তবুও তোমাকেই চাই

3.5
(12)

চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে তৃষা লক্ষ্য করলো দরজাটা খোলা । কেবল মাত্র ভেজিয়ে দেওয়া হয়েছে । সাথে সাথে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। তার স্পষ্ট মনে আছে যে বের হওয়ার সময় সে দরজা লাগিয়েই বের হয়েছিলো । তার মানে তার অপু যখন বের হয়েছে তখন দরজা লাগায় নি । পুরোটা দিন রুম খোলা ছিল ! তৃষা লক্ষ্য করলো ওর মেজাজটা আস্তে আস্তে খারাপ হতে শুরু করেছে । এখন ঘরের ভেতরে ঢুকে যদি দেখে কিছু চুরি হয়েছে তাহলে আজকে সে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিবে । আজকে নতুন কেনা ট্যাবলেট অফিসে নিয়ে যায় নি । যদি সেটা খোয়া যায় তাহলে অপুর খবরই আছে !

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তৃষা একটু অবাক হয়ে গেল । সাথে একটু অপ্রস্তুতও । অপু ড্রয়িং রুমের সোফার বসে আছে কফির মগ হাতে নিয়ে । সামনে টিভি খোলা রয়েছে । ব্যাপারটা ওর কাছে একটু অস্বাভাবিক লাগলো । অপু কখনই এতো সকালে বাসায় আসে না । ল্যাব থেকে তার বাসায় আসতে আসতে প্রায়ই দিন বেশ রাত হয় । কোন কোন দিন ফেরেও না । ল্যাবেই থেকে যায় । আর সেই অপু আজকে বসে বসে টিভি দেখছে ।
ওকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অপু বলল, গুড ইভিনিং ! অফিস কেমন ছিল ?

শেষ কবে অপু ওকে এমন কথা জিজ্ঞেস করেছে সেটা তৃষার মনেও পড়লো না । সব কিছু ঠিক আছে কি? তৃষাকে দ্বিধান্বিত হতে দেখে অপু বলল, কফি খাবে ? তারপর তৃষার উত্তরের অপেক্ষা না করেই রান্না ঘরের দিকে হাটতে শুরু করলো । যাওয়ার আগে বলল, তুমি চট করে ফ্রেস হয়ে আসো । আমি কফির সাথে আরও কিছু নিয়ে আসছি !

তৃষা সত্যিই খানিকটা অবাকই হচ্ছে । অপুর আচরণটা সেই নতুন নতুন বিয়ে হওয়ার সময়ের মত মনে হচ্ছে । ওদের যখন নতুন নতুন বিয়ে হয় তখন প্রায়ই এমনটা করতো অপু । তৃষার অফিস থেকে ফিরে এসে দেখতো অপু বাসাতেই রয়েছে । ওর জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসছে কিংবা কিছু পিয়াজু ডিম টোস্ট ভেজে নিয়ে আসছে । সেই সময়েই সন্ধ্যা গুলো কেমন চমৎকার ছিল ।
কিন্তু তারপর ….
তৃষা জোর করে মাথা থেকে চিন্তা গুলো দুর করে দিল । এসব এখন ভাবতে চাচ্ছে না । ফ্রেশ হয়ে যখন আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে এল তখন দেখলো গরম গরম কফির কাপের সাথে হাতে বানানো প্যান কেক । অপু প্যান কেকও ভাল বানাতে পারতো !

