মিয়োর কাছ থেকেই আমি প্রথম সেই অদ্ভুত শহরের কথাটা প্রথম শুনেছিলাম। গ্রীষ্মের সেই বিকেলে আমরা বাধ দেওয়া নদীর পাড় দিয়ে হাটছিলাম। স্নিগ্ধ বাতাসে ভরে ছিল চার পাশটা। আমরা আমাদের স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়েছিলাম। খালি পায়ে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে আমরা হেটে যাচ্ছিলাম । নদীর মৃদু পানির আওয়াজ চারিদিকে যেন মাতোয়ারা করে রেখেছিল। সেই সময়ে মিয়ো আমাকে সেই অদ্ভুত শহরের কথা বলেছিল। আমরা এক সময়ে নদীর পাড়ের নরম ঘাসে বসে পড়লাম । তখন মিয়ো আমাকে সেই শহরের কথা বলল।
-শহরের চারদিকে উচু দেওয়া দেওয়া। শহরটা খুব বেশি বড় না । তবে এতো ছোটও না যে এক ঝলকেই সবটুকু দেখে নেওয়া যাবে।
মিয়ো শহরটা নিয়ে আরও কত কথা আমাকে বলল। তখন শহরের পুরো চিত্রটা যেন আমার সামনে ফুটে উঠতে শুরু করল ।
ঐ শহরের পাশ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। পুরো শহর জুড়ে তিনটা ব্রিজ আছে। ইস্ট ব্রিজ, ওল্ড ব্রিজ আর ওয়েস্ট ব্রিজ। এছাড়া শহরে একটা লাইব্রেরি রয়েছে। একটা বড় ওয়াচটাওয়ার আছে। একটা পরিত্যাক্ত কারখানা রয়েছে আর আছে কিছু বাড়িঘর।
মিয়ো আমাকে সেদিন অদ্ভুত কথাটা বলেছিল। সে আমাকে বলেছিল, আসল আমি সেই উচু দেওয়াল ঘেরা শহরে থাকি ।
-তাহলে আমার পাশে যে তুমি বসে আছো, এটা কে? এটা আসল না?
-না । আমি আসল না। আমাকে বলতে পারো কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত একটা সত্তা। অথবা বলতে পারো আমি আসল আমি ছায়া মাত্র।
মিয়োর এই কথা শুনে আমি কিছু সময় কোনো কথা বললাম না। চুপ করে কিছু সময় ভেবে বললাম, আচ্ছা, তাহলে সেই আসল তুমি সেই শহরে কী কাজ কর?
-আমি সেখানে একটা লাইব্রেরিতে কাজ করি। এই ধর বিকেল পাঁচটা থেকে রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত সেই লাইব্রেরি কাজ করি।
-প্রায় বলছো কেন?
-প্রায় বলছি কারণ, সেই শহরে সময় নির্দিষ্ট ভাবে জানার উপায় নেই। সেখানে ক্লক টাওয়ার আছে। তবে সেই টাওয়ারের ঘড়িতে কোন কাটা নেই।
আমি কিছু সময় সেই কাটা ছাড়া ঘড়িটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। ঘড়ির যদি কাটাই না থাকে তাহলে সেটা আবার ঘড়ি কিভাবে হল?
-তা ঐ লাইব্রেরিতে যে চাইলেই কি যেতে পারে?
-না। চাইলেই সেখানে যে কেউ সেই লাইব্রেরিতে ঢুকতে পারে না । এই লাইব্রেরিতে ঢুকতে হলে কিছু বিশেষ গুণ থাকা চাই। তবেই কেউ সেই লাইব্রেরিতে যেতে পারবে। নতুবা কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
-আমি কী যেতে পারবো সেখানে?
-হ্যা পারবে। তুমি সেখানে গিয়ে ড্রিম রিডারের কাজ করবে। আমার ঠিক পাশে বসেই। প্রতিদিন।
আমি একবার ব্যাপারটা চিন্তা করলাম। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্বন্ত একটা লাইব্রেরিতে কাজ করা মিয়োর পাশে বসে। পাশাপাশি। আমার আসলে এখন আর অন্য কিছু মনে হয় না। মিয়োর এই ইমাজিনারি শহরেই যদি আমি যেতে পারি এবং প্রতিদিন ওর পাশে বসে কাজ করতে পারি তাহলে আমার খুব একটা আপত্তি থাকবে না। আমি খুশি মনেই যেখানে চলে যেতে পারব। তবে মিয়োর মতে সেই শহরে চাইলেই যাওয়া যায় না। এই জন্য আমাদের নিজেদের ছায়াকে চিরোদিনের মত ত্যাগ করতে হয়। এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মাথা ত্যাগ করেই তবেই ঐ শহরে প্রবেশ করা যায় । এবং মিয়োর মতে ঐ শহরে প্রবেশ যেমন কঠিন সেখান থেকে বের হওয়া আরো কঠিন। পুরো শহরটাই উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা সেই উচু দেয়াল পার করে কেউ আর বের হতে পারে না।
মিয়োর সাথে আমার এই ভাবে ঘন্টার পরে ঘন্টা কথা হত। আমরা বিরামহীম ভাবে একে অন্যের সাথে কথা বলেই যেতাম। যদিও আমাদের মাসে একবার কি দুইবারের চেয়ে বেশি দেখা হত না। তবে বাকি সময়টা আমরা একে অন্যকে চিঠি লিখতাম। মিয়ো আমাকে সব সময় বড় বড় চিঠি লিখত। ওর গোটাগোটা হাতের লেখায় কত বিষয় নিয়েই যে লেখা থাকত, সেই তূলনায় আমার চিঠিগুলো ছোট হত। আমি মূলত মিয়োর চিঠির জবাব দিতাম কেবল।
আমি মাঝে মাঝে এই ভেবে অবাক হতাম যে মিয়োর লেখার হাত আমার থেকে এতো ভাল হওয়া সত্ত্বেও আমি কিভাবে মিয়োর থেকে আগের পুরস্কারটা পেয়েছিলাম। আমার আর মিয়োর পরিচয় হয়েছিল একটা রচনা লেখার প্রতিযোগিতা থেকেই। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপরে ছিল না। আমি সেই প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হলাম আর মিয়ো হয়েছিল পঞ্চম। আমাদের পুরস্কার দেওয়ার জন্য একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। আমি আর মিয়ো পাশাপাশি বসেছিলাম। সেই দিনই ওর সাথে আমার প্রথম কথা হয়। তারপর অনুষ্ঠান শেষে আমি একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম। আমি জানি না সেদিন আমার মনে কিভাবে এতো সাহস এসে হাজির হয়েছিল। মুখচোরা স্বভাবের আমি সেদিন মিয়োকে একটা কাগজে আমার ঠিকানা লিখে দিয়ে ওকে চিঠি লিখতে বলেছিলাম। আমার কাগজ দেওয়াতে মিয়ো একটু অবাক হয়েছিল বটে তবে তার চোখে আমি সেদিন কোন বিরক্তি দেখতে পাই নি। বরং মনে হয়েছিল মিয়ো যেন একটু খুশিই হয়েছিল সেদিন।
সপ্তাহ খানেক পরে মিয়োর প্রথম চিঠিটা এসে হাজির হয়। এরপরে নিয়মিত ভাবে আমাদের মাঝে চিঠি আদান প্রদান চলে। তারপর একদিন আমরা সময় করে একে অন্যের সাথে দেখা করতাম। বলা যায় সেটাই ছিল আমাদের প্রথম ডেট।
মিয়ো চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে ছিল। কারো সাথে সে ঠিক মিশতো না বা কথা বলত না। তবে আমার সাথে যখন ও থাকত তখন যেন ওর কথার খই ফুটতো। ওর ভাষ্যমতে আমাকে সে এমন সব কথা বলতে পারতো যা অন্য কাউকে কোন দিন বলতে পারে নি। আমি বাদ দিয়ে ওর একমাত্র কাছের মানুষ ছিল ওর নানী। তবে তত দিনে তিনিও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
