার পরই হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে এক মহিলা ছুটে বেড়িয়ে এল । তারপর তানজিনার চোখের কাছে চোখ নিয়ে একভাবে তাকিয়ে রইলো ।
ঘটনা এটোটাই দ্রুত ঘটলো যে সবাই একটি অপ্রস্তুত হয়ে গেল ।
মহিলা কিছুক্ষন তাকয়ে থেকে বলল
-হ্যা । এটা আমার মিলির চোখ । আমার মিলির । আমার মেয়ের চোখ ।
চার
অপু একটু অবাকই হয়েছ । একটু না বেশ খানিকটা অবাক হয়েছে । এতোদিন তানজিনার কথা গুলো ওর বিশ্বাস হয় নি । কিন্তু কোন প্রকার ঠিকানা ছাড়া তানজিনা যেমন করে ওর আই ডোনার কে খুজে পেল তা আসলেই খানিকটা অবাক করার বিষয় ।
গাফফার চৌধুরী বলল
-আমি জানতাম একদিন কেউ কেউ না কেউ আসবে ।
-কিভাবে জানতেন ?
-আসলে তুমি যে কথা গুলো বলত সেটা আমার মেয়েটাও বলতো । বলতো তার ভেতরে নাকি কিছু একটা আছে । শেষ সময়টাতে ও কেমন জানি কথা বার্তা বলতো । ওর ভিতর কি জানি আছে । আমার মেয়েটা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পরেছে । তাই ওর কথা গুলো ফেলে দিতে মন চাই তো না । তবে যখন ও মরনের পরে চোখ দান করার কথা বলল তখন আমরা কেউই রাজি ছিলাম না । কিন্তু মেয়ের শেষ ইচ্ছা কিছুতে ফেলে দিতে পারলাম না । আমি জানতাম আমার মেয়ের চোখ একদিন কেউ নিয়ে আসবে । মাঝে মাঝে ও অদ্ভুদ কিছু কথা বলতো যার অনেক টাই আশ্চার্য ভাবে সত্যি হয়ে যেত । সেই চোখই তুমি পেয়েছ ।
-জি । সাথে সাথে সেই কিছু একটাও । তাই না ?
-হুম ।
গাফফার চৌধুরী একটু সময়ের জন্য ভেতড়ে চলে গেলেন । ফিরে এলেন কিছু সময় পরেই । হাতে একটা ছোট নোটবুক ।
-এটা নাও ।
তানজিনা নোট বইটা হাতে নিল ।
-এটা মিলির শেষ সময়ের সঙ্গি । ও অনেক কিছু লিখেছে । হয়তো তুমি বুঝতে পারবে । আর আজকে তোমরা দুপুরে দেখেও যাও । মিলির মা তোমাকে পেয়ে যেন তার মেয়েকে পেয়েছে । তোমরা খেয়ে গেলে অনেক খুশি হবে ।
ঢাকা পৌছাতে পৌছাতে প্রায় রাত হয়ে গেল । মিলির মা যেন কিছুতেই ওদেরকে আসতে দিবে না । শেষে বলে এসেছে যে আবার যাবে ওরা । সময় পেলেই যাবে ।
পুরো রাস্তাটা তানজিনা মিলির নোট বুকটা পড়তে পড়তে এসেছে । বিভিন্ন দিনের কথা বার্তা লেখা তাতে । একবারে শেষের কয়েকটা লাইনে তানজিনার চোখ আটকে গেল ।
মিলি লিখেছে
“আজকে দিশানকে জড়িয়ে ধরেছিলাম । যতক্ষন ছায়াটা ছিল ততক্ষন । এক পর্যায়ে ছায়া টা আমার চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল । এর মানে ঠিক বুঝলাম না । মৃত্যু পথযাত্রীকে কি তাহলে বাঁচানো সম্ভব?”
তারপরের কয়েকটা পেজে কেমন আঁকা জুকি করা ।
একপেইজে এসে লেখা
“আমি বুঝে গেছি আমাকে কি করতে হবে”
বেশ কয়েকবার লাইনটা লেখা ।
ব্যস ।
এখানেই নোটবুকটা শেষ । তার মানে কি ? মিলির শেষ দিন গুলোতেও কি মিলি কাউকে বাঁচিয়েছিল । মৃত্যুদুতের হাত থেকে ?
আর ও কি বুঝে গেছিল ?
তানজিনা নোটবুক বের বন্ধ করে একটু চোখ বন্ধু করে রইলো ।
আচ্ছা হঠাৎ করেই মিলি কেন নিজের চোখটা দান করে দিল ।
সব চেয়ে অবাক করার বিষয় যেটা তানজিনা আর অপুকে অবাক করেছে সেটা হল এই চোখ গুলো মিলির নিজের না । স্কুলে থাকতে মিলির চোখটা প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল । একটা দুর্ঘটনায় পরে মিলিও নিজের চোখ হারিয়েছিল । তারপরেই চোখ প্রতিস্থাপন করা হয় ।
আশ্চর্য ।
কার এই চোখ ?
তানজিনা চোখ বন্ধ করেই চিন্তা করতে লাগলো ।
পাঁচ
-আরে আপনি কি করছেন ? আমার মেয়েকে ছাড়ুন ।।
বই মেলা । চারিদিকে অসংখ্যা মানুষ । মোটামুটি সবাই তানজিনার দিকে তাকিয়ে আছে । তানজিনা একটা ৫/৬ বছরের মেয়ের জড়িয়ে বসে আছে । পাশে অপু দাড়িয়ে আছে অপ্রস্তুত ভাবে ।
মেয়ের মা বারবার মেয়েকে ছেড়ে দিতে বলছে ।
হঠাৎই তানজিনা কঠিন গলায় বলল
-আপনি কি চান আপনার মেয়ে মারা যাক ?
এই প্রশ্নটা শুনে হঠাৎ থমকে গেল মহিলা । অপু নিজেও খানিকটা অবাক হল ।
মেয়ের মা আমতা আমতা করে বলল
-জি না ।
-তাহলে চুপ করে দাড়িয়ে থাকুন । আমি আপনার সামনেই আছি । আপনার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছি না ।
তানজিনা আসলেই মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে না । কেবল হাটু গেড়ে বসে রইলো মেয়েটাকে জড়িয়ে । হাত তিনেক দুরে সেই কালো আলখাল্লা পরা ছিপছিপে লম্বা লোকটা দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে ।
তানজিনা মেয়েটিকে আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধরলো । যেন কিছুতেই তাকে ছেড়ে দেবে না ।
-কি নাম মা মনি তোমার ?
-আমার নাম লিরা ।
-লিরা মা মামনি । আমার নাম তানজি । বুঝেছো । তোমার কোন ভয় নেই । আমি আছি ।
-আমার ভয় করছে না ।
-এই তো গুড গার্ল । ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই ।
তানজিনা তাকিয়ে দেখলো কালো ছায়াটা এখনও দাড়িয়ে আছে । হঠাৎ কালো ছায়ার মুখ থেকে কালো কাপড় সরে গেল । সেখানে লিরার চেহারাটা ভেসে উঠলো । কিন্তু সেখানে কোন কোমলতা নেই । আছে এক ধরেনর হিংস্র ভাব । ছায়ার চোখ দিয়ে যেন আগুন জ্বলছে । এভাবে আরও কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পরে কালো আলখাল্লা পরা লিরা ভিড়ের ভিতর হারিয়ে গেল ।
তানজিনাও তখন লিরাকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে এল ।
সন্ধ্যা বেলা ।
ওরা দুজন টিএসসিতে বসে আছে ।
-ওটা কি ছিল ?
-তুমি বুঝো নি ?
-না । ওভাবে চিনো না জানো না, একটা বাচ্চা মেয়েকে জড়িয়ে ধরার মানে কি ?
তানজিনা উত্তর না দিয়ে হাসলো কেবল মনে মনে ।
পরিশিষ্টঃ
-সকল ফর্মালিটি তৈরি । আপনি কেবল সাইন করলেই হবে ।
তানজিনা একটু হেসে কলম টা তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সাইন করে দিল । যখন বেরিয়ে আসবে তখন সাদা এপ্রোন পরা ভদ্রলোক বলল
-আসলেই আপনাদের মত ইয়াং এডুকেটেড ছেলেমেয়েদের কে এমন মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে দেখে খুব ভাল লাগছে । মৃত্যুর পর চক্ষু দান একটি মহৎ গুন ।
তানজিনা একটু হেসে বলল
-আপনাকেও ধন্যবাদ । আপনারাও তো কম করছেন না । ভাল থাকবেন ।
(সমাপ্ত)
স্বীকারোক্তিঃ বেশ কদিন আগে একটা মুভি দেখেছিলাম । “দ্য আই” গল্পটার প্রথম অংশ টুকু লিখেছিলাম সেই মুভিটা দেখার পর । গল্পটার মুল কাহিনী সেই নিয়ে যাই নি তবে এই টুকু স্বীকার করতেই হবে গল্পটা ঐ মুভির দ্বারা খানিকটা অনুপ্রানীত।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.