রিয়াদ তার সেক্রেটারি দিকে আরেকবার ভাল করে তাকাল। চোখে মুখে একটা দ্বিধা এখনও লেগে রয়েছে। এমন একটা কাজ সে করতে যাচ্ছে যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এমন কি এই কথা তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। হওয়ার কথাও না।
তার সেক্রেটারি মজিবুল রিয়াদের মনের ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে বলল, স্যার আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি নিজে যদিও ব্যাপারটা পরখ করি নি কিন্তু এমন সব মানুষের কাছ থেকে ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত হয়েছি তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আপনি আমাদের জেলার আজমল সাহেবকে চেনেন তো?
-ফেরিঘাট রোডে যার বড় আড়ত রয়েছে?
-জ্বী স্যার। তার মা মারা গেছে সম্প্রতি। লোকটা খুব মা ভক্ত ছিল। সে মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে যায়। কাজের পরে লোকটা মেয়েটাকে এক বস্তা টাকা দিতে চেয়েছিল। মেয়েটা নেয় নি। এমন কি একটা টাকাও নেয় নি। আপনি বলেন আজমল সাহেবের মত ঝানু ব্যবসায়ী কাউকে এমনি এমনি একবস্তা টাকা দিতে চায়? আর মেয়েটার বাবাও এই জেলার বড় ব্যবসায়ীদের একজন। তার মেয়ে টাকার জন্য এসব করবে না।
রিয়াদ আবারও কিছুটা সময় ভাবল। মনের দ্বিধা যেন কাটছে না। মজিবুল আবার বলল, স্যার এই রকম আরও অনেক ঘটনা আছে। সব চেয়ে বড় কথা মেয়েটা কারো কাছ থেকে একটা টাকাও নেয় না। এমন কি সবার বাসাতে যায়ও না। অনেক অনুরোধের পরে কারো কারো বাসায় যেতে রাজি হয়। আমি যদিও জানি না যে আপনার কথায় সে আপনার কাছে আসবে কিনা। তবে আপনি যদি না চান তাহলে আমি আপনাকে জোর করব না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করে একটা কাজ দিয়েছিলেন। আমি সেটা করেছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।
মজিবুল রিয়াদের সাথে রয়েছে অনেক দিন ধরেই। এর আগে রিয়াদ দুইবার পোস্টিং হয়েছিল। দুইবারই মজিবুলকে সে সাথে নিজের জেলাতে পোস্টিং করিয়েছে। মজিবুল তার জীবনের সব কিছুই জানে। এমন কি ডালিয়ার পরকিয়ার ব্যাপারটাও মজিবুল জানে খুব ভাল করেই জানে। মজিবুলই সব কিছু সামলেছে। কাউকে ব্যাপারটা জানতে দেয় নি।
রিয়াদ বলল, আচ্ছা ব্যবস্থা কর। মেয়েটাকে নিয়ে এসো। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।
মজিবুলের মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, জ্বী স্যার আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তবে সে যদি না আসতে চায় তাকে আনা যাবে না।
সপ্তাহ খানেক পরেই মজিবুল জানাল যে লিলির নামের মেয়েটা তার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে। তবে শর্ত একটাই যে এই একবারই কেবল সে আসবে। পরে আর সে আসবে না।
নির্দিষ্ট দিনে লিলি যখন এসে হাজির হল তখন রিয়াদ মেয়েটাকে দেখে একটু অবাকই হল। মেয়েটার বয়স খুব বেশি হবে না। লিলির নামের মেয়েটার বয়স যে এতো কম হবে সেটা রিয়াদ ভাবতেও পারে নি।
লিলি শান্ত চোখেই রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রিয়াদ জেলা টিওনো অফিসার। সবার তার সামনে কেমন একটা নতুজান ভাব নিয়ে থাকে অথচ এই মেয়েটার চোখে তেমন কোণ অভিব্যক্তি নেই।
রিয়াদ একটু হাসল। তারপর বলল, আসার জন্য ধন্যবাদ।
-ইটস ওকে। আসুন, শুরু করা যাক।
-মানে কিভাবে শুরু করা যাবে?
-আপনার স্ত্রীর ব্যবহারের কোন কিছু নিয়ে আসুন। তাতেই হবে। আর একটা পাটি নিয়ে এসুন। আমার সামনে এসে বসুন।
রিয়াদ তখনই অবাক হয়ে খেয়াল করল যে লিলি নামের মেয়েটা তাকে হুকুম করছে। আজকে সে মজিবুলকে সামনে রাখে নি। লিলিই নাকি বলেছে এই কাজে কেবল সেই সামনে থাকবে যে কথা বলবে। ঘরে আর কেউ থাকবে না।
রিয়াদ বিনা বাক্য ব্যয় করে আলমারি থেকে ডালিয়ার ব্যবহৃত একটা ওড়না নিয়ে এল। একটা পাটি মেঝেতে বিছিয়ে দিল। লিলি পাটিতে বসে ওড়নাটা হাতে নিল। তারপর রিয়াদের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, আপনি আমার সামনে এসে বসুন।
রিয়াজ চুপচাপ লিলির সামনে বসল। কিছু সময় কেটে গেল কোন কথা ছাড়াই।
রিয়াদ কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না। প্লানচেট টাইপের কিছু আশা করেছিল সে। ঘরের আলো বন্ধ করে মোম বাতি জ্বালিয়ে মন্ত্রটন্ত্র পড়া হবে ভেবেছিল কিন্তু সেই রকম কিছুই না। এখন দিনের বেলা একদম। এই দিনের বেলায় তার মৃতস্ত্রীর আত্মা এসে হাজির হবে ব্যাপারটা রিয়াদের কাছে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
রিয়াদের মনের কথা যেন লিলি বুঝতে পারল। সে চোখ না খুলেই বলল, যখন সে আসবে তখন আপনি এমনি এমনিই বুঝতে পারবেন। আর আবেগে ভেসে গিয়ে কোন ভাবেই যেন আমাকে ধরতে আসবেন না।
রিয়াদ কিছুটা বোকা বনে গেল। মেয়েটা ওর মনের কথা কিভাবে টের পেয়ে গেল? তারপরেই মনে হল যে এই মেয়েটা এই কাজই করে আসছে অনেক দিন ধরে। তাই এমন প্রশ্ন শুনেই সে অভস্ত্য । এই জন্য এমন কিছু একটা বলেছে। রিয়াদ আর কোন প্রশ্ন না করে চুপ করে রইলো। মেয়েটার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো।
এটা তার নিজের ঘর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে যারা ভুত বা আত্মা নামায় বলে দাবী করে তারা নিজেদের পছন্দের আবহ তৈরি করে ঘরে। তবে এখানে তেমন কিছুই হচ্ছে না। এই ঘরের উপরে লিলি নামের এই মেয়েটার কোন নিয়ন্ত্রন নেই। তার মানে মেয়েটা কোন ভাবেই তাকে ধোকা দিতে পারবে না। রিয়াদের মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি এসে জড় হল। নিজের কাছেই নিজেকে খানিকটা বোকা বোকা মনে হল। সে কি আসলেই এই কাজটা করতে যাচ্ছেন? এই বুঝরুকিতে বিশ্বাস আনতে যাচ্ছেন? এসব কি সম্ভব?
কিন্তু রিয়াদের আসল সত্যটা জানতেই হবে। ডালিয়া কেন এই কাজটা করলো? কেন সে রিয়াদের মত স্বামী রেখেও পরকীয়া জড়াল? মানুষ বলে প্রতিটা পরকিয়ার পেছনেই নাকি কোন না কোন কারণ থাকে। রিয়াদ এই কারণটাই জানতে চায়। সে জানতে চায় কেন ডালিয়া অন্য পুরুষের কাছে গিয়েছিল? সে তো তাকে সব দিক দিয়ে সবার থেকে সেরা ছিল। তারপরেও ডালিয়া কেন অন্য পুরুষের কাছে গিয়েছিল?
নিজের চিন্তায় সে মগ্ন ছিল যে খেয়ালই করলো না ঘরের আবহাওয়া বদলে গেছে। যখন থপ করে ঘরের আলোটা নিভে গেল তখনই চমকে তাকাল মেয়েটার দিকে।
রিয়াদ কিছুতেই বুঝতে পারল না যে এভাবে ঘরের আলো কিভাবে নিভে এল! ঘরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। এমন তো হওয়ার কথা না। কারণ বাইরে তখনও দিনের আলো বিদ্যামান। তার ঘরের পর্দাও খুব বেশি পুরু নয় যে আলো আসবে না। কিন্তু এখন বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে পুরো দিনের আলো গায়েব হয়ে গেছে। তবে সেদিকটা একেবারে ঘুরুঘুটে অন্ধকার নয়। চাঁদের আলোর মত মৃদু আলো বাইরে রয়েছে এবং সেই আলো ঘরে আসছে।
তখনই রিয়াদের কন্ঠটা শুনতে পেল।
-রিয়াদ
রিয়াদ তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকালো লিলি নামের মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেন সেটা জ্বলছে।
-তুমি কেন ডেকেছো আমাকে?
রিয়াদ সত্যিই তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো লিলির দিকে। এমন না যে লিলির কন্ঠ একেবারে ডালিয়ার মত হয়ে গেছে তবে ডালিয়ার ঠিক যে টোনে কথা বলত লিলির কন্ঠে সেই টোন শোনা যাচ্ছে। রিয়াদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না যে ডালিয়া লিলির উপরে সত্যিই এসেছে। তীব্র একটা অনভূতির সৃষ্টি হল মনের ভেতরে।
-তুমি সত্যিই এসেছো?
-কেন ডেকেছো? কেন আমাকে মুক্তি দিচ্ছো না? তোমার জন্য আমি মরেও শান্তি পাবো না?
রিয়াদ কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। কেবল অবাক হয়ে সে লিলির দিকে তাকিয়ে রইল। লিলি আবার বলল, আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই। বুঝেছো?
-কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতাম ভালবাসি।
-ভালোবাসা মাই ফুট! তুমি কেবল নিজেকে ভালোবাসো। তুমি এতো যোগ্য সবাই তোমাকে ভালবাসবে এটাই তোমার মনভাব। যখন দেখলে আমি তোমার বিয়ের প্রস্তাব নাকোচ করে দিলাম তখন তোমার মনে জেদ চেয়েছিল। আমি একজন সাধারণ মেয়ে হয়ে কিভাবে তোমার মত যোগ্য কাউকে না করে দিলাম। তোমার সহ্য হয় নি। তাই না?
রিয়াদ কোনো কথা না বলে লিলির দিকে তাকিয়ে রইলো। হ্যা, সে সত্যি এমনটা করেছিল। ডালিয়াকে প্রথম দেখাতেই তার পছন্দ হয়েছিল। তখন সে ডালিয়াদের জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেস ছিল। একটা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডালিয়ার নাচ দেখে তাকে পছন্দ করেছিল। খোজ নিয়ে ডালিয়াদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে সময় লাগে নি। সেই সময় আসলে রিয়াদ বিয়ের জন্য পাত্রী খুজছিল। তার হাতে অপশনের অভাব ছিল না। মেয়ের বাবারা যেন তার হাতে পায়ে ধরেই তার সাথে নিজেদের মেয়েদের বিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। শুধু কি মেয়ের বাবারা? মেয়েরাও তো একেবারে এক পায়ে খাড়া ছিল। কিন্তু যখন ডালিয়া বিয়েতে রাজি হল না, ব্যাপারটা রিয়াদের ইগোতে এসে লাগল। তার মত এতো যোগ একজন পাত্রকে কেউ কেন মানা করতে পারে?
আরও একটু খোজ খবর নিয়ে জানা গেল যে ডালিয়ার এক প্রেমিক রয়েছে। সেই প্রেমিকার অবস্থা দেখে রিয়াদের রীতিমত জেদ চেপে গেল। সেই প্রেমিক সবে মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছে। এখনও চাকরি পায় নি। চাকরি খুজছে। চাকরি পাবে এমন কোন নিশ্চইয়তা নেই। অথচ তার মত এমন নিশ্চিত ভবিষ্যতওয়ালা একজনের বিয়ের প্রস্তাব মেয়েটা ফিরিয়ে দিচ্ছে! আশ্চর্য বোকা এই মেয়ে।
তারপর অনেক কাঁঠখড় পুড়িয়ে সে ডালিয়াকে বিয়ে করেছিল শেষ পর্যন্ত। বিয়ের দিন সে ভেবেছিল সে বুঝি বিজয়ী হয়েছে। প্রথম প্রথম ডালিয়া একটু মুখ ভার করে থাকলেও একে সময় বিয়ের পরের সংসারের সাথে সে মানিয়ে নেয়। রিয়াদ ভেবেছিল সব কিছু এমনই হয়। মেয়েরা আসলে সব এমনই হবে।
ডালিয়া আবার বলল, তোমাকে আমি কোন দিন ভালোবাসি নি। কোন দিন না। আমার শরীরটা পেয়েছ, কিন্তু আমাকে কোন দিন পাও নি। আর এই শরীর তো শুধু তুমি পাও নি আরও অনেকেই পেয়েছে, এমন কি তোমার আন্ডারে কাজ করে এমন অনেকেই ……
এই বলে ডালিয়া হো হো হেসে উঠল।
রিয়াদ তীব্র একটা কষ্টের অনুভূতি নিয়ে ডালিয়া অর্থ্যাৎ লিলির চোখের দিকে তাইয়ে রইলো। তখনই রিয়াদ একটা কাজ করতে গেল। সে লিলির দিকে এগিয়ে গেল। হাত দিয়ে লিলিকে স্পর্শ করলেই একটা তীব্র ঝটকার মত খেল যেন। রিয়াদের মনে হল যে কেউ ওকে ৪২০ ভোল্টের ঝটকা দিল। একটা ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে গিয়ে পড়ল। মাথার ভেতরে একটা ঝিমঝিম ভাব করতে লাগল। যখন তার সেন্স আবারও ফিরে এল তখন দেখতে পেল মজিবুল তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার থেকে একটু দুরে লিলির ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রিয়াদের মাথাটা তখনও খানিকটা ঝিমঝিম করছিল। লিলি তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ঐ কাজটা কেন করতে গেলেন? আপনাকে না আমি মানা করলাম!
তারপর মজিবুলের দিকে তাকিয়ে লিলি বলল, মজিবুল সাহেব, আপনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি এসেছিলাম। দয়া করে এরপরে এই কাজের জন্য আমাকে আর ডাকবেন না। কথা যেন মনে থাকে।
তারপর আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লিলি ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মজিবুলও পেছন পেছন গেল তার।
রিয়াদ কিছুটা সময় ঝিম মেরে বসে রইলো। একটু আগে তার সাথে যা হল সেটা সে মাথার ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করছে? একটু আগে যা হল সেটা কি সত্যিই হয়েছে? মেয়েটার উপরে সত্যিই কি ডালিয়ার মৃত আত্মা এসেছিল? এমন ভাবে আসতে পারে? কিন্তু মেয়েটা কিভাবে ডালিয়াকে চিনবে? ডালিয়া যেভাবে কথা বলত সেভাবে কিভাবে কথা বলবে? ডালিয়ার কথা বলার নিখুঁত ভঙ্গি মেয়েটার মধ্যে ছিল। প্রথম বাক্যটা শুনেই রিয়াদ পরিস্কার ভাবেই ডালিয়াকে চিনতে পেরেছিল।
মজিবুল ফিরে এল একটু পরেই একটু পরেই।
-স্যার আপনি ঠিক আছেন?
-হ্যা আছি।
নিজেকে আরেকটু সামলে নিল সে। তারপর মজিবুলের দিকে তাকিয়ে বলল, লিলি মেয়েটা কি চলে গেছে?
-জ্বী স্যার।
রিয়াদের মাথায় তখনও ব্যাপারটা ঘুরছে। সে মজিবুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ওর সাথে নেক্স মিটিংয়ের ব্যবস্থা কর!
রিয়াদ আশা করেছিল যে মজিবুল বুঝি জ্বী স্যার বলবে, তবে সে কোন কথা না বলাতে তার দিকেক চোখ তুলে তাকাল। মজিবুলের চোখে একটু দ্বিধা দেখতে পেল সে। রিয়াদ বলল, কী হল?
-স্যার এটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
-কেন?
-স্যার আমি তো আগেই বলেছি।
-টাকার অফার কর।
-স্যার এই মেয়েটাকে টাকা নেয় না।
-টাকা না নিলে ভয় দেখাও। দরকার হলে পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে আসো। ব্যবস্থা কর।
মজিবুক খানিকটা দ্বিধা নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল। রিয়াদ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যে ডালিয়াকে সে আবার ডেকে আনবে। তাকে সে মৃত্যুর পরেও শান্তিতে থাকতে দিবে না। ওকে না ভালবাসার ফল সে পাবে।
তবে লিলিকে মজিবুল আনতে পারল না। রিয়াদ এটা শুনে খুবই রেগে গেল। মজিবুলের কোন কথাই সে শুনলে চাইলো না। রিয়াদের এক কথা। সে লিলিকে চায় মানে চায়। যেকোন ভাবেই হোক তার সামনে লিলিকে হাজির করতেই হবে। শেষে একদিন রিয়াদ নিজেই পুলিশ নিয়ে হাজির হল লিলিদের বাসার সামনে। তবে বাসার সামনে গিয়েই কিছুটা চমকে গেল। লিলিদের বাড়ি যে এমন হবে সেটা সে আশা করে নি।
মজিবুল তাকে বলার চেষ্টা করেছিল যে লিলিরা আসলে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নয়। ওরা বাবা চাচারা বেশ প্রভাবশালী মানুষ। অনেক ব্যবসা বানিজ্য আছে। রিয়াদ এসব কানে নেয় নি। সে এলাকার টিওনো। তার থেকে ক্ষমতাধর মানুষ আবার কে আছে এখানে। তাই সে নিজেই হাজির হল লিলিদের বাসার সামনে। আজকে লক্ষ্য ছিল যে লিলিকে ধমক দিয়েই নিজের বাসায় নিয়ে যাবে। নয়তো ওর পুরো পরিবারকে পাকড়াও করে জেলে ঢুকাবো। জেলে ঢুকলেই লিলির সুড়সুড় করে চলে আসবে বলে ধারণা করেছিল। কিন্তু লিলিদের বাসার সামনে এসে তার ভুল কিছুটা ভাঙ্গল। কারণ বাড়িটা রীতিমত জমিদার বাড়িই বলা যায়। বাড়ির সামনে বিশাল এক গেট। সেই গেট বন্ধ।
গেটের সামনে কয়েকবার হাকডাক দিতেই একজন দারোয়ান গোছের মানুষ বের হয়ে এল। ভেতরে যাবো বলতেই দারোয়ান জানতেই চাইলো কার কাছে যাবে। এখন বাসায় কেউ নেই। সবাই বাজারে আছে। দেখা করতে চাইলে সেখানে যেতে বলল। এখন গেট দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
রিয়াদ রীতিমত অবাক হল। এই দারোয়ান তার পেছনে পুলিশ দেখেও মোটেই ভয় পায় নি। সাধারণ ভাবে তাকে দেখেই অনেকেই ভয় পেয়ে যায়। সে যা বলে তাই করে। কিন্তু এই দারোয়ান খুবই ভাবলেসহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কথা বার্তার এক পর্যায়ে একজন বয়স্ক লোক বের হয়ে এল গেট দিয়ে বের হয়ে এল। নিজেকে নকিব আলী বলে পরিচয় দিল। সে জানালো সে এই বাড়ির কেয়ারটেকার।
-আপনারা কার সাথে দেখা করতে চান? বড় সাহেব তো বাসায় থাকেন না এই সময়ে। আপনি বড় বাজারে উনার আড়তে যান।
রিয়াদ বলল, আমি আপনার বড় সাহেবের সাথে দেখা করতে আসিনি।
-তাহলে?
-আমি লিলির সাথে দেখা করব।
নকিব আলীর মুখে একটু সরু হল। সে এবার বলল, লিলি মা কি আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছে?
রিয়াদ কী বলবে প্রথমে খুজে পেল না। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, আমার ওর সাথে দেখা করা জরূরী?
-তার মানে সে দেখা করতে চায় নি। তাই তো?
-আমার দেখা করা দরকার।
-লিলি মা যেহেতু চায় নি। আপনি তার সাথে দেখা করতে পারবেন না। আপনারা চলে যান।
রিয়াদের মুখে লাল হয়ে গেল। সে খানিকটা গলা চড়িয়ে বলল, আপনি জানেন আমি কে?
-ইট ডাজেন্ট ম্যাটার, হু ইউ আর !
নকিব আলীর মুখে ইংরেজিটা শুনে রিয়াদ একটু চমকে গেল। তার পরেই সে বুঝতে পারতে পারল যে এই লোককে মোটেই ভয় দেখানো যাবে না। তবে নিজের ইগোর কারণেই সে এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। সে পেছনের পুলিশদের নির্দেশ দিল ভেতরে ঢোকার।
নির্দেশ শুনে তারা একটু যেন দ্বিধাবোধ করল। এই বাড়িতে ঢুকতে তারা ইতস্তঃ করছে। তারা খুব ভাল করেই জানে যে এই বাড়ির ভেতরে ঢোকার ফল তাদের পক্ষে ভাল হবে না। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ মানতে তারা বাধ্য। কিন্তু যখন যারা ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই রিয়াদের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিন দেখেই রিয়াদের ভুরু কুচকে উঠল। ফোন করেছেন বিভাগীয় কমিশনার। ফোনটা রিসিভ করল সাথে সাথেই।
-স্যার !
-আপনি কার বাসার সামনে এখন? ওখানে আপনার কাজ কী?
-স্যার!
ফোনের ওপাশ থেকে ধমকে উঠলেন বিভাগীয় কমিশনার।
-কী জন্য গেছেন ওখানে? এখনই বের হন এখনই।
-জ্বী স্যার !
রিয়াদ যখন ফোন রাখল তখন নকিব আলীর দিকে তাকাল। সে খানিকটা উপহাসের চোখেই তাকিয়ে আছে। তার চোখ বলছে, বলেছিলাম না, ইট ডাজেন্ট ম্যাটার হু ইউ আর!!
রিয়াদ যখন গাড়ি নিয়ে ফিরে আসছিল তখন অপমানে তার মুখ লাল হয়ে গেল। মজিবুল চুপ করে বসে রইলো পাশে। সে একটা কথাও বলল না। তবে ঘটনা এখানেই শেষ হল না। ঠিক দুইদিন পরেই রিয়াদকে ওএসডি করা হল। রিয়াদের বিস্ময়ের সীমা রইলো না। সেই সাথে লিলি নামের ঐ মেয়েটার উপরে রাগ গিয়ে পড়ল। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। যখন সে পদে ছিল তখনই সে লিলির কিছুই করতে পারে নি। এমন কি লিলির ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সাথে দেখা পর্যন্ত করতে পারে নি। আর এখন ওএসডি অবস্থায় সে কিছুই করতে পারবে না।
এই ঘটনার প্রায় মাস দুয়েক পরে রিয়াদকে অবাক করে দিয়েই লিলি তাকে ফোন দিল। জানালো যে সে দেখা করতে চায়। কোথায় দেখা করতে হবে সেটা সে মেসেজে জানিয়ে দিচ্ছে। তারপর ফোনটা কেটে দিল। রিয়াদের সময় হবে কিনা বা রিয়াদ দেখা করতে চায় কিনা এই ব্যাপারে রিয়াদকে কোন প্রশ্ন করল না। রিয়াদ ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেও মেনে নিল।
নির্দিষ্ট দিনে লিলি রেস্টুরেন্টে এসে হাজির হল। রিয়াদ এসেছিল আগেই। লিলিকে দেখে ঠিক আগের মতই ভাবলেশহীন মনে হল। সে রিয়াদের সামনে কিছু সময় বসে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আপনাকে আমি কেন ওএসডি করিয়েছি জানেন?
-তুমি আমাকে ওএসডি করিয়েছো?
-আপনার কি এই ব্যাপারে এখনও সন্দেহ আছে?
রিয়াদ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। লিলি বলল, আপনার বিভাগীয় কমিশনার সাহেব, আমার বাবার বন্ধু মানুষ। আমাদের গ্রামেরই । তার উপরে রহিমন দাদী মানে তার আম্মার মৃত্যুর পরে আমি তার সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। যাই হোক এসব না বলে আসল কথায় আসি।
এই বলে লিলি একটু থামল। সরাসরি রিয়াদের দিকে তাকিয়ে লিলি বলল, রাফি নামের ছেলেটার সাথে আপনি মোটেই ভাল কাজ করেন নি। কেবল মাত্র ডালিয়াকে বিয়ে করার জন্য আপনি রাফির জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন।
রাফির নামটা এভাবে সামনে আসবে রিয়াদ ভাবতেও পারে নি। এতোদিন পরে এই কথা কেন আসল। আর এই মেয়ে কিভাবে রাফির কথা জানলো?
-ভাবছেন আমি কিভাবে জানলাম রাফির কথা? যখন কেউ আমার মাঝে এসে ভর করে তখন তার অনেক কিছুই আমার মধ্যে চলে আসে। ডালিয়া জানতো রাফির কথা। আপনি যে ডালিয়াকে বিয়ে অরার জন্য ডালিয়ার প্রেমিককে মাদক মামলায় ফাঁসিয়েছিলেন সেটা ডালিয়া জানত। সেই হিসাবে আমি নিজেও জানি। এখন আপনি এই অন্যায়টা ঠিক করবেন।
-যদি না করি?
-তাহলে আপনি আর কোন দিন নিজের চাকরি ফেরত পাবেন না। তার উপরে আপনার উপর তদন্ত শুরু হবে। আমাকে হ্যারাসমেন্টের তদন্ত। এবং এটাও প্রমাণিত হবে। কে সাক্ষী দিবে জানেন? আপনার পছন্দের পিএস মজিবুল ইসলাম। এরপর কী হবে জানেন? বরিনগরে আপনি যে ২৬ বিঘা জমি অবৈধ ভাবে নিজের করে নিয়েছেন সেটার পেছনেও তদন্ত হবে।
রিয়াদ এবার একটু চমকে গেল। বরিনগরের এই জমির কথা এই মেয়েটা কিভাবে জানল?
লিলি এই চমকানোর ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করল। সে বলল, রিয়াদ সাহেব আপনি সম্ভবত এখনও আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করেন নি যে আপনার স্ত্রী যা জানতো আমিও তাই জানি। যাইহোক, যা বললাম আপনার স্ত্রী আপনার অনেক কুকাজের কথাই জানতেন। সেই হিসাবে আমিও জানি।
রিয়াদ বুঝতে পারল সে বেশ ভাল ভাবেই ফাঁদে পরেছে। যদি সত্যিকারের তদন্ত শুরু হয় তাহলে তার অবৈধ সম্পদের কথা বেরিয়ে আসবে ঠিকই। তখন আসলেই বিপদ হবে।
লিলি এবার রিয়াদের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিল। রিয়াদ সেটা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে একটা জিমেইল আর পাসওয়ার্ড রয়েছে।
-এটা কী?
লিলি হাসল । তারপর বলল, আপনার স্ত্রী আপনার উপরে কিভাবে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল জানেন?
-কী ভাবে?
-এই জিমেইলের ড্রাইভে সেগুলো পাবে। যে যদি দুর্ঘটনা মারা না যেত তাহলে ঠিকই এটা সে করত। এই ড্রাইভে থাকা ভিডিও গুলো দেখলেই আপনি টের পাবেন। যদি রাফির ব্যাপারটা মিমাংসা আপনি না করেন তাহলে এগুলো সামনে চলে আসতে পারে।
লিলির শেষ কথাটা অনেকটাই হুমকির মত শোনাল। যাওয়ার আগে লিলি বলল, রাফির ব্যাপারটা সমাধান করেন। তারপরই আপনি আপনার পদ ফিরে পাবেন। তারপর যে যার জীবনে চলে যাবে।
বাসায় ফিরে রিয়াদ প্রথমে সেই জিমেইলে লগিন করল। লগিন করল। ড্রাইভে বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে। এগুলো সব ডালিয়ার ভিডিও। ডালিয়ে যতগুলো মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এগুলো সেই ভিডিও। এগুলো যদি বাইরে আসে তাহলে ডালিয়া তো বটেই তার মান সম্মান সব চলে যাবে।
রিয়াদের পা হাত সব ঠান্ডা হয়ে গেল । ডালিয়ে সত্যিই কোন দিন তাকে ভালোবাসে নি। একটা মানুষের মনে কী পরিমান ঘৃণা থাকলে এমন একটা কাজ করতে পারে শুধু মাত্র রিয়াদকে ক্ষতি করার জন্য। রিয়াদ এবার বুঝতে পারে কেন তার স্ত্রী পরকীয়া লিপ্ত হয়েছিল ! তাকে সে ঘৃণা করে। পৃথিবীর সব থেকে বেশি ঘৃণা রিয়াদের জন্য জমা হয়ে আছে। তার স্ত্রী যেন তাকে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে যে সে তাকে ঘৃণা করে।
রিয়াদ বুঝতে পারল যে পৃথিবীতে সব সত্য জানতে হয় না। সে যদি এই সত্যটা জানার জন্য জেদ না করতো তাহলে হয়তো কষ্টটা তাকে সহ্য করতে হত না।
-০-
পরকীয়ার পক্ষে কোন সাফাই নেই। ঘটনা যাই ঘটুক পরকীয়া সব সময়ই একজনের চয়েজ এবং এটা অন্যায়।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.