দি সিটি এন্ড ইটস আনসারটেইন ওয়ালস (পর্ব দুই)

4.9
(8)

আমি কিভাবে এই গর্তের ভেতরে এসে হাজির হলাম আমি জানি না। আমি কিছু সময় ধরে মনে করার চেষ্টা করলাম যে আমি ঠিক কোথায় ছিলাম। কিন্তু কিছুই আমার ঠিক মনে পড়ল না। আমি কেবল অনুভব করলাম যে আমি বড় একটা গর্তের ভেতরে পড়ে আছি। উপর দিয়ে গাছের ডাল পালা আর আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমি সেদিকেই কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম। এখনও আমার কাছে কিছুই পরিস্কার হচ্ছে না। আমি নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম । এটাই আমার শেষ স্মৃতি। তাহলে আমি এখানে কেন এলাম? কিভাবে এলাম?

এমন সময় আমি গর্তের মুখ একজন শক্ত সমর্থ্য মানুষের চেহারা দেখতে পেলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু থমকে চেয়ে রইলো। আমাকে সে এখানে আশা করে নি। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, এখানে কী কর তুমি? কিভাবে এলে?

আমি কোন জবাব দিতে পারলাম না। লোকটা আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, উঠে এসো উপরে । গর্তে আমি আগুন ধরাবো। 

আমাকে গর্ত ছেড়ে উপরে উঠতে সাহায্য করল সে। আমি গর্ত থেকে উঠেই চারিদিকটা দেখতে শুরু করলাম। আমি একটা জঙ্গলের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে জঙ্গল আর অন্য দিকে একটা উচু দেয়াল। লম্বা দেয়ালটা চলে গেছে দুরে । দেয়ালটা কিছু একটা ঘিরে রেখেছে। আমার সামনেই রয়েছে বিশাল বড় একটা গেট। আর তখনই আমি অপরিচিত জায়গাটাকে চিনতে পারলাম । 

যদিও এর আগে আমি কোন দিন এখানে আসি নি, তারপরেও আমি জানি এইটাই সেই শহর যে শহরে মিয়ো রয়েছে। এই দেয়াল ঘেরা শহরের ভেতরে একটা লাইব্রেরি আছে আর সেই লাইব্রেরিতেই মিয়ো কাজ করে। মিয়ো আমাকে বলেছিল যে আমি এখানে ড্রিম রিডারের কাজ করতে পারব। তবে এই শহরে প্রবেশ করাটা সহজ কাজ নয়। এই শহরটা খুজে বের করাটাও সহজ কাজ নয়। তবে আমি এই খুজে পেয়েছি। কিভাবে আমি এই শহরটা খুজে পেয়েছি আমি সেটা জানি না । তবে পেয়েছি এটাই বড় কথা। এখন আমাকে এই শহরের ভেতরে ঢুকতে হবে।

মিয়ো আমাকে বলেছিল যে শহরে ঢুকতে হলে নিজের ছায়াকে কেটে বাদ দিতে হবে। নিজের ছায়া নিজের শরীর থেকে কেটে আলাদা করে ফেলার ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত ব্যাপার মনে হল। নিজের ছায়া কি নিজের থেকে আলাদা করে ফেলা যায়? অবশ্য এর আগে মিয়ো আমাকে বলেছিল যে তার ছায়াকে আলাদা করে ফেলেছে। বরং আমার সাথে যে মিয়োর দেখা হয়েছিল সেটা মূলত মিয়োর ছায়াই ছিল। আসল মিয়ো তো থাকে এই শহরেই।

-তুমি কি এই শহরে ঢুকতে চাও?

আমি এই শহরে ঢুকতে চাই। আমি মিয়োর কাছে যেতে চাই। জীবনের একটা লম্বা সময় আমি মিয়োর জন্য অপেক্ষা করেছি, ওকে নিজের করে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি। এখন যখন আমি জানি যে মিয়ো ঠিক এই দেয়ালের ওপাশের শহরে আছে তখন আমি সেখানে অবশ্যই যেতে আই । 

গেটকিপার আমাকে বলল, তুমি যদি এই শহরের ভেতরে ঢুকতে চাও তাহলে তোমার ছায়াকে এখানেই দরজার এপাশেই রেখে যেতে হবে। আর একবার যদি ভেতরে ঢুকে পড় তাহলে আর কিন্তু বাইরে যেতে পারবে না।

-আমার ছায়াকে এখানে রেখে গেলে ওর কী হবে?

