চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে তৃষা লক্ষ্য করলো দরজাটা খোলা । কেবল মাত্র ভেজিয়ে দেওয়া হয়েছে । সাথে সাথে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। তার স্পষ্ট মনে আছে যে বের হওয়ার সময় সে দরজা লাগিয়েই বের হয়েছিলো । তার মানে তার অপু যখন বের হয়েছে তখন দরজা লাগায় নি । পুরোটা দিন রুম খোলা ছিল ! তৃষা লক্ষ্য করলো ওর মেজাজটা আস্তে আস্তে খারাপ হতে শুরু করেছে । এখন ঘরের ভেতরে ঢুকে যদি দেখে কিছু চুরি হয়েছে তাহলে আজকে সে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিবে । আজকে নতুন কেনা ট্যাবলেট অফিসে নিয়ে যায় নি । যদি সেটা খোয়া যায় তাহলে অপুর খবরই আছে !
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তৃষা একটু অবাক হয়ে গেল । সাথে একটু অপ্রস্তুতও । অপু ড্রয়িং রুমের সোফার বসে আছে কফির মগ হাতে নিয়ে । সামনে টিভি খোলা রয়েছে । ব্যাপারটা ওর কাছে একটু অস্বাভাবিক লাগলো । অপু কখনই এতো সকালে বাসায় আসে না । ল্যাব থেকে তার বাসায় আসতে আসতে প্রায়ই দিন বেশ রাত হয় । কোন কোন দিন ফেরেও না । ল্যাবেই থেকে যায় । আর সেই অপু আজকে বসে বসে টিভি দেখছে ।
ওকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অপু বলল, গুড ইভিনিং ! অফিস কেমন ছিল ?
শেষ কবে অপু ওকে এমন কথা জিজ্ঞেস করেছে সেটা তৃষার মনেও পড়লো না । সব কিছু ঠিক আছে কি? তৃষাকে দ্বিধান্বিত হতে দেখে অপু বলল, কফি খাবে ? তারপর তৃষার উত্তরের অপেক্ষা না করেই রান্না ঘরের দিকে হাটতে শুরু করলো । যাওয়ার আগে বলল, তুমি চট করে ফ্রেস হয়ে আসো । আমি কফির সাথে আরও কিছু নিয়ে আসছি !
তৃষা সত্যিই খানিকটা অবাকই হচ্ছে । অপুর আচরণটা সেই নতুন নতুন বিয়ে হওয়ার সময়ের মত মনে হচ্ছে । ওদের যখন নতুন নতুন বিয়ে হয় তখন প্রায়ই এমনটা করতো অপু । তৃষার অফিস থেকে ফিরে এসে দেখতো অপু বাসাতেই রয়েছে । ওর জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসছে কিংবা কিছু পিয়াজু ডিম টোস্ট ভেজে নিয়ে আসছে । সেই সময়েই সন্ধ্যা গুলো কেমন চমৎকার ছিল ।
কিন্তু তারপর ….
তৃষা জোর করে মাথা থেকে চিন্তা গুলো দুর করে দিল । এসব এখন ভাবতে চাচ্ছে না । ফ্রেশ হয়ে যখন আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে এল তখন দেখলো গরম গরম কফির কাপের সাথে হাতে বানানো প্যান কেক । অপু প্যান কেকও ভাল বানাতে পারতো !
তৃষা কফির কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল । তারপর অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে এই সময়ে বাসায় ?
-হুম ! আজকে ফ্রি !
-তোমার মত কাজের লোকের আমার ফ্রি ডে আছে নাকি ?
-আর এতো চাপ নেব না ঠিক করেছি । এবার থেকে কেবল মাত্র ছাত্র পড়াবো । আর কোন গবেষণা নয় !
তৃষা একটু অবাক চোখে অপুর দিকে তাকালো । অপু আবার বলল, এখন থেকে ক্লাস শেষ করে সোজা বাসায় ।
-এতোদিন পরে এমন করার ইচ্ছে হল হঠাৎ? যে প্রজেক্টে কাজ করছিলে সেটা শেষ !
-হুম শেষ ! ভাল ভাবেই।
এবার তৃষা একটু অবাক হল । অপু এবং তার টিম টাইমমেশিন বানানোর একটা প্রোজেক্টে কাজ করছিলো বেশ কয়েক বছর ধরে । মানে কি সেটা সফল হয়েছে । তৃষা বলল, মানে টাইম ট্রাভেল….
-হ্যা । সফল ভাবেই শেষ করেছি । আজ অতীতে গিয়েছিলাম আমি ।
তৃষা চোখ বড় বড় করে বলল, তারপর?
-তারপর আর কি? দেখতেই পাচ্ছো ফিরে এসেছি । আরও কিছু খুটিনাটি কাজ বাকি তবে সেটাতে আমার যাওয়ার দরকার নেই । ওরাই পারবে! আমি একটু বিশ্রাম নিই । সপ্তাহ খানেক পরে ঘোষণা আসবে ।
তৃষা হঠাৎ বলল, কোথায় গিয়েছিলে? আই মিন কত সালে ?
অপু শান্ত কন্ঠে বলল, ২০৭৬ । ২৩ জানুয়ারি ।
তারিখ টা শুনতেই চমকে উঠলো তৃষা ! ২৩ জানুয়ারি তৃষার জন্মদিন । আর দুই হাজার ছিয়াত্তর সালটা একটা বিশেষ দিন ওদের জন্য । ওরা দুজনেই তখন ক্লাস নাইনে পড়ে । এই সালের এই দিনেই অপু ওকে প্রোপোজ করেছিলো । তৃষাও অনেক আগে থেকেই অপুকে পছন্দ করতো বেশ । সেও সাড়া দিয়েছিলো সেই ডাকে । তারপর দীর্ঘ ১০ বছর প্রেম করার পরে ওরা বিয়ে করেছিলো ।
বিয়ের পরেও ওদের সম্পর্ক বেশ চমৎকার ছিল । সুখেই কেটে গেল প্রায়ই দুইটা বছর । তারপর একটা সময় মনে হল এবার একটা বাচ্চা নেওয়া দরকার । কিন্তু টেস্ট করে জানা গেল তৃষার বাচ্চা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। ব্যাপারটা ওদের দুজনের সংসারে যেন একটা ধাক্কার মত ছিল । তৃষা নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করলো । ওর নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হত লাগলো । ওদের মাঝে একটা ফাঁটল দেখা দিল । দুজন এক ঘরের নিচে থাকলেও আর এক সাথে ছিল না । তারপর অপু প্রজেক্টে কাজ শুরু হল । সব কিছু ভুলে থাকতেই প্রজেক্টের কাজে নিজেকে একেবারে ডুবিয়ে রাখলো সে । কখন বাসায় আসতো আর কখন যেত কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না । এমনও দেখা যেত যে ওদের দুজনের দিনের পর দিন দেখা হচ্ছে না ।
তৃষা বলল, তারপর?
অপু একটু হাসলো । বলল, তারপর আর কি? আমার সেই অতীতের আমার সামনে গিয়ে হাজির হলাম ।
তৃষা খানিকটা কৌতুহল নিয়ে বলল, কী বললে?
-বললাম যে তোমাকে যেন প্রোপোজ না করে । তাহলে সামনের জীবনটা সুখের হবে না ।
-তোমার কথা বিশ্বাস করলো সে?
-প্রথমে করে নি । তারপর আমি যখন প্রমান দিলাম তখন করলো । তাকে বললাম যে একটা সময়ে গিয়ে আমরা আর সুখে থাকবো না । এর থেকে বেটার আজকে যেন প্রোপোজটাই না করে । অন্য কারো সাথে জীবন বাঁধলে হয়তো হয় সুখে থাকবো । তখন সে কী বলল জানো? বলল যে ১০ বছর প্রেম করেছি তো তারপর বিয়ে হয়েছে আমাদের ! ব্যাস আর কিছু দরকার নেই । তৃষা আমার চোখের সামনে থাকবে এটাই যথেষ্ট আমার জন্য । ও আমার সাথে কথা না বলুক দিনের পর দিন তাতেও চলবে । কেবল আমরা এক ছাদের নিচে আছি এটা জানলেই আমি খুশি !
অপু কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, আমি কেবল আমার সেই ছোট আমিটাকে দেখছিলাম অবাক হয়ে । তোমার জন্য কী তীব্র ভালোবাসা ওর চোখে ছিল ! তারপর আমি ফিরে এসে আয়নাতে নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সেই চোখ বদলায় নি । একদম বদলায় নি । আমি এখনও তোমাকে আগের মতই ভালোবাসি তৃষা !
তৃষা তাকিয়ে দেখলো ৩৮ বছরের তার স্বামীর চোখে পানি । ওর দিকে কী ব্যকুল চোখে তাকিয়ে রয়েছে । তৃষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো তার নিজের চোখেও পানি এসেছে । কফির মগটা টেবিলের উপরে রেখে কেবল অপুর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো । বুঝতে পারলো যে এতোদিন যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল ওদের মাঝে তৈরি হয়েছিলো সেটা মুহুর্তের ভেতরে ভেঙ্গে গিয়েছে । আগে এগিয়ে এল তৃষাই । গভীর ভাবে অপুকে জড়িয়ে ধরলো সে । তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলো ।
সেই সময়ে যখন জানতে পেরেছিলো সে কোন দিন মা হতে পারবে না তখন সে কাঁদে নি । কেবল নিজেকে কেমন যেন অযোগ্য মনে হয়েছিলো নিজের কাছেই । বারবার মনে হয়েছিলো অপু বুঝি এখন আর আগের মত তাকে ভালোবাসবে না । অপু পরে অনেক বারই নিজ থেকে কাছে আসার চেষ্টা করেছে কিন্তু তৃষার কেবল মনে হয়েছে যে অপু ওকে বুঝি করুণা করছে । করুণা করেই কাছে আসছে । এই ভাবনাটাই ওকে দিন দিন দুরে নিয়ে যেত আরও ।
আজকে এতোদিন পরে ওরা আবারও একে অন্যের কাছে এল খুব । গভীর ভাবে ভালোবাসলো দুজনকে । তৃষার সত্যিই মনে হল যে অপু ওকে করুণা করছে না । মোটেই না । সে গভীর ভাবেই তাকে ভালবাসে ঠিক আগের মতই । ভালোবাসার ব্যাপার গুলোই এমন। এখানে কে ছোট কে বড় কিংবা কার কি নেই সে সব কখনই সামনে আসে না । কেবল ভালোবাসাটাই সামনে আসে ।
পরিশিষ্ট
তৃষা আর অপু একটা বড় গাছের আড়ালে দাড়িয়ে রয়েছে । আড়াল থেকে তাকিয়ে রয়েছে পার্কের বেঞ্চটার দিকে । বেঞ্চে দুজন কিশোর কিশোরী বসে আছে । পাশাপাশি । তৃষা আর অপু দুজনেই জানে এখন কী হবে ! এই ঘটনাটা প্রায় ১৮ বছর আগে ওদের সাথে ঘটে গিয়েছে । তৃষার বায়নাতে অপু আবারও ওকে টাইম ট্রাভেল করে সেই বিশেষ দিনটাতে নিয়ে এসেছে । সেই দিনটা যেদিন অপু ওকে প্রথম ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো । প্রথমবারের মত চুমু খেয়েছিলো ।
তৃষা অপলক চোখে তাকিয়ে আছে নিজেদের অতীতের দিকে । কী সুমধুর অতীত তাদের ছিল । মনে মনে আবারও ঠিক করে নিল যে এই চমৎকার অতীতের মতই সামনের দিন গুলোও চমৎকার হবে !
সমাপ্ত
গল্পের থিমঃ সায়ক আমান