তৃষা কফির কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল । তারপর অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে এই সময়ে বাসায় ?
-হুম ! আজকে ফ্রি !
-তোমার মত কাজের লোকের আমার ফ্রি ডে আছে নাকি ?
-আর এতো চাপ নেব না ঠিক করেছি । এবার থেকে কেবল মাত্র ছাত্র পড়াবো । আর কোন গবেষণা নয় !
তৃষা একটু অবাক চোখে অপুর দিকে তাকালো । অপু আবার বলল, এখন থেকে ক্লাস শেষ করে সোজা বাসায় ।
-এতোদিন পরে এমন করার ইচ্ছে হল হঠাৎ? যে প্রজেক্টে কাজ করছিলে সেটা শেষ !
-হুম শেষ ! ভাল ভাবেই।
এবার তৃষা একটু অবাক হল । অপু এবং তার টিম টাইমমেশিন বানানোর একটা প্রোজেক্টে কাজ করছিলো বেশ কয়েক বছর ধরে । মানে কি সেটা সফল হয়েছে । তৃষা বলল, মানে টাইম ট্রাভেল….
-হ্যা । সফল ভাবেই শেষ করেছি । আজ অতীতে গিয়েছিলাম আমি ।
তৃষা চোখ বড় বড় করে বলল, তারপর?
-তারপর আর কি? দেখতেই পাচ্ছো ফিরে এসেছি । আরও কিছু খুটিনাটি কাজ বাকি তবে সেটাতে আমার যাওয়ার দরকার নেই । ওরাই পারবে! আমি একটু বিশ্রাম নিই । সপ্তাহ খানেক পরে ঘোষণা আসবে ।
তৃষা হঠাৎ বলল, কোথায় গিয়েছিলে? আই মিন কত সালে ?

অপু শান্ত কন্ঠে বলল, ২০৭৬ । ২৩ জানুয়ারি ।
তারিখ টা শুনতেই চমকে উঠলো তৃষা ! ২৩ জানুয়ারি তৃষার জন্মদিন । আর দুই হাজার ছিয়াত্তর সালটা একটা বিশেষ দিন ওদের জন্য । ওরা দুজনেই তখন ক্লাস নাইনে পড়ে । এই সালের এই দিনেই অপু ওকে প্রোপোজ করেছিলো । তৃষাও অনেক আগে থেকেই অপুকে পছন্দ করতো বেশ । সেও সাড়া দিয়েছিলো সেই ডাকে । তারপর দীর্ঘ ১০ বছর প্রেম করার পরে ওরা বিয়ে করেছিলো ।
বিয়ের পরেও ওদের সম্পর্ক বেশ চমৎকার ছিল । সুখেই কেটে গেল প্রায়ই দুইটা বছর । তারপর একটা সময় মনে হল এবার একটা বাচ্চা নেওয়া দরকার । কিন্তু টেস্ট করে জানা গেল তৃষার বাচ্চা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। ব্যাপারটা ওদের দুজনের সংসারে যেন একটা ধাক্কার মত ছিল । তৃষা নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করলো । ওর নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হত লাগলো । ওদের মাঝে একটা ফাঁটল দেখা দিল । দুজন এক ঘরের নিচে থাকলেও আর এক সাথে ছিল না । তারপর অপু প্রজেক্টে কাজ শুরু হল । সব কিছু ভুলে থাকতেই প্রজেক্টের কাজে নিজেকে একেবারে ডুবিয়ে রাখলো সে । কখন বাসায় আসতো আর কখন যেত কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না । এমনও দেখা যেত যে ওদের দুজনের দিনের পর দিন দেখা হচ্ছে না ।

তৃষা বলল, তারপর?
অপু একটু হাসলো । বলল, তারপর আর কি? আমার সেই অতীতের আমার সামনে গিয়ে হাজির হলাম ।
তৃষা খানিকটা কৌতুহল নিয়ে বলল, কী বললে?
-বললাম যে তোমাকে যেন প্রোপোজ না করে । তাহলে সামনের জীবনটা সুখের হবে না ।
-তোমার কথা বিশ্বাস করলো সে?
-প্রথমে করে নি । তারপর আমি যখন প্রমান দিলাম তখন করলো । তাকে বললাম যে একটা সময়ে গিয়ে আমরা আর সুখে থাকবো না । এর থেকে বেটার আজকে যেন প্রোপোজটাই না করে । অন্য কারো সাথে জীবন বাঁধলে হয়তো হয় সুখে থাকবো । তখন সে কী বলল জানো? বলল যে ১০ বছর প্রেম করেছি তো তারপর বিয়ে হয়েছে আমাদের ! ব্যাস আর কিছু দরকার নেই । তৃষা আমার চোখের সামনে থাকবে এটাই যথেষ্ট আমার জন্য । ও আমার সাথে কথা না বলুক দিনের পর দিন তাতেও চলবে । কেবল আমরা এক ছাদের নিচে আছি এটা জানলেই আমি খুশি !

অপু কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, আমি কেবল আমার সেই ছোট আমিটাকে দেখছিলাম অবাক হয়ে । তোমার জন্য কী তীব্র ভালোবাসা ওর চোখে ছিল ! তারপর আমি ফিরে এসে আয়নাতে নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সেই চোখ বদলায় নি । একদম বদলায় নি । আমি এখনও তোমাকে আগের মতই ভালোবাসি তৃষা !

তৃষা তাকিয়ে দেখলো ৩৮ বছরের তার স্বামীর চোখে পানি । ওর দিকে কী ব্যকুল চোখে তাকিয়ে রয়েছে । তৃষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো তার নিজের চোখেও পানি এসেছে । কফির মগটা টেবিলের উপরে রেখে কেবল অপুর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো । বুঝতে পারলো যে এতোদিন যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল ওদের মাঝে তৈরি হয়েছিলো সেটা মুহুর্তের ভেতরে ভেঙ্গে গিয়েছে । আগে এগিয়ে এল তৃষাই । গভীর ভাবে অপুকে জড়িয়ে ধরলো সে । তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলো ।
সেই সময়ে যখন জানতে পেরেছিলো সে কোন দিন মা হতে পারবে না তখন সে কাঁদে নি । কেবল নিজেকে কেমন যেন অযোগ্য মনে হয়েছিলো নিজের কাছেই । বারবার মনে হয়েছিলো অপু বুঝি এখন আর আগের মত তাকে ভালোবাসবে না । অপু পরে অনেক বারই নিজ থেকে কাছে আসার চেষ্টা করেছে কিন্তু তৃষার কেবল মনে হয়েছে যে অপু ওকে বুঝি করুণা করছে । করুণা করেই কাছে আসছে । এই ভাবনাটাই ওকে দিন দিন দুরে নিয়ে যেত আরও ।

আজকে এতোদিন পরে ওরা আবারও একে অন্যের কাছে এল খুব । গভীর ভাবে ভালোবাসলো দুজনকে । তৃষার সত্যিই মনে হল যে অপু ওকে করুণা করছে না । মোটেই না । সে গভীর ভাবেই তাকে ভালবাসে ঠিক আগের মতই । ভালোবাসার ব্যাপার গুলোই এমন। এখানে কে ছোট কে বড় কিংবা কার কি নেই সে সব কখনই সামনে আসে না । কেবল ভালোবাসাটাই সামনে আসে ।

পরিশিষ্ট

তৃষা আর অপু একটা বড় গাছের আড়ালে দাড়িয়ে রয়েছে । আড়াল থেকে তাকিয়ে রয়েছে পার্কের বেঞ্চটার দিকে । বেঞ্চে দুজন কিশোর কিশোরী বসে আছে । পাশাপাশি । তৃষা আর অপু দুজনেই জানে এখন কী হবে ! এই ঘটনাটা প্রায় ১৮ বছর আগে ওদের সাথে ঘটে গিয়েছে । তৃষার বায়নাতে অপু আবারও ওকে টাইম ট্রাভেল করে সেই বিশেষ দিনটাতে নিয়ে এসেছে । সেই দিনটা যেদিন অপু ওকে প্রথম ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো । প্রথমবারের মত চুমু খেয়েছিলো ।
তৃষা অপলক চোখে তাকিয়ে আছে নিজেদের অতীতের দিকে । কী সুমধুর অতীত তাদের ছিল । মনে মনে আবারও ঠিক করে নিল যে এই চমৎকার অতীতের মতই সামনের দিন গুলোও চমৎকার হবে !

সমাপ্ত

গল্পের থিমঃ সায়ক আমান

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 3.5 / 5. Vote count: 12

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →