বিসিএস ফেইল

5
(24)

নীলাদের বাড়িতে আজকে একটা আনন্দময় পরিবেশ । আজকে পাত্রপক্ষ নীলাকে দেখে গেছে এবং মোটামুটি পাঁকা কথা দিয়েই গেছে। নীলাকে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। অবশ্য নীলা এমনই মেয়ে যে ওকে অপছন্দ হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রথম দেখাতেই নীলাকে সবার পছন্দ হবে। আর ছেলেও খুব ভাল । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। জার্মানি গেছে পিএইচডি করতে। এই ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসবে। তখনই বিয়ে হবে। সবাই খুশি হলেও জামিল সাহেব নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা যেন আঁচ করতে পারলেন । তার মনে হল যেন নীলা এই বিয়েছে খুশি না !
রাতের বেলা ঘুমানোর আগে জামিল আহমেন নিজের মেয়ের ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।
-আসবো নীলু !
-আসো বাবা !
ঘরে ঢুকে দেখলেন নীলা খাটের উপরে বসে আছে । খাটের উপর বই খাতা ছড়ানো। নীলা একবার বলেছিল ছেলে পক্ষকে কদিন পরে আসতে। ওর নাকি কদিন পরেই সেমিস্টার ফাইনাল । তবে জামিল সাহেব বলেছিলেন, তুই পড়াশোনা কর। ওরা আসবে, তোর সাথে একটু কথা বলবে তারপর চলে যাবে। তোকে তো এতো চিন্তা করতে হবে না । বিছানার সামনে দাঁড়িয়েই জামিল সাহেব বললেন
-কেমন আছিস মা?
নীলা বই থেকে মুখ তুলে তাকাল তার বাবার দিকে । বলল, বাবা কিছু বলবে? আমি পড়ছি। জরূরী কিছু থাকলে বল । খোশ গল্প এখন করব না।
জামিল সাহেবের একবার মনে হল মেয়ের পড়াশোনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটানোর দরকার নেই । তিনি বরং চলেই যান নিজের ঘরে। কিন্তু সেই সময়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছে যে মেয়েটার মনটা খারাপ। যত ভাল ছেলেই হোক, মেয়ের ইচ্ছের একটা দাম তার কাছে রয়েছে । নীলা যদি রাজি না থাকে তাহলে এই স্থানে সে মেয়েকে বিয়ে দিবেন না ।
তার মেয়েটা আজীবন তার কথা শুনে এসেছে । কোনদিন অবাধ্য হয় নি । বিয়ের মত এতো বড় ব্যাপার তিনি মেয়ের উপরে চাপিয়ে দিবেন না বলেই ঠিক করছেন ।
জামিল সাহেব এবার বসলেন মেয়ের বিছানার এক কোণে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর বিয়েতে আপত্তি আছে কোনো?
নীলা মুখ তুলে তাকাল তার বাবার দিকে। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়েই জামিল সাহেবের মনে হল যে মেয়ে বিয়েতে রাজি না । তাহলে?
নীলার কি অন্য কাউকে পছন্দ?
কোন ছেলের সাথে কোন সম্পর্ক আছে?
জামিল সাহেব প্রশ্ন করলেন মেয়েকে, তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? বিয়ের মত এতো বড় একটা ব্যাপার আমি তোর উপরে চাপিয়ে দিতে চাই না।
-বাবা আমার কারো পছন্দ নেই। তোমার ভয় নেই। কারো সাথে আমি প্রেম করছি না।
নীলা কথাটা বলল বটে তবে জামিল সাহেবের কেন জানি মনে তার মেয়ে কিছু যেন বলতে গিয়েও বলল না। তবে এখন আর মেয়ের উপরে জোর খাটালেন না । তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখনই জোর করে মেয়েকে বিয়ে দিবেন না সে। যেদিন নীলার সাথে কথা বলে মনে হবে যে সত্যিই ও বিয়েতে রাজি সেদিনই পাত্রপক্ষকে পাঁকা কথা দিবেন । তার আগে না।
সপ্তাহ খানেক পরে সন্ধ্যা বেলা নীলাকে ছাদে আবিস্কার করলেন জামিল সাহেব। নীলা কেমন যেন উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন কথা না বলে জামিল সাহেব মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। বেশ কিছুটা সময় বাবা মেয়ে বসে রইল পাশপাশি। জামিল সাহেবের মনে হল আজকে নীলা নিজ থেকেই ওর মন খারাপের কারণ বলবে।
-বাবা আমার কারো সাথে কোন প্রেমের সম্পর্ক নেই। আমি জানি তুমি ছেলে মেয়েদের এই প্রেম ভালবাসাটা কী পরিমান অপছন্দ কর । আমি কখনই এমন কিছু করি নি যা তোমার অপছন্দ হবে।
-আমি জানি সেটা । তোর মন কেন খারাপ বলবি?
-মন খারাপ না বাবা। তবে…
কিছু একটা বলতে গিয়েও নীলা থেমে গেল। কিছু যেন ভাবল । অথবা সব কিছু মনের ভেতরে গুছিয়ে নিচ্ছে বলার জন্য ।
-আমার যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন মনে আছে আমি পহেলা বৈশাখের একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম?
-হ্যা মনে আছে ।
-ঐদিনের পরে একটা ছেলে আমার পিছু নেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তবে অন্য ডিপার্টমেন্টের । বখাটে টাইপের । রাজনীতি করে ।
-তারপর ?
-সে আমার সাথে প্রেম করবেই এমন ! বেশ কিছু দিন ঘুরল আমার পেছনে। একদিন আমি সরাসরি তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। সরাসরিই তাকে বললাম যে তার সাথে আমি কখনই প্রেম করব না । বেশি বিরক্ত করলে ডিনের কাছে রিপোর্ট করব। আর যদি তাতেও কাজ না হয় পড়াশোনাই ছেড়ে দিব। আমার কথাটা এতোটাই জোরালো ছিল যে সে চুপ করে গেল। তারপর তার জ্বালানো বন্ধ হয়ে গেল। তবে মাস খানেক পরে সে আবার এসে হাজির হল আমার সামনে। আমার দিকে কারত চোখে তাকিয়ে জানাল যে এই কদিনে সে অনেক চেষ্টা করেই আমাকে তার মাথা থেকে নাকি বের করতে পারে নি।
আমি বললাম, আমি যাই করেন না কেন আমি আপনার সাথে প্রেম করব না । কেবল আপনার সাথে কেন কার সাথেই প্রেম করব না কখনো !
সে তখন বলল, বিয়ে? যদি তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাই তখন?
-আমার বাবা আপনার মত কারো সাথে বিয়ে দিবে না ।
-কী করতে হবে? আই মিন কী করলে তোমার বাবা রাজি হবে?
আমি তার কন্ঠের একটা আকুলতা ভাব দেখেছিলাম । যে কোন কিছুই বিনিময়ে আমরা যখন কিছু পেতে চাই, তেমন একটা ভাব। আমি বললাম, পড়াশোনা শেষ করে ভাল চাকরি জোগার করুন ! এই সামনের বিসিএস আসছে ওটা ক্রস করুন । তাহলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান তখন হবে!
নীলা এক টানে কথা গুলো বলে থামল । জামিল সাহেব নীলার দিকে তাকালেন। মেয়ের মুখের ভাব দেখেই বুঝতে পারছেন যে সে খানিকটা অস্থির হয়ে আছে। নীলা আবারও বলতে শুরু করল, আমি সত্যি সেদিন অন্য কিছু ভেবে কথাটা বলি নি। আমি কেবল ওর কাছে মুক্তি চাইছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ওর কারো পক্ষে বিসিএস ক্রস করা সম্ভবই না । প্রিলিতেই বাদ পড়ে যাবে। আমার আর পিছু নেবে না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে যে ওর ভেতর এমন পরিবর্তন আসবে আমি বুঝতে পারি নি। পরের একটা বছর আমি ছেলেটাকে একদমই দেখলাম না। তবে অন্য একটা ছেলের সাথে আমার দেখা হল । ছেলেটা ওর রুমমেট । সে জানাল যে এই এক বছর আরিফ একেবারে বদলে গেছে। এই এক বছরে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন কেবল পড়াশোনা । অন্য কিছুর দিকে নজর নেই । কেবল পড়াশোনা । খবরটা শুনে আমি কী বলব বুঝতেই পারলাম না । একটা ছেলে আমার জন্য একেবারে পুরোটা বদলে গেছে। আমাদের ক্লাসেরই একজন ছিল ওর হলে। সেও একই কথা জানাল যে । হলে নাকি এরই ভেতরে আরিফের কথা সবাই জানে। বড় ভাই এক মেয়েকে পাওয়ার জন্য নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে।
নীলা চুপ করল । জামিল সাহেব বললেন, তারপর?
-গত মাসে রেজাল্ট দিয়েছে বিসিএসের ! হয় নি ওর । ওর সেই বন্ধুটা আবারও আমার কাছে এসেছিল। পাশ না করতে পেরে আরিফ নাকি হাউমাউ করে কাঁদছিল ।
জামিল সাহেব অনুভব করতে পারলেন যে তার মেয়ে এই অংশটুকু বলতে গিয়ে গলা স্বর কেমন যেন আদ্র হয়ে উঠল । নীলা বলল, আমি কখনো কোন ছেলের জন্য কোন ভালবাসা অনুভব করি নি । কিন্তু ওইদিন কী যে হল আমি জানি না । একটা ছেলে আমার জন্য দুইটা বছর জান প্রান দিয়ে চেষ্টা করল, পারল না, তারপর আমার জন্য কাঁদল । আমি জানি না এই অনুভূতি কেমন ! আমি সত্যিই জানি না। কতবার চেষ্টা করলাম মন থেকে ওকে বের করতে কিছুই বের হল না। ওর সেই বন্ধ আমাকে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল । পুরো ঘর অন্ধকার, সে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়েই চলেছে। ভিডিওটা যে আমি কতবার দেখেছি আমি জানি না।

দীর্ঘ সময়ে আর কেউ কোন কথা বলল না । এক সময়ে নীলাই বলল, তোমাকে সব কিছু বলতে পেরে ভাল লাগছে। তুমি ওদের কথা দিয়ে দাও। তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই বাবা !
নীলা আর কিছু না বলে উঠে গেল ।

দুই
নীলার আজকে বাকদান অনুষ্ঠান । খুব ছোট করেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । তাদের পরিবার, সাথে পাত্রপক্ষ। আংটি পরানো হবে । তারপর দুই তিন মাস পরেই বিয়ে। নীলা শাড়ি পরেছে আজকে । হালকা একটু সেজেছে । সাজগোস শেষ হতেই বুঝতে পারল যে মেহমানরা চলে এসেছে । বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। আরিফ যখন জানবে তখন হয়তো মন খারাপ করবে খুব। ছেলেটার জন্য একটু মন খারাপই হল নীলার । মন থেকে কেন জানি খুব চাইছিল যে আরিফের বিসিএসটা হয়ে যাক। একজন মানুষ ওকে পাওয়ার জন্য এত কষ্ট করছে এই ব্যাপারটা সে সহজে মন থেকে বের করতে পারছে না।
এক সময়ে নীলা মা ঘরে ঢুকল । ওকে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে হাজির হল । নীলা প্রথমে মাথা নিচ করেই ছিল কিন্তু যখন মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকাল তখনই মনে যে ও ভুল দেখছে !
আরিফ !
এখানে কেন?
আরিফের চেহারা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিপাটি হয়ে এসেছে । আগের মত বখাটে ভাবটা নেই । নীলা এবার তাকাল ওর বাবার দিকে । জামিল সাহেব মিটি মিটি হাসলেন। তারপর বললেন, ভাল চাকরিওয়ালা ছেলেই শেষ কথা না। যে ছেলে তোর জন্য নিজেকে বদলে ফেলতে পারে সেই ছেলের থেকে ভাল আর কেউ হতে পারে না। আর এই বিসিএস হয় নি তো কী হয়েছে পরের বিসিএস হবে, না হলে অন্য কোন চাকরি বা ব্যবসা করবে!

পরিশিষ্টঃ
নীলা আর আরিফ ওদের ছাদে বসে রয়েছে । রাত প্রায় দশটা বাজে । আংটির পরানোর অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে । এখন খাওয়া দাওয়া হবে । তার ফাঁকে আরিফ ওকে নিয়ে ছাদে এসেছে ।
-তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?
নীলা হাতটা বাড়িয়ে দিল। আরিফ হাতটা ধরে কিছু সময় সেদিকেই তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমি কখন ভাবতে পারি নি যে তোমার হাতটা আমি ধরতে পারব । যখন বিসিএসটা হল না তখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম। যে জীবনে তোমাকে পেলাম না সেই জীবনে আর কিছু দরকার নেই। কিন্তু একদিন তোমার বাবা আমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলেন। আমি সত্যিই জীবনে এতো অবাক হয় নি ।
-আমার বাবা আমাকে বলেই নি কিছু !
-সাইপ্রাইজ দিতে চেয়ছিল।
আরও কিছু কথা বলল ওরা। ওদের দুজনের চোখেই এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন । এক সাথে দুজন মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন !

অবশ্য বাস্তবে এসব সতি হয় না। কেবল অপুতানভীরের গল্পেই হয় ।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 24

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →