অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কফির কাকে চুমুক দেওয়া নওরিনের অভ্যাস। আজকেও নিজের ডেস্কে বসে সেই কাজই করছিল। সকালের শুরুটা একটু কাপের চাপ থাকলেও লাঞ্চ আওয়ারের পরে কাজের চাপ একটু কম থাকে। সেই সময়ে কফির চুমুক দিতে নওরিনের বেশ লাগে। আজও সেই একই কাজ করছিল। হাতে কোন কাজ না থাকায় কফির কাপ নিয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে নানান ওয়েবসাইটে ব্রাউজ করছিল। ঠিক এই সময়ে পাশে বসা লিনা বলল, এই নওরিন!
-কী হল?
-আজকে শায়ান চৌধুরীর কনসার্ট আছে, যাবে নাকি?
-নাহ ! আমি কনসার্ট ভাল লাগে না । এতো মানুষের ভীড় আমার ভাল লাগে না।
লিনা নওরিনের দিকে এমন চোখে তাকাল যেন সে অন্য কোন গ্রহের প্রাণী। অবশ্য ব্যাপারটা একেবার অস্বাভাবিকও না। শায়ান চৌধুরীর কনসার্টে যেতে না চাওয়া কোন মানুষ বিশেষ কোন মেয়ে এই দেশে আছে বলে লিনার জানা নেই। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কোন দেশের প্রানী গো বাপু ?
নওরিন বলল, ঐ লোকের গান শুনতে যাব না বলে আমি অন্য দেশের মানুষ হয়ে গেলাম?
-হ্যা, হয়ে গেলে !
তারপর মুখের ভাবটা এমন করল যেন নওরিনের সাথে কথা বলাই ঠিক হয় নি । নওরিন অবশ্য আর লিনার দিকে মনযোগ দিল না। সে কফিটা শেষ করে নিজের কাজে মনযোগ দিল । মনে মনে একটু মুচকি হাসল । অফিস সহ সব জায়গাতে এই অনাগ্রহের ভাবটা ধরে থাকতে নওরিনের বেশ মজাই লাগে। সে মনে মনে ভাবে যে যখন সবাই আসল সত্যটা জানতে তখন কী হবে?
শায়ান চৌধুরীকে চেনে না এমন কোন মানুষ এই দেশে আছে বলে নওরিনের জানা নেই। নওরিনও তাকে চেনে খুব ভাল করে । এবং সত্যি বলতে তার অনেক গানই নওরিনের পছন্দ । তবে যে কথাটা বাইরের অনেকেই জানে না যে শায়ান চৌধুরী নওরিনের স্বামী ! এই কথাটা যখন বাইরের মানুষ জানবে তখন যে কী হবে সেটা নওরিন ভাবতেও পারে না।
এখনও নওরিনের কাছে পুরো ব্যাপারটা একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হয় । ওর কাছে মনে হয় যে এমন করে আসলে কেউ কারো প্রেমে পড়তে পারে না যেভাবে শায়ান ওর প্রেমে পড়েছিল।
পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই শায়ানের সাথে ওর দেখা হয়। ঠিক দেখা হয় বললে ভুল বলা হবে। শায়ান ওকে দেখে। তখনও শায়ান এতোটা বিখ্যাত হয়ে ওঠে নি। টুকটাক গান গাইতো। আর নওরিন বিশ্ববিদ্যালয় থাকতেই ওর নাচতো । শিল্পকলার সাথে যুক্ত ছিল । শায়ানের গানের আগে নওরিনের নাচ ছিল।
নাচ শেষ করে নওরিন ব্যাকস্টেজ থেকেই শায়ানের গান শুনছিল। সত্যি বলতে বেশ ভাল লাগছিল তার। নওরিন নিজেকে বিশ্ব সুন্দরী মনে করে না। তবে দেখতে শুনতে সে ভালই বলা যায় । চেহারায় একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে।
মূলত তারপর থেকেই শায়ানের নাম ফুটতে শুরু করল । একেবারে বছর খানেকের ভেতরেই শায়ান বিখ্যাত হয়ে উঠল । বেশ কয়েকটা একক গান ছাড়ল নিজের ইউটিউবে। বেশ কয়েক কনসার্ট করল । সবগুলো একেবারে হিট। তার লেখা গানগুলো সবার মুখে মুখে চলতে লাগল ।
নওরিন অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। তবে একদিন নওরিনকে অবাক করে দিয়ে নওরিনের সামনে এসে হাজির হল শায়ান। ওর ফোন নম্বর কোথা থেকে সে পেল জানে না । হয়তো কোন ভাবে যোগার করেছে। প্রথমে নওরিনের একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এতো বিখ্যাত একজন গায়ক কিনা তার সাথে কথা বলতে ফোনে ওর সাথে কথা বলতে চাইল । প্রথমে দেখা না করতে চাইলেও পরে রাজি হল।
একান্তে কথা বলার জন্য শায়ান একটা রেস্টুরেন্টের কেবিন ভাড়া করেছিল যাতে ওদের কথা বলার সময় কেউ কোন রকম ঝামেলা না করতে পারে। নওরিন যখন সেই কেবিনে গিয়ে হাজির হল তখনও ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না শায়ান চৌধুরী ওর সামনে বসে আছে।
কিন্তু তারপরে শায়ান যা বলল তা শুনে নওরিনের বিস্ময়টা আরও একটু বেড়ে গেল । শায়ান বলল, আমার এই সব কিছু কেবল তোমার জন্য ?
কথাটার মানে ঠিকমত বুঝতে না পেরে নওরিন বলল, মানে ঠিক বুঝলাম না।
-তোমার মনে আছে তুমি একবার তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে নেচেছিলে? এই বছর খানেক আগে । আমিও সেখানে ছিলাম । তোমার নাচের পরেই আমার গান ছিল!
-হ্যা হ্যা মনে আছে। সেদিন আমি সুন্দর গেয়েছিলেন।
-ওটাই ছিল তখনও পর্যন্ত আমার সব থেকে সেরা পারফর্মেন্স । কেন ছিল জানো?
-কেন?
-তোমার জন্য ! তোমাকে দেখা পরে আমার ভেতরে কী যে পরিবর্তন এল সেটা আমি নিজেও বলতে পারব না। তারপর থেকেই আমার উত্থান । তারপর থেকে আমার সব গান সব লেখা সব কিছু তোমাকে কেন্দ্র করে। আর কিছু না ।
বিস্মিত ভাবে নওরিন সেদিন কেবল শায়ানের কথা শুনছিল । মনের ভেতরে একটা তীব্র দ্বিধা জন্মালো । এসব তার কাছে মোটেই স্বাভাবিক মনে হল না । সেদিন শায়ান আরো অনেক কিছু বলেছিল । অনেক কিছুই নওরিনের মাথায় ঢোকে । সেই নাকি শায়ানের ইন্সপিরেশন আরও কত কিছু !
এরপরে শায়ান আরও কয়েকবার ওর সাথে দেখা করতে চাইলেও নওরিন নানান অযুহাতে সেটা মানা করে দিয়েছিল। একেক বার মানা করতো আর শায়ানের নতুন নতুন বিরহের গান আসতো । সেটা আরও হিট হত !
শেষে শায়ান ওর বাবা মাকে নিয়ে একেবারে নওরিনদের বাসায় এসে হাজির । সরাসরি নওরিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় । ব্যাপারটা এতোটাই আকস্মিক ছিল যে নওরিন প্রথমেই মানা করে দেয় । পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দেয় যে কোন ভাবেই সে এখন বিয়ে করবে না। আর শায়ানের মত কাউকে তো করবেই না।
কারণ হিসাবে বলেছিল যে এতো বিখ্যাত মানুষের সাথে বিয়ে করার কোন ইচ্ছে তার নেই । তাকে বিয়ে করলে নওরিনের নিজের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। সে সারা জীবন হয়ে যাবে কেবল শায়ানের বউ। আর স্বাভাবিক ভাবে সে এই যে বড় হয়েছে, ঘুরে বেড়িয়েছে, এটা তার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে । নওরিন এই ব্যাপারটা হারাতে চায় না। ও সাধারণ মানুষই থাকতে চায় । বিখ্যাত কেউ হতে চায় না, বিখ্যাত কারো বউ হতে চায় না সে !
নওরিন ভেবেছিল হয়তো ঝামেলা শেষ হয়েছে। শায়ান চলে যাবে ওর জীবন থেকে । কিন্তু মাস ছয়েক পরেই এমন একটা ঘটনার কথা সে জানতে পারল যে তীব্র ভাবে বিস্মিত না হয়ে পারল না । সেইদিন ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিল। রিক্সার জন্য যখন অপেক্ষা করছিল তখন একটা সাদা রংয়ের গাড়ি এসে থামল ওর সামনে । সেখান থেকে একজন ভদ্রমত মহিলা নেমে এলেন। তারপর নওরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সাথে কিছু সময় কথা বলা যাবে?
প্রথমে একটু অবাক হল। এই মহিলাকে ঠিক চিনতে না পারলে একটু পরে তাকে চিনে ফেলল। শায়ান সেদিন তার মাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল ওদের বাসায়।
শায়ানের মায়ের গাড়িতে উঠে বলল নওরিন । তারপর নানান কথা জানতে চাইল। এবং সব থেকে বড় বিস্ময়কর কথা যেটা নওরিন জানতে পারল সেটা হচ্ছে, শায়ান চৌধুরী গান ছেড়ে দিয়েছে । সে এখন একজন সাধারণ মানুষ হতে চায় । সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে । চাকরি পেলেই সে তোমাকে বিয়ে করার আবার আসবে।
নওরিন এই ব্যাপারটা জানার পরে এতোটাই অবাক হয়ে গেল যে শেষ পর্যন্ত সে শায়ানের কাছে যেতে বাধ্য হল । তবে একটা শর্ত দিল যে ওদের বিয়ের ব্যাপারটা কোন ভাবেই বাইরে প্রকাশ করা যাবে। ওদের দেখা হবে গোপনে।
শায়ানের কোন আপত্তি ছিল না । খুব গোপনেই ওদের বিয়ে হল । সংসারও শুরু হল গোপনে । তারপর থেকে সব কিচু গোপনেই চলছে। এই যেমন আজকে বিকেলে কনসার্ট আছে সেটার কথা নওরিন জানে আগে থেকেই। এটাও জানে যে কনসার্ট শেষ করে সোজা সে নওরিনের কাছেই আসবে । নওরিন অফিসের কাছেই একটা ফ্লাটে থাকে । এটাই ওদের বাসা । প্রতিদিন রাতের বেলা শায়ান আসে । ছুটির দিন গুলোতে ওরা বাসায় সময় কাটায় এক সাথে।
গতমাসে শায়ানের একটা কনসার্ট ছিল অস্ট্রেলিয়াতে । ঠিক এই সময়েই নওরিনও অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘুরে এল । বলাই বাহুল্য ওরা একই প্লেনে গেলেও ওরা যে পরিচিত এটা কেউ টের পেল না। থাকলও একই হোটেলে । রাতে হোটেলের কামরাতে ঢুকেও পড়ল । কনসার্ট শেষ করে পুরো দল চলে গেলেও ব্যক্তিগত কারণে দেখিয়ে শায়ান রয়ে গেল । আরও চারদিন পরে ফিরল সে । এই পুরোটা সময় শায়ান ওকে নিয়ে। সময়টা খুব চমৎকার কাটল ওর । মনের ভেতরে তখন সেই ইচ্ছেটা আবার ফিরে এসেছিল। যদি সে কোন সাধারণ মানুষকে বিয়ে করত তাহলে এভাবে বাইরে তার স্বামীকে নিয়ে ঘোরাফেরা করা যেত। ফেসবুকে ছবি দেওয়া যেত । কিন্তু তারপরেই আবার নিজের মনকে বুঝে দিয়েছে। নওরিন খুব ভাল করেই জানে যে জীবনে সব ইচ্ছী পুরণ হয় না । শায়ান ওকে যেভাবে ভালবাসে সেই রকম ভালোবাসা অন্য কারো পক্ষে যে সম্ভব না সেটা নওরিন খুব ভাল করেই জানে। তাই এই ইচ্ছেটা সে মেনেই নিয়েছে। তবে সেই সাথে এটাও জানে যে কোন না কোন ওদের এই বিয়ের কথা মানুষ জন জেনে যাবেই। তখন আসলে কী হবে সেটা নওরিন নিজেও জানে না । তবে এখন সেই সময়ের কথা নিয়ে ভাবে না ।
আজকে কী করবে সেটা আরেকবার চিন্তা করল । চাইলে শায়ানের কন্সার্টে যাওয়া যায় । শায়ান সব সময় ওর জন্য ভিআইপি গ্যালারির একটা টিকিট রেখে যায় । চাইলেই যাওয়া যায় । একেবারে সামনে থেকে শায়ানের গান শুনতে পারবে ও তবে নওরিন কখনই যায় না। শায়ান অনুরোধ করলেও না। নওরিনের কথা হচ্ছে যে সে শায়ানের অন্য সবার সামনে শুনতে ওর ভাল লাগবে না। শায়ান যখন কেবল তার জন্যই গান গাইবে তখনই সে কেবল শুনবে। অন্য কোন সময় নয় !
অফিস থেকে একটু দেরি করেই বের আজকে সে। আজকে শায়ানের বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে । আগে আগে বাসায় ফিরে ওর কোন কাজ নেই। একবার মনে হল পুরানো কোন বন্ধুকে ফোন করে আড্ড দেয় কিছু সময় । তবে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিল। আপন মনে রাস্তা দিয়ে হাটতে লাগল । প্রায়ইস এ এই কাজটা করে থাকে। আপন মনে একা একা হাটতে থাকে । কোন নির্দিষ্ট দিকে না। যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে। তবে সব সময় চেষ্টা করে যেন যেদিকে গাড়িঘোড়া কম থাকে সেদিকে যেতে। গাড়ির হর্ণ ওর একেবারেই পছন্দ না। হাটতে হাটে তাই নির্জন রাস্তার দিকে হেটে গেল সে। কানে হেডফোন । শায়ানের গানই সেখানে বাজছে। আপন খেয়ালেই মত্ত । তাই খেয়াল করল না একটা মাইক্রো ওর পিছু নিয়েছে। নিশ্চুপ ভাবে গাড়িটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
যখন নওরিন বুঝতে পারল ততক্ষণে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। শক্ত দুটো হাত নওরিনকে চেপে ধরল তারপর তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে মাইক্রোতে তুলে নিল। নওরিন এতোটাই বিস্মিত হল যে মুখ দিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত করতে পারল না । বিস্ময়ের স্থানে যখন ভয় এসে জড় হতে শুরু করেছে ঠিক সেই সময়ে অনুভব করল ওর মুখে একটা রুমাল চেপে ধরা হয়েছে।
দুই
নওরিন জানে ওকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। বেশির ভাগ সময়ে ওকে ঘুম পাড়িয়েই রাখা হয়েছে। কতগুলো দিন যে পার হয়ে গেছে সেটা নওরিন জানেও না। প্রতিদিনই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ওকে জাগিয়ে তোলা হয়, তারপর ওর সামনে খাবার রেখে দেওয়া হয়। প্রথম কয়েকদিন ভেবেছিল রাগ করে খাবে না । তবে একটা সময়ে প্রচন্ড খিদের কারণে খেতে বাধ্য হয়েছে। এভাবেই দিনের পর দিন ওকে আটকে রাখা হয়েছে। ওর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করছেন না কেউ কোন কথাও বলছে না। নওরিন কোথায় আছে সেটা ও জানে না। আর কেউ জানে কিনা নওরিন সেটাও বলতে পারে না । দিন দিন নওরিন দিন ক্ষণের হিসাব হারিয়ে ফেলল । কতদিন ওকে আটকে রাখা হল সেটা ও বলতে পারল না।
তারপর যখন নওরিন নিজের মুক্তি আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে ঠিক সেই সময় নওরিনকে ওরা ছেড়ে দিল। সেদিন সকাল বেলা ওকে ঘুম থেকে তুলল । তারপর ওকে নাস্তা করিয়ে গাড়িতে তুলল। নওরিন কেবল অবাক হয়ে ভাবছিল যে ওর সাথে আসলে কী হচ্ছে । এক সময়ে ওকে বাইরে বের করে নিয়ে গাড়িতে তুলল । এই সময়ে নওরিনের চোখ বাঁধা ছিল না । তবে যে কয়জন ওর সাথে ওদের সবার মুখে মাস্ক পরা ছিল। তাই কাউকে সে চিনতে পারল না। তারপর ঢাকা ময়মনসিংহ হাইওয়ের মাঝখানে গাড়িটা থামিয়ে ওকে নামিয়ে দিল । নামানোর আগে ওর হাতে ওর ব্যাগটা তুলে দিল। ওকে কোন কথাই না বলে গাড়িটা চলে গেল উল্টো দিকে । কিছু সময় নওরিন কেবল বোকার মত । কিছুইতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাগ খুজে ফোনটা খুজে পেল । তবে সেটা বন্ধ । ভেবেছিল হয়তো চালু হবে না কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়েই ফোনটা চালু হয়ে গেল। এবং সাথে সাথে কতগুলো নোটিফিকেশন যে এল তার কোন ঠিক নেই। সব কিছু বাদ দিয়ে সে সবার আগে ফোন দিল শায়ানকে । ফোনটা প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ হল । ওপাশ থেকে শায়ানের বিস্মিত কন্ঠ শুনতে পেল নওরিন !
তিন
পরের কয়েকটা দিন কিভাবে যে কাটল নওরিন সেটা বলতে পারবে না । বাসায় আসার পরে জানতে পারল প্রায় তিন মাস সে গুম ছিল। তবে কেন আর কারা তাকে গুম করেছিল সেটার ব্যাপারে কারো কোন ধারণা নেই।
কয়েক দফা পুলিশের সিয়াইডির সাথে কথা হল ওর । ওকে নানান রকম প্রশ্ন করল কিন্তু নওরিন কোন উত্তর ঠিক মত দিতে পারল না ।
এই তিন মাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে । শায়ান যে বিবাহিত এবং তার বউ যে কিডন্যাপ হয়েছে সেটা পুরো দেশের মানুষ জেনে গেছে । এমন কি নওরিনের চেহারাও এখন সবাই জানে। এই তিন মাসে শায়ান বেশ কয়েকটা গান লিখেছে এবং গেছে । শায়ান জানাল যে ওকে হারানো কষ্ট ভুলে থাকার জন্যই এই গান গুলো লিখেছে সে । সেই গান গুলো খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিয়ে হয়েছে জেনে অনেক নারি ভক্তের আগ্রহ কমে যায় সাধারণত তবে এখানে তেমন কিছু হয় নি রবং ওর গানের জনপ্রিয়তা যেন আরও বেড়েছে।
নওরিন আরও দুইটো মাস একেবারে বাসার ভেতরেই থাকল । এই দুই মাসের প্রায় পুরোটা সময় শায়ান ওর সাথেই রইলো। এবার ওদের এক সাথে থাকার এই ছবি শায়ান নিজেই নিজের ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিত, স্টোরী দিত। সেই স্টোরিতে হাজার হাজার রিএকশন পড়তো। নওরিনের কেন জানি ভালই লাগল । ওর নিজের ফেসবুক ফলোয়ারের সংখ্যাও হুহু করে বেড়ে চলল। তারপর আস্তে ধীরে ওর জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করল । নতুন একটা চাকরি ঢুকল সে আরও মাস তিনেক পরে। এবং সেখানেই সবাই জানে যে নওরিন শায়ানের স্ত্রী। এখন আর রাকঢাকের কিছুই নেই।
কিন্তু এখনও নওরিন ঠিক জানে না যে ওকে সেই দিন কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তবে একদিন নওরিনের মনে একতা অদ্ভুত চিন্তা এসে হাজির হল । একটা টিভি সিরিজ দেখছিল দেখছিল । যেখান থেকেই সে মিউজের ব্যাপারটা জানতে পারে। নিজের সাথে এই মিউজের একটা মিল খুজে পেল। শায়ানের একজন শিল্পী আর মিউজরা হচ্ছে শিল্পীদের ইনস্পারেশন । সিরিজের একজন রাইটারের ব্যাপারে এমন ভাবেই দেখানো হয়েছে।
নওরিনের সাথে দেখা হওয়ার আগে শায়ান একেবারে সাধারন একজন শিল্পীই ছিল। ওকে দেখার এবং ওর কাছে আসার পরেই শায়ানের শিল্পী সত্ত্বার বিকাশ ঘটে। এরপর যখন শায়ানকে ও বিয়ে করতে রাজি হল তখন বেশি কিছু হিট বিরহের গান উপহার দিল । তারপর বিয়ের পরে অনেক গুলো রোমান্টিক গান লিখল সে। এখন ও যখন গুম ছিল সেই সময়ে বেশ কিছু বিরহের গান এল। নওরিন কিছু একটা মেলার চেষ্টা করল যেন । এমন কি হতে পারে ওকে ঠিক এই কারণেই কিডন্যাপ করেছিল কেউ?
কে করতে পারে?
বিশেষ করে কিডন্যাপ করলেও ওর কোন ক্ষতি কিন্তু করা হয় নি। এমন কি কিডন্যাপারটা ওর সাথে বিন্দু মাত্র খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করে নি। ওকে কোন একটা বাগান বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল । যদিও ওকে নিজের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় নি তবে শেষ দিন যখন ওকে নিয়ে বের হল সেদিন বাড়িটার একটা ঝলক সে দেখতে পেয়েছিল। বাড়িটা কার হতে পারে?
কেবল একটা নামই মনে আসল ওর ! রাফাত হাসান । শায়ান যে মিউজিক কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সেই কোম্পানীর মালিক ।
নিজের সন্দেহের কথা সে শায়ানকে বলল না । কারণ খুব ভাল করেই জানে যে যদি এই কথা শায়ান জানতে পারে তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে। তবে কৌশলে শায়ানকে বাগানবাড়ির কথা জানতে চাইল । শায়ানের নিজেরও একটা বাংলো বাড়ি রয়েছে গাজিপুরে। তবে নওরিন সেখানে যেতে চাইলো না । বলল, অন্য কোথাও যাওয়া যায় না ?
তারপর মনে মনে কাঙ্খিত কথাটা শুনতে চাইল । একেবারে প্রথম বারেই শায়ান সেই কথাটাই বলল, রাফাত ভাইয়ের একটা বাংলো বাড়ি রয়েছে । দাঁড়াও খোজ নিয়ে দেখি ওটা ফাঁকা আছে কিনা !
সাথে সাথেই নওরিন মানা করল । বলল, না খোজ নিতে হবে না । চল যাই !
-আরে খোজ না নিয়ে যাবো কিভাবে ! ফাঁকা থাকলে যাব নয়তো চলে আসব । চল চল !
শায়ান একটু অবাক হল বটে । তবে মানা করল না। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। সন্ধ্যার কিছু আগে সে বাংলোবাড়িটাতে পৌছালো ।
গেটের কাছে আসতেই দারোয়ান কে শায়ান নিজের পরিচয় দিয়ে বলল তার মালিককে ফোন দিতে । নওরিন গেট দিয়ে যখন ভেতরে ঢুকল তখন পরিস্কার ভাবেই চিনতে পারল জায়গাটা । এটা সেই জায়গা !
দারোয়ান এসে জানালো যে মালিক অনুমূতি দিয়েছে। ওরা ভেতরে আসতে পারে।
নওরিন ঠিক সেই ঘরটাই খুজে পেল যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল। নওরিন এবার খানিকটা বুঝতে পারল যে কেন ওকে কেউ খুজে পায় নি । কেউ কখনও কল্পনাই করতে পারবে না যে নওরিনকে রাফাত হাসানের বাংলো বাড়িতে রাখা হতে পারে। দারোয়ানের সাথে কথা বলে জানা গেল যে এখানে নতুন কাজে যোগ দিয়েছে। নওরিন সময়টা হিসাব করে দেখল যে সময়টা ঠিক ওর কিডন্যাপার পরে ।
পরদিন সকালে স্বয়ং রাফাত হাসান বাংলোবাড়িতে এসে হাজির হল। সকালে নাস্তার টেবিলে রাফাত হাসান যখন নওরিনের চোখের দিকে তাকাল তখন সেটা স্পষ্টই যে সে বুঝতে পেরেছে নওরিন সব কিছু জেনে গেছে।
পরিশিষ্ট
-আমি যদি ওকে বলে দিই কী হবে একবার ভেবেছেন?
বিকেল বেলা ওরা তিনজন পাশের গ্রামে হাটতে বের হয়েছিল। শায়ান মাঠে ফুটবল দেখতে নেমে গেল । এই ফাঁকে নওরিন রাফাত হাসানের সাথে একা কথা বলার সুযোগ পেল।
-তোমার কাছে কোন প্রমান নেই।
-প্রমানের দরকার নেই। আমি কেবল বললেই হবে । হবে না? আপনিও জানেন সেটা !
কিছু সময় চুপ করে থেকে রাফাত হাসান বলল, হ্যা আমি জানি। কিন্তু তুমি দেখো ওর জনপ্রিয়টা এখন কতটা ! তোমার বিহরে ও যে কয়টা গান লিখেছে সেগুলো সব হিট । অথচ তোমার সাথে যখন ছিল তখন সেই সময় কেবল প্রেমের গান । একটাও বিরহের গান নেই । এই ধাক্কাটা ওর দরকার ছিল। আমি ওর ভালর জন্যই করেছি। আর আমি সব সময় খেয়াল রেখেছি যেন তোমার কোন ক্ষতি না হয় !
নওরিনের নিজের মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা দ্বিধা কাজ করল । মনের একটা অংশ বলছে এখনই শায়ানকে সব কিছু বলে দিয়ে বেটাকে জেলে ঢোকার ব্যবস্থা করে আবার অন্য অংশ বলছে যে রাফাতের ভালর জন্যই সে সব কিছু করেছে এবং ফলও সেই রকমই পাওয়া গেছে । দিন দিন রাফাতের জনপ্রিয়তা বাড়ছেই !
নওরিন আর কোন কথা বলল না । উঠে দাড়াল । এখানে আর থাকার কোন ইচ্ছে নেই। তবে রাফাত হাসানের ব্যাপারে সে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি ।
গল্পটা আপাতত এখানেই শেষ। একজন মানুষের জীবনে অন্য একটা মানুষ খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে একজন মানুষের সংস্পর্শ পুরোপুরি ভাবে পরিস্ফুটো অরে তুলতে পারে আবার একেবাএ ধ্বংশ করে দিতে পারে। অনেক আগে একটা গল্প লিখেছিলাম যেখানে মেয়েটির প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায় ছেলেটিকে ভালোবাসার কারণে, কাছাকাছি থাকার কারণে। তারপর দুরে যখন চলে যায় তখন আবার ফিরে আসে সেই প্রতিভা ! যাই হোক, প্রিয় পাঠিক নওরিনের এখন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ? সব কিছু বলে দেওয়া উচিৎ নাকি বলা উচিৎ না !