এই শহরের সব কিছু বড় অদ্ভুত। এখানকার মানুষেরাও অনেক অদ্ভুত। কেউ ঠিক মত কোন কথা বলতে পারে না। আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তারা এই শহরে কিভাবে এসেছে। তারা তাদের আগের জীবন সম্পর্কে কিছু মনে রেখেছে কিনা কিন্তু কেউ কিছু জানে না। তারা যেন শুরু থেকেই এখানে আছে। অথচ এখানে কেউ শুরু থেকে থাকতে পারে না।
এই শহরের আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে হরিণের মত বড় শিংওয়ালা পশু। গেটকিপার ছাড়া এরাই একমাত্র প্রাণী যারা শহরের গেট দিয়ে বাইরে এবং ভেরতে আসা যাওয়া করতে পারে। এছাড়া আর কেউ পারে না। এই প্রানীগুলো সারাদিন শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় শান্ত ভাবে। তবে সন্ধ্যার আগে গেটকিপার একটা বাশি বাজায়। এই বাশির সুর শুনলেই এই প্রাণীগুলোর মাঝে এক অদ্ভুত মাদকতা দেখা দেয়। তখন এই প্রাণীগুলো গেটে দিকে দৌড় দেয়। এই সময়ে এদের সামনে পড়লে অবস্থা খারাপ হবে। প্রাণীগুলো অন্য সময় শান্ত থাকলেও এই বাঁশির শব্দ শুনলে এদের মধ্যে কেমন যেন একটা ভাব দেখা যায়।
গেট কিপারের কথা শুনে আমি আমার ছায়ার সাথে দেখা করতে এলাম। গেট কিপারের ঘরের ভেতর দিয়ে আমি ছোট কটেজে এসে হাজির হলাম। দেখলাম আমার ছায়া বেশ কাবু হয়ে গেছে। আমাকে দেখে হাসল। তারপর বলল, আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। যদি তুমি এখানে থাক তাহলে আমি আর বেশি দিন টিকব না আর আমি একবার চলে গেলে তুমি আর কোনো দিন এই শহর থেকে বের হতে পারব না। এই শহরের প্রতিটা মানুষ ঠিক এই ভাবে এখানে আটকা পড়ে আছে।
আমি তাকে কোন পরিস্কার জবাব না দিয়ে চলে এলাম। তবে এটা সত্য যে আর কিছুদিন যদি আমাকে ছাড়া আমার ছায়া থাকে তবে সে সত্যিই মারা যাবে। তবে ছায়ার বলা অন্য কথাটা আমি মন দিয়ে ভেবে দেখলাম। এখানকার সব মানুষই আসলে তাদের ছায়া হারিয়ে এখানে আটকা পড়ে আছে। আমারও এখানে আটকা পরে যেতে হবে?
আমি এবার পুরো শহরটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। পুরো শহরটা উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা হওয়ার কথা। তবে আমি যখন দক্ষিণ দিকে একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে হাজির হলাম। এখান দিয়ে পাহাড়ে উঠতে হবে। পাহাড়ে ওঠার পরে বিশাল একটা খড়স্রোতা নদী দেখতে পেলাম। তার মানে এই শহর থেকে এই নদী দিয়ে বের হওয়া যাবে। নদীর স্রোত নিশ্চিত ভাবে শহর থেকে বাইরে নিয়ে যাবে ।
আমি শহরের অনেককেই এই নদীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। দেখলাম অনেকেই এই নদীর কথা ঠিকমত জানে না। আর জানলেও তারা এই নদী নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে চায় না। এমন কি মিয়ো নিজেও এটা নিয়ে খুব বেশি কথা বলল না। বলল যে এভাবে রোদের ভেতরে আমি যদ বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই তাহলে আমি অসুখ বাঁধাব। তারপরেও আমি ঘোরাঘুরি বন্ধ করলাম না। এবং সত্যিই একদিন অসুখ বাধালাম। নিজেকে ঘরে জ্বরের ঘোরে বারবার আমি সেই ১৭ বছরের মিয়োর সাথে কাটানো সময়ে ফিরে যাচ্ছিলাম যেন।
জ্বর থেকে সেরে উঠেই আমার মনে হল যে আমার ছায়ার কথা শুনতে হবে। ওকে নিয়ে এই শহর থেকে পালাতে হবে।
আমি পরিকল্পনা মোতাবেগ গিয়ে হাজির হলাম গেটকিপারের কটেজের পাশে, যেখানে আমার ছায়া থাকে। সেখানে গিয়েই দেখলাম আমার ছায়ার অবস্থা বেশ সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। ঠিকমত হাটতে যেন পারছে না। আমি তাকিয়ে দেখলাম গেটকিপার এখন আশে পাশে নেই। দেয়ালের পাশ থেকে ধোয়া উঠতে দেখলাম। গেটকিপার সেই গর্তে মৃত প্রাণীদের জ্বালীয় ভষ্ম করে। মনে হল এটাই আমার কাছে সুযোগ। অনেকটা সময় গেটকিপার সেখানেই থাকবে। এই সুযোগে আমাকে ছায়াকে নিয়ে পালাতে হবে।
তবে আমার ছায়ার অবস্থা একেবারেই খারাপ। তার দৌড়ানোর মত অবস্থা নেই। আমি তাকে কাধে তুলে নিলাম। কটেজ থেকে বের হওয়ার আগে আমি গেটকিপারের বাঁশিটা হাতে নিয়ে নিলাম। এটা বাজালেই হরিণের মত প্রাণীরা সব গেটের বাইরে যাওয়া শুরু করবে।
আমি ছায়াকে কাধে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম নদীর দিকে। আমি যখন ছায়াকে কাধে রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম তখন শহরের মানুষগুলো আমাদের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। তারা সম্ভবত এমন একটা দৃশ্য এর আগে কখনো দেখে নি।
পাহাড়ে গোড়ায় আসতেই আমি বাঁশি বাজিয়ে দিলাম। এতো সময় গেটকিপার ঠিকই টের পেয়ে গেছে যে আমার ছায়াটা তার কটেজে নেই। তাই সে আমাদের পেছন পেছন আসবে ঠিকই। আমার বাঁশি বাজিয়ে দেওয়ার ফলে এখন সব প্রাণীগুলো খানিকটা বন্য হয়ে গেটের দিকে দৌড়ে যাবে। আর এই সময়ে শহরের কেউ রাস্তায় থাকে না। এই সময়ে প্রাণীগুলোর সামনে পড়া মানেই হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করা। আমি নিশ্চিত গেটকিপারও এখন আসার সাহস পাবে না। আমি এই সময়টা পাবো।
বাঁশি বাজানোর পরে আমি আবার ছায়াকে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। আমাকে যেকোন ভাবেই হোক গেটকিপারের আসার আগেই পাহাড়ের শেষ মাথায় পৌছাতে হবে। সেখানে নদীতে যদি ঝাপ মারে তবে আমার ছায়া এই শহর থেকে মুক্তি পাবে। আমার প্রতিমুহুর্তেই মনে হচ্ছিল যে এইবুঝি গেটকিপার এসে আমাকে ধরে ফেলবে। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা পৌছাতে পারলাম।
আমার ছায়া আমার সাথে থেকে আবার একটু শক্তি সঞ্চয় করেছে দেখলাম। সে নিজে নিজেই এবার দাড়াতে পারল। সে নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো আমরা এক সাথে ঝাপ দিই। আমরা এক সাথে এই শহর থেকে বের হয়ে যাই।
সত্যি বলতে কি আমার যে ইচ্ছে করল না সেটা আমি বলব না। আমি আমার জীবনের অর্ধেকের বেশ সময় মিয়োকে ভালোবেসে পার করেছি। কিন্তু এখন আমি যখন মিয়োকে পেয়েছি তখন আমি আবিস্কার করলাম যে এই মিয়োকে তো আমি চিনিই না। আমার সেই মিয়ো এটা নয়।
তবে শেষ পর্যন্ত আমি ঝাপ দিতে পারলাম না। আমার ছায়া কে দেখলাম নদীতে ঝাপ দিতে! একবার পানির ভেতরে মাথা তুলেও সে পানির নিচে হারিয়ে গেল।
দুই
আমার চাকরি ছাড়ার কথা শুনে আমার বস বেশ অবাক হলেন। এতো ভাল চাকরি আমি কেন ছাড়ছি সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। সে আমি আমার কাজে কর্মে বেশ দক্ষ। ১৫ বছরের বেশি আমি এই বুক ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীতে আছি। এখন আমি হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি দেখে বসে মনে হয়েছে আমি হয়তো ভাল কোম্পানীতে আরও বেশি বেতনে চাকরি পেয়েছি। সে আমার বেতন বাড়িয়ে প্রস্তাব পর্যন্ত দিল। আমি তাকে আস্বস্ত করে করে বললাম যে এমন কোনো ব্যাপার না। আমি আসলে সব কিছু থেকে একটু ব্রেক নিতে চাচ্ছি।
আমি কিছু দিন নিজের ফ্লাটেই শুয়ে বসে কাটালাম। আমি সেই দেয়ালঘেরা শহর থেকে ফিরে এসেছি কিছু দিন হল। আমার তবে আমি এখন নিশ্চিত করে বলতে পারছি না যে আমি এখন আসল আমি নাকি আমার ছায়া! কে সেই শহর থেকে ফিরে এসেছি?
তবে চাকরি ছেড়ে একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোন মানে নেই। যদি কোন কাজ কর্ম না করি তবে জমানো সব টাকা পয়সা শেষ হয়ে যাবে। আমার ইচ্ছে এবার ছোট কোন শহরের কোন লাইব্রেরীতে চাকরি করার। আমি আমার কিছু পরিচিত মানুষদের বলে মাধ্যমে খোজ লাগালাম। কিছু দিনের মধ্যে এমন একটা খোজো পেয়ে গেলাম। জেদ মফস্বল শহরের ছোট একটা লাইব্রেরি। আমি ফোন করে এপোয়েন্ট নিয়ে নিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমি বেলা তিনটার সময়ে সেই লাইব্রেবীতে গিয়ে হাজির হলাম। রিসিপশনে মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আমার আসার কারণ কারণ জানতে চাইলো। আমি তখন তাকে জানালাম যে মিস্টার কিয়েৎসু আমাকে এখানে আসতে বলেছে। মহিলাটি আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন বটে তবে সেটা সামলে নিলেন। আমাকে দোলতলায় যেতে বললেন। আমি তার দেখানো পথে দোতলায় চলে গেলাম।
মিস্টার কিয়েৎসুর সাথে আমার ইন্টারভিউ ভাল হল। তিনি আমাকে লাইব্রেরীর হেড হিসাবে জয়েন করতে বললেন। বেতন হিসাবে যা অফার করলেন তাতে দেখলাম যে খেয়ে পড়ে চলে যাবে। আমি আর বেশি চিন্তা করলাম না। আমি কিছুটা দিন এই শান্ত পরিবেশে থাকতে চাই।
পরের সপ্তাহেই আমি চলে এলাম। কাজ কর্ম বুঝে নিলাম। মিস্টার কিয়েৎসু আমাকে সাহায্য করলেন অনেক। তিনি আমার জন্য একটা থাকার জায়গার ঠিকানাও দিলেন। এবং মাঝে মাঝে তিনি আমার অফিস ঘরে এসে হাজির হতেন। নানান কথা বার্তা হত আমাদের মাঝে। এই লাইব্রেরিতে স্থায়ী স্টাফ বলতে আমি আর মিসেস সায়েদা। রিসিপশনের মহিলা। এছাড়া আর কয়েকজন পার্টটাইমার আছে।
এভাবেই কিছু দিন চলার পরে আমি ভয়ংকর একটা তথ্য জানতে পারলাম।
মিস্টার কিয়েৎসু আমার এখানে আসার অনেক আগেই মারা গেছে। আমি যার কথা বলেছি এবং যে মাঝে মাঝে আমার সাথে এসে কথা বলে সেই লোকটা একজন ভুত! অশরীরি!