আমার এই কথা শুনে গেটকিপার কিছু সময় ভাবল। তারপর বলল ছায়া নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হবে না। আমার কটেজের পাশেই একটা ছোট থাকার ঘর আছে। তোমার ছায়া যেখানে থাকবে। তবে নিজের শরীর থেকে আলাদা হয়ে ছায়ারা বেশিদিন বাঁচে না। তার এক সময় মারা যায়।

নিজের ছায়া মারা যাবে? এই কথাটা মনে হতেই আমার মনের ভেতরে কেমন যে একটা অনুভূতি হল। তবে আমি সেটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করলাম না। আমাকে এখন যে কোন ভাবেই হোক এই শহরের ভেতরে ঢুকতেই হবে। আমাকে মিয়োর কাছে যেতেই হবে।

গেটকিপারকে আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। 

আমি ভেবেছিলাম যে আমার থেকে যখন আমার ছায়াকে আলদা করা হবে তখন বুঝি আমার ব্যাথা লাগবে তবে এমন কোন ব্যাথাই অনুভব করলাম না। কেবল দেখলাম গেটকিপারের বড় অস্ত্রটার আঘাতে আমার শরীর থেকে একেবারে দূরে গিয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল সে। আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে রইলো আমার ছায়াটা। 

গেটকিপার আমাকে বিস্তারিত জানাল শহরের ব্যাপারে। এমন একটা ভাব যেন তারা জানতোই আমি এখানে আসব। আমার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করা হয়ে আগে থেকেই। এই শহরের ড্রিম রিডার হিসাবে আমি কাজ করব। গেট কিপার আমার থাকা খাওয়ার ব্যাপারেও জানালো। শহরের কমিউনিটি ভবরের উল্টো পাশে একটা ছোট কুঠিরের ব্যবস্থা করা হয়েছে আমার থাকার জন্য। আমি সেখানে গিয়ে থাকতে পারব। আমি সব কথা শুনে, শেষ বারের মত আমার ছায়াটার দিকে তাকিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম । 

দিনের বেলাতেও পুরো শহরটা কেমন যেন আবছায়া কুয়াশায় আবৃত হয়ে রয়েছে। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধ ভাব বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে যেন আমি কোন মৃত্যুপুরিতে এসে হাজির হয়েছি। চারিদিকে আমি আমি কাউকেই দেখতে পেলাম না। আমি পায়ে পায়ে সামনে দিকে এগিয়ে চললাম। একেবারে আমি কুঠিরের সামনে এসে হাজির হলাম । গেত কিপার আমাকে কুঠিরের চাবি দিয়েছিল । সেটা দিয়ে তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। একেবারে ছোট ছিমছাপ ঘর। তবে আমার থাকার জন্য যথেষ্ঠ। 

আমি শহরের নানা রাস্তায় হাটতে শুরু করলাম । বলা ভাল যে ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখতে শুরু করলাম। 

পশ্চিম দিকে ব্রিজটা পার হতেই আমি শহরের লাইব্রেরিটা দেখতে পেলাম। আমি অনুভব করলাম আমার বুকের ভেতরে অন্য রক আন্দোলন শুরু হয়েছে। মিয়ো এই লাইব্রেরিতেই কাজ করে। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। আমিও এই লাইব্রেরিতেই ড্রিম রিদার হিসাবেই কাজ করা শুরু করব । অন্তত আমাকে এমনটাই বলা হয়েছে। 

আমি বিকেলের দিকে লাইব্রেরিতে গিয়ে হাজির হলাম। দরজার খুলে যখন ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন অনুভব অরছিলাম যে আমার বুকের ভেতরে একটা কাঁপন অনুভব করছি। তাহলে কি এতোদিন পরে, এতোগুলো বছর তাকে আমি সত্যিই দেখতে পাবো? 

মিয়োকে আমি এতোদিন পরে দেখতে পাব?

কিন্তু লাইব্রেরিতে ঢুকেও আমি কাউকে দেখতে পেলাম না। সব কিছু কেমন নিস্তব্ধ আর নিশ্চুপ। যেন অনেকদিন লাইব্রেরিতে কেউ আসে না। তবে আমি লাইব্রেরি এই ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু সময়। এটা বাইরের ঘর। অভ্যর্থতা কক্ষ । অথচ মিয়ো আমাকে বলেছিল যে এই লাইব্রেরিতে কেউ আসে না। এই লাইব্রেরিতে কোন বই নেই। তবে সারি সারি তাকে বইয়ের বদলে রয়েছে পুরানো স্বপ্ন। ওল্ড ড্রিম। মিয়ো আমাকে বলেছিল। এই লাইব্রেরিতে কোন বই থাকে না। এখানে শুধু মাত্র যদিও মিয়ো  কয়েকবার ডাক দিলাম নাম ধরে। কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। আমি পায়ে পায়ে ভেতরের দিকে গিয়েও আমি কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে এখানে একটা স্টোভ দেখতে পেলাম । জ্বলছে। আপেল কাঠের সুগন্ধ পুরো ঘরটাকে সুগন্ধি করে রেখেছে। আমি একটা টুল টেনে বসলাম। আর তখনই আমি মিয়োকে দেখতে পেলাম।

মিয়ো ঠিক আগের মত আছে। সেই ১৭ বছর বয়সের মিয়ো । ওর বয়স একদম বাড়ে নি। কিন্তু আমার বয়স বেড়েছে।

আমার দিকে মিয়ো এমন ভাবে তাকিয়ে রয়েছে সেটা দেখে আমার বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না যে সে আমাকে চিনতে পারে নি। মিয়ো আমাকে বলেছিল আমাদের আগের পৃথিবীতে যে আছে সে কেবলই তার ছায়া মাত্র। আসল মিয়ো থাকে এই শহরে এবং আসল মিয়ো আমাকে চেনে না। এই আসল মিয়ো আসলেই আমাকে চেনে না। আমি তার কাছে অপরিচিত একজন মানুষ। এই ভাবনাটা আমার মনের ভেতরে একটা কষ্টের অনুভূতি বাড়িয়ে দিল। 

মিয়ো আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, তুমিই তাহলে নতুন ড্রিম রিডার?

আমি হাসলাম। বললাম, হ্যা আমিই নতুন ড্রিম রিডার।

মিয়ো আমাকে ঠিক যেমনটা বলেছিল এখন থেকে সেটাই হবে। আমি প্রতিদিন এখন এখানে বিকাল থেকে রাতের বেলা মিয়োর পাশে বসে কাজ করব। এমন একটা দিনের জন্যই আমি আমি আমার পুরো জীবন অপেক্ষা করেছি আর আজকে সেই দিনটাই আমার সামনে চলে এসেছে। মিয়ো আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল আমি লাইব্রেরিতে ওর পাশে বসে কাজ করব। পুরাতন স্বপ্ন গুলো পড়ব আর মিয়ো আমাকে হারবাল চা বানিয়ে খাওয়াবে। আমি এখন আমার জীবনের সেই পর্যায়ে চলে এসেছি। আমি সত্যি সত্যিই মিয়োর পাশে বসে আছি আর ও আমার জন্য হারবান চা বানাচ্ছে। 

##

গেটকিপার আমার চোখের একটা ঔষধ ঢেলে দিয়েছে। আমি চোখে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না। সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমার চোখে এই ঔষধ ঢেলে দেওয়া হয়েছে যাতে আমি পুরানো স্বপ্নগুলো ঠিকঠাক মত পড়তে পারি। এটা নাকি জরুরী। তবে এই কারণে আমার চোখে একটু সমস্যা দেখা দিল। আমি সব কিছু একেবারে পরিস্কার ভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে মিয়ো আমাকে জানালো যে এটা সাময়িক। 

আমি আস্তে আস্তে পুরানো স্বপ্ন গুলো পড়তে শুরু করলাম। মিয়ো আমাকে প্রতিদিন পুরো তাক থেকে স্বপ্নগুলো নিয়ে এসে দিতো। আমি সেগুলো হাত দিয়ে ধরতেই সেগুলো কাঁপতে শুরু করে। তারপর আমি তাদের কথা শুনতে পাই। যদিও পরিস্কার ভাবে আমি কিছুই বুঝতে পারি না। অস্পষ্ট সব কথা কানে আসে। মনে হয় যেন অনেক মানুষ এক সাথে কথা বলছে দুর থেকে যার কোন কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। মিয়োকে এই ব্যাপারটা বলতেই সে আমাকে অভয় দিয়ে বলল যে আমি যেন মোটেই চিন্তা না করি এই ব্যাপারটা নিয়ে। এক সময় না এক সময় আমি ঠিক ঠিক পুরোনো স্বপ্নগুলো পড়তে পারব।

যদিও আমার আর মিয়োর বাসা একে অন্যের থেকে বিপরীত দিকে আমি মিয়োকে প্রতিদিন কাজ শেষ করে বাসায় পৌছে দিতে শুরু করলাম। যদিও মিয়োকে যেদিন বলেছিলাম যে আমি ওর বাসা পর্যন্ত যেতে চাই সেদিন সে একটু অবাকই হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ও রাজি হয়েছিল। একদিন তাই সাহস করে আমি আমার মনের কথা বলে দিলাম। আমি এখানে কেন এসেছি আর বাইরের পৃথিবীতে আমি মিয়োকে কিভাবে চিনতাম সেই সব কিছু। সব কিছু শুনে মিয়ো কিছু সময় চুপ করে রইলো। তারপর আমাকে বলল যে বাইরের পৃথিবীর যে মিয়োকে আমি ভালোবাসি সেই মিয়ো আর সে মোটেই এক জন নয়। এই একই কথা মিয়োও আমাকে বলেছিল। বলেছিল বাইরের পৃথিবীতে কেবল তার ছায়া থাকে। আসল মিয়ো থাকে এই দেয়াল ঘেরা শহরে। আর আমি সেই দেয়াল শহরে আসল মিয়োর সামনে এসে হাজির হয়েছে। আর সে আমাকে বলছে যে আমি যে মিয়োকে চিনতাম সেই মিয়ো আলাদা একজন। আমি যদিও আগে থেকেই এই কথাটা জানতাম তারপরেও মিয়োর মুখ থেকে এই কথাটা শুনে আমার মনের ভেতরে একটা তীব্র কষ্টের অনুভূতি জেগে উঠল। এই কষ্টের অনুভূতিটা আমি কিভাবে প্রকাশ করব সেটা আমার জানা ছিল না।

প্রথম পর্ব

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 8

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →