তৃষা আমার দিকে খানিকটা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। আমরা পাশাপাশি বসেছি তাই ঘরে আলো না থাকলেও ওর চোখের ভাষা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হচ্ছে না। তার চোখ দেখে আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি যে সে এসব কান্ড কারখানাতে মোটেই খুশি হচ্ছে না। এবং আমার কাজে যে খুশিও হচ্ছে না। তবে একই সাথে সে মুখ ফুটে কিছু বলবেও না। সে চাচ্ছে যেন আমি কোন অযুহাতে এটা মানা করি যেন সব কিছু আমার উপর দিয়ে যায়। আমি তার চোখে চোখ রেখেই একটু ইশারা করলাম। বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে নির্দোষ মজা করার ভেতরে সমস্যা নেই কোন। তৃষা আর কিছু বলল না। সে সব সময় চোখে মুখে একটা হাসির ভাব ধরে রাখলেও আমি এই হাসির অর্থ খুব ভাল করেই জানি। রাতে আমার উপরে সে চড়াও হবে নিশ্চিত।
আমরা আজকে সকালে এই রইসপুরে এসে হাজির হয়েছি। এখানে তৃষা এবং তার বাবার এক ব্যবসায়িক বন্ধু মিলে একটা রিসোর্ট করার পরিকল্পনা করছে। অনেকটা জমিদার বাড়ির আদলেই তৈরি হবে রিসোর্টটা । প্রাচীন জমিদাররা যেভাবে থাকতেন গেস্টদের ঠিক সেভাবেই রাখা হবে। এই জন্য একটা জমিদার বাড়ির কেনার সকল পরিকল্পনা করা শেষ। আসল কাঠামো অক্ষত রেখেই পুরো বাড়িটা রেনোভেট করা হবে। এখন তৃষার বাবার ব্যবসায়িক বন্ধুর মনে হয়েছে যে পুরোপুরি ভাবে কেনার আগে এই পুরানো জমিদার বাড়িতে দুই একটা দিন কাটিয়ে আসা যাক। আগে নিজেরাই এখানে থেকে দেখবে যে আসলেই সে জমিদারির মত অনূভত হয় কিনা। যদি নিজেদের কাছেই তেমনটা না মনে হয় তাহলে গেস্টদের তো সেই অনুভূতি দেওয়া যাবে না। সেই জন্যই আমাদের এখানে আসা।
যদিও আমার আসার কোন ইচ্ছে ছিল না। ব্যবসায়ী তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে যাবে। পার্টনার হিসাবে তৃষাও যাবে। সে একা একা যাবে তাই আমাকে তৃষার সাথে আসতে হয়েছে। অবশ্য কেবল তৃষার একা একা আসার ব্যাপারটা শুধু না। আমার আবার তৃষাকে ছাড়া রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে। তৃষার বাবার ঐ ব্যবসায়ীক বন্ধুর যে বড় ছেলে সে নাকি এক সময়ে তৃষার পেছনে খুব লেগেছিল। তৃষা নাকি পাত্তা দেয় নি। এই ব্যাপারটা আমার মোটেও ভাল লাগবে না যে এমন একটা ছেলে ট্রিপে থাকবে যে কিনা আমার বউয়ের পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছিল আর আমার বউ সেখানে একা থাকবে। আমাকে সেখানে থাকবেই হবে যে।
সকালে রওয়ানা দিয়ে আমাই দুপুরের ভেতরেই এখানে এসে হাজির হলাম। একটা বড় মিনি বাস ভাড়া করে ঢাকা থেকে এসেছি। আমাদের সাথে কয়েকজন সাহায্য করার মানুষও এসেছে। ওদের কাজ হচ্ছে ঘর দোর পরিস্কার করা আর রান্না বান্নার ব্যবস্থা করা।
বাড়িটাতে কয়েক বছর ধরেই কেউ বসবাস করে না। যদিও একজন কেয়ারটেকার রাখা আছে। সে নিয়মিত দেখাশোনা করে। ৪/৫ বছর আগে বাড়ির কর্তা হার্টএটাকে এখানে মারা যায়। তারপর তার স্ত্রী বাড়ি এখানে রেখে ঢাকায় গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। এখন সেই এই বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছেন।
দুইতলা বাড়ির সামনে এসে আমার মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। এই অনুভূতির পেছনে আসলে কারণ কী সেটার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। কেবল শুধু মনে হল যে এই জায়গার ভেতরে অশুভ কিছু একটা রয়েছে। তবে এই কথা আমি মুখে প্রকাশ করলাম না। যদি তৃষা এসব শোনে তাহলে আমাকে একেবারে আস্ত চিবিয়ে খাবে।
অবশ্য সেই ভুত প্রেতের ব্যাপারটা সামনে চলে এল ঠিকই। রাতের বেলা খাওয়া দাওয়ার আগে বাড়ির বৈঠক খানাতে আড্ডা বসল। আড্ডায় আমরা সবাই হাজির হয়েছি যদিও আমার ইচ্ছে ছিল যে তৃষাকে নিয়ে আমি কিছুটা সময়ে এদিক ওদিক হাটব। তবে মারিয়া অর্থ্যাৎ তৃষার বাবার সেই বন্ধুর মেয়ের কারণে সেটা হল না। মারিয়ার বড় ভাই মারুফ এবং ওদের বাবা মা মিস্টার জহুরুল আলম এবং রোজিয়া আলমও আমাদের সাথে বসলেন। আমার ব্যাপারে রোজিয়া আলম বেশ খবর নিতে লাগলেন। বিশেষ করে আমি কী করি না করি এসব। আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম যে তিনি আসলে নিজের ছেলের সাথে আমাকে মেলানোর চেষ্টা করছেন। আমি হাসি মুখে জবাব দিলাম।
এরপর নানান দিকে কথা চলল। এরই ফাঁকে ধুপ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। আমাদের অবশ্য খুব একটা সমস্যা ছিল না। সময়টা বসন্তের শুরু তবে এখনও গরম পড়ে নি। আর এই গ্রামে এখনও খানিকটা যেন শীত রয়ে গেছে। একজন কাজের মানুষ আমাদের টেবিলের সামনে একটা ছোট হ্যারিক্যান রেখে গেল। আমরা সেটার আলো একটু কমিয়ে দিয়ে গল্প করতে লাগলাম। গল্প করতে করতে ভুতের গল্পে গিয়ে হাজির হল।
তখনই মারিয়া জানালো যে তার ব্যাগে একটা ইউজা বোর্ড আছে। এবং সে নাকি কয়েকবার মৃত মানুষের প্রেতাত্মা ডেকে নিয়েছিল। আমি উৎসাহ নিয়ে বলল, আরে তাই নাকি? তুমি কি মিডিয়াম?
-না ভাইয়া মিডিয়াম না। আসলে মিডিয়ামের দরকারও নেই। উইজা বোর্ডেই উত্তর দিবে। দাড়ান দাড়ান আনি আমি।
এই বলতে বলতে সে উঠে দৌড় দিল ঘরের দিকে। তৃতৃষা আমার দিকে খানিকটা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। আমরা পাশাপাশি বসেছি তাই ঘরে আলো না থাকলেও ওর চোখের ভাষা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হচ্ছে না। তার চোখ দেখে আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি যে সে এসব কান্ড কারখানাতে মোটেই খুশি হচ্ছে না। এবং আমার কাজে যে খুশিও হচ্ছে না।
মারিয়া ফিরে এল কিছু পরেই। দেখতে পেলাম ওর হাতে একটা ছোট দাবার কোর্টের মত একটা বোর্ড। আমি উইজা বোর্ড আগেও দেখেছি। বোর্ডগুলো একটু বড় হয় তবে এই বোর্ডটা বেশ ছোট। মারিয়া বোর্ডটা যখন খুলল তখন দেখতে পেলাম সেখানে অদ্ভুত সব কিছু চিহ্ন আঁকাবুকি রয়েছে। আমি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলাম বটে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বোর্ডে কোন অক্ষর দেওয়া নেই। তবে সেখানে ইয়েস আর নো লেখা দুইটা স্থান আছে। সেই একটা ছোট তীর রয়েছে।
আমি বললাম, এমন বোর্ড তো আগে দেখি নি।
মারিয়া একটু গৌরবের হাসি দিয়ে বলল, এটা আমি এক তান্ত্রিকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। এটা খুব কাজের।
-তাই নাকি?
-হ্যা।
-তা কিভাবে কাজ করে এটা?
আমি এই লাইনটা বলেই তৃষার দিকে তাকালাম । তার চোখের সেই বিরক্তির ভাবটা যেন আরও একটু বেড়েছে। তবে আমি জানি সে আমাকে সরাসরি মানা করবে না। মারিয়া বলল, এটা দিয়ে অবশ্য দুরের কাউকে কিংবা বিখ্যাত কাউকে নিয়ে আসা যায় না। যদি এই ঘর কিংবা বাড়ির আশে পাশে কোন প্রেত আত্মা থাকে তবেই এখানে আসবে?
-আমরা কিভাবে বুঝব যে সে এসেছে?
-সেটা আসলেই বুঝবেন। আমাকে আলাদা ভাবে কিছু বলে বুঝিয়ে দিতে হবে না।
উইজাবোর্ড নিয়ে অনেক ধরনের মিথ প্রচলিত আছে। কেউ কেউ সত্যিই বিশ্বাস করে যে আশে পাশে থাকা মৃত আত্মা নাকি সত্যিই হাজির হয় এই উইজাবোর্ডের সাহায্যে। তবে বেশির ভাগ মানুষই এটাকে একেবারে বোগাজ মনে করে । বিশেষ করে যারা মিডিয়াম হিসাবে কাজ করেই তারাই মূলত কারসাজি করে, ভাল অভিনেতা হতে তাদের। গলার স্বর পরিবর্তন করতে পারে তারা।
এখানে যেহেতু কোন মিডিয়াম ব্যবহৃত হবে না তাই আশা করা যায় যে সেই রকম কিছু হবে না। তবে কি সত্যিই কিছু হবে? এই ধরনের জমিদার বাড়িতে অনেক খারাপ কাজ হয়ে থাকে। অতীত তাই বলে। যদিও এই জমিদারবাড়িতে এমন কিছু ঘটেছে কিনা বলা মুস্কিল। আমি খুব ভাল করেই জানি যে তৃষা এসব মোটেই পছন্দ করে না। আর আমি এসবের ভেতরে থাকি সেটাও সে পছন্দ করে না। তার ইচ্ছে হচ্ছে আমি একেবারে তার মনের মত করে থাকি সব সময়।
আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে বললাম, আরে বাবা আসো মজা হবে!
তৃষা একটু চোখ গরম করে বলল, হ্যা খুব মজা হবে।
আমরা বসেছিলাম বৈঠকখানাতে পাটি বিছিয়ে। আমাদের মাঝে হারিক্যানটা রাখা ছিল। মারিয়া সেই হারিক্যানটা একটু সরিয়ে সেখানে মাঝ খানে রাখলো বোর্ডটা । তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল এবার আসুন সবাই একটু গোল হয়ে বসি।
আমরাই তাই করলাম। অবশ্য খুব বেশি নড়তে চড়তে হল না। আমরা এমনিতেই খানিকটা গোল হয়েই বসে ছিলাম। মারিয়া আমাদের জানাল যে এরপর আমাদের সবার চোখ বন্ধ করতে হবে এবং এক ভাবে মনে মনে এক ভাবে আশে পাশের কোন মৃত আত্মাকে ডাকতে হবে। বলতে হবে যে যদি কেউ আশে পাশে থেকে থাকে তাহলে যেন সে আমাদের সাথে এসে কথা বলে।
আমি সত্যিই সত্যিই চোখ বন্ধ করেই সেই কথাগুলো বলতে লাগলাম যেন সত্যিই সত্যিই আমি কোন মৃত আত্মাকে ডাকছি, আমি চাচ্ছি যে সে যেন এখানে এসে হাজির হয়। তৃষা আমার হাত ধরেই ছিল। অনুভব করলাম যে সে আমার হাতে একটু জোড়ে চাপ দিয়ে ধরেছে। চোখ খুলে দেখি সে আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছে যে এসব ছেলেমানষী এখনই বন্ধ করে।
আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সবাই চোখ বন্ধ করে আছে। সত্যিই যেন ওরাও ডাকছে।
আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে আবার যখন ওদের দিকে তাকাতে যাবো তখনই একটা অবাক হওয়ার মত ঘটনা ঘটল । আমি দেখতে পেলাম আমাদের হারিক্যানটা ধপ করে নিভে গেল। এবং সাথে সাথেই আমার কাছে সেই অশুভ অনুভূতিটা ফিরে এল যেটা হয়েছিল আজকে সকালে এখানে আসার সাথে সাথেই। এই অনুভূতিটা তীব্র হয়ে আমার কাছে ধরা দিল। ঠিক সেই সময়ে আমি ঘরের ভেতরে কিছুর একটা উপস্থিতি টের পেলাম। এবং আমার কেন জানি মনে হল কেবল আমি নই তৃষাও ঠিক এই ব্যাপারটা টের পেয়েছে। কারণ আমার হাতের উপরে ওর হাতের চাপ আমি অনুভব করতে পারছিলাম বেশ ভাল ভাবেই। তখনই মারিয়ার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, কেউ মোবাইলের আলো জ্বালবেন না। আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমাদের ক্ষতি করার কোন ক্ষমতা ওদের দেওয়া হয় নি।
কেউ কোন কথা বলল না। মারিয়া এবার বলল, আপনি কি এসেছেন? আপনি কি এসেছেন? এসে থাকলে সাড়া দিন। আমাদেরকে সাড়া দিন।
ঠিক সেই সময়ে আমি মৃদু আওয়াজ শুনতে পেলাম। যেন খুব ছোট একটা জিনিস ঘষে ঘষে চলছে। তারপর সব থেকে বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে পেলাম । যে হ্যারিক্যানটা আমি নিভে যেতে দেখেছিলাম নিজের চোখে সেটাই আবার জ্বলে উঠল। সত্যি বলতে এটা কিভাবে হল আমি জানি না তবে হল। আমার চোখের সামনে হল ।
ঘরে আবার মৃদু আলো ফিরে এল এবং সেই আলোতেই আমি বিস্ময় নিয়ে দেখলাম যে সেই তীর চিহ্নটা খুব খুব ধীরে ধীরে নড়ছে এবং নড়তে নড়তে সেটা ইয়েস এর ঘরে গিয়ে ঠেকল। এটা আমার কোন চোখের ভুল নয়। তৃষাও ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে । তার চোখে আমি বিস্ময় দেখতে পেলাম।
আপনি কি পুরুষ?
তীর চিহ্নটা নড়ে উঠল । সে মাঝ বরাবর গিয়ে আবারও ইয়েস লেখার জায়গাতে ফিরে এল। মারিয়া আবার প্রশ্ন করল,
যখন বেঁচে ছিলেন তখন আপনি কি এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন?
ইয়েস
আপনি কি বিবাহিত ছিলেন?
ইয়েস।
আপনার কি ছেলে মেয়ে আছে?
নো।
আপনার স্ত্রী কি এখনও জীবিত আছে?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু সময় লাগল তবে সেটা মাঝে গিয়ে আবারও ইয়েস এ ফিরে এল।
এই বাড়ির বাসিন্দা, যার কোন ছেলে মেয়ে নেই এবং এখনও তার স্ত্রী বেঁচে, এমন কেবল একজনই হতে পারে । সে হচ্ছে এই বাড়ির শেষ মালিক দিপ্ত প্রতাপ চৌধুরী। আমি এমন উইজাবোর্ডের গল্প পড়েছি অনেক। আজকে নিজের চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটতে দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। বুকের ভেতরে যে একটু ভয় ভয় করছিল না সেটা আমি বলব না তবে করছিল ঠিকই।
তারপর একটা তৃষা একটা অবাক করা প্রশ্ন করল। মারিয়ার প্রশ্নের আগেই তৃষা বলল, আপনার মৃত্যু কি স্বাভাবিক ছিল?
তীর চিহ্নটা মাঝ বরাবর গেল এবং তারপর এবার নো তে গিয়ে ঠেকল। আমি সহ ঘরের সবাই তীব্র বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এরপরে তৃষা যে প্রশ্নটা করল সেটার জন্য আমরা কেউ ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। সে বলল, আপনার মৃত্যুতে কি আপনার স্ত্রীর হাত ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তরে তীর চিহ্নটা প্রথমে মাঝে গিয়ে স্থির হয়ে রইল । মনে হল যেন সেখানেই পড়ে থাকবে । তবে আমার কেন জানি মনে হল যে দিপ্ত প্রতাপের আত্মা এখনও ঘরের ভেতরেই আছে। কারণ ঘরের ভেতরের সেই অস্বাভাবিক অনুভূতিটা আমি এখনও অনুভব করতে পারছিলাম। বেশ কিছুটা সময় চুপ করে আমরা অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তীর চিহ্নটা নড়ল না। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখনই আমাদের মনে হল যে তীর চিহ্নটি নড়তে শুরু করবে ঠিক সেই সময়েই বিদ্যুৎ চলে এল। পুরো ঘরে একেবারে আলোকিত হয়ে গেল। আমরা সবাই একটু চমকে উঠলাম। তবে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পেলাম সবাই খানিকটা ভয় মিশ্রিত কৌতুহল রয়েছে। হঠাৎ করে আলো চলে আসায় সবাই যেন একটু হতাশও হয়েছে। যেন তারা অপেক্ষা করছিল আসল কথাটা জানার জন্য । তবে আলোর চলে আসার কারণে সেটা আর হল না। তবে আমি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে ঘরের ভেতরে ভার ভার ভাব ছিল সেটা এখন আর নেই। মনে হচ্ছে যেন খারাপ কিছু ঘর থেকে চলে গেছে।
তবে তৃষার চেহারা স্বাভাবিক। সে আমার দিকে স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। একটু আগে যে আমরা একটা ভুতের সাথে কথা বলেছি সেটা যেন কোন ব্যাপারই না। তৃষার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন ও প্রতিদিন দুই চারটা ভুতের সাথে এভাবেই কথা বলে। মারিয়ার চেহারাও স্বাভাবিক। ও যেহেতু আগেও এই কাজ করেছে তাই ওর সাথে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হতে পারে। তবে ঘরের অন্য সবার চোখেই একটা ভয়ের ছাপ আমি ঠিকই দেখতে পারছি। ওরা সম্ভবত ব্যাপারটা আগে থেকে অনুমান করতে পারে নি।
এরপর কেন জানি আর আড্ডা জমলো না। আর খাওয়ার ডাক পরার পরপরই আমরা সবাই ডাইনিংয়ের দিকে ছুটলাম। খাওয়া শেষ করে নিজেদের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। শোবার সময় আমি তৃষাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এরকম শান্ত মুখে কিভাবে আছো?
তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি দেখি আসলেই বোকাই রয়ে গেলে?
-মানে?
-মানে কী আবার! কোন ভুতটুত যে নেই এটা তুমি কি এখনও বুঝতে পারো নি।
-তুমিও তো কথা শুনলে? শোনো নাই?
-আরে গাধা! ওটা ভেন্ট্রিলোকুইজম করা! আমি নিশ্চিত মারিয়ার কাজ?
-নাহ। হতেই পারে না। মারিয়া আমার পাশেই বসে ছিল। ওর কাছ থেকে শব্দ আসলে আমি বুঝতে পারলাম।
-তাহলে ওর ভাইয়ের কাজ। দুই ভাইবোন মিলে এই কাজ করেছে। শোনো আমি কিছু অভিয়াস প্রশ্ন করেছি। আমি জানতামই যেন এই উত্তর আসবে। এটাই হয়েছে। যদি বিদ্যুৎ না আসতো দেখতে বলত যে তার বউ তার প্রেমিকের সাথে মিশে এই কাজ করেছে। বেশির ভাগ ভুতের গল্পগুলোতেই এসব হয়। এটাও তাই।
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। তৃষার কথা আমি ফেলে দিতে পারলাম না। কারণ ভেন্ট্রিলোকুইজমের ভিডিও আমি দেখেছি অনেক। জেফ ডানাম নামে আমার পছন্দের একজন ভেন্ট্রিলোকুলিস্ট আছে। তার শো আমার অনেক পছন্দ। মনের ভেতরের দ্বিধাটা চলে গেল না। কারণ এই শব্দ ছাড়াও একটা অস্বস্তিবোধ কাজ করছিল যখন দিপ্ত প্রতাপের আত্মা এসেছিল। এটাও ভেন্ট্রিলোকুইজম? এই কথা ভাবতে ভাবতেই রাতে ঘুম চলে এল।
পরদিন সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা আবার ঢাকা চলে এলাম। তৃষা রাতের কথা তুলল না। এমন কি মারিয়া কিংবা ওর পরিবারের কেউ-ই কাল রাতের ঘটনা নিয়ে কোন কথা বলল না।
তবে এই বাড়িটা তৃষাদের আর কেনা হল না।
ঢাকায় ফেরার সপ্তাহ খানেক পরে তৃষা অফিস থেকে ফিরে একটু গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। আমি ওর চেহারার দিকে তাকিয়েই বুঝলাম যে কিছু হয়েছে। বললাম, কী হয়েছে?
তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দিপ্ত প্রতাপের জমিদার বাড়িটা আমাদের এখনই কেনা হচ্ছে না।
-কেন? সব কিছুই না ফাইনাল ছিল। আমরা দেখেও তো এলাম।
-হ্যা সব ফাইনাল ছিল । তবে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। দিপ্ত প্রতাপের এক চাচাতো ভাই আছে। সে অনেক দিন ধরেই বলে আসছিল যে দিপ্তের বউ চৈতি নাকি তার ভাইকে মেরে ফেলেছে। এই কাজে তাকে সাহায্য করেছে দিপ্ত প্রতাপের ব্যক্তিগত ডাক্তার আদিল মাহমুদ। সে নাকি ধীরে ধীরে দিপ্ত প্রতাপের শরীরে অল্প অল্প আর্সেনিক প্রবেশ করিয়ে তার শরীর খারাপ করিয়ে দিয়েছে। আদিল আর চৈতির ভেতরে একটা অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আমি ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলাম । এটা যদি সত্য হয় তাহলে তো সেদিন সেই আত্মা যা বলেছিল সেটা একেবারে সত্যি। আমার চেহারার ভাব দেখেই তৃষা বলল, শোনো এর ভেতরে ভুতটুতের কোন ব্যাপার নেই। দিপ্ত প্রতাপের বউ মানে চৈতি ঐ আদিল মাহমুদকেও ধোকা দিয়ে অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছে। এই বাড়ি বিক্রির টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। এই জন্য ঈর্ষায় বশবর্তী হয়ে আদিল সব রিপোর্ট করেছে। বুঝেছো?
-বুঝলাম।
আমি মুখে স্বীকার করলেও মনে মনে বললাম আমি ঐদিন রাতের বেলা যে স্বস্তিটা অনুভব করেছিলাম সেটা কোনো ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না। তার ভেতরে অস্বস্তি কিছু ছিলই। সেদিন ঠিক ঠিক দিপ্ত প্রতাপের আত্মা এসেছিল আমাদের কাছে। হয়তো শেষ চেষ্টা হিসাবে নিজের খুনীর কথা আমাদের কাছে জানিয়ে গেল। জমিদার বাড়ির ভুত আমাদের সাথে কথা বলে গেল।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.