জীবনের রঙ

4.8
(31)

ক্লাসের ঘন্টা বাজার ঠিক দুই মিনিট আগে আমি নিশিকে দেখতে পেলাম । দরজায় এসে দাড়িয়েছে । ওর চেহারা দেখেই আমার মনে হল যে ও এতোটা পথ দৌড়ে এসেছে । আমার সাথেই যে দেখা করতে এসেছে, সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না । ওর মুখের ভাবটা দেখে আমার আবারও মনে হল যে গত দিন ওকে কথা গুলো বলা আমার একদম ঠিক হয় নি । ওর কাছ থেকেও আমার ব্যাপারটা লুকানোর দরকার ছিল । যেমনটা আমি সারাটা জীবন লুকিয়ে এসেছি আর সবার কাছ থেকে । এটা নিশিকে জানানো আমার একদম উচিৎ হয় নি । যদি ওকে না জানাতাম তাহলে ঝামেলাটা সৃষ্টি হত না ।

এখন আমি কি করবো ?

নিশি দরজার কাছে দাড়িয়েই কিছুটা সময় এদিক ওদিক তাকালো । আমি জানি ওর চোখ আমাকেই খুজে বেড়াচ্ছে । আমাকে খুজে পেতে ওর খুব একটা দেরী হল না । আমাকে দেখার সাথে সাথেই আমার দিকে হাটা দিল ।

মাঝের দিকে একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম । আমার হাত ধরে একেবারে শেষের দিকে নিয়ে বসালো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-তুমি ফোনে কি বললে ?

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । নিশি আবার তীব্র কন্ঠে বলল

-বল কি বললে ? আমার কাছে কি লুকাচ্ছো ? সত্যি করে বল । আমি কি মারা যাচ্ছি ? যাবো ?

আমি মাথা নাড়ালাম । নিশি আবার বলল

-তাহলে ? কে মারা যাবে ? আমার বাবা নাকি মা ?

আমি চুপ করে রইলাম । ব্যাপার নিশিকে আমি কিভাবে বলবো বুঝতে পারলাম না । আমি এখন যাই বলি না কেন তার ফল মোটেই ভাল হবে না । আমি নিশিকে বললাম

-দেখ, এটা নির্ধারিত । আমরা এটাকে বদলাতে পারি না । এমন কি আগে থেকে এটা জানাও ঠিক না ।

নিশি এক প্রকার চিৎকার করেই বলল

-আমি কিছু জানতে চাই না । আমি কেবল সত্যটা জানতে চাই !

নিশি এতোই জোরে চিৎকার করে কথাটা বলল যে সামনে থেকে অনেকে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলল

-শান্ত হও দয়া করে । সময় আছে । এখনও অনেকটা সময় আছে ।

এই কথাতে নিশি খানিকটা শান্ত হল । আমি আরও কিছু বলতে যাবো তার আগেই ক্লাসে স্যারে ঢুকে পড়লো । আর কিছু বলা হল না । তবে মনের মধ্যে সেই খুঁতখুতানিটা রয়েই গেল । আমার তখন আরেকবার মনে হল যে নিশির কাছে আমার এই গোপন কথাটা বলা মোটেই উচিৎ হয় নি । একদমই না । এটা সারা জীবন আমার ভেতরে লুকিয়ে রাখাই উচিৎ ছিল ।

ছোট বেলা থেকেই আমি মোটামুটি একা একাই বড় হয়েছি । বিশেষ করে আমার ভেতরের এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা আছে এটা জানার পরে আমি নিজেকে অন্য মানুষের কাছ থেকে আলাদা হয়ে পড়ি । আমার নিজের কাছেই মনে হয় আমি অন্য সবার মত নই । সবার থেকে আলাদা । এই আলাদা হওয়ার জন্যই আমি সবার কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে নি । কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে কিছুটা ব্যতীক্রম হয়েই গেল আমার জীবন । নিশির সাথে জড়িয়ে যেতে হল । তবে চুড়ান্ত ভাবে জড়িয়ে যাওয়ার আগে আমার এই ব্যাপারটা নিশির কাছে বলা উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছিলো । তাই নিশিকে আমি আমার জীবন সব থেকে গোপন কথাটা জানিয়ে দিয়েছিলাম । প্রথমে ও আমার কথা একদম বিশ্বাস করতে চায় নি । কিন্তু যখন প্রমান দিলাম ও তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ।