ছোট বেলায় মিয়োর মা মারা। তারপর মিয়োর আব্বা আবারও বিয়ে করেন। মিয়োর নতুন মা মিয়োর প্রতি কোন অন্যায় কোন দিন করে নি। তাকে আন্তরিক ভাবে ভালবাসত। শুধু যখন মিয়ো তার নানীর সাথে দেখা করতে যেত তখন মিয়োর নতুন মায়ের মুখটা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে যেত। যদিও মুখ ফুটে সে কোনদিন কিছু বলে নি তারপরেও মিয়ো পরিস্কার ভাবেই বুঝতো যে তার নানীর কাছে যাওয়াটা তার নতুন মা মোটেই পছন্দ করছে না। তারপর একদিন মিয়োর নানী মারা গেলেন হঠাৎ। মিয়ো এনে একদম একা হয়ে গেল। আমার সাথে পরিচয়ের পরেই যেন আবার ও নিজের মাঝে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
মিয়ো আমার থেকে খুব বেশি দুরে থাকত না। ট্রেনে করে ওর শহরে যেতে ঘন্টা খানেক সময় লাগত । আমি ওর বাসার কাছেই একটা পার্কে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। মিয়ো এলে ওকে নিয়ে হয়তো শান্ত নির্জন কোন ক্যাফে বসতাম কিংবা আমি শহরের এদিক ওদিক হেটে বেড়াতাম। সেইদন নির্দিষ্ট সময়ে আমি পার্কে গিয়ে হাজির হলাম। প্রতিবারই এমন হত যে আমার আসার আগেই মিয়ো এসে হাজির হত। তবে সেদিন ওর কোন দেখা নেই। আমি পার্কে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আর মনের ভেতরে নানান রকম চিন্তা এসে হাজির হতে লাগল । মনে হতে লাগল যেন এখানে আসার পথে মিয়োর সাথে বুঝি খারাপ কিছু হয়েছে।
তবে এক সময়ে মিয়ো এসে হাজির হল। ওর গম্ভীর মুখ দেখেই আমি বুঝে নিলাম যে কোন একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কী সমস্যা হয়েছে সেটা মিয়ো বলল না। শুধু আমার পাশে এসে বসে রইলো কিছু সময়। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে হাটতে শুরু করলো। আমি কোন প্রশ্ন না করেই ওর পিছু নিলাম। আমরা শহরের আনাচে কানাচে হেটে এক সময়ে আবারও সেই আগের পার্কেই হাজির হলাম। তখন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। তারপর মিয়ো অবাক করে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল। আমি এবারও ওর কান্নার কারণ জিজ্ঞগেস করলাম না। কেবল ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দিলাম । ওকে কেবল এই জানান দিয়ে গেলাম যে আমি তোমার পাশে আছি।
সেইদিনে ওর শহরতলী থেকে চলে আসার পরে কিছুদিন বিরতি দিয়ে মিয়োর সাথে আবার দেখা হল। সেদিন ও নিজ থেকেই আমাকে ঐদিনের কথা জানাল । ওর ভাষ্য মতে মাঝে মাঝেই নাকি মিয়োর এমন হয়। হঠাৎ করেই পুরো মাথাটা একেবারে ফাঁঁকা হয়ে যায়। তখন পুরোটা দিন আর কোন কিছুতেই মন বসে না। কোন কাজ করতে ইচ্ছে না । স্কুল যেতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন কেবল বিছানায় শুয়ে থাকে সে। এমন কি খাওয়া দাওয়াও করতে ইচ্ছে করে না। সেদিন আমার সাথে দেখা করার আগেও মিয়োর ঠিক এই অনুভূতিটাই ফিরে এসেছিল। প্রথম কিছু সময় সে বিছানায় শুয়ে ছিল। ইচ্ছে ছিল না আমার সাথে দেখা করার। কিন্তু তারপরেও সেদিন সে জোর করেই আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আর এই অনুভূতিটা একটু কমে যখন সে পুরো শহরে হেটে বেড়ায় । হাটলেই নাকি তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সহজ হয়।
তারপর অনেক দিন মিয়োর কাছ থেকে কোন চিঠি এল না। আমি ওকে অনেক গুলো চিঠি লিখলাম বটে তবে সেই চিঠির কোন জবাব এল না। অপেক্ষা করতে করতে একটা বছর পার হয়ে গেল। তারপর একদিনের চিঠিতে মিয়ো আমাকে গভীর ভাবে ভালবাসার কথা বলল। সে জানালো যে পুরোপুরি ভাবে আমার হতে চায়। একেবারে আমাকে আপন করে কাছে পেতে চায়। তবে আমিও যদি তাকে পেতে চাই তাহলে আমাকে সেই দেয়ালঘেরা শহরে গিয়ে হাজির হতে হবে। সেই শহরে আমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা সে করে রেখেছে। সেখানকার লাইব্রেরিতে ড্রিম রিডারের চাকরি। আমি যদি সেই শহরে গিয়ে হাজির হতে পারি তবেই আমি তার কাছাকাছি হতে পারব।
কিন্তু আমি সেই শহরে কিভাবে যাবো সেই উপায় মিয়ো তার চিঠিতে লেখে নি। আমি পরের চিঠিতে সেই কথা তার কাছে জানতে চাইলাম বটে তবে সেই চিঠির কোন জবাব এল না। শুধু কেউ চিঠিই কেন, এরপরে আর কোন চিঠিরই জবাব এল না।
আমি মিয়োর কত খোজ করলাম কিন্তু তার কোনো খোজ আমি আর পেলাম না। যে টেলিফোন নম্বরটা আমার কাছে ছিল সেই নম্বর দিয়ে আমি অনেকবার তাকে ফোন করলাম। প্রথম প্রথম কেবল ফোনটা রিং হত তার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যেত। একদিন এক বৃদ্ধ সেই ফোন ধরল। আমি মিয়োর খোজ করতেই ফোনের লাইনটা কেটে গেল । পরে আবার যখন আমি সেই নম্বরে ফোন দিলাম তখন ওপাশ থেকে এই রেকর্ডেড আওয়াজ ভেসে এল কেবল। এই নম্বরটি এখন আর কার্যকর নয়।
এরপর আমি চিঠির ঠিকানা মোতাবেগ মিয়োর বাসা খোজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেখানে গিয়েও আমি মিয়োর খোজ খোজ পেলাম না। সেই বাসাটা নাকি অনেক দিন ধরেই পরিত্যাক্ত হয়ে আছে। আমি হতাশ হয়ে কেবল চেয়ে রইলাম।
এরপর মিয়োর সাথে আমার আর কখনই দেখা হয় নি। মিয়ো যেন আমার জীবন থেকে একেবারে মন্ত্রপুতের উবে গেল। এমন ভাবে সে গায়েব হয়ে গেল যেন সে কোন দিন আমার জীবনে আসেই নি।
আমার জীবন অবশ্য থেমে রইলো না। আমি হাই স্কুল পাশ করে টকিওতে চলে গেলাম । বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিলাম একটা বুক ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে। জীবনের অর্ধেকটা আমি সেখানেই কাটিয়ে দিলাম। তবে মিয়োর পরে আমি আর কাউকেই ভালবাসতে পারি নি। মিয়ো আমাকে জানিয়েছিল সে আমার হতে চায়। একেবারে পুরোপুরি ভাবে সে আমার হতে চায়। সম্ভবত আমিও মিয়োর হতে চেয়েছিলাম। আমি আমার ভালোবাসার সব টুকুই মিয়োকে চিয়েছিলাম। তাই আর কাউকে আর আমি কোন দিন ভালবাসতে পারি নি। দেখতে আমার বয়স বেড়ে ৪৪ এ এসে ঠেকল। কিন্তু তবুও আমি আমার জীবনে থিতু হতে পারলাম না। কয়েকটা মেয়ের সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু তাদের কে মন থেকে ভালবাসা কিংবা তাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন আমি দেখতে পারি নি।
আমি এই এতোদিন পরেও তীব্র ভাবে মিয়োর প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতাম। মিয়ো আমাকে বলেছিল সেই শহরে যদি আমি কোন দিন যেতে পারি তবেই আমি তার দেখা আবার পাবো।
তারপরই আমার জীবনে সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটল।
এই গল্পটা মূলত হারুকি মুরাকামির নতুন উপন্যাস দি সিটি এন্ড ইটস আনসারটেইন ওয়ালস গল্প। সম্প্রতি এই বইটা আমি পড়ে শেষ করেছি। বিশাল বড় একটা উপন্যাস। তবে এই পুরো উপন্যাসের কাহিনীর উপরে ভিত্তি করে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে জাগল মনে। সেখান থেকেই আজকের এই গল্পের প্রথম পর্ব। বইটার একটা রিভিউ পড়ে আসতে পারেন আমার বুক রিভিউ পোস্ট থেকে।