তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে আরেকবার বলল
-তো তুমি যাবা না ? সিওর ?
-আরে আমি ওখানে গিয়ে কি করবো শুনি ? তুমি থাকবা নিজের কাজে ব্যস্ত । এমন না যে আমি ওখানে তোমার সাথে ঘুরতে যাচ্ছি ! আমি এখানে নিজের কাজ ফেলে যাবো ?
তৃষার মুখে একটা দুষ্টামীর হাসি দেখতে পেলাম । তারপরই সে বলল
-আচ্ছা না গেলে আর কি ! তবে ধর যে আমি একা যাচ্ছি । ঐদিনে ভদ্রলোক আবার দেখতে বেশ চমৎকার তার উপর স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছে । তোমাদের পুরুষ মানুষদের তো বিশ্বাস নেই । ধর….।
তৃষা খুব ভাল করেই জানে আমাকে ঠিক কোন জায়গাতে ধাক্কা দিতে হয় । আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
-থাক থাক । ধরাধরি বাদ দাও । আগে দাড়াও ছুটি ম্যানেজ করে নিই । একদিন হলে চলবে তো !
-আরে একদিন হলেই চলবে । যাবো । কাজ করবো তারপর চলে আসবো ।
-তোমার মত আর আমার না । চাইলেই ছুটি পাওয়া যায় না ।
তৃষা কেবলই হাসলো । কারণ সে খুব ভাল করেই জানে সেখানে সে যতদিনই থাকুক না কেন আমিও তার সাথে সেখানে ততদিনই থাকবো । তাকে ছেড়ে নড়বো না ।
এবার বায়ারের সাথে ঢাকাতেই ডিলটা হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু মাঝখান দিয়ে একটা ঝামেলা বেঁধে গেল । তার নাকি শরীর খারাপ হয়ে গেছে । বিছানায় পড়ে আছেন । এদিক দিয়ে সব কিছুই তৈরি কেবল মুখোমুখিএকটা সাক্ষাত হলেই বাকি কাজ হয়ে যাবে । কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না ভদ্রলোকের হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ার কারণে । তিনি এখন ঢাকা নেই । তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকছেন একটু শান্তির জন্য । তাই তৃষা ঠিক করেছে সেখানে গিয়েই সব কিছু ঠিক করে আনবে । আর তার সাথে তাই আমাকেও যেতে হবে ।
কি আর করা ! বউ বলে কথা !
ভদ্রলোকের নাম আহমেদ শরীফ । গাজিপুরে তার বিশাল বড় কাপড়ের ফ্যাক্টারি আছে । তার বাসাটা গাজিপুরের আরও ভেতরে । ঘন্টা দুয়েকের পথ । দুপুরের মধ্যেই আমরা সেখানে পৌছে গেলাম । বাড়িট নাম আন্দরমহল । আহমেদ শরীফের গ্রামের এই বাড়িটাকে ঠিক বাসা বলা চলে না । এটা একটা বিশাল রাজ প্রাসাদ । গাড়ি থেকে নেমে কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই বাড়িটার দিকে । দুইতলা বিশাল অট্টালিকা । ডান দিকে সান বাঁধানো বিশাল পুকুর । তারপরেই বেশ কিছুটা বন । প্রকৃতিক কোন জঙ্গল না । মানুষের বানানো জঙ্গল । আর বাড়ির বাঁ দিকে একটা ছোট্ট ও্য়্যার হাউজের মত দেখতে পেলাম । তার তার পাশেই একটা কুয়া । তবে কুয়ার মুখটা কাঠ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে । সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বাগান বাড়ি । বাড়ির সব থেকে বেশি যে জিনিসটা ভাল লাগছে সেটা হচ্ছে নির্জনতা । এতো নির্জন পরিবেশে অনেক দিন আসা হয় নি ।
একজন খানসামা আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন । আমাদেরকে তার পেছন পেছন আসতে বলল । আমরা খানসামার পেছন পেছন সেই প্রাসাদে প্রবেশ করলাম । খানসামার কাছ থেকেই জানতে পারলাম এতো বড় বাড়ি সব সময় খালিই পড়ে থাকে । মাঝে মাঝে আহমেদ শরীর আর তার স্ত্রী এসে থাকেন এখানে । তবে কদিন আগে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই আহমেদ শরীফ এখানেই আছেন । কাজ কর্ম ঠিক মত দেখছেন না । দুই ছেলে আর এক মেয়ে আছে তাদের । তারা সবাই দেশের বাইরে থাকেন । বলতে গেলে এই মাঝ বয়সে এসেই তিনি একেবারে একা হয়ে গেছেন ।
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই আমার কাছে কেমন যেন একটা গুমট অনুভূতি হতে লাগলো । একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল তবে সেটা কি আমি জানি না । বাইরের পরিবেশটা চমৎকার ছিল কিন্তু ভেতরের পরিবেশটা আমার কাছে ভাল লাগলো না । এমন কি বাইরে থেকে প্রসাদ দেখতে যতখানি বড় মনে হয়েছিলো ভেতরে ততখানি মনে হল না । আমরা খানসামার পেছন পেছন হাটতে হাটতে একটা বড় প্যাসেজের মধ্যে এসে পড়লাম । সেটারই দেওয়ালে একটা বড় ছবি টাঙ্গানো । দেখলাম তৃষা সেখানেই দাড়িয়ে গেছে । ওর দেখা দেখি আমি নিজেও দাড়িয়ে গেলাম ।
বিশাল ওয়েলপেইন্টিং । একজন সম্ভ্রান্ত চেহারার পুরুষ দাড়িয়ে আছে । ঠিক তার সামনে চেহারে বসে আছে একজন সুন্দরী মহিলা । এরা যে সেটা বুঝতে আমাদের মোটেই কষ্ট হল না ।
আমাদেরকে দাড়িয়ে পড়তেই খানসামা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল
-বড় সাহেব । আর তার মেম সাহেব ।
আমরা ছবিটার দিকে আরও কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে আবারও হাটতে লাগলাম । তবে আমার মনে সেই গুমট ভাবটা কিছুতেই গেল না । বারবার মনে হতে লাগলো কিছু একটা যেন ঠিক নেই । কিন্তু সেটা যে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না । তবে মনে মনে এটা ভেবে শান্তি পাচ্ছিলাম যে আমি তৃষার সাথে আছি । ওকে একা এখানে আসতে দেই নি ।
আমাদেরকে রুমে রেখে খানসামা চলে গেল । আর বলে যে স্যারের শরীরটা সকাল থেকে ভাল নেই । উনি বলেছেন বিকেল বেলা আমাদের সাথে কথা বলবেন । তখনই সব কাজ কর্মের কথা শেষ হবে ! আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । সাথে করে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে এসেছি। যদিও আমাদের রাতে এখানে থাকার কোন ইচ্ছে নেই । বিকেলে কাজ শেষ হলে ফিরতে ফিরতে রাত হবে । তবে সেটা খুব একটা সমস্যা হবে না আশা করি ।
আমি কিছুটা সময় ঘরের মধ্যে পায়চারি করে তৃষাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে চলে এলাম। সেখানে গিয়ে বসলাম । পুকুর পাড়ে বসতেই সব গুমট ভাবটা কেটে গেল । আমি শান্ত নিটল পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললাম
-এই পানিতে গোসল করে খুব আরাম পাওয়া যাবে !
তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আরাম ?
-হুম ! একেবারে প্রাকৃতিক পানি । জানো ছোট বেলাতে এমন পুকুরে কত ঝাপাঝাপি করেছি । ঘন্টার পর ঘন্টা ! এখন আর সেই পুকুর নেই ।
তৃষা বলল
-এখানে নামো ।
-এখানে ? না বাবা দরকার নেই । যে পানির চেহারা, মনে হচ্ছে খুব ঠান্ডা হবে । আর এই পুকুরে ডুব দিলে ঠান্ডা লেগে যাবে নিশ্চিত । আর জানোই তো যদি ঠান্ডা লাগে আমার বউ আমাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে ।
কিছু কিছু বলতে গিয়েও বলল না । কেবল আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো । যেন আমার কথা শুনে ও খুব মজা পেয়েছে । সান বাঁধানো পুকুর পাড়েই বসে রইলাম ওর হাত ধরে । সকাল বেলা যে আসতে চাইছিলাম না, এখন মনে হচ্ছে না আসলে খুব বড় মিস হয়ে যেত ।
বিকেল বেলা সব কাজ কর্ম শেষ হয়ে গেল । পুকুর পাড়েই আমাদের মিটিংটা হল । আহমেদ শরীফ খুবই অমায়িক মানুষ । আমাদের জন্য সব কিছুই সহজ করে দিলেন । তারপর খুব করে অনুরোধ করতে লাগলেন যেন আমরা তার এখানে আরও দুটোদিন থেকে যাই । কিন্তু আমার ইচ্ছে করলো না । এই পুকুর পাড়ে বসে বসে থাকার পরে আমরা যখনই ঢাকার দিকে রওনা দিতে যাবো তখনই বিপত্তি বাঁধলো । আকাশ ভেঙ্গে ঝড় শুরু হল । শরীফ সাহেব আমাদের আমাদেরকে আর বাইরে যেতে দিল না ।
তৃষার অবশ্য এখানে থাকতে কোন সমস্যা ছিল না । আমারও ছিল না । তবে একটা ব্যাপার নিয়ে একটু যেন খুঁতখুতে ভাব কাজ করছিলো । বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে আমার যেন ভাল লাগছিলো না । কেমন একটা অশুভ অনুভূতি হচ্ছিলো । সেটা অবশ্য তৃষাকে বলতে পারলাম না । বললে ও হয়তো হাসাহাসি করবে । তৃষা অস্বাভাবিক কোন কিছুতেই ভয় পায় না ওর বক্তব্য হচ্ছে সব কিছুরই একটা ব্যাখ্যা আছে । আমি শুক্রবার ভুত এফএম শুনি বলে ও আমাকে নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে । তাই ওকে কিছু বললাম না ।
রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল তৃষার ডাকে । আমি ঘুম থেকে উঠে কিছু সময় বুঝার চেষ্টা করলাম আমি কোথায় আছি । তারপরই সব মনে পড়লো । পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার । বাইরে তখনও ঝড় হচ্ছে । আমরা যখন রাতে ঘুমাতে যাই তার আগেই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিলো । বাড়ির নিজেস্ব জেনারেটরে আলো জ্বলছিলো । তবে এখন সেটাও কোন কারনে বন্ধ । আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি হয়েছে ?
-তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছো ?
আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম । আসলেই একটা আওয়াজ হচ্ছে । কেউ যেন কোথাও ধাক্কা দিচ্ছে । আমি বললাম
-বাইরে ঝড় হচ্ছে তো । সম্ভবত গাছের কোন ডাল কিছুর সাথে ধাক্কা লাগছে ।
তৃষার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমার সেটা মনে হচ্ছে না । আরেকটু ভাল করে শুনো । আওয়াজটা বাইরে থেকে নয় ভেতর থেকেই আসছে ।
আসলে আমার সেটাই মনে হচ্ছে যে আওয়াজটা বাইরে থেকে নয় বরং বাড়ির ভেতর থেকেই আসছে । তৃষা বলল
-আমার বাড়ির ভেতরে ঢুকার প্রথম থেকেই কেমন যেন লাগছিলো ।
এবার আমি খানিকটা অবাক হলাম । আমারও ঠিক এই অনুভূতি হয়েছিলো । দুজনের যখন একই অনুভুতি হয়েছিলো তখন মনে হল যে এখানে কিছু একটা সমস্যা ঠিকই হয়েছে । আমরা দুজনেই বাইরে বেরিয়ে এলাম ।
পুরো বাসাটা একদম যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে । আমি আর তৃষা একে অন্যের হাত ধরে হল ওয়েতে বেরিয়ে এলাম । আমাদের হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট টা জ্বালানো । আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি । আমাদের হাতের ফ্ল্যাশের আলোতে বলতে গেলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না । ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর সেই আলোর কিছুটা অংশ ঘরের ভেতরে আসছে । আমরা যতই এগিয়ে যেতে শুরু করলাম ততই আমাদের কানে সেই আওয়াজটা বাড়তে লাগলো । বাইরের ঝড়ের আওয়াজ ছাড়াও সেই আওয়াজটা আমরা দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম ।
আমরা দুজনেই সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম । দুজনেই আস্তে আস্তে এগোচ্ছি । আমার একটু একটু অস্বস্তি লাগা শুরু করেছে । ঠিক জানি না কারনটা কি । তবে সব থেকে বেশি চিন্তা হচ্ছে তৃষা কে নিয়ে । বিপদ যদি আসে সেটা আমার উপর দিয়ে আসুক । ওর কিছু হলে সেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না । আমার হাতটাকে ও শক্ত করেই ধরে রেখেছিলো । আমার হাতের উপর উপর ওর হাতের চাপের ধরণ থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম যে ও নিজেও বেশ ভয় পাচ্ছে ।
যদিও ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই । আমাদের দুজনেরই উচিৎ নিজেদের বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া । কিন্তু কিছু একটা আছে যেটা আমাদের দুজনকেই ঘুমাতে দিচ্ছে না । এই বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথেই আমাদের দুজনেরই একই কথা মনে হয়েছে যে এই বাসায় কিছু একটা ঠিক নেই । এখন আমাদের দুজনেরই মনে হচ্ছে এই আওয়াজটা সাথে সেই কিছু একটা ঠিক না থাকার একটা সম্পর্ক আছে । লম্বা প্যাসেজের সামনে আসতেই আমরা দুজনেই যেন জমে গেলাম । কারন তখনই একবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো । আর আমরা দুজনই সেটা দেখতে পেলাম । তৃষাও ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস কারন সেই সময়ে ও আমার হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরেছে । আমরা দুজনেই তাকিয়ে দেখি আমাদের থেকে কিছুটা একজন দাড়িয়ে আছে । কেবল দাড়িয়েই নেই, দেওয়ার সাথে নিজের মাথা ঠুকছে । আওয়াজটা সেখান থেকেই আসছে !
