রকিবের অগ্নি মূর্তি দেখে দিশা কিছুটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিয়ের পরে আজকে প্রায় ৫ বছরে রকিব এই প্রথমবার তার উপরে এমন ভাবে রাগ দেখালো। রকিব আবার কঠিন কন্ঠে বলল, তুমি এখনই ব্যাগ গোছাবে। এখনই আমার সাথে বাসায় যাবে।
দিশা কিছু সময় হতবিহব্বল হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল। সে জানে রকিব কোন ভাবেই ওকে এখান থেকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না। দিশা বলল, আমি যাবো না। আমি এখানেই থাকব।
-দেখো দিশা ভাল হবে না বলছি ।
-যতই ভাল না হোক। আমি এই বাসায় থাকব।
-তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে ডিভোর্স দিব। তোমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখব না।
দিশা এবার সত্যিই তিব্র বিস্ময় নিয়ে তাকাল রকিবের দিকে। রকিব যে ওকে এমন একটা কথা বলতে পারে সেটা দিশা মোটেই ভাবতে পারে নি। আর তখনই ওর মনে সেই সন্দেহটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। রকিব কেন ওকে নিজের বাসায় রাখতে এতো উতলা?
মনে মনে আরো দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিল যে সে কোন ভাবেই এবার রকিবের সাথে ফিরে যাবে না।
দিশা বলল, ডিভোর্স দিবে? দাও। তবুও আমি যাব না।
দিশার এই মনভাব দেখে রকিব একটু দ্বিধায় পড়ে গেল । রকিব ভেবেছিল ডিভোর্দের কথা শুনে দিশা হয়ত ভয় পেয়ে যাবে আর ওর সাথে ফিরে যেতে রাজি হবে। কোন নারী এই সময়ে চাইবে না স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হতে। তবে দিশার ভাব দেখে সেটা মোটেই মনে হল না।
রকিব আরও কিছু সময় হম্বিতাম্বি করল বটে তবে কাজ হল না । এই সময়ে দিশার বাবা আফজাল মিয়া ঘরে ঢুকে রকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ও যখন যেতে চাইছে তুমি কেন জোর করছো?
-আব্বা আপনি বুঝতে পারছেন না, ওকে যেতেই হবে।
-আমি সব কিছুই বুঝতে পারছি। আমি শুধু বুঝতে পারছি না যে তুমি কেন এতো উতলা ওকে নিয়ে যেতে। এই সময়ে মেয়েরা বাবার বাড়িতে থাকে। এই সময়ে ওর বেশি বেশি যত্ন দরকার।
-আপনি কি বলছেন যে আমি ওকে যত্ন করি না। আমি দেখা শোনা করি না?
-আমি সেটা বলছি না। কিন্তু মেয়ে বাচ্চা হওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে যত্ন পায় সেটা স্বামী দিতে পারে না তা তুমি যতই ভাল দেখা শোনা কর না কেন। আর পরপর দুইবার একই ঘটনা ঘটার পরে আমি আর এই রিস্ক নিবো না। আমার মেয়ে এখানেই থাকবে। তুমি দরকার হয় নিয়মিত দেখে যাবে ওকে। খুব তো বেশি দূরে না বাসা?
রকিব এবার সত্যিই রেগে গেল। চিৎকার করে বলে গেল যে সে পুলিশ নিয়ে এসে নিজের বউকে নিয়ে যাবে। এখানে কোন ভাবেই তার বউ থাকবে না।
দিশা এবার নিজের বাচ্চার ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক। পরপর দুইটা বাচ্চা একেবারে শেষ মুহুর্তে মারা গেছে। পুরোটা সময়ে বাচ্চার কোন সমস্যা ছিল না। দিশা নিজেও কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় নি। সব কিছু স্বাভাবিক ছিল অথচ পরপর দুইবারই মৃত বাচ্চা প্রবস করেছে সে । দিশা ব্যাপারটা মোটেই মেনে নিতে পারে নি। তাই যখন তৃতীয়বার দিশার পেটে বাচ্চা এল তখন সে এক প্রকার জোর করেই নিজের বাবার বাসায় চলে এল। কোন ভাবেই সে শ্বশুরবাড়িতে এই সময়ে থাকবে না। প্রথম কয়েকদিন তার স্বামী রকিব অনুরোধ করলেও যতই দিন পার হতে লাগল, দিহা যতই ফুলে উঠলে লাগল ততই রকিব যেন মরিয়ে হয়ে উঠতে শুরু করল। যে কোন ভাবেই সে দিশাকে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে চায়। এটাই দিশার মনে আরও সন্দেহের উদ্রেক ঘটালো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল যে কোন ভাবেই সে স্বামীর বাসায় বাচ্চা হওয়াবে না। এইবার নিজের বাসাতেই থাকবে।
এরপরে প্রায় দিনই রকিব এসে হাজির হত দিশাদের বাড়িতে। সে যেকোন ভাবেই দিশাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু দিশা কোন ভাবেই যাবে না। দিশার মনে যেন একবানে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল যে আগের দুটো বাচ্চা মারা যাওয়ার পেছনে তার স্বামীর হাত রয়েছে। কিভাবে সেই হাত রয়েছে সেটা দিশা জানে না, তবে তার মন চিৎকার করে তাকে এই কথাই জানান দিচ্ছে।
তবে রকিব একেবারে ভয়ংকর কাজ করে ফেলল যখন দিশাকে জোর করে তুলে নিয়ে আসার জন্য কয়েকজন লোক ভাড়া করে নিয়ে এল। তবে ভাগ্য ভাল যে দিশা দরজাই খোলে। তার বদলে পুলিশকে ডাক দিল। পুলিশ যথা সময়ে চলে আসার পরে সে যাত্রায় দিশা রক্ষা পায়।
দুই
দুঃসংবাদটা এল ঠিক এই ঘটনার পরের দিন। ঐদিন পুলিশ এলেও দিশা কিংবা তার বাবা কেউই চান নি পুলিশ রকিবকে ধরে নিয়ে যাক। কেবল ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। আর রকিব যেন আর তার বাসায় না আসে। অন্তত ডেলিভারির আগ পর্যন্ত যেন কোন ভাবেই না আসে । তবে বাচ্চা হওয়ার পরে সে বাচ্চাকে দেখতে আসতে পারবে।
তবে সেই দিন আর এল না। রকিব যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছিল তখন সে দিশার দিকে করুন চোখে তাকাল। সে বুঝতে পেরেছে যে তার আর কোন ভাবেই দিশাকে নিয়ে যেতে পারবে না। দিশার মনে হল রকিব যেন হঠাৎ করেই ভীষণ ভীত হয়ে গেছে।
খবরটা এল পরের দিন দুপুরবেলা। তার শ্বাশুড়ি ফোন দিয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল যে তার ছেলে অর্থ্যাৎ রকিব মারা গেছে।
তিন
হুজুর সাফেদ উদ্দিন অনেকটা সময় ধরেই ঘরের ভেতরে বসে রয়েছে। চোখ বন্ধ করে তিনি কিছু পড়েই চলেছেন। তারপর এক সময়ে চোখ খুলে তিনি তাকালেন দিশার দিকে। ঘরে দিশা আর দিশার বাবা আফজাল মিয়া রয়েছে। দিশার মা ঘরের এক কোণার দিয়ে রয়েছেন।
হুজুর বললেন, না আপনারা যা ভাবছেন তেমন কিছুই না। অন্তত দিশা মায়ের সাথে কিছু নাই।
আফজাল মিয়া বললেন, কিন্তু প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা ?
হুজুর এই কথার বিপরীতে কিছু বলতে পারলেন না। কেবল বললেন, সেইটা আমি নিজেও জানি না। তবে ওর সাথে এখন কিছু নাই, এইটা কইতে পারি। এমন হইতে পারে যে রাইতে রাইতে ওর কাছে কোন জ্বীন আইতেছে। কিন্তু কেন আইতেছে এইটা দেখার বিষয়। এমন তো হওয়ার কথা না যদি না……
কথাটা বলতে গিয়ে হুজুর থেমে গেলেন। আফজাল মিয়া সাথে সাথে বললেন, যদি না?
হুজুরকে এবার কিছুটা চিন্তিত মনে হল। তারপর সে আরেকবার দিশার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা তোমার আগে দুইটা বাচ্চা মারা গেছে? পেটে থাকতেই?
দিশা মন খারাপ করেই বলল, জ্বী।
-বাচ্চার কোন সমস্যা ছিল না কিংবা তোমার?
-না । আমার কিংবা বাচ্চার কোন সমস্যা সমস্যা ছিল না। সুস্থ স্বাভাবিক ছিলাম । আমি নিয়মিত চেকআপ করাতাম।
হুজুর এবার আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন । তারপর বলল, একটা ব্যাপার হইতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত না করে কিছুই বলতে পারতেছি না। তাই এখন বলব না। তবে চিন্তার কোন কারণ নেই। যদি সেইটা হয়তো তবুও ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি এর ব্যবস্থা নিতেছি।
হুজুর আর বেশি সময় দাড়ালেন না। রাতের খাবার দেওয়া হল। খাওয়া শেষ করে হুজুর দিশার ঘরটা ভাল করে দোয়া পড়ে বন্ধ করে দিলেন। তারপর দিশাকে নানান রকম পরামর্শ দিয়ে গেলেন।
তবে দিশার মন থেকে ভয় কিছুতেই চলে গেল না। দিশার এখন সব কিছুই কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়।
সেদিন রকিবের মৃত্যু সংবাদ শুনে সে ছুটে গিয়েছিল স্বামীর বাড়ি। বাসায় প্রবেশের সাথে সাথেই একটা তীব্র অস্বস্তি তার মনকে গ্রাস করে নেয়। মনে হয়েছিল যেন এই বাসাতেই কী যেন একটা অশুভ কিছু একটা রয়েছে, ওকে দেখছে। এতোদিনের পরিচিত বাসাটা দিশার কাছে একেবারে অপরিচিত মনে হচ্ছিল।
রাতে ঘুমানোর সময় নিজের ভেতরেই একটা শূন্য অনুভব করছিল। তার বাচ্চা জন্মের আগেই পিতৃহারা হয়ে গেল, এই অনুভূতিটা বারবার তাকে গ্রাস করছিল। সেই সাথে আরেকটা অনুভূতিও তাকে বারবার পীড়া দিচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল যে যদি সে রকিবের সাথে এই বাসায় আসত তাহলে হয়তো আজকে রকিব বেঁচে থাকত!
সেদিন রাতেই সে প্রথম স্বপ্নটা দেখতে পায়। স্বপ্নে দিশা দেখে যে তার ঘরে খাটের পাশে এক মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। আরও ভাল করে তাকিয়ে দেখলে দিশা বুঝতে পারল যে মহিলা আসলে তার পেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দিশার সাথে যখন মহিলার চোখাচোখি হল তখন মহিলা একটা হাসি দিয়ে বলল, তোর মাইয়াটা আমারে দে। ওইটা আমার !
দিশার ঘুম ভেঙ্গে গেল সাথে সাথেই। পুরোঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে আছে। একটু অবাক না হয়ে পারল না সে। দিশা কখনই একেবারে ঘর অন্ধকার করে ঘুমায় না। ঘরে ডিম লাইট জ্বলে । এছাড়া জানালা খোলা থাকার কারণে বাইরে থেকেও আলো আসে। কিন্তু এখন ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আছে। এতো অন্ধকার যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পারছে না। এই অন্ধকারের ভেতরেও দিশা অনুভব করল কেউ যেন ওর ঘরে রয়েছে। এই অনুভূতিটা দিশার মনে একটা তীব্র ভয়ের সঞ্চালন করল। মুখ দিয়ে আপনা আপনি একটা চিৎকার বের হয়ে এল। চোখ বন্ধ করে যখন আবার খুলল তখন অবাক হয়ে দেখতে পেল যে ওর ঘরের সেই ঘুরঘুটে অন্ধকার ভাবটা আর নেই। ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে। খোলা জানালা দিয়ে আলোও আসছে বাইরে থেকে। একটু পরে দরজা খুলে দিশার মাও ছুটে এল ঘরে।
দিশা আর একটা দিনও থাকে নি সেই বাসায়। পরের দিনই চলে এসেছে নিজের বাবার বাসায়। তবে সেই স্বপ্ন তার পিছু ছাড়ে নি। প্রায় প্রতিদিনই ঘুমের ভেতরে সে স্বপ্নটা দেখতে লাগল। যতদিন দিশার পেট বড় হচ্ছে তত সেই স্বপ্নটা যে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একদিন সব কিছু ছাড়িয়ে গেল। রাতের বেলা যক্ষন দিশা শুয়ে তখন সে অনুভব করে যে তার পেট ধরে কেউ যেন টানাটানি করছে। পেটের সামনের দিক দিয়ে চাপ দিয়ে নিচের দিকে নামানোর চেষ্টা করছে। দিশা ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবং ঘুম ভেঙ্গেই সে পেটে ব্যাথা অনুভব করতে শুরু করল। তখনই দিশার মনে হল যে তার পেটের বাচ্চাটা এখনই বের হয়ে আসতে চাইছে। জোরে একটা চিৎকার করে উঠল। তার ব্যাথা শুরু হয়েছে।
আফজাল মিয়া দ্রুত এম্বুলেন্স ডেকে দিশাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। যখন দিশাকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হল তখন দিশার অবস্থা বেশ সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। ডাক্তার দিশার অবস্থা দেখেই বলল ভেতরের বাচ্চাকে বের করতে হবে। দিশার ডেলিভারির ডেট আসতে এখনও মাস খানেক বাকি আছে। তবে ভেতরে নিশ্চিত ভাবে কোন সমস্যা হচ্ছে। রক্ত বের হচ্ছে। তাই এখনই সিজার করতে হবে।
সব কিছুর ব্যবস্থা করাআ হল। যখন দিশাকে ওটিতে নেওয়া হল তখনও দিশার জ্ঞান রয়েছে। দিশা তখন আবারও দেখতে পেল সেই মহিলাকে। ডাক্তারদের মাঝেই সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখের দিকে তাকিয়েই দিশার মনে তীব্র একটা ভয় এসে জড় হল। তার কেবলই মনে হল যে জ্ঞান হারানোর পরপরই এই মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে যাবে। দিশা নিজেকে যথা সম্ভব জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল।
দিশার পক্ষে এক সময়ে আর জ্ঞান ধরে রাখা সম্ভব হল না। তবে জ্ঞান হারানোর ঠিকা গে সে দেখতে পেল সেই মহিলা যে কিনা এতো সময় হাসছিল সে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকাল। তারপর সে এক লাফে বিপরীত পাশের দেয়ালের দিকে দৌড় দিলেন। দিশা আর কিছু মনে রইলো না। সে জ্ঞান হারাল।
চার
দিশা জ্ঞান ফিরল এক দিন পরে। জ্ঞান ফিরতে সে প্রথম যখন নিজের সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করল।
পাশেই দিশার মা বসে ছিল। সে দিশার দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় পাশ না। তোর মেয়ে ঠিক আছে। আপাতত চিন্তার কোন কারণ নেই। তবে এখন সে আইসিইউতে। আরও কয়েকদিন সেখানেই থাকবে। দিশার মনে তখন সেই চিন্তাটা আবার ফিরে এল। সেই মহিলাটা কোথায়? জ্ঞান হারানোর ঠিক আগেই সে দেখেছিল সে কাউকে কিংবা কিছু একটা সেই মহিলাকে সে পালিয়ে যেতে দেখেছিল। শেষ দৃশ্য এমন ছিল বলেই সে একটু যেন শান্তি পেয়েছিল। কিন্তু সেই মানুষটা কিংবা বস্তুটা কী ছিল ?
উত্তরটা পাওয়া গেল আরও একদিন পরে যখন হুজুর সাফেদ উদ্দিন এসে হাজির হলেন হাসপাতালের কেবিনে। দিশার দিকে তাকিয়ে হুজুর বললেন মা তোমার আর কোন বিপদ নেই। সব কিছু ঠিক আছে।
তখনই দিশার মনে হল সম্ভবত হুজুর সাহেবই সেদিন এসেছিলেন। দিশার মনের কথা যেন হুজুর সাফেদ উদ্দিন সাথে সাথেই বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, না মা আমি কিছু করি নি। তোমার অপারেশনের দিন অন্য একজন এসেছিল । তাকে দেখেই সেই জ্বীনটা পালিয়েছে।
-কে এসেছিল?
হুজুর হাসলেন। তারপর বললেন, এসেছিল। আমি নিজেও তার খুব একটা দেখা পায় না। সবার সাথে সে দেখাও করে না।
-বড় কোন হুজুর?
হুজুর এবারও দিশার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেল। তবে সে উঠে এসে দিশার বালিশের নিচে হাত দিয়ে এক একটা হলুদ লেবুর মত একটা ফল বের করে আনলেন। ফলটা দেখে দিশা বেশ অবাক হয়ে গেল। এটা তার বালিশের নিচে কে রেখে গেল।
হুজুর সাফেদ উদ্দিন বললেন ঠিক এই জিনিসটার কারণে সেই দুষ্ট জ্বীন তোমার ধারে কাছে আসতে পারে নি। এটা যতদিন তোমার আশে পাশে থাকবে ততদিন কোন খারাপ কিছু তোমার কাছে আসবে না। এমন একটা ফল তোমার মেয়ের বেডের কাছেও রাখা আছে।
দিশা ফলটা হাতে নিয়ে দেখল। সাধারণ কাগজি লেবু যেমন হয় এটাও ঠিক তেমনই। হাত স্পর্শ করার পরে মনে যেন এখনই গাছ থেকে এটা নিয়ে আসা হয়েছে। নাকের কাছে একটু শুকল সে। তাজা একটা মৃদু মোলায়েম গন্ধ নাকে এল।
-কী ফল এটা?
-কী ফল কোথা থেকে এটা এসেছে আমার জানা নেই। তবে এটা যতদিন তোমার আছে আছে ততদিন কোন ভয় নেই। এরপরই ভেতরেই ঐ অশরীরিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিশিষ্ট
সাফেদ উদ্দিন আস্তে আস্তে হাটছে। মূল সড়ক থেকে তার বাসাটা একটু ভেতরের দিকে। বাস থেকে নেমে এই রাস্তা টুকু চাইলেই রিক্সা করে আসা যায় তবে সাফেদ উদ্দিন এই পথ থেকে হেটে আসতেই পছন্দ করেন। আজকেও সেই একই ভাবে বাস থেকে নেমে সে নিজের বাসার দিকে হাটতে লাগল। ঠিক মাঝের দিকে এসেই সাফেদ উদ্দিনের মনে হল যেন সব কিছু থেমে গেল। সাফেদ উদ্দিন ভয় পেলেন না। এমনটা তার সাথে মাঝে মাঝেই হয়। দোয়া পড়তে যাবেন তখনই পেছন থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল।
-সাফেদ সাহেব।
কন্ঠটা তার পরিচিত। তবে প্রতিবার যখনই সে এই কন্ঠস্বরটা মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি কাজ করে। আজও তাই হল।
মানুষটা এসে তার পাশে দাড়াল। এই গলিতে সাধারতণ অন্ধকারই থাকে সব সময়। পাশে দাঁড়ানো মানুষটা সব সময় কালো পোশাক পরে থাকে। তাই মনে হয় যেন অন্ধকার ফুড়েই সে বের হয়ে এল।
-দিশাকে সত্যটা না বলার জন্য ধন্যবাদ।
সাফেদ উদ্দিন একটু মলিন কন্ঠে বললেন, আমি সত্যটা জেনে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি নাই। একজন বাবা কিভাবে কেবল নিজের স্বার্থের জন্য এভাবে নিজের সন্তানকে বলি দিতে পারে?
-ওটা ওদের বংশগত। ওদের পরিবারের সবাই এমন করেছে। এই জন্যই তো প্রভাব প্রতিপত্তি ওদের ছিল। সব ছিল সেই অপদেবতার থেকে প্রাপ্ত।
সাফেদ উদ্দিন পুরো ঘটনাটাই জানে। প্রায় দুইশ বছর আগে রকিবের এক পূর্ব পুরুষ এই অপদেবতার সাথে এই চুক্তিটা করে। অপদেবতা তাকে বলে যে তার পরপর তিন সন্তানকে সে নিয়ে যাবে যাবে বিনিময়ে যা চাইবে তাই পাবে, যে ব্যবসায় হাত দিবে সেই ব্যবসায় ফসল হবে। টাকা পয়সা জায়গা জমি প্রভাব প্রতিপত্তি সব পাবে সে। তবে যদি এই প্রক্রিয়া ব্যাঘাত ঘটে তবে তার পরিনাম হবে ভয়াবহ। তাকে খুব বেশি কিছু করতে হবেনা। কেবল এমন কি সন্তান জন্মের আগেই সে তার ভোগ নিয়ে যাবে। শুধু দুইটা কাজ কাজ করতে হবে। যখন সন্তান তার স্ত্রীর পেটে আসবে তখন তাকে একটা মন্ত্রপড়া পানি খাওয়াতে হবে এবং যখন পেটের ভেতরে সন্তান আট মাস হবে তখন কোন এক রাতে স্ত্রীর পেটের উপরে একটা চিহ্ন একে দিতে হবে। ব্যস আর কোন ঝামেলা নেই। বাকি কাজ সেই অপদেবতাই করে নিবে। রকিব পরপর দুইবার ঠিক একই ভাবে তার সন্তানকে তুলে দিয়েছিল। তবে শেষবার দিশা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে রকিবের আশে পাশে থাকলেই তার সন্তান আর বাঁচবে না। তাই অনেকটা জোর করেই নিজের বাবার বাড়িতে চলে এসেছিল সে। এরপরে অপদেবতার ভোগ মিস হয়ে যায়। পরিনামে অপদেবতা রকিবকে হত্যা করে।
সাফেদ উদ্দিন বললেন, আর সমস্যা হবে না তো পরে?
-না আর কোনো ভয় নেই। দিশার পেছনে ওটা আর কোন দিন আসবে না। আর দিশার যেহেতু মেয়ে হয়েছে তাই আশা করা যায় ওটা আর পিছু নিবে না। ছেলে হলে অবশ্য একটা ভয় ছিল। এবং রকিব বংশের শেষ ছেলে হওয়ার কারণে ওর সাথে সাথে সব কিছ শেষ হয়ে এসেছে। যদি রকিবের ছেলে হত তবে অবশ্য আবার একটা চান্স ছিল।
সাফেদ উদ্দিন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বলেন, আপনাকে ধন্যবাদ।
কালো পোশাক পরা মানুষটা কিছু বলে না। তবে সাফেদ উদ্দিন এক সময়ে খেয়াল করেন যে তার পাশে সেই মানুষটা আর নেই। সে যেভাবে নিরবে এসেছিল ঠিক সেভাবে চলে গেছে। তিনি অবাক হলেন না । কেবল নিরবে একটু হাসলেন।
এই গল্পটার মূল থিম আফনান ভাইয়ের একটা গল্প থেকে অনুপ্রানীত।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.