নওরিন ভীত চোখে সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কান্না আসছে কিন্তু কান্না আটকে আছে । ওর সাথে একটু পরে যে কী হবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারছে না । আজকে কোন ভাবেই নিজেকে আর সে রক্ষা করতে পারবে না । সামনের বসা এই মানুষটা আজকে ওকে ছিড়ুকুড়ে খাবে ।
নওরিন জানেও না ওকে ঠিক কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। মাইক্রোবাসে উঠেই অনুভব করেছি কেউ ওর নাকে কিছু একটা চেপে ধরেছিল। তখনও ওর কোন ধারণা ছিল না কে বা কারা ওকে নিয়ে যাচ্ছে ! মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসেছিল কেবল । তারপরই অনুভব করেছিল যে তার চেতনা ধীরে ধীরে কমে আসছে। তারপর অনেকটা সময় নওরিনের কোন হুস ছিল না। যখন ঘুম ভাঙ্গল দেখতে পেল একটা ঘরের বিছানাতে শুয়ে আছে । কিছুটা সময় মনেই করতে পারল না যে কোথায় আর কেন আছে। তবে কিছু সময় পার করতেই সব মনে পড়ে গেল ওর । ভয়ের একটা স্রোত বয়ে গেল পুর শরীর জুড়ে। কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না। তবে ভয়ের ভাবটা কিছু সময় পরেই কমে এল। তারপরেই সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। যে ঘরটাতে ওকে রাখা হয়েছে ওটা বন্দীশালা মনে হল না, বরং বেশ সুন্দর করে সাজানো। দেখে কারো শোবার ঘরই মনে হচ্ছে।
নওরিন যখন ভাবছিল যে পালিয়ে যাবে ঠিক তখনই খালেদ ঢুকল ঘরে। মানুষটাকে দেখেই সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল নওরিনের কাছে । বার কয়েক ওর মনেই হচ্ছিল যে ওকে কেবল একজনই তুলে নিয়ে আসতে পারে । হাতের ইশারাতে ওকে ঘরর বাইরে বের হয়ে আসতে বলল। একবার মনে হল যে খালেদের কথা সে শুনবে না । এই ঘরেই বসে থাকবে। কিন্তু তারপরেই মনে হল এখানে ওর কোন জেদ চলবে না । কিছুই করার নেই ওর । বিছানা থেকে নেমে খালেদের পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে গিয়ে হাজির হল । সেখানেই দেখতে পেল সেই আসল মানুষটাকে দেখতে পেল । বর্তমান সরকারের ছাত্রনেতা রাশেদ ।
ওর দিকে তাকিয়ে রইলো হাসি মুখে। নওরিন বসল সামনের সোফাতে । রাশেদ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে কতবার ডাক দিলাম । এলে না তো !
ভয়ে ভয়ে নওরিন নিজেকে খানিকটা শান্ত করার চেষ্টা করল । ও আজকে ওর অবস্থা কী হবে? ব্যাপারটা ভাবতেই ওর কান্না চলে এল । এতো সময় যে কান্না আটকিয়ে রেখেছিল সেটা আর পারল না। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল । সামনের এই মানুষটা ওর সাথে কী করবে সেটা নওরিন জানে খুব ভাল ভাবেই।
-আমাকে যেতে দেন!
-যদি না দেই?
নওরিন কী বলবে খুজে পেল না । সত্যিই তো ওকে যদি না যেতে দেয় তাহলে তো ওর কিছুই করার নেই। নওরিন এরই ভেতরে দেখল রাশেদ এগিয়ে এল। ভয়ে নওরিন নিজের চোখ বন্ধ ফেলল । আবারও ফুঁপিয়ে কেদে উঠল । রাশেদ বেশ কিছুটা সময় সেদিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা যে ভয় পেয়েছে সেটা আর ওকে বলে দিতে হয় না। এখন চাইলেই রাশেদ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, যা ইচ্ছে জোর খাটাতে পারে কিন্তু চাইলেই সবার সাথে জোর খাটানো যায় !
রাশেদ বলল, ভয় পেও না। তোমাকে কিছু করব না! তুমি না চাইলে তোমার গায়ে হাতও দেব না।
নওরিন এবার চোখ খুলল। রাশেদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে সে আসলেই সত্যি কথা বলছে কিনা ! কান্না ভেজা কন্ঠেই বলল, আমি হলে যাব !
রাশেদ বলল, এখন কিভাবে যাবে? এখন তো রাত । হলের গেট বন্ধ হয়ে গেছে! সকাল বেলা যেও ! রাতের খাবার টেবিলে রাখা আছে। খেয়ে শুয়ে পড়। ভয় নেই। কেউ কিছু করবে না।
-আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?
রাশেদ লম্বা একটা সময় কোন কোন কথা বলল না। সে এক ভাবে নওরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল, আজকে আমার খুব কাছের একজন বন্ধু মারা গেছে। এতো অস্থির লাগছিল যে কোন ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না । তারপর মনে হল যে তোমার দিকে যদি কিছু সময় তাকিয়ে থাকি তাহলে হয়তো শান্ত হবে!
নওরিন সত্যিই অবাক হল। রাশেদের কাছ থেকে এমন উত্তর সে আশা করে নি একদমই। আর রাশেদ যে সত্যি কথা বলছে সেটা যে মিথ্যা নয় সেটা রাশেদের চোখের দিকে তাকিয়েই নওরিন খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে। তখনই নওরিনের ভয়টা কমে এল । সে শান্ত ভাবে রাশেদের দিকে তাকাল । তবে রাশেদ আর বসল না । ওকে ঘরের ভেতরে রেখেই দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।
একটু পরে খালেদ ঢুকল ঘরে । খালেদের হাতে একটা কোকের বোতল । ওর দিকে একটু তাকিয়ে সে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেল । সেটা সেখানে রেখে আবারও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তখনই নওরিনের অনুভব হল যে ওর খুব বেশি ক্ষুধা লেগেছে । এতো সময় ভয়ে এতো উত্তেজিত ছিল যে খাওয়ার কথা মনে ছিল না।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে । গিয়ে দেখতে পেল সেখানে সুলতান থেকে আনা কাচ্চির প্যাকেট । সুলতানের কাচ্চি যে নওরিনের খুব বেশি পছন্দ সেটা কি রাশেদ জানে? না জানলে কেন নিয়ে এল ? নাকি পুরো ব্যাপারটাই কাকতালিও?
নওরিন অবশ্য আর চিন্তা করল না । পেট পুড়ে খেয়ে নিল।
পরের দিন সকালে খালেদ নওরিনকে পৌছে দিল । ও ভেবেছিল সকালে হয়তো রাশেদের সাথে দেখা হবে তবে দেখা হল না। নওরিনকে মোহাম্মাদপুরের বসিলা ব্রিজ পার হয়ে একটা বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বাড়িটা নদীর ধারে । নওরিনের হঠাৎ মনে হল চারিপাশটা একটু ঘুরে দেখে। বললে হয়তো ঘুরে দেখাও যেত তবে কেন যেন একটা সংকোচ হল । তাই আর বলল না।
পরের কিছু দিন নওরিন দেখল যে রাশেদ একটা বারের জন্যও ওর সামনে এল না । ক্যাম্পাসে তাকে প্রায়ই দেখা যেত । তবে ওর দিকে কোন মনযোগ দিতো না । এমন একটা ভাব করে যেন ওকে চেনেই না। এমন কি রাশেদের কোন সাঙ্গপাঙ্গও ওকে জ্বলাতন করা বন্ধ করে দিল । রাশেদ যে ওর পেছনে লেগেছে এটা ক্যম্পাসের অনেকেই জানে।
তারপর একদিন ক্যাম্পাসে বেশ বড় রকমের একটা ঝামেলা হল । দুই রাজনৈতিক দলের মাঝে সেই মারামারি । সেটা চলল প্রায় পুরো দিন ধরেই। দুইদিন পরে যখন সব কিছু শান্ত হল তখন জানা গেল যে রাশেদদের দলের বেশ কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি। এবং এর ভেতরে রাশেদ নিজেও আছে। ক্যাম্পাস থেকে অনেকেই হাসপাতালে দেখতে গেল তাকে । অবশ্য দেখতে যাওয়াটাই স্বাভাবিক । সবাই তার নেক নজরে পড়তে চায় । হাসপাতালে দেখতে যাওয়া মানে তার প্রতি একটা ভালবাসা দেখানো।
খালেদ দেখা করতে এল পরের দিন। নওরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যাবে দেখতে?
-আমি কেন যাবো? আপনার বস আপনাকে পাঠিয়েছে?
-না । তার অবস্থা এখনও খারাপ । দিনের বেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়েই থাকে । মাথায় আঘাত লেগেছে । একটা হাতও ভেঙ্গেছে। কারো সাথে ঠিক মত কথা বলছে না। আমি এসেছি নিজ থেকে । তুমি গেলে তার ভাল লাগবে !
-তার ভাল লাগা না লাগা দিয়ে আমার কিছু করার নেই। মারা মারি করতে গেছে কেন ?
নওরিন দেখতে পেল খালেদের চেহারায় একটা রাগ ফুটে উঠল । তবে সে নিজেকে সামলে নিল । এই মেয়ের ব্যাপারে তার বড় ভাই খুব কড়া করে সাবধান করে দিয়েছে। কোন ভাবেই একে বিরক্ত করা যাবে না । খালেদ আর কিছু বলল না ।
দুই
নওরিন নিজের কাছেই সব কিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজের কাছেই প্রশ্ন করল যে এখানে সে কী করছে! কেন এসেছে?
ঐদিন খালেদ চলে যাওয়ার পর নওরিনীর মনে অদ্ভুত একটা চিন্তা এসে হাজির হয়েছিল । কিছুতেই সে শান্তি পাচ্ছিল না । কোন কারণ নেই তবে বারবার মনে হচ্ছিল যে ওর হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ । কেন উচিৎ সে জানে না তবে উচিৎ এটাই কেবল জানে । প্রথমে ভেবেছিল যে বিকেলের দিকে আসবে । তবে এই সময়ে প্রচুর লোক থাকে । সবার সামনে ওর আসা কোন ভাবেই সম্ভব না। সাতটার দিকে কেবিনের সামনে এসে হাজির হল । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বড় করে দম নিল । তারপর আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ।
দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেল তাকে । বিছানাতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিছানার পাশে একটা সোফাতে একজন মহিলাকে দেখতে পেল । দরজা খুলে ঢুকতেই ওর দিকে তাকাল । বলে দিতে হল না যে এই মহিলা রাশেদের মা । নওরিন কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না । এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে বুঝতে পারছে না ।
হাতের ইশারাতে ডাকল ওকে । নওরিন ভেতরে হেটে গেল তার কাছে। ওর দিকে তাকিয়ে রাশেদের মা বলল, বস ।
নওরিনের তখনই একটা লজ্জা ভাব ফুটে উঠল । কারণ রাশের মায়ের চেহারার ভাব দেখেই ওর কাছে মনে হল যে নওরিনকে সে চেনে । অন্তত মুখ তো চেনেই । তার মানে রাশেদ কি ওর কথা নিজের মায়ের কাছে বলেছে !
কী লজ্জার ব্যাপার।
ঘন্টা খানেক কেবিনে বসে রইলো সে। এই সময়ে অবশ্য রাশের ঘুম ভাঙ্গল না । এক হিসাবে নওরিন একটু খুশিই হল । ঘুম ভাঙ্গলেই বরং লজ্জার পরিমানটা বাড়তো ।
এরপর আরও দুইজন নওরিন দেখা করতে গেল । অবশ্য এক দিনও রাশেদের সাথে কথা হল না । রাশেদের মাকে সে অনুরোধ করল যেন তার আসার কথা রাশেদকে না জানানো হয় । হাসি মুখে তিনি সেটা মেনেও নিলেন।
আরও মাস খানেক পরে রাশের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল । আরও দিন পনের পরে সে ক্যাম্পাসে এল । সেদিন নওরিনের ডাক পরল । নওরিনের একবার মনে হল যে সে মানা করে দেয় । কারণ মানা করে দিলে কিছুই হবে না সেটা সে ভাল করেই জানে । তবুও কেন জানি দেখা করতে ইচ্ছে করল সে । ক্লাস শেষ ক্করে গিয়ে হাজির হল কাঠাল তলাতে।
-কী খবর তোমার?
নওরিন শান্ত কন্ঠে বলল, ভাল। আপনার কী খবর ?
-দেখতেই পাচ্ছো?
কিছু সময় নিরবতা ! তারপর রাশেদ বলল, আমাকে দেখতে গিয়েছিলে?
নওরিন বলল, আপনাকে কেন দেখতে যাবো ?
যদিও খুব চেষ্টা করছে যে নিজের চেহারায় একটা কাঠিন্য ভাব ধরে রাখতে । তবে পারছে না সে জানে কারণ সামনের মানুষটার মুখ হাসি হাসি ।
-আন্টি বলেছে?
রাশেদ হাসতে হাসতে বলল্ম না মা বলে নি। খালেদ তোমাকে দেখেছে হাসপাতালে যেতে !
-আপনাকে দেখতে যাই নি। আমার এক আত্মীয় ছিল । তাকে দেখতে গেছি !
খুব যেন মজা পেয়েছে এমন ভাব করে রাশেদ খুব জোড়ে হেসে উঠল । তারপর বলল, বুঝতে পেরেছি।
নওরিন আর দাড়াল না । সোজা হাটা দিল নিজের হলের দিক । ওর খুব বেশি লজ্জা লাগছে । কেন জানি মনে হচ্ছে লজ্জার কোন ব্যাপার জেনে গিয়েছে কেউ ! দ্রুত হাটতে লাগল নিজের হলের দিকে । ওর মুখটা যে লাল হয়ে গেছে লজ্জায় সেটা যে কেউ দেখলেই বলে দিতে পারবে ।