একজন মহিলা !
সকাল থেকে আসার পর একটা ব্যাপার আমরা দুজনেই জানতে পেরেছি যে এই বাসাতে কোন মহিলা নেই । আরও ভাল করে বলতে গেলে এই বাসাতে কেবল দুজন মানুষ থাকে । আহমেদ শরীফ আর তার কাজের মানুষটা । এখন আমরা দুজন আছি । এই চারজনই এখন বাসায় আছি ।
তাহলে এই মহিলা কে ?
মহিলা বড় সেই ওয়েল পেইন্টিংটার ঠিক উল্টোদিকে দাড়িয়ে থেকে দেওয়ালের সাথে মাথা ঠুকছে । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । কিছুটা সময় কেটে গেল । তৃষা তখনই একটা কাজ করলো । সে মহিলার উদ্দেশ্যে চিৎকারে উঠলো । বলল
-হ্যালো
এমন একটা পরিস্থিতিতে তৃষা যে হ্যালো বলে উঠতে পারে আমি সেটা ভাবতেই পারি নি । ওর হ্যালো শুনে আমি নিজেই চমকে উঠলাম । ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ও মহিলার দিকেই তাকিয়ে আছে । আমি আবারও সামনে দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকালাম । মহিলা ততক্ষণে আমাদের দিকে তাকিয়েছে । বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে আমি মহিলার চেহারাটা দেখতে পেলাম ।
মহিলাকে আমার চিনতে কষ্ট হল না । ওয়েল পেইন্টিং আহমেদ শরীফের পাশে এই মহিলাই দাঁড়িয়ে ছিল ।
ইনি আহমেদ শরীফের স্ত্রী !
তার মানে কি ?
এই মহিলাকে আমরা দুজেনই দেখছি কেন ?
আহমেদ শরীফ বলেছিলো তার স্ত্রী নাকি তাকে ছেড়ে গেছে । কিন্তু তাহলে আমরা তাকে কেন দেখছি ?
তার মানে হচ্ছে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে যায় নি । তার স্ত্রী মারা গেছে । আর সম্ভবত তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে ।
তৃষার আমার দিকে ঝট করে তাকালো । অন্ধকারের মাঝেও আমি ওর চোখের দুত্যি দেখতে পেলাম । আমার মোটেই বুঝতে কষ্ট হল না যে আমার মনে ঠিক যে চিন্তাটা এসেছে ওর মনেও ঠিক একই চিন্তা এসেছে ।
খুনি কে ?
আহমেদ শরীফই !
সামনের মহিলা হাটতে শুরু করলো । কিছু দুরে হেটে একটু দাড়ালো । আমাদের দিকে তাকালো । আমরা বুঝতে পারলাম যে সে আমাদের হাতের ইশারায় তার পেছন পেছন আসতে বলছে । তারপর আবারও হাটতে শুরু করলো ।
আমরা আবারও দুজন দুজনের দিকে তাকালাম । তারপর হাটতে শুরু করলাম সেই মহিলার পেছনে । ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম । বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহিলা বাঁ দিকে গেল । আমার বুঝতে কষ্ট হল না মহিলা কোন দিকে যাচ্ছে । বাঁ দিকের ওয়্যার হাউজের সামনে যে কুয়াটা দেখেছিলাম সেখানেই গিয়ে থামবে সে । হলও তাই । সেখানেই থামলো । কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো সেদিকে ।
আমি যদি এই বাড়িতে কাউকে মেরে ফেলতে চাইতাম তাহলে তার বডিটা আমি ঠিক ঐ কুয়াটার ভেতরেই ফেলতাম । আহমেদ শরীফও ঠিক একই ভাবে তার স্ত্রীর মৃতদেহটাকে এখানে লুকিয়ে ফেলেছে । তারপর গল্প ফেঁদেছে যে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে ।
-আপনারা বাইরে কি করছেন ?
আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম । তাকিয়ে দেখি দোতলার একটা বারান্দা থেকে একটা মুখ ভেসে উঠেছে । তবে অন্ধকারে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না । আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম যে সেটা আহমেদ শরীফ । এতো রাতে আমরা দুজন এখানে কি করছি সেটার কোন ব্যাখ্যা আমার মাথায় এল না । তৃষা তখন চিৎকার করে বলল
-আমরা একটু ভেজার চেষ্টা করছি । ঢাকাতে তো এমন বৃষ্টি পাওয়াই যায় না ।
আহমেদ শরীফ যেন একটু হাসলো । তারপর বলল
-বেশি ভিজবেন না । ঠান্ডা লেগে যেতে পারে !
-আচ্ছা !
আমি তৃষার দিকে ফিরে তাকালাম । তৃষার রাত বিরাতে বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস আজকের নয় । রাতে বৃষ্টি হলেই তার বেজা চাই ই চাই !
আমি তাকিয়ে দেখি সেই মহিলাও কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে । আমরা কেবল একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । এতো সময় ধরে আমরা কার পেছনে হাটলাম সেটা আমরা কেউ ই বলতে পারবো না । তবে যদি চোখের ভুল হয় তাহলে এক জনের হবে । দুইজনই একই সাথে যখন একই জিনিসকে দেখলাম তখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা ভুল দেখি নি ।
তারপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত । সকালবেলাই তৃষা পুলিশকে খবর দেয় । কুয়ার মুখ খুলতেই একটা তীব্র দুর্ঘন্ধ নাকে এসে লাগে । সেখান থেকেই মিসেস শরীফের পচা গলা লাশটা বের করে আনা হয় ।
একটু ভয় ছিল যে আহমেদ শরীফ একজন টাকাওয়ালা মানুষ । ভেবেছিলাম তিনি অনেক হম্ভিতম্ভি করবে কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম তেমন কিছুই করলেন না । বরং ওনার মুখ দেখেই মনে হল ব্যাপারটাতে তিনি যেন একটু খুশিই হয়েছেন । স্ত্রী যে কোন কারনে তার হাতে খুন হয়েছিল। তারপর তিনি সেটা ধামা চাপাও দিয়েছিলেন কিন্তু একটা অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো । এই জন্যই হয়তো আমরা যখন পুলিশ ডেকেছিলাম তিনি আমাদের উপর রাগ করেন নি ।
গাড়িতে করে ফিরে আসার সময় আমি তৃষাকে বললাম
-রাতে আমরা দুজনে যা দেখেছি তার ব্যাখ্যা কি ?
তৃষা আমার দিকে তাকালো না । অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-হয়তো আমাদের হ্যালুসিনেশন হয়েছিলো ।
-দুজনের এক সাথে ?
-হ্যা । ঐ কুয়া তারপর কুয়ার মুখ আটকানো সেই সাথে শরীফ সাহেবের স্ত্রী চলে যাওয়া সব মিলিয়ে আমাদের ব্রেনের নিউরন গুলোকে বেশি উত্তেজিত করেছে আমাদের অজান্তেরই । হয়তো কোন ক্যামিকেল রিএকশন হয়েছে . সেখান থেকেই এই গল্প সাজিয়েছি । আর তুমি তো জানো তোমার গল্প পড়ে পড়ে আমিও বুঝতে পারি যে তুমি এরপর কি ভাবতে পারো । সেই জন্য দুজনে হয়তো একই জিনিস দেখেছি ।
আমি বললাম
-বুঝলাম ! তুমি আমার বউ না হয়ে মিসির আলীর বউ হলেই ভাল করতে ।
তৃষা হেসে বলল
-নাহ । মিসির আলী আমাকে সামলাতে পারতো না । দুদিনেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেত !
-সত্য !
দুজনেই হেসে উঠলাম ।
গল্পটা পুরানো । তৃষার গল্পে প্রকাশিত হয়েছিল।