তবে এই অস্বাভাবিকত্ব আমাদের সম্পর্কের ভেতরে কোন সমস্যা সৃষ্টি করে নি । ও মাঝে মাঝেই আমার কাছে জানতে চাইতো আমি কার ভেতরে কি রং দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু ব্যাপারটা কেবল সেই পর্যন্তই আটকে ছিল । আমি নিজেও খুশি ছিলাম । একজন অন্তত পাওয়া গেছে যে আমার ভেতরের এই অস্বাভাবিকত্ব দেখেও আমাকে গ্রহন করে নিয়েছে । কিন্তু গতকালকে ও যখন আমাকে ওর বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে গেল তখন আসল ঝামেলা শুরু হল । গতকাল রাতেই আমার মনে হল যে নিশিকে না বললেই হয়তো ব্যাপার আরও ভাল হত ।

মানুষ জন্মের সময়টা আগে থেকে ধারনা করতে পারে । একেবারে সঠিক সময়টা না পারলেও কাছাকাছি ধারনা পায় যে কখন শিশুটার জন্ম হতে পারে সেটা আগে থেকেই বলতে পারে । কিন্তু মানুষ কখন মরবে সেটা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না । এটা অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালই । কারন যদি মানুষ আগে থেকে জানতে পারতো সে কখন মারা যাবে কিংবা সামনের মানুষটা কখন মারা যাবে তখন ব্যাপারটা অন্য রকম হত । এটা না জানা মানুষের জন্য এক প্রকার সৌভাগ্যই বলা যায় ।

তবে এই সৌভাগ্য আমার নেই । আমি আগে থেকেই বলতে পারি আমার সামনের মানুষটা কখন মারা যাবে । একদম সঠিক সময়টা বলতে না পারলেও কাছাকাছি সময়টা আমি ঠিকই বুঝতে পারি । আমি তাদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি সেই মানুষটা কি অতি শীঘ্রই মারা যাবে নাকি এখনও অনেক দিন বাঁচবে ।

হয়তো ব্যাপারটা আমার জন্ম থেকেই শুরু হয়েছে । আরও ভাল করে বললে বলতে হয় আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই এই ব্যাপারটা আমার মধ্যে ছিল । আমি আগে ভাবতাম হয়তো আমার আর সবাই এই ব্যাপারটা দেখতে পায় । তাই যখনই আমি এই রংয়ের ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করতাম তারা আমার দিকে কেমন চোখে তাকাতো । আমার মা বাবা এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো । তারা একজন মনের ডাক্তারের সাথে কথা বললেন । সেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে সেই ডাক্তার আমাকে বুঝাতে থাকে যে আমি যা কিছু দেখতে পাই সেগুলো আসলে সঠিক না । এসব আমার মনের সৃষ্টি । তখনই আমি আসলে বুঝতে পারি যে এই ব্যাপারটা কেবল মাত্র আমি নিজেই দেখতে পাই । অন্য কেউ আমার মত নয় । তার মানে হচ্ছে আমি অস্বাভাবিক ।

সেই ডাক্তারকে বলতে পারি নি যে তার নিজের শরীর থেকে লাল রং বের হচ্ছে । তখনও আমি ঠিক আবিস্কার করতে পারি নি যে আমি আসলে কেন এই রঙ গুলো দেখতেছি । কেন বিভিন্ন মানুষের শরীর থেকে বিভিন্ন রঙ আমার চোখে পড়ছে । কিন্তু যখনই সেই ডাক্তার এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল তখনই ব্যাপারটা আমার মাথায় সর্ব প্রথম ধাক্কা মারলো । তখনই আমি আসলে আবিস্কার করলাম যে আমি মানুষের মারা যাওয়ার ব্যাপারটা দেখতে পারি ।

মারা যাওয়ার ব্যাপারটা দেখতে পারি বলতে তাদের দিকে তাকালেই আমি বলতে পারি না যে সামনের মানুষটা আর কতদিন বেঁচে থাকবে তবে একটা ধারনা করতে পারি । এবং যদি তার মৃত্যু কি আসন্ন কি না সেটাও ধারনা করতে পারি । এই ব্যাপারটা আমার বুঝতে পারি তাদের শরীর থেকে বের হওয়া রঙ থেকে । যেমন রঙিন বাল্ব থেকে বিভিন্ন আলো বের হয় ঠিক তেমনি ভাবে প্রত্যেক মানুষের শরীর থেকে বিভিন্ন ধরনের আলো বের হয় । এই আলো গুলোই আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে মানুষটা আর কতদিন বেঁচে থাকে । ব্যাপারটা আমি প্রথম ধরতে পারি ঐ মনের ডাক্তার মারা যাওয়ার পরপরই ।

যদি একটা মানুষের শরীর থেকে সবুজ আলো বের হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে মানুষটা আরও অনেক দিন বাঁচবে । গাছের পাতার মত । বয়স হওয়ার সাথে সাথে পাতা গুলো আরও সবুজ আর পরিপক্ক হয় সেই রকম । একটা সময় গাছের পাতাটা আস্তে আস্তে ধূসর হয় । তারপর শুকনো হলুদের মত রং হয়ে ঝড়ে পরে । মানুষের বেলাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে ।

যদি মানুষটা স্বাভাবিক ভাবে না মরে অসুস্থ হয়ে মারা যায় তাহলে মানুষটার শরীর থেকে সবুজ রং আর বের হবে না । তখন তার শরীর থেকে বের হয় নীল রং । বিভিন্ন রোগের জন্য নীলের ভেতরে বিভিন্ন রং বের হতে থাকে । যখন রংটা তীব্র হয়ে ওঠে তখনই বুঝতে পারি যে তার মারা যাওয়ার সময় চলে এসেছে ।

আর মানুষটা যদি আত্মহত্যা করতে যায় তাহলে তার ভেতরে থেকে কালো রং বের হয়ে আসে । অন্য দিকে মানুষটা যদি দুর্ঘটনায় পরে মারা যায় তখন হঠাৎ করেই তার শরীর থেকে লাল রংয়ের আলো বের হয়ে আসে । এই রং গুলো প্রথমে হালকা থাকলেও যতই মারা দিন চলে আসে ততই তীব্র আর ঘন হতে থাকে ।

যেদিন আমি প্রথম নিশিকে কথাটা বলি ও আমার কথা একেবারে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল । আমার কথা ওকে বিশ্বাস করানোর জন্য একটা কাজ করতে হল । আমি জানতাম আমাদের ক্লাসের এক মেয়েটা খুব শীঘ্রই আত্মহত্যা করতে চলেছে । সেটাই একটা কাগজে লিখে খামে আটকে আমি নিশির হাতে দিলাম । ওকে বললাম যে কিছু ঘটতে যাবে খুব জলদি । মেয়েটার শরীর থেকে বের হওয়া রঙ থেকে আমি বলেছিলাম তিন দিনের মাথাতেই মারা আত্মহত্যা করবে । কিন্তু কোন মেয়েটা সেটা বললাম না । মেয়েটার নাম লিখে কেবল নিশির হাতে দিলাম ।

নিশি তখন খানিকটা ইতস্তত করতে লাগলো । তারপর বলল

-যখন তুমি জানো তখন তুমি সেটা আটকাচ্ছো না কেন ?

আমি বললাম

-এটা আমি করতে পারি না । কারন কি জানো ?

-কি কারন ?

-কারনটা হচ্ছে জন্ম আর মৃত্যু কিন্তু আমাদের হাতে নেই । এটা নির্ধারন করার ক্ষমতা আমাদের কারো নেই । এটা উপরওয়ালার হাতে । আমরা যদি সেই কাজে বাঁধা দেই তাহলে এটা ফল ভাল হয় না । যখন নির্ধারিত মানুষের কাছ থেকে মৃত্যুদূত বিফল হয়ে ফেরৎ যায় তখন সে অন্য কাউকে ঠিকই নিয়ে যায় যার মৃত্যুর সময় তখনও হয় নি । বুঝতে পেরেছো ?

তার ঠিক দিন তিনেক পরেই আমাদের ক্লাসের মুমু নামের একটা মেয়ে নিজের ঘরে আত্মহত্যা করলো । যে খামটা আমি নিশির হাতে দিয়েছিলাম সেই খামের ভেতরে এই নামই ছিল । তারপরই নিশি আমার কথা বিশ্বাস করা শুরু করলো । ব্যাপারটা এই পর্যন্তই সীমা বদ্ধ ছিল । কিন্তু গতকালকের পরে সব কিছু অন্য রকম হয়ে গেল ।

দিনদিন আমাদের সম্পর্কটা আরও গভীর হচ্ছিলো । একটা সময় নিশির মনে হল যে আমার তার বাবা মায়ের সাথে দেখা করা দরকার । তারপর আমার কোন প্রকার কথা বার্তা না শুনেই আমাকে ওদের বাসাতে নিয়ে গেল । গতকালকেই ওদের বাসাতে আমার দুপুরের দাওয়াত ছিল । যখন ওদের বাসাতে গিয়ে হাজির হলাম তখন নিশির বাবা বাসাতে ছিল না । কি একটা কাজে যেন বাইরে গিয়েছিলো । আমি নিশি আর ওর মায়ের সাথেই কথা বলছিলাম । একটা সময় আমরা টিভির ঘরে বসে বসে গল্প করতে লাগলাম । নিশিের মা চলে গেল রান্নার কাজটা দেখতে । দুপুরের খাওয়ার কিছুটা সময় আগে নিশির বাবা এসে হাজির হল । আমাকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে এল ।

কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না ।

নিশি কিংবা ওর আম্মুর শরীর থেকে সেই স্বাভাবিক সবুজ আলোই বের হচ্ছিলো কিন্তু নিশির বাবার শরীর থেকে নয় । উনির শরীর থেকে লাল রংয়ের আলো বের হওয়া শুরু হয়েছে । রংয়ের পরিমান দেখেই আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে সবে সেটা শুরু হয়েছে । এর অর্থ হচ্ছে আর সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই নিশির বাবা কোন দুর্ঘটনায় মারা যাবে । আমি নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম । নিজের মুখের ভাবটা স্বাভাবিক রেখে ওদের ওখানে খাওয়া আর গল্প গুজব করে চলে এলাম বাসায় । কিন্তু আমি যে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছি নিশির চোখে এড়িয়ে গেল না । রাতে সে আমাকে ঠিকই চেপে ধরলো । আর এখন আমার সামনে বসে আছে ।

ক্লাশ শেষ করে আমি আর নিশি কাঠাল তলাতে গিয়ে বসে রইলাম বেশ খানিকটা সময় । দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই । একটা সময় নিশি বলল

-আর কয়দিন আছে বলে তোমার মনে হয় ?

-আর ৫ দিন । আমার যতদুর মনে হয় ।

-আমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই । আমি বাবাকে খুব ভালবাসি ।

আমি কি বলব কিছুই খুজে পেলাম না । নিশি কি অনুভব করছে আমি বুঝতে পারছি । কিন্তু আমাদের এখানে কিছুই করার নেই । এটা আমাদের সিদ্ধান্ত না ।

আমি বললাম

-আমি জানি না তুমি কি করবে ! তোমাকে বলেছিলাম না যে যদি আমরা নিয়তি পাল্টাতে যাই তাহলে কি হবে ?

যখন প্রথম প্রথম আমি ব্যাপারটা ধরতে পারি যে কোন রঙ দেখা গেলে এর ফল কি হয় তখন আমিও ভেবেছিলাম যে আমি হয়তো চাইলেই মানুষকে বাঁচাতে পারি । এমনই একটা কাজ করেছিলাম । আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই এক যুগল থাকতো । তিন চার বছর হয়েছে বিয়ে হয়েছে । ছেলেটা একটা ব্যাংকে চাকরি করে । তাদের এক বছরের একটা ছোট্ট মেয়েও ছিল । একদিন লিফটের ভেতরেই দেখলাম সেই ছেলেটার শরীর থেকে লাল আভা বের হচ্ছে । বুঝতে কষ্ট হল না যে ছেলেটা খুব জলদিই মারা যাবে । একবার মনে হল এসব দিকে আমি মাথা না ঘামাই । এখানে আমার কিছুই করার নেই কিন্তু নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না । মনে হল যে যদি আমি বাঁচাতে পারি তাহলে কেন বাঁচাবো না ? হয়তো এই জন্যই আমার ভেতরে এই ক্ষমতা এসেছে ।

তাই করলাম । অনুমানের উপরেই ভিত্তি করে একদিন সকালে তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । তারপর ছেলেটাকে বাইরে যেতে মানা করলাম । প্রথম প্রথম ছেলেটা আমার কথা পাত্তাই দিতে চাইলো না । যদিও আমি কিভাবে এই কথাটা বলছি সেটা বললাম না । কারন বললে আমাকে সবাই পাগল ভাবতো । কিন্তু দুর্ঘটনার কথা শুনে স্ত্রীটি কিছুতেই তার স্বামীকে বাইরে যেতে দিল না । বলল যে একদিন বাইরে না গেলে কিছু হবে না ।

ঐদিন বিকেল বেলা আবার যখন গেলাম ঐ ফ্ল্যাটে তখন দেখি ছেলেটার শরীর থেকে আর লাল আভা বের হচ্ছে না । সবুজ আলো বের হচ্ছে । তার মানে হচ্ছে ছেলেটা এখন নিরাপদ ।

আমি মনে আনন্দ নিয়ে বের হয়ে এলাম । নিজের কাছেই খুব ভাল লাগছিলো । বারবার মনে হচ্ছিলো যে আমি খুব চমৎকার একটা কাজ করেছি । কিন্তু ঠিক দুইদিন পরেই সেই চমৎকার অনুভূতিটা উবে গেল । আমাদের বাসায় লিফটের তার ছিড়ে গেল পড়লো । তার ছিড়ে পড়ার সময় লিফটের মধ্যে সেই ছেলেটার স্ত্রীটি আর বাচ্চাটি ছিল । আমি স্পষ্ট দেখেছি যে তাদের কারোই মরার কথা ছিল না । কিন্তু তারা ঠিকই মারা গেছে । তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে কে বাঁচবে আর কে মরবে সেটা ঠিক করার অধিকার আমার নেই । আমি হয়তো কোন ভাবে ব্যাপারটা আগে থেকেই টের পেতে পারি কিন্তু এরার ব্যাপারে কিছু করতে যাওয়ার ফল মোটেই ভাল হবে না । আমার কেবলই মনে হতে লাগলো ঐ মৃত্যুর জন্য আমি নিজে দায়ী । কেবল মাত্র আমি নিজে !

এখন নিশির বাবা ব্যাপারে কি হবে সেটাও আমি জানি না । ঐদিনের পরে নিশি আর ক্যাম্পাসে এল না । আমি ওকে ফোন করলেও ফোন ধরতো না । ঠিক আট দিন পরে ও আমাকে ফোন দিল । তখন আমি টিউশনীর জন্য বের হয়েছি । রিক্সায় উঠতে না উঠতেই ওর ফোন এসে হাজির হল ।

আমি জানি নিশি কি করেছে । কারন নিশির বাবার মৃত্যুর খবর আমি তখনও শুনতে পাই নি । তার মানে নিশি সেই কাজটাই করেছে । নিশিকে অবশ্য দোষ দিতেও পারছি না । নিশির জায়গাতে হলে আমিও ঠিক এই কাজটাই হয়তো করতাম । যে কোন মুল্যেই নিজের বাবাকে বাঁচাতে চাইতাম । পরিমান যত খারাপই হোক না কেন ?

আমি বললাম

-কথা শুনলে না আমার ?

নিশি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল

-আমার জায়গাতে তুমি হলে পারতে ?

-নাহ । আমিও একই কাজ করতাম ।

তারপর দুজনেই চুপ কিছুটা সময় । এরপর আমি বললাম

-তোমার বাবা এখন ঠিক আছে ?

-হ্যা । নেপালে যাওয়ার কথা ছিল বাবা । আমি যেতে দেই নি ।

দুইদিন আগেই নেপালে একটা বিমান বিঃধস্ত হয়েছে । নিশির বাবার হয়তো যাওয়ার কথা ছিল সেখানে । আমি বললাম

-এখন ঠিক আছো তুমি ?

-হ্যা । সবাই ঠিক আছি । তারপর অনেকটা সময় নিরবতা । একটা সময় নিশি আবার বলল

-অপু ! আমার ভয় লাগছে ।

-কেন ?

-জানি না । মনে হচ্ছে মারা যাবো !

আমি কি বলে শান্তনা দিব বুঝতে পারলাম না । তবুও বললাম

-আরে না । কিছু হবে না ।

-তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে । আসবে একটু !

-এখন ?

-সবে তো সন্ধ্যা । আসবে ?

আমি বললাম

-আচ্ছা আসছি । তুমি বের হয়েও না । আমিই আসছি তোমাদের বাসায় ।

ফোনটা রেখে দিলাম । তারপর রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম

-মামা রিক্সা ঘুরান । আট নাম্বারের দিকে যেতে হবে ।

রিক্সাওয়ালা মামা রিক্সা ঘুরিয়ে দিল প্রায় সাথে সাথেই ।

ঠিক তখনই একটা তীব্র আলো আমার চোখে লাগলো । সাথে সাথেই দেখতে পেলাম আমার নিজের শরীরের থেকে একটা তীব্র লাল আলো বের হওয়া শুরু করেছে । আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা দ্রুত গতির বাস আমার রিক্সার দিকে এগিয়ে আসছে । কেবল প্রবল বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছাড়া আমার আর কিছু করার রইলো না । মৃত্যুদূত নিশির বাবাকে নিয়ে যেতে পারে নি, তার বদলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 31

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →