গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড এবং আমেরিকান ডলার

5
(2)

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের ব্যাপারটা আপনারা অনেকেই জানেন। এখন যেমন ফেডারেল রিজার্ভ চাইলে ডলার ছাপাতে পারে, আগে এই ব্যাপারতা সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে টাকা ছাপানোর জন্য ব্যাংকের হাতে সেই পরিমান স্বর্ণ বা অন্য কোন মূল্যবান ধাতু থাকতে হত। এই কথার অর্থ হচ্ছে আপনি যদি এক ডলারের কাগজের নোট ছাপাতে চান তাহলে আপনার ব্যাংকের ভল্টে অবশ্যই এক ডলার সম মূল্যের স্বর্ণ থাকতে হবে।  

অনেক আগেই এই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের উৎপত্তি। বার্টার সিস্টেমের পর থেকেই মানুষ বিনিময়ের জন্য মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার করত। মূল্যবান ধাতুকে মুদ্রা বা বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করত। স্বর্ণকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার প্রাচীন মিশর, গ্রিস, রোম, এবং চীনের মতো সভ্যতায় প্রচলিত ছিল। তবে আধুনিক গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের সূচনা ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সেই সময় ব্রিটেন প্রথম গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক মুদ্রা ব্যবস্থা হিসাবে। ১৮১৬ সালে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড চালু করে। সেই সময়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের কাগজের মুদ্রা (পাউন্ড) স্বর্ণের সাথে যুক্ত করে। এই ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পাউন্ডের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ বিনিময় করা যেত। সেই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন মুদ্র প্রচলিত ছিল কিন্তু এক মুদ্রার সাথে অন্য মুদ্রার বিনিময়ের কোন সুনির্দিষ্ট হার ছিল না। এই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের ফলে এই বিনিময় হার প্রতিষ্ঠা হয়। আস্তে আস্তে সেই সময়ের অন্যান্য পরাশক্তির দেশগুলো এই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড গ্রহন করতে শুরু করে। এর ফলে এটিই অর্থনীতির একটা প্রধান কাঠামো হয়ে ওঠে। আজকে যেমন ডলার বিশ্বের ব্যবসা বানিজ্যেয়র প্রাণ ঠিক সেই সময়ে, ব্রিটিশ পাউন্ড ছিল ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণ। এটিই ছিল বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা। আর লন্ডন ছিল হয়ে ওঠে আর্থিক বাজারের প্রাণকেন্দ্র।

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের দীর্ঘ সময় ধরে টিকে ছিল। এই ব্যবস্থায় খুব সহজেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কোনো দেশ তাদের স্বর্ণের মজুদের বেশি পরিমান মুদ্রা ছাপতে পারত না। ফলে বাজারে নতুন টাকার প্রবাহ আসতো না। সরকার চাইলেও অতিরিক্ত ব্যয় বা অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপাতে পারত না। আন্তর্জাতিক বাজাতে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড একটি স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য বিনিময় হার হিসাবে ব্যবহার হত এবং এর ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটতো। তবে একই সাথে এই ব্যবস্থার একটা বড় সমস্যা ছিল সেটা হচ্ছে ব্যবসা-বানিজ্যের বৃদ্ধি নির্ভর করতো স্বর্ণের সরবারহের উপরে। স্বর্ণ মানুষ চাইলেই বানাতে পারে না। খনি হতে বেশি বেশি স্বর্ণ পাওয়া গেলে ব্যবসা বানিজ্য এগিয়ে যেত নয়তো স্থবির হয়ে থাকতো। যদি দেশের স্বর্ণের মজুদ কমে যেত, তবে তারা মুদ্রার সরবরাহ কমাতে বাধ্য হতো আর এটি তখন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা বা ডিফ্লেশনের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারত। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি হতো, তবে স্বর্ণ বিদেশে চলে যেত, যা দেশটির অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের বিপুল ব্যয় মেটাতে অনেক দেশ এই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড থেকে সরে আসে এবং কাগজের মুদ্রা ছাপতে শুরু করে। অর্থ্যাৎ দেশগুলো তখন নিয়ম করল যে কাগজের টাকা ছাপাতে ব্যাংকগুলোকে আর সমপরিমান স্বর্ণের মজুদ রাখতে হবে না। খুব সামান্য কিছু নিয়ম মানলেই টাকা ছাপানো যাবে। হঠাৎ করেই তখন বাজারে প্রচুর অর্থ এসে হাজির হল। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেল। এবং একই সাথে বিনিময় হার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। যুদ্ধের পরে, ১৯২০-এর দশকে, অনেক দেশ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে ফিরে আসার চেষ্টা করল বটে কিন্তু আগের অবস্থায় আর কেউ ঠিক মত ফিরে যেতে পারল না। আগে এই ব্যবস্থাটা যত ভাল ভাবে কাজ করছিল যুদ্ধের পরে সেটা আর ততভাল ভাবে কাজ করছিল না। ১৯২৯ সালে যখন মহামন্দা শুরু হয় তখন এই ব্যবস্থা একেবারেই একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৩১ সালে ব্রিটেন গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসে। আসলে তখন তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমান স্বর্ণের মজুদ ছিল না। এই ব্যবস্থার ভেতরে থাকলে ব্রিটেন তাদের ব্যবসা বানিজ্যে এগিয়ে নিতে পারছিল না। ১৯৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ব্যক্তিগত স্বর্ণ মালিকানা নিষিদ্ধ করেন। একই সাথে তিনি ডলারের মূল্য স্বর্ণের তুলনায় কমিয়ে দেন। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের উপর বড় একটা ধাক্কা ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনে একটি নতুন ধরনের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায়, আমেরিকান ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় (৩৫ ডলারে ১ আউন্স স্বর্ণ), এবং অন্যান্য দেশের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই ব্যবস্থাটাই ডলারকে বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। মানে, আজকের দিনে ডলার যেভাবে পুরো বিশ্বের উপর রাজত্ব করছে সেটার শুরু মূলত এখান থেকেই।

কিন্তু এক সময়ে আমেরিকাতে স্বর্ণের মজুদ কমতে থাকে। ব্রেটন উডস চুক্তিতে থাকা অনেক দেশ তাদের ডলারের মজুদের বিনিময়ে আমেরিকার কাছ থেকে স্বর্ণ দাবি করতে শুরু করে। বিশেষ করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গলের নেতৃত্বে ইউরোপের অনেক দেশ ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ফেরত নেয়। এই সময়ে আমেরিকার অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপুল ব্যয়, প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের ‘গ্রেট সোসাইটি’ কর্মসূচি, এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির কারণে ডলারের উপর চাপ বাড়তেই থাকে। অনেক দেশ ডলারের মূল্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং স্বর্ণের দাবি বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা দেন যে ডলার দিয়ে আর স্বর্ণ বিনিময় করা যাবে না। এটা ‘নিক্সন শক’ নামে পরিচিত। এটি ব্রেটন উডস ব্যবস্থার অবসান ঘটায় এবং গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের চূড়ান্ত পতন ঘটে। 
ব্রেটন উডস ব্যবস্থার অবসান ঘটালেও ডলার কিন্তু ততদিনে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে ডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তি, শিল্প উৎপাদন, এবং রাজনৈতিক প্রভাব ডলারের আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করে। আমেরিকার আর্থিক বাজার, বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বন্ড মার্কেট, বিশ্বের প্রধান আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠানে আমেরিকার প্রভাব, এবং ডলারে ঋণ প্রদানের প্রচলন ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্যকে আরও জোরদার করে।

কিন্তু এসব ছাড়াও আরও একটা ব্যাপার ছিল যা আমেরিকান ডলারের আধিপত্য সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছি। সেটা হচ্ছে পেট্রোডলার। ১৯৭১ সালে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার পতনের পর ডলারকে ব্যাকআপ দেওয়ার মত কোন ব্যবস্থা ছিল না। মানুষ আগে ডলারকে মূল্য দিত কারণ তারা জানতো যে এই ডলার আমেরিকান ব্যাংকে জমা দিলে তারা এটার বদলে স্বর্ণ দিবে। কিন্তু নিক্সন শকের পরে সেটা আর সম্ভব ছিল না। অন্যান্য দেশগুলো ডলার দিয়ে আর স্বর্ণ নিতে পারছিল না। এই পরিস্থিতিতে ডলারের বৈশ্বিক চাহিদা বজায় রাখা আমেরিকার জন্য বড় একটা এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময়ে ১৯৭৩ সালে, আমেরিকা সৌদি আরবের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরব তাদের তেল রপ্তানির লেনদেন শুধুমাত্র আমেরিকান ডলারে করতে সম্মত হয়। বিনিময়ে, আমেরিকা সৌদি আরবকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই চুক্তি দ্রুত অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর (যেমন ওপেক সদস্য দেশ) মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তেল বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান উপাদান। আরও ভাল করে বললে তেল ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতি অচল বলা যায়। আর এই তেল কিনতেই এখন সবার ডলার দরকার। সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী আবারও ডলারের চাহিদা বাড়িয়ে দিল। এই ‘পেট্রোডলার’ ব্যবস্থা ডলারকে আবারও বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে স্থান করে দেয়।

এখনও পর্যন্ত ডলার বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা। বিশ্বের বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক লেনদেন, তেলের বাণিজ্য, এবং রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার ব্যবহৃত হয়। তবে, পেট্রোডলার ব্যবস্থার উপর চ্যালেঞ্জও উঠছে। চীন, রাশিয়া, এবং অন্যান্য দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রায় তেলের লেনদেন শুরু করার চেষ্টা করছে, যা ডলারের আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তবুও, আমেরিকার আর্থিক বাজার, সামরিক শক্তি, এবং বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে ডলারের আধিপত্য এখনও অটুট।

অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তিকে তাদের বিশ্বমোড়ল হওয়ার কারণ হিসাবে দেখে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে বড় শক্তি হচ্ছে তাদের ডলার স্টাটাস। এটি যতদিন বিশ্বে টিকে আছে ততদিন সে বিশ্ব মোড়লই থেকে যাবে। 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 5 / 5. Vote count: 